মৌলানা কিয়ামৎ আলি (মৃত্যু: ১৮৭৩), হাজী শরিয়তুল্লাহ কিংবা রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তিনি নন। উনিশ শতকীয় গ্রামীণ বঙ্গসমাজকে তিনি ধর্মের অমিয়কথা শোনাতে চাননি। সেই অর্থে, তাঁকে ধর্মপ্রবর্তক, ধর্মপ্রচারক কিংবা ধর্মসংস্কারকদের গোত্রভুক্ত করা যায় না। তিনি এক নিঃসঙ্গ লোকসাধক। চারপাশে অসংখ্য মানুষ আর শিষ্য-ভক্তদের উদ্বেল উপস্থিতি, তারপরও তিনি একা; বড় একা। এমনই এক ব্যতিক্রমী সাধক-পুরুষের নাম লালন ফকির (১৭৭৪-১৮৯০)।
কত নামেই না আমরা তাঁকে চিনি! লালন সাঁই, লালন শাহ, ফকির লালন, লালন গোঁসাই। কারও কারও কাছে তিনি চিশতিয়া নিজামিয়া তরিকার মহাসাধক, কারও কাছে উচ্চস্তরের সুফি-অলি। কারও কাছে দর্শন-দারিদ্র্যের দেশের একমাত্র দার্শনিক। পণ্ডিত-গবেষকদের কাছে তিনি নিরক্ষর গেঁয়ো বাউল। আর আখড়ার বাউলদের কাছে তিনি ‘সহজ মানুষ’, ‘পতিতপাবন পরমেশ্বর’। পাকিস্তানি জমানায় (১৯৪৭-১৯৭১) তাঁকে মুসলমান দরবেশ বানানোর জন্য দিল্লির সুফি-সাধক হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মকবরার আদলে তাঁর সুরম্য সমাধি-সৌধ নির্মাণ করা হয়। হিন্দু পালাকাররা তাঁকে হিন্দু-কায়স্থ পরিবারের সন্তান হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য যাত্রাপালা রচনা করেছেন। কিন্তু আমাদের কাছে তিনি লালন— কেবল-ই লালন। এক বিশুদ্ধ জীবন-রসিক। জাতিগোত্রে-বিশ্বাসহীন গৌণধর্মে বিশ্বাসী লোকায়ত লালন।
বিত্ত-বৈভব, নশ্বর জীবনের নিরর্থকতা উপলব্ধি করেও তিনি দুঃখদীর্ণ, রোগ-শোক জর্জরিত মনুষ্য জীবন, জগৎ-সংসার ও জগতের মানুষকে ভালবেসেছিলেন। ভালবেসেছিলেন এই মানবজীবনকে। তাঁর কাছেই আমরা জেনেছি, অজস্র জনমের তপস্যার ফলস্বরূপ আমরা এই ধরাধামে এসেছি মানবরূপে। দেব-দেবতা এবং ফেরেশতারাও নাকি এই মানবজীবন পেয়ে ধন্য হতে চেয়েছেন। কারণ মানব জনম দুর্লভ জনম, এমন জনম খুব সহজে লাভ করা যায় না। তাই প্রবৃত্তির বশে, লোভ-লালসায় পড়ে, কাম-ক্রোধে মত্ত হয়ে এই ক্ষুদ্র জীবনটাকে ব্যর্থ হতে দেয়া যায় না। জীবনকে সুস্থ, সুন্দর, আনন্দময় ও সার্থক করে তুলতে হবে। যে সব সংস্কার মনুষ্যজীবনের স্বাভাবিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, সেসব সংস্কারের ওপর আঘাত হানতে হবে, উপড়ে ফেলতে হবে। তবে একা নয়, সবাইকে নিয়ে— সবাই মিলে।
জাতপাত, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ লালন মানতেন না। মানতেন না ধর্মান্ধতা, অলৌকিকতা, যুক্তিহীনতা ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি। তিনি মনে করতেন, মানবসৃষ্ট এসব সংস্কার মানুষের স্বাভাবিক বিকাশে অন্তরায় সৃষ্টি করে। সব সংস্কার দূর করে সবাইকে নিয়ে একটি মুক্ত সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন মুক্তবিশ্বের মুক্তচিন্তার মুক্তমানব হিসেবে। তিনি ছিলেন নিম্নবর্গীয় হিন্দু-মুসলমানের প্রাণের মানুষ, মিলন-সাধক। স্বপ্নবান মানুষ হিসেবে স্বপ্ন দেখতে ও দেখাতে ভালবাসতেন তিনি। তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন জাতপাত, হিন্দু-মুসলমান, যবন-কাফের বড় নয়; মানুষ পরিচয়টাই আসল। মনে করতেন অজ্ঞ-শাস্ত্রকানা-ধান্দাবাজ মানুষ জাতি বানিয়ে মানুষকে বিভক্ত করেছে। শাস্ত্র-কেতাব, জাতপাত মানুষেরই বানানো। হিন্দুদের ব্রাহ্মণ-কায়স্থ, মুসলমানদের সৈয়দ-পাঠান মানুষের-ই বানানো। গঙ্গাজলের মহিমা— সেও তো মানুষের মনগড়া!
তিনি শাস্ত্র-কেতাবের ধার ধারেননি। জগৎ-জীবনের সারাৎসার জানতে খোঁজ করেছেন ‘মনের মানুষ’। সেই মনের মানুষকে নাগালে পেতেই ব্যয় করেছেন সারাটি জীবন। তার সেই আরাধ্য মানুষ বা মনের মানুষ মসজিদ-মন্দিরে নেই, শরিয়তে নেই, শালগ্রামশিলায় নেই। তিনি আছেন মানুষের দিল-কাবায় কিংবা হৃৎকমলে। মানুষের মধ্যে ‘মনের মানুষ’ কিংবা খোদা খুঁজেছেন যিনি, তিনি-ই তো লালন। তাই তো এই মানুষটিকে কেবল লালন রূপেই চিনি এবং লালন রূপেই তাঁকে চিনতে চাই। চিনতে চাই বৈরাগ্যের ধূপছায়ায় নিমগ্ন একজন সাধক হিসেবে, একজন সমাজমনস্ক অধ্যাত্ম-পুরুষ হিসেবে। এত কথা যাঁর সম্পর্কে বলছি, তাকে কি আমরা আজও চিনতে পেরেছি? তাঁর জন্ম, জন্মস্থান, পারিবারিক ধর্ম সম্পর্কে সঠিক তথ্য কি উদ্ধার করা গেছে?
লালনের জীবনী রচনা বা পুনর্নির্মাণের জন্য যেসব তথ্য প্রয়োজনীয়, তার অনেক কিছুই পাওয়া যায়নি। তাঁর তিরোধানের (মৃত্যু: ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ) একশ’ তিরিশ বছর পার হয়েছে, কিন্তু তাঁর প্রথম জীবনের অনেক কিছুই আলো-আঁধারিতে ঢাকা। তাঁর ধর্ম ও পারিবারিক পরিচয়ও কুয়াশায় আচ্ছন্ন। তিনি এমন কোনও বিখ্যাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেননি, যে পরিবারের তৎকালীন সমাজে উল্লেখ করার মত পরিচিতি বা স্বীকৃতি ছিল। তাঁর এমন কোনও ‘শিক্ষিত’-শিষ্য ছিলেন না, যাঁরা লালন-সম্পর্কে কিঞ্চিৎ পরিমাণে লিখতে জানতেন বা লিখে গেছেন। তাঁর শিষ্য-ভক্ত-অনুগামীরা ছিলেন অধিকাংশই কৌলিন্য-গৌরব বঞ্চিত নিরক্ষর, কেউ আবার শুধুই অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন।
কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, মীর মশাররফ হোসেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, জলধর সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সরলাদেবী চৌধুরানীর মত প্রথিতযশারা তাঁকে চিনতেন, কিন্তু তাঁর জীবন-কাহিনি সম্পর্কে খুব সামান্যই জানতেন। লালন প্রয়াত হন ১৮৯০ সালে। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ তাঁর কালে লালনকে প্রায় তিরিশ বছর পেয়েছিলেন। অথচ লালনের জীবন-কাহিনি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ খুব বেশি মাথা ঘামাননি। কাঙাল হরিনাথ কিংবা মীর মশাররফও তাঁর জীবন-কাহিনি নিয়ে তেমন আগ্রহ প্রদর্শন করেননি। তাঁর সাক্ষাৎ-শিষ্য ভোলাই শাহ, শীতল শাহ, মনিরুদ্দিন শাহ, দুদ্দু শাহ, পাঞ্জু শাহ, গগন হরকরা প্রমুখ তাঁদের গুরুর প্রথম জীবন সম্পর্কে তেমন খুব বেশি জানতেন না, কারণ প্রথম যৌবনেই লালন তাঁর মা-স্ত্রী, পরিবার-পরিজন ও নিজ এলাকার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। তাঁর পরিবার, ধর্ম, জন্মস্থান, আয়ুষ্কাল সম্পর্কে যে তথ্য বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া যায় তা নির্ভরযোগ্য নয়। তাই নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবে লালনের অভ্রান্ত জীবনী-রচনা কিংবা তাঁর গানের বাণী-দর্শন ব্যাখ্যা করা একপ্রকার দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাছাড়া তাঁর সম্পর্কে নানা ধরনের কিংবদন্তি, উপকথা, চটকা-গল্প চালু আছে, তাই লালনকে নিয়ে কাজ করা দিনকে দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠেছে। তবে তিনি যে-দিলখোলা, উদার ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন তা তাঁর গানের বাণী ও সুর বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়। তিনি যতটা মরমিয়া ভাবুক ছিলেন, তারও অধিক ছিলেন মানবদরদি জীবনরসিক ও মাটিলগ্ন সাধুজন। বিষয়-বিরাগী হলেও তত্ত্ব-কপচানো জীবনবিরোধী মানুষ ছিলেন না তিনি। তিনি জীবনকে ভালবাসতেন, শাস্ত্র না-আউড়ে কেবলই গান গেয়ে গেছেন। জগৎ-জীবনের গান, জীবনযুদ্ধে জয়ী হবার গান, ব্যথিত চিত্তের গান, জাতপাতকে রুখে দেবার গান। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বেদনা, জানা-অজানার যন্ত্রণা তিনি গানে-গানেই ব্যক্ত করে গেছেন। তার চারপাশের মূর্খ ও মুমুক্ষু ভক্ত-অনুরাগীরাও গান বেঁধেছেন। চারপাশ প্লাবিত ছিল আকুল-করা গানের সুধারসে। তাঁর শিষ্য গগন হরকরা, দুদ্দু শাহ, মনিরুদ্দিন শাহও গান বেঁধেছেন। গান দিয়েই লালন ও তাঁর শিষ্যরা মর্মের কথা, ধর্মের কথা, পরাভব ও যন্ত্রণার কথা ব্যক্ত করেছেন। তাই তো তাঁকে ঘিরে গানের এত বিপুলতা। উনিশ শতকের অবিভক্ত বাংলার সামাজিক ইতিহাস করতে হলেও লালনের গানের কাছে যেতেই হবে।
গান রচনা, নিঃসঙ্গ নির্জন ও ব্যতিক্রমী জীবন-সাধনার জন্য জীবৎকালেই সান্নিধ্য লাভ করেন বাংলার শিক্ষিত ও সারস্বত পরিমণ্ডলে খ্যাতিমান রথী-মহারথীদের। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর-পরিবার বৃহত্তর বাঙালি পাঠকের কাছে তাঁর প্রচারে অংশ নেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্কেচবুকে লালনের একটিমাত্র আসল প্রতিকৃতির সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁর আখড়া বা গানের আসরে প্রতিদিন-ই জমত অসংখ্য শিষ্য, ভক্ত ও অনুরাগী। সেখানে সমঝদাররা আসতেন। এঁরা কেউ কেউ তাঁর সম্পর্কে বহু গালগল্প বানিয়েছেন। এসব গালগল্প অতিরঞ্জিত, কল্পনার রঙে রাঙানো, কোনও কোনও ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী। সত্যি বলতে কী, তাঁর জীবন-কাহিনিগুলো অধিকাংশই অনুমান, জনশ্রুতি ও কল্পনা-নির্ভর। যে-যা বলেছেন তার নির্ভরযোগ্যতা যাচাই-বাছাই না করেই কোনও কোনও লেখক, নাট্যকার-গবেষক তাঁর জীবনভিত্তিক গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্র, জীবনী রচনায় নিরত হয়েছেন। ফলে আসল লালন চাপা পড়ে গেছেন মিথ্যা ও বিভ্রান্তির জঞ্জালে। মিথ্যার আবর্জনার স্তূপ সরিয়ে সত্যিকারের লালনকে আবিষ্কার বেশ দুঃসাধ্য ব্যাপার।
যা-ই হোক লালনের জীবন-কাহিনির নাটকীয়তা, তাঁর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাঁর গানের ভাণ্ডার বাঙালির কাছে এক গৌরবমণ্ডিত উত্তরাধিকার। সেই উত্তরাধিকার যে সঠিকভাবে আমরা বুঝেছি বা নিজেদের জীবনে গ্রহণ করেছি, এমনও নয়। তারপরও তাঁকে নিয়ে আমরা গর্ব করি, বাড়াবাড়ি করি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির সীমা-পরিসীমা থাকছে না। আজকাল একদল মন্ত্রী, আমলা, রাজনীতিক এবং বুদ্ধিজীবী লালনকে নিয়ে বেশ মাতামাতি করছেন, কেউ কেউ আবার তাঁর সম্পর্কে রটিয়ে দিচ্ছেন কিংবদন্তি বা অলীকপুরাণ। অথচ লালন অনুসারীরা গ্রামেগঞ্জে ক্রমাগত প্রান্তিক অবস্থানে চলে যাচ্ছেন। প্রভাবশালীদের দ্বারা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হচ্ছেন। তাঁদের আখড়া-আশ্রমের ওপর আক্রমণ চালানো হচ্ছে। কুষ্টিয়া, যশোর, পাবনার বিস্তৃত জনপদে এক সময় লালন ভাবাদর্শে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য আখড়া-আশ্রম, যেগুলি অধিকাংশই নিষ্প্রভ বা বন্ধ হতে চলেছে।
পরাক্রান্ত সমাজের প্রতিকূলতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে লালন একদিন প্রথাগত ধর্মের বাড়াবাড়ি, ভোগবাদ আর সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যে-চেতনা জনমনে সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন, সেই চেতনা আমাদের সমাজের গভীরে তেমন প্রোথিত করা যায়নি। তাঁর দর্শনের নিগূঢ়তা আর জীবনপ্রত্যয়ের বলিষ্ঠতা বাউল-সমাজ কিংবা আমাদের শিক্ষিত-সংস্কৃতিমান সমাজ বা রাষ্ট্র গ্রহণ করেছে খুব সামান্যই। তিনি মানুষকে বিশ্বাস করতে বলেছিলেন; ভেদাভেদ ঘোচাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বাসহীনতা আর অবিশ্বাসের সংস্কৃতি ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে। যে-বেএলেম অর্থাৎ অজ্ঞানীরা বহু বছর আগে লালন ও তাঁর অনুসারীদের ধ্বংস করার ফতোয়া দিয়েছিল, তারা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে প্রবলভাবে। লালন ও তাঁর গানকে ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। মানুষের মধ্যে বিভেদের সুউচ্চ দেওয়াল তুলে দেয়া হচ্ছে। হিংসা-হানাহানি বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভোগবাদ আর লুণ্ঠন। অসহিষ্ণুতা ও পরধর্ম বিদ্বেষ হয়ে উঠেছে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলির প্রধান কাজ।
তাহলে এই পুঁজি-নিয়ন্ত্রিত, দুর্বৃত্ত কবলিত, ভোগসর্বস্ব বাংলাদেশ, বাঙালি সমাজ ও তার অনুগত বুদ্ধিজীবী-সমাজ কোন লালনকে নিয়ে মাতামাতি করছে? আর কেনই-বা করছে? এই মাতামাতিকে একধরনের ভাঁড়ামি বলেই মনে হয়। এটা করা হচ্ছে, কেবলই পুঁজিবাদী সমাজের কর্পোরেট-স্বার্থ রক্ষা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসম্প্রদায়ের তুষ্টি ও সমর্থন লাভের আশায়। এদের কাছে তো সবই পণ্য! ধান, গান, ভোরের শিশির, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গীতাঞ্জলি, অগ্নিবীণা কিংবা লালন-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল পণ্য বৈ অন্য কিছু নয়। সবই তো ক্ষমতা লাভের হাতিয়ার। দীর্ঘকাল ধরে লালন নানাভাবেই আমাদের শিক্ষিত শহুরে ভদ্রলোকদের কাছে অপাঙক্তেয় হয়ে ছিলেন। এখন তাঁকে নিজেদের স্বার্থে কিংবা ফ্যাশান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আসল লালনকে ঢেকে দেয়া হচ্ছে রাজনীতির ডামাডোল আর লোকসংস্কৃতিবিদ-গবেষকদের পাণ্ডিত্যের ঝকমারি দিয়ে।
আমরা কখনওই লালনকে জানতে চাইনি, এখনও তাঁকে বুঝতে না। বুঝতে চাইনি, কেন তিনি আমাদের বড়লোকদের সমাজ-ধর্ম এবং আচার-আচরণ ছেড়ে গভীর নির্জন পথ বেছে নিয়েছিলেন? কোন অভিমানে তিনি নিজেকে সমাজচ্যুত, জাতিচুত ও শ্রেণিচ্যুত করেছিলেন? কেন তিনি বেদ কোরান ব্রাহ্মণ মৌলভি, মন্দির মসজিদ খারিজ করে দিয়ে দুর্গম প্রত্যন্ত গ্রাম বেছে নেন বসবাসের জন্য? কেন তিনি গানে গানে ধর্মের মর্মকথা ব্যাখ্যা করেছেন? তা কি কেবলই পারলৌকিক মুক্তির আশায়? না, কেবল পরমার্থিক মুক্তি তিনি চাননি। জাগতিক ও ইহলৌকিক মুক্তিও তিনি চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন শোষণহীন-ভেদবুদ্ধিমুক্ত মানবিক সমাজ। চেয়েছিলেন সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা ও সমতা। চূর্ণ করতে চেয়েছিলেন জমিদারতন্ত্রের অহমিকা আর দাম্ভিকতা। শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেন অস্পৃশ্য, অনাথ, বিপন্ন ও নিরন্ন মানুষকে। অসাম্প্রদায়িক ও ভেদবুদ্ধিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষে প্রেম ও মানবতার বাণী সবচেয়ে বেশি করে প্রচার করেছেন লালন ও তাঁর অনুগামীরা। এ কারণেই লালন-অনুসারী বাউলদের সম্পর্কে বলা হয়েছে:
‘ভেদবুদ্ধিহীন মানবতার উদার পরিসরে, সাম্য ও মানবতার সুউচ্চ মিনারে বসেই বাউলেরা সাধনা করে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাধকের ও দর্শনিকের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তারা সাম্য ও মানবতার বাণী প্রচার করে।’
(আহমদ শরীফ: বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য। ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮০)
আজ যে-লালনকে নিয়ে মাতামাতি করা হচ্ছে, তিনি আসলে তথাকথিত গবেষক ও ফেরেব্বাজদের বানানো নকল লালন। এই বানানো নকল লালনের দাপটে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছেন আসল লালন এবং তাঁর সমসাময়িক সাধক-মহাজনরা। আমরা যদি সত্যিকারের লালনকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে গ্রহণ করতে পারতাম, তাহলে সমাজে বহুত্ববাদী মানবিক চিন্তার বিকাশ ঘটত। আমাদের চিন্তন-মননের ক্ষেত্র প্রসারিত হত মহৎ ভাবুকতা গ্রহণ ও আত্মীকরণে। কিন্তু আমরা তা পারিনি। মনের গভীরে কেবলই প্রশ্ন জাগে, আউলচাঁদ, রামশরণ পাল, চরণ পাল, বলরাম হাড়ি (১৭৮৫-১৮৫০), কুবির গোঁসাই (১৭৮৭-১৮৭৯), খুশি বিশ্বাস, দুলালচাঁদ ওরফে লালশশী (১৭৭৬-১৮৩৩) প্রমুখ কার দোষে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেলেন? নিশ্চয় তাঁদের নিজেদের দোষে নয়। তাহলে কাদের দোষে? উন্নাসিক পণ্ডিতদের দোষে? পাকিস্তানি জমানার দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক ধর্মাশ্রিত অপরাজনীতির কারণে? নাকি, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ও ভোগবাদী সংস্কৃতির কারণে? যে কারণেই হোক, অখণ্ড মানবিক-সমাজ গড়ার জন্য মাটিলগ্ন জীবনরসিক-লালন ও তাঁর সমসাময়িক সাধক-মহাজনদের খুঁজে বের করতেই হবে এবং সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে তাঁদের গ্রহণ করতে হবে। নইলে, সামনের ঘোর সংকটকালে প্রবল-পরাক্রান্ত প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠবে।