Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্কেচে লালন ফকির

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যেখানেই যান সেখানেই প্রাণের প্রাচুর্য, হৈহল্লা-গানবাজনা, জমজমাট আড্ডার আসর। ঠাকুরবাড়ির এই যুবকটির সবখানেই বেশ কদর। মেটেবুরুজে নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের বাড়িতে যেদিন হাজির হন, সেদিন সেখানেও তাঁর সম্মানে রাতভর গান-বাজনার মেহফিল হয়। লক্ষ্ণৌ থেকে আগত এই নবাবের সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দারুণ দহরম মহরম। আবার অক্ষয় চৌধুরী, প্রিয়নাথ সেন, জানকীনাথ ঘোষালের মত সুহৃদ ও আত্মীয়ের সঙ্গে খোসগল্প করেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে। হিন্দু কলেজের সহপাঠী রমেশচন্দ্র দত্ত ও নবীনচন্দ্র সেনের সঙ্গেও সম্পর্ক মলিন হয়নি। বাড়িতে এলে কবিবন্ধু বিহারীলাল চক্রবর্তীকে সময় দিতে কার্পণ্য করেন না। বাংলার বিশিষ্ট লেখক, পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে একটি সারস্বত সমাজ গঠন করতে চান তিনি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধির জন্য একটি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা দরকার বলেও তিনি মনে করেন। এ কাজে তিনি বেলেঘাটার রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মত পণ্ডিত ও সুলেখককে সম্পৃক্ত করতে চান। নিত্যনতুন পরিকল্পনা তাঁর মাথায় গিজগিজ করে। এক অসাধারণ ব্যতিক্রমী মানুষ তিনি। সঙ্গীতপ্রিয়, নাট্যামোদী, মজলিসি স্বভাবের মানুষ তিনি, কিন্তু কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে রেখেছেন নানাদিকে। সন্ধ্যার পর তাঁকে বাড়িতে পাওয়া যায় না, নাটকের মহড়া নিয়ে মেতে থাকেন অনেক রাত পর্যন্ত। কেবল ঘরোয়া পরিবেশে নয়, পাবলিক থিয়েটারেও তাঁর নাটক খুব জনপ্রিয়। লোকে টিকিট কেটে তাঁর নাটক দেখে। গিরিশ ঘোষ, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, অমৃতলাল, নটী বিনোদিনীর মত নট-নটীরাও তাঁর নাটকে পার্ট করেছেন এবং অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তার ‘অলীক বাবু’ নাটকে অভিনয় করেছেন ছোটভাই রবীন্দ্রনাথ ও স্ত্রী কাদম্বরী দেবী। তিনি নিজে অভিনয় করেছেন জ্ঞাতিভাই গণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাট্যশালায়। বারবণিতাদের নিয়ে প্রকাশ্যে নাট্য-অভিনয় করাতে গোঁড়া হিন্দুদের আপত্তি থাকলেও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কিংবা ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে তেমন আপত্তি তোলা হয়নি। বরং ঘরোয়া নাটকে ঠাকুরবাড়ির মেয়েরাও যাতে অভিনয় করেন, সে ব্যাপারে জ্যোতিবাবু সব সময় সরব থাকেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বহু প্রতিষ্ঠান তাঁকে চালনা করতে হয়। শিলাইদহের জমিদারিও তাঁকে তদারকি করতে হয়। জল-জাহাজের ব্যবসাটিও তাঁকে দেখতে হয়। এছাড়াও কুষ্টিয়াতে পাটের ব্যবসাও চালু করা হয়েছে ভগ্নিপতি জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে। জানকীনাথ অবশ্যি কংগ্রেসি রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথকেই সব সামলাতে হয়। এরপরও ছবি আঁকেন, গভীর রাত পর্যন্ত তন্ময় হয়ে পিয়ানো বাজান। আবার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, মীর মশাররফের সঙ্গে যখন আড্ডায় বসেন, তখন মনে হয় তাঁর কাজের কোনও তাড়া নেই। অথচ প্রতিদিন একবার করে সেরেস্তায় বসে হিসেবপত্র বুঝে নেন। এক স্বতন্ত্র ধাঁচের মানুষ তিনি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাজপোশাক ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে এমন কিছু মহিমা আছে, যার জন্য ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সব মানুষ তাঁর সান্নিধ্য পেতে ছুটে আসে। সম্ভবত জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের মহিমায় লালনও আকৃষ্ট হন। একদিন ছুটে যান তাঁর বজরাতে।

এত ঐশ্বর্য! এত ঝকমারি! এত সাজসজ্জা! সুসজ্জিত বজরায় ঢুকেই লালন হচকচিয়ে যান। কুষ্টিয়া-পাবনা-যশোর এলাকায় কত জমিদার আছেন। কিন্তু এর আগে কোনও জমিদার তাঁকে নেমন্তন্ন জানাননি, এমন খাতিরযত্নও করেননি। সত্যিই জ্যোতিবাবু অন্য রকম মানুষ। নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে হয় লালনের। লালন মানবজীবনের সার্থকতা খুঁজে পান। ইদানীং তাঁর বেশ নামডাক ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন আখড়া থেকে আমন্ত্রণ আসে, সেসব আখড়ায় তাঁকে গান গাইতে হয়। ব্যতিক্রমী জীবনযাপন ও ধর্মাদর্শের কারণে জনপ্রিয়তাও বেড়ে চলেছে। মজবুত হচ্ছে লালন শাহি মতবাদের ভিত। তাঁকে ও তাঁর ক্রিয়াকলাপ ঘিরে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের মিথ ও কল্পকাহিনি। কোথাও ঘোষণা করা হচ্ছে, লালন আল্লাহর ওলি— উচ্চস্তরের কামেল ফকির। কেউ আবার বলছেন, তিনি হলেন গৌরাঙ্গের সাক্ষাৎ অবতার। কোথাও বলা হচ্ছে, তিনি ত্রিকালদর্শী মহাজ্ঞানী সাধক যাঁর ওপর সৃষ্টির রহস্যজ্ঞাপক মহাজ্ঞান নাজেল হয়েছে। এবং যিনি এক মহাতত্ত্বের ব্যাখ্যাকারী। কিন্তু এ ধরনের অতিরঞ্জিত প্রচারে লালন ভীষণ বিব্রতবোধ করেন। ভোলাই শাহ, শীতল শাহ, মানিক শাহ-রা তাঁকে সাঁইজি মানলেও তিনি নিজেকে সাধক ভাবতে লজ্জাবোধ করেন। নিজেকে একজন দীনহীন ফকির হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বচ্ছন্দ্য অনুভব করেন। তিনি সাধু-দরবেশ হতে চান না। হতে চান না মহাজ্ঞানী-মহাজন। এ জন্যে লালন তাঁর গানের ভণিতায় নিজেকে ভেড়ো, অবোধ, বোকা, বুদ্ধিহারা, ভজনহীন, মদনা কানা হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। জ্যোতিবাবুর বজরায় লালন যে-আমন্ত্রিত হয়েছেন তার পিছনে গভীর আন্তরিকতার পরশ আছে। আছে কাঙাল হরিনাথের অবদান। হরিনাথ বঙ্গীয় জমিদারতন্ত্র ও ঠাকুর জমিদারদের ঘৃণা করলেও ব্যক্তি-জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা করেন। কারণ তাঁর মধ্যে কোনও অহংকার নেই, দাম্ভিকতা নেই। দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাতি হলেও জ্যোতিবাবু অতিশয় বিনয়ী, সদা হাস্যোজ্জ্বল ও সংগীতানুরাগী। লালন-গানের দারুণ ভক্ত। আলাপ করলে বোঝা যায়, তিনি কত উদার, কত সরল ও দিলখোলা মানুষ! সব বিষয়ের প্রতি তিনি সমান কৌতূহলী, সমান অনুরাগী— হোক তা ইহজাগতিক কিংবা আধ্যাত্মিক। নানাভাবে জেনেছেন লালন গুণী মানুষ। তিনি শিলাইদহের বাউলদের গান শুনেছেন, এবার লালনের গান শুনতে চান।

পত্র পেয়ে ভোলাই কারিগর ও শীতল শাহকে নিয়ে লালন বজরায় যখন প্রবেশ করছেন তখন সূর্য মধ্যগগন ছেড়ে পশ্চিম দিকে একটু ঢলে পড়েছে। দোতলা বজরা, আধুনিক জীবনযাপনের সব সুযোগ সেখানে রয়েছে। অনেক সময় জ্যোতিবাবু বজরাতেই রাত্রিযাপন করেন। রাত্রিযাপনের ইচ্ছে হলে যাতে সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাঘাত না হয়, তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা এতে থাকে। ব্র্যান্ডি, হুইস্কি, শ্যাম্পেইনের ব্যবস্থাও থাকে। সুরার প্রতি জ্যোতিবাবুর তেমন আসক্তি নেই, তারপরও ওগুলো রাখতে হয়, কারণ কখনও কখনও দেশীয় জমিদার, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী কিংবা সাহেব-মেমদের আপ্যায়ন করতে দরকার হয়। সঙ্গত করার জন্য নিজেও মাঝেমধ্যে সুরাপান করেন। মদ্যপান কিংবা বাঈজি নাচানো উনিশ শতকীয় বনেদিয়ানা ও আভিজাত্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও ওই সব বদভ্যাস জ্যোতিবাবুর মধ্যে নেই। উনিশ শতকের অন্য জমিদারদের তুলনায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধাঁচের মানুষ। জমিদারি কাজকর্ম ছেড়ে দারুণ আড্ডাবাজ হয়ে ওঠেন কখনও কখনও। লালনের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে কাটাতে চান পুরো একটা দিন। লালন যখন গাইছেন: ‘ক্ষ্যাপা তুই না জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায়?/ আপন ঘর না-বুঝে বাহিরে খুঁজে পড়বি ধাঁধায়।’— তখন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ স্তব্ধ হয়ে গেলেন। এ কী! এক দীনহীন গ্রামীণ সাধক কী গাইছেন! এটা গান, নাকি বিদগ্ধ দার্শনিক চিত্তের আকুল ক্রন্দন! আর এই দার্শনিক উপলব্ধির স্পিরিটটা পেলেন কোথায়! লালনের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যান। গান শেষে বললেন— সাধু সাধু। লালন বেশ বুঝতে পারেন, জ্যোতিবাবু অন্য জমিদারদের তুলনায় একেবারে ব্যতিক্রমী। বঙ্গদেশের সব জমিদার একসূত্রে গাঁথা নন। এদের মধ্যে কেউ কেউ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।

এমন অনেক জমিদার আছেন যাঁরা কেবল গানবাজনা নয়, মানুষকেও ভালবাসেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেই সকল জমিদারের একজন যিনি একাধারে সংস্কৃতিবান, সংগীতানুরাগী, মানবদরদি ও জীবনরসিক। সেদিন লালন ফকির ও তাঁর দলবল দারুণভাবে আপ্যায়িত হন। দুপুরের খাবার হিসেবে পরিবেশন করা হয় মাছ-ভাত, দই-মিষ্টি, ফলমূল এবং খাবার শেষে বিলিতি সিগারেট। অবশ্য সিগারেট গ্রহণ করতে লালন অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। এরপর দুজনের মধ্যে শুরু হয় দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এক পর্যায়ে লালনকে প্রশ্ন করেন, ‘আচ্ছা ফকির, আপনি যে ধর্মমতের প্রচার করছেন, সেখানে সকল ধর্মের বিশেষত হিন্দু-মুসলমানের মিলনের কথা বলা হয়েছে। আপনি কি মনে করেন যে, দু’ধর্মের মিলন সম্ভব?’

লালন হেসে বললেন, ‘দেখুন, আমি কোনও নবি-পয়গম্বর কিংবা অবতার নই, এমনকি ধর্মসংস্কার কবা ধর্মপ্রচারকও নই। কোনও নতুন ধর্মমত তথা মতবাদ প্রবর্তন করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে আমি আল্লাহ বিশ্বাস করি, আমি নাস্তিক নই। আমি লেখাপড়া জানি না, কোরান-গীতা, রামায়ণ-মহাভারত-বাইবেল পড়িনি। তবে জীবনের পাঠশালায় আমি পড়েছি। আপনারা শিক্ষিত, আপনারা বড়লোক। বড়লোক ও গরিব কোনওদিন এক ও আত্মীয় হতে পারে না। তেলে-জলে যেমন মিশ খায় না, তেমনি গরিব ও বড়লোক আত্মীয় হতে পারবে না। তাই আমার মতের সঙ্গে আপনাদের মত মিলবে না। আমি মনে করি, হিন্দু-মুসলমানে কোনও তফাৎ নেই। মুসলমানের খোদা আর হিন্দুর হরি একই জন। সবাই তাঁর চোখে সমান। সবাইকে তিনিই সৃষ্টি করেছেন, সবার প্রতি তিনি দয়াশীল। আল্লাহর কাছে কোনও ভেদাভেদ নেই। জোতদার-জমিদার আর মোল্লা-পুরুতরা স্বার্থ হাসিলের জন্য মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি করেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই বিভাজন একদিন উঠে যাবে। সেদিন মানুষের পরিচয় হবে কেবলই মানুষ।’

এক নিরক্ষর গ্রামীণ ফকিরের মুখে ধর্মের মর্মকথা শুনে জ্যোতিবাবু অবাক হয়ে গেলেন। কবীর-নানকরাও তো ওই একই রকম কথা বলেছেন। কবির বলেছেন: ‘হিন্দু মুখে রাম কহি মুসলমান খুদাই।/ কহৈ কবির সো জীবিতা সৈঁ কদে ন জাই।।’ অর্থাৎ হিন্দু মরে রাম রাম করে, মুসলমান মরে খোদা খোদা করে, এই সব ভেদবুদ্ধির মধ্যে যে না পড়ল সেই বাঁচল। তাঁর মনে হল, লালন ফকির সম্ভবত মানুষসৃষ্ট ভেদবুদ্ধি থেকে বেরিয়ে আসা এক গ্রামীণ-ফকির। বর্ণহীন আলখাল্লা পরা ফকিরের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা-ভক্তি বেড়ে গেল। দীনহীন ফকির হলেও বড় মনের ও মাপের মানুষ তিনি। তিনি কেবল শিষ্য-ভক্তদের অন্নসংস্থান করেন তা নয়, অনাথ-এতিম, বিধবাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্বও নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন। বজরাতে বসেই মনে মনে ভাবলেন যে, ছেউড়িয়ার আখড়ায় একদিন যাওয়া দরকার। লালনের গানের বাণী তাঁর মনে বেশ ধরে যায়। সত্যিই লালন যেন ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা। তাঁর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা-বুদ্ধি ও নবজাগৃতির উদ্ভাস নেই, তারপরও তাঁর দিকে তাকালে কিংবা তাঁকে অনুসরণ করলে এক ধরনের ভক্তিভাব, এক ধরনের প্রেম জেগে ওঠে। তিনি সবার মাঝে বাস করেন, তবুও তাঁর জীবন আলাদা, মতাদর্শ আলাদা, ধর্ম-পোশাক-আশাক আলাদা। তিনি সবার মাঝে থেকেও বাস করেন চেনা-অচেনার মাঝামাঝি এক অলৌকিক-বন্দরে। তাঁকে চিনতে হলে কেবল সুফিবাদ কিংবা বৈষ্ণববাদ দিয়ে চেনা যাবে না, তাঁকে চিনতে হবে বাঙালির চিরায়ত মানবতাবাদ তথা হিউম্যানিজম ও অসাম্প্রদায়িকতার আলো দিয়ে। এই ব্যতিক্রমী মানুষটির একটি প্রতিকৃতি আঁকতে চান তিনি, তাই আবারও লালনকে নেমন্তন্ন জানালেন। আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দলবলসহ বিদায় নিলেন লালন ফকির। আবার যেদিন জ্যোতিবাবুর বজরায় এলেন, সেদিন গ্রামবাংলায় শরৎ এসেছে। শরৎ মানেই শিউলি-শেফালির গন্ধভরা স্নিগ্ধ সকাল। নীল আকাশে তুলোর মত পেঁজাপেঁজা মেঘ, নরম রোদ, স্নিগ্ধ বাতাস। মনোরম দিন। অবাক-বিস্ময়ে লালনের দিকে তাকিয়ে আছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। বিকেলের পরিপূর্ণ আলোয় লালনের মুখটা জ্বলজ্বল করছে, যদিও বয়সের ভারে ন্যুব্জ। জীবনে অনেক পরিচিত-অপরিচিত মানুষের প্রতিকৃতি এঁকেছেন জ্যোতিরিন্দ্র। বাবা মহাশয়, ঠাকুরদার প্রতিকৃতি এঁকেছেন। কিন্তু লালনের প্রতিকৃতিটি ভিন্নভাবে আঁকতে চান। যাতে করে এই প্রতিকৃতির মধ্যে আঁকিয়ের মনের ভাব, দরদ, মমতা পরিস্ফূট হয়। ছবির মধ্যে তিনি নিজের ভাব প্রকাশ করতে চান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই বিষয়টি দেশের সমঝদাররাও বুঝতে চান না। প্রতিকৃতি আঁকায় বঙ্গদেশের কোনও বিখ্যাত ব্যক্তি মনোনিবেশও করেননি। জ্যোতিবাবু প্রতিকৃতি এঁকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত লালন ফকির। এটি লালন ফকিরের জীবদ্দশায় অঙ্কিত একমাত্র প্রামাণ্য চিত্র।

লালনের প্রতিকৃতি যখন আঁকা হচ্ছে, তখন তাঁর বয়স একশ পার হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে যৌবনের উন্মাদনা। ম্লান হয়েছে চোখমুখের দীপ্তি। আলো মরে গেলে রঙিন পাখির রং যেমন মরে যায়, তেমনি লালন ফকিরের আলখাল্লার বর্ণদ্যুতি ও কণ্ঠের ভাবতরঙ্গ মলিন হয়ে যাচ্ছে। একে একে ফিকে হয়ে আসছে সব নানান রঙের দিনগুলির স্মৃতি। তারপরও জীবনের আনন্দ শেষ হয় না। প্রতিদিনের সূর্য, প্রতিটি সকালকেই তাঁর নতুন ও সুন্দর মনে হয়। এ কী ঈশ্বরের বিচিত্র লীলা! তাঁর কেবলই মনে হয়, যে দিনটি মহাকালের অতল তলে হারিয়ে গেল, সেটি আর ফিরবে না কোনওকালে। জ্যোতিরিন্দ্র যখন নিবিষ্ট চিত্তে প্রতিকৃতি আঁকছেন, তখন লালন নিবিড়ভাবে আঁকিয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছেন। জমিদারনন্দনটিকে যতই দেখছেন ততই বিস্মিত হচ্ছেন। প্রথমে ভেবেছিলেন এটা বড়লোক, শহুরে শিক্ষিতদের ভাববিলাস। কত বিলাসিতাই তো থাকে বড়লোকদের! কিন্তু না, এটা কোনও বড়লোকি-ভাববিলাসিতা কিংবা খেয়ালিপনা নয়। জ্যোতিবাবুর একটি বড় মন আছে। তিনি বিত্তেও ধনী, চিত্তেও ধনী। এসব মানুষ কেন যে মেকি-ভেজাল ঘেরটোপে আটকা পড়ে থাকেন? লালন ভাবেন, এমন মানুষ যদি আমার আখড়ায় পেতাম? আমি যে ‘মনের মানুষের’ কথা বলি, ইনিই হতে পারেন সেই যথার্থ মানুষ। হয়তো-বা জ্যোতিবাবুর সহানুভূতি ও উদারতার কারণে তাঁর আখড়াবাড়িটি টিকে আছে। নইলে কবে পাইক-পেয়াদা-বরকন্দাজরা এটি ভেঙেচুরে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিত। মানুষটি যে মহান মানুষ, তা তাঁর আত্মমগ্নতা দেখেই বোঝা যায়। বঙ্গদেশের কোনও জমিদার এমন গভীর ও মগ্ন চিত্তে ছবি আঁকতে পারবেন? নিজের প্রতিকৃতির দিকে লালন তাকিয়ে থাকেন, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারেন না। হিজিবিজি কতকগুলো রেখা ছাড়া কিছুই ভাবতে পারেন না। প্রতিকৃতিটি দেখে নিজেকে যেন চিনতেই পারেন না লালন। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথের চোখেমুখে ফুটে ওঠে এক অপার্থিব আনন্দ। তিনি জীবনে অনেক প্রতিকৃতি ও ছবি এঁকেছেন, কিন্তু এমন প্রাণময়-জীবন্ত ছবি সম্ভবত একটিও আঁকতে পারেননি। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি ও লালন চিরকাল বেঁচে থাকবেন না, কিন্তু ছবিটি বেঁচে থাকবে। আগামী দিনে এই ছবি দেখে মানুষ লালনকে চিনবে এবং জানবে। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কীই বা হতে পারে!

আত্মার অবিনশ্বরতা ও জন্মান্তরবাদ নিয়ে লালন কখনও চিন্তা করে দেখেননি। মৃত্যুর পর তাঁর গান কেউ গাবে বা গাইতে পারে— এসব বিষয়ও ঘুণাক্ষরে চিন্তা করেননি। তবে কাঙাল হরিনাথ, মীর মশাররফ তাঁর গানের সত্যিকারের সমঝদার। তাঁরা প্রায়ই বলেন যে, বাংলাদেশের মানুষকে সাঁইজির গান গাইতেই হবে। একদিন শহরের শিক্ষিতরাও তাঁর গানের মূল্যায়ন করবে এবং করতে বাধ্য হবে। আর সেটা হবে তাঁর তিরোধানের পর। শহরের শিক্ষিত বাবুরা আর মোল্লা-পুরুতরা আজ তাঁকে না চিনলেও একশো বছর পর ঠিক-ই চিনবে। লালন তাঁর মনের আরশিতে চোখ রেখে দেখতে স্পষ্ট দেখতে পান, গ্রামবাংলার কৃষকরা তাঁর গান গেয়ে মাঠে ধান বপন করছেন, ফসল কাটছেন, তাঁতিরা তাঁত বুনে চলেছেন, ভিখিরিরা ভিখ মাঙছেন। আখড়া-আশ্রমে তাঁর গান নিয়ে সাধক-মহাজনরা তর্ক করছেন। এসব ভাবতে ভাবতে, তাঁর বুকটা আনন্দে ভরে ওঠে। তবে যশখ্যাতি, নগদপ্রাপ্তি কিংবা কবিখ্যাতির জন্য তিনি গান বাঁধেন না, বাঁধতেও চান না। গ্রামবাংলার চিরবঞ্চিত গরিবগুরবো মানুষগুলোকে জাগিয়ে রাখতে এবং আনন্দ দিতে তিনি গান বাঁধেন। কারও জীবন যে নিরর্থক নয়, সবার জীবনের একটি অর্থময়তা আছে তা বোঝানোর জন্যই তিনি গান করেন। মানুষে মানুষে সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরির জন্য কুষ্টিয়া-যশোর-পাবনার বিভিন্ন আসরে তাঁকে গান গাইতে হয়। কলকাতার কবিয়ালরা বিশেষত অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ও ভোলা ময়রা গান গেয়ে প্রচুর টাকা আয় করেন, কিন্তু এমন চিন্তা কোনওদিন তিনি মাথায় বাসা বাঁধতে দেননি।

সেদিন জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে বিদায় জানানোর সময় তাঁর কেবলই মনে হচ্ছিল, তিনি বোধ হয় বেশিদিন বাঁচবেন না, বয়স তো ঢের হয়ে গেল। আর বেশিদিন বেঁচেই-বা লাভ কী! কী হবে বেশিদিন বেঁচে! এক যাবে, আর-এক আসবে, এটাই প্রকৃতির অমোঘ বিধান। বেশিদিন বাঁচা মানে বেশি করে রোগশোকে জর্জরিত হওয়া। বেশি বেশি করে শোকতাপকে বরণ করে নেয়া। তাই বেশিদিন বাঁচতেও চান না তিনি। জীবনের অনেক স্বপ্নই অপূর্ণ থেকে গেল। জীবনের সব স্বপ্ন, সব চাওয়া-পাওয়া কি পূরণ হয়? তবে জ্যোতিবাবুর সঙ্গে সাক্ষাতের এই দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আগামীদিনের আবেগী, অভিমানী ও ক্ষুব্ধ মানুষ যদি আমাকে ও আমার গানকে মনে রাখে, তাহলে নিশ্চয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত এই প্রতিকৃতিটি বেঁচে থাকবে। মুদ্রিত পণ্ডিত এলেমদারদের কেতাবে-পুস্তকে, উৎকীর্ণ হবে ভদ্রলোকদের দেওয়ালে দেওয়ালে।

চিত্র: গুগল

লালন ফকির: এক নিঃসঙ্গ সাধক

ফকির লালন: জন্মপরিচয় ও জাতধর্ম

কালীগঙ্গার তীরে এক অচিন মানুষ

লালনের স্বপ্ন, লালনের জেহাদ

লালন ও কাঙাল হরিনাথ মজুমদার: মরমি ও মানবদরদি

তর্কে-প্রতর্কে দুই মহাত্মা: লালন ও গান্ধীজি

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »
শুভদীপ রায়চৌধুরী

শুভদীপ রায়চৌধুরীর দুটি কবিতা

অন্ধকারের তুমি,/ নরম পুঁইমাচার নিচে সবজেটে বহুরূপী/ তোমাকে আলোর কণার ভেতর গড়িয়ে যেতে দেখব বলে/ আমি এই পাগলের পৃথিবী ছেড়েছি/ টিলাপায়ে বাস করি/ নাম, সমুদ্রসম্ভব।/ পাতার ইমারত আছে, আছে/ কিছু দৈনন্দিন কাজ/ মাছ ধরার নাম করে/ বালসাভেলায় অনেকদূর যাওয়া/ যতদূর ভেসে গেলে ঢেউয়ের চুম্বন থেকে/ ছোবলটুকু আলাদা করাই যায় না

Read More »
নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | দ্বিতীয় পর্ব

সকালে চিড়ে নারকেল-কোরা আর গুড় খেয়ে আমি সাইকেলে চেপে ছুটিয়ে দিলাম— আট মাইল রাস্তা ঠেঙিয়ে যখন পৌঁছালাম— তখন গণগণে রোদ্দুর তেষ্টায় গলা কাঠ। ঘন্টাখানেক গাড়ি চালিয়ে একটা বাড়ি দেখে সাইকেল থেকে নেমে পড়লাম যদি একটু জল খাওয়া যায়। বাড়ির বারান্দায় একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি বসেছিলেন— তার কাছে উদ্দিষ্ট ঠিকানার কথা প্রশ্ন করতেই তিনি উঠে এসে আমার হাত ধরে আমাকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে একটা পাটি পেতে বসতে দিলেন। আমি আবার জল চাইলে বললেন, “দাদাঠাকুর ব্যস্ত হবেন না— ঠিক জায়গায় এসে পড়েছেন।”

Read More »