প্রথমত হিজাব বা অন্য কোনও ধর্মীয় চিহ্নর সঙ্গে নারী স্বাধীনতা বা প্রগতিশীলতার কী সম্পর্ক তা আমি সত্যই বুঝি না। আমার মতে, প্রগতিশীলতার সঙ্গে সম্পর্ক শুধুমাত্র মননের। অন্য কিছুর নয়। আমি আমার মা-কে দেখেছি। যিনি শাঁখা-সিঁদুরের মত হিন্দু ধর্মীয় চিহ্ন পরিধান করলেও ছিলেন মেয়েদের উচ্চশিক্ষা এবং চাকরির সমর্থক। মনে করতেন পুজোয় ব্রাহ্মণ ডাকা নিষ্প্রয়োজন। বিশেষত যে ব্রাহ্মণ শুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণ করতে পারেন না। মায়ের মতে, তাদের প্রণামী দেওয়া মিছিমিছি অর্থদণ্ড মাত্র। অনেক সময়েই বলতে শুনেছি, ‘ওইসব বিটকেল বামনাগুলোকে না ডেকে আমাকে দিয়ে পুজো করাও। আমিই ভাল মন্ত্র পড়তে পারব।’ এমন একজনকে কী বলব? প্রগতিশীল না প্রগতিবিরোধী? কর্মস্থলেও দেখেছি, অনেক শিখ, মুসলমান বা খ্রিস্টান পুরুষ ধর্মীয় চিহ্ন ব্যবহার করলেও চিন্তা-চেতনায় যথেষ্ট আধুনিক। আর হিন্দু সধবা নারীদের প্রায় সবাই শাঁখা-সিঁদুর পরেন। শহরে না হোক, গ্রামের প্রায় সকল হিন্দু মহিলাই ঘোমটা টানেন। উল্লেখ্য, আমার মা আমার বা আমার ভাইয়ের সামনে ঘোমটা না টানলেও স্বামী, ভাসুর, দেবর, ননদ এমনকি নিজের বাবার সামনেও ঘোমটা টানতেন।
সুতরাং, প্রগতিশীলতা বা আধুনিকতার সঙ্গে ধর্মীয় চিহ্ন বহনের যে কোনওরকম সম্পর্ক নেই, তা সকলেই স্বীকার করবেন। তাই হিজাব নিয়ে বর্তমানে যে বিতর্ক উঠেছে তা পুরোপুরি অনর্থক। আমি সেই অনর্থক বিতর্কে যাব না। বরং উল্লেখ করব এমন একটি বিষয়ের যা গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রায় অনুচ্চারিত।
সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যে খবরটি প্রাধান্য পেয়ে আসছে তা হল, হিজাব পরিধান না করায় ইরানে ২২ বছরের যুবতী মাহসা আমিনির পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু। ১৯৭৯ সালের অর্থাৎ, ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ইরানে বাধ্যতামূলক হিজাব পরিধান চালু, যা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের মতে অতিশয় নিন্দনীয়। একমাত্র ইরানের মত এক ‘বর্বর’ দেশেই চালু থাকতে পারে এমন ‘বর্বর’ প্রথা।
কিন্তু সত্যিই কি তাই? না। ইরান ছাড়াও বাধ্যতামূলক হিজাব চালু রয়েছে ইরাক, সৌদি আরব, ইয়েমেন আর ইন্দোনেশিয়ায়। তালিবান অধিকৃত আফগানিস্তানের অবস্থাটা আরও ভয়াবহ। সেখানে বাধ্যতামূলক হিজাব চালু না-থাকলেও, বেশ কিছু জায়গায় মাথা ঢাকা আবশ্যক। উন্মুক্ত জায়গায় মুখ খুলে রেখে ঘোরা চলবে না। মেয়েদের মাধ্যমিক স্কুল বন্ধ। স্বাভাবিকভাবেই ২০২২ সালের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট মোতাবেক ১৪৬টি দেশের মধ্যে ১৪৬তম স্থানটি আফগানিস্তানের দখলে। কিন্তু এইসব দেশে মেয়েদের অধিকার নিয়ে কোনও হইচই দেখেছেন কি? তালিবান জমানায় আফগান মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে কিছু প্রতিবেদন হয়তো দেখেছেন। কিন্তু তা নিঃসন্দেহে এই হিজাব বিতর্কের মত আলোড়ন যে ফেলেনি তা বলাই বাহুল্য।
এখানেই অন্য রকম গন্ধ টের পাচ্ছেন ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ। তাঁদের মতে, আমেরিকা তথা পশ্চিমি দুনিয়ার সঙ্গে ইরান ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সাংঘর্ষিক সম্পর্কের বিষফল এটি। এই সম্পর্ক সেই ১৯৭৯ সাল থেকে বিদ্যমান।
১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন ইরানের প্রধান রেজা শাহ পহলভীকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন রহুল্লা খোমেনি। এই পরিবর্তন আমেরিকা, ব্রিটেন ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলি মেনে নিতে পারেনি। কারণটা সহজবোধ্য। ১৯২১ সালে এই রেজা শাহ পহলভীর বাবা রেজা শাহকে ক্ষমতায় বসায় তারা। ইরানে শুরু হয় পহলভী আমল। এই আমলে বেশ কিছু সদর্থক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও পহলভীদের স্বৈরাচার মেনে নিতে পারেননি ইরানের সাধারণ মানুষ থেকে ধর্মীয় নেতা, ভূস্বামী, ব্যবসাদার ও বিদ্বজ্জনেরা। তারা প্রথমে জাতীয়তাবাদী নেতা মহম্মদ মোসাদ্দেঘ ও পরে রহুল্লা খোমেনির নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য, ১৯৫১ সালে রেজা শাহকে উৎখাত করে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন মোসাদ্দেঘ। তিনি তৈলকূপগুলির জাতীয়করণ করলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন ব্রিটিশ ও মার্কিনি পুঁজিপতিরা। ১৯৫৩ সালে সিআইএ-র সহযোগিতায় মোসাদ্দেঘকে সরিয়ে পহলভী শাসন পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয়।
কিন্তু ১৯৭৯-র পর আর পহলভী আমল ফিরিয়ে আনা যায়নি। যদিও আমেরিকার তরফ থেকে চেষ্টার কোনওরকম ত্রুটি রাখা হয়নি। এই ২০১৮ সালেও রেজা শাহ পহলভীর সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। সাত কেন আঠাশ মণ তেল পুড়িয়েও রাধাকে নাচানো যায়নি। মার্কিন বিরোধিতায় ইরানের মানুষ এককাট্টা। এতে খোঁচা খাওয়া বাঘের মত আরও তেড়েফুঁড়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। এখন তারা ইরানের ভেতরেই অভ্যন্তরীণ গোলযোগ সৃষ্টি করবে বলে মনস্থ করেছে। চলমান হিজাব বিতর্ককে তারই অঙ্গ বলে মনে করছেন এই অংশটি।
[মতামত লেখকের নিজস্ব]
দুঃখিত আপনার পন্ডিতি বিশ্লেষণ সম্পূর্ণটা মানতে পারছিনা।সরল সমীকরনা ।পারস্য দেশে কোন সামাজিক আন্দোলন হলেই ব্যাখ্যা আসবে আপনার মত করে বিশ্লেষন। এটা ঘা খাওয়া সাম্রাজ্যবাদের প্রতিশোধের ছোবল দেয়ার অপচেষ্টা। সত্য। কোন ভুল নেই ।কিন্তু কোন ঘটনা তা সে ক্ষুদ্র,মাঝারী,বড় যাই হোক না কেন দ্বান্দ্বিক ভাবেন না দেখলে শ্রেনী সংগ্রামের পর্বগুলো,পর্যায়গুলো নিবিড়ভাবে দেখায় ভুল হবেই।