লালন দূর পাড়াগাঁয়ের এক অখ্যাত-অবজ্ঞাত বাউল। কলকাতা তিনি চেনেন না, কলকাতার লোকজনও তাঁকে চেনে না। উনিশ শতকীয় কলকাতাকেন্দ্রিক যে বঙ্গীয় নবজাগৃতি, তার পরশ তিনি পাননি। ইংরেজদের অনুকম্পায় গড়ে ওঠা নব্য-নবাবদের অর্থনীতির সঙ্গেও তাঁর কোনও সম্পর্ক ছিল না। শহরের বাবুদের গানবাজনার মেহফিলেও যোগ দেবার সুযোগ তাঁর হবে কেমন করে! ইমাম গাজ্জালি, রুমি, শেখ সাদীর দর্শনের পাঠ নেবেন, তেমন এলেমদার ব্যক্তির সান্নিধ্য-সুযোগ কে তাঁকে করে দেবে! লালনের ধর্মজ্ঞান, তাঁর মানবতাবোধ, অধ্যাত্মচেতনা ও জীবনচেতনা— সবই প্রকৃতির পাঠশালা থেকে শেখা। সাধক-মহাজনদের গানের আসর থেকে জেনে নেয়া। ব্যক্তিগত জীবনের কঠোর-কঠিন অভিজ্ঞতা এবং চেনা মানুষদের নিষ্ঠুর আচরণ-ই তাঁকে সাধক বানিয়েছে। তীর্থ থেকে ফেরার পথে বসন্তরোগে আক্রান্ত হলে বন্ধুরা তাঁকে মৃত ভেবে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়। দৈবক্রমে তিনি বেঁচে যান। একবুক ভালবাসা নিয়ে নিজের মা ও স্ত্রীর কাছে ফিরে আসেন, কিন্তু আশ্রয় পান না। প্রত্যাখ্যাত হয়ে চিরদিনের জন্য গৃহত্যাগ করেন। ঠাঁই নেন এক অপরিচিত মুসলমান পরিবারে। হতাশ ক্ষুব্ধ লালন বায়াত গ্রহণ করেন পালকি বেহারা সিরাজ সাঁইয়ের কাছে। বদলে যায় তাঁর ধর্মপরিচয়, বদলে যায় জীবনবোধ। স্বজনদের নিষ্ঠুরতা, মানুষের স্বার্থপরতা, ধর্মের অসহিষ্ণুতা তাঁকে মরমী ও বিদ্রোহী করে তোলে। প্রচণ্ড আক্রোশে হিন্দুধর্ম ছেড়ে বেছে নেন লোকায়ত ফকিরি-ধর্ম। লালনের সমকালে অবিভক্ত নদীয়ায় গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু গৌড়ীয় বৈষ্ণবীয় ভাবের জোয়ার এনেছিলেন, সেই ভাবের সঙ্গে তাঁর আত্মিক যোগাযোগ ছিল। এক অজানা মানুষের কথা শুনে একদিন গৌরাঙ্গ ঘর ছেড়ে মাথা মুড়িয়েছিলেন, লালনও তেমনই নিজেকে নতুন করে নির্মাণ করেন মনের মানুষের ডাক শুনে। এরপর গানে গানে নিজ ধর্মের কথা, মর্মের কথা ব্যক্ত করতে থাকেন। লালনের গানে যে-অধ্যাত্মভাবনা রয়েছে, সেখানে পরমার্থিক মুক্তির চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ইহজাগতিক মুক্তি এবং তৎকালীন বঙ্গীয় সমাজের নিম্নবর্গীয় জনতার আনন্দ-বেদনা। বড় হয়ে উঠেছে জীবন-জিজ্ঞাসা ও দীর্ঘ জীবনলাভের বাসনা। লালনের গানের বাণীতে ধরা আছে, উনিশ শতকের অবিভক্ত বাংলার সমাজজীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা, অবক্ষয়, ভ্রষ্টতা ও আত্মবঞ্চনার নির্মম আলেখ্য। এজন্য তাঁকে চিনতে হলে গানের ভিতর দিয়ে চিনতে হবে। লালনের জীবন-কাহিনি ও তাঁর বিশ্বাসের নানাদিক ছড়ানো আছে তাঁর গানের বাণীতে। গানের মাধ্যমেই তিনি অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ করেছেন। জাতপাতকে ঘৃণা করে বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে একাত্ম হতে চেয়েছেন। লালন যখন গান রচনায় রত তখন কুমারখালি এলাকাটি বেশ সমৃদ্ধ। তাঁর সাধনক্ষেত্র ছেঁউড়িয়া গ্রামটিও ছিল কুমারখালি থানার মধ্যে। এখানে ছিল ব্যাপক নীল-রেশমের চাষ। নদী-বন্দর ও ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবেও স্থানটি প্রসিদ্ধ ছিল। রেশমচাষ ও ব্যবসা দেখার জন্য ইংরেজ বণিকরা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করত। কুমারখালি হাট ছিল তাঁতের কাপড়ের সবচেয়ে বড় হাট। কুমারখালি এতটাই সমৃদ্ধ জনপদ ছিল যে, সেখানে কলকাতার উনিশ শতকীয় এলিটরা আসতেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর পুত্রদের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে কুমারখালির যোগাযোগ ছিল। ঠাকুরবাড়ির অনেকেই লালন ফকিরকে চিনতেন।
একদিন এক শিষ্য দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বলল, ‘ওঁরা তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, সাঁইজি।’ লালন বললেন, ‘কারা দেখা করতে এসেছেন?’ শিষ্যটি জানাল, ঠাকুর এস্টেটের লোকজন। খবরটি শুনে লালনের খুব ভাল লাগল। মুখটা কেমন এক অলৌকিক আনন্দে ভরে উঠল। কিছুক্ষণ আগে তিনি গোষ্ঠলীলা শেষ করেছেন। বাতাসে তখনও ভাসছে গানের রেশ। সেই গানের মধ্যে রয়েছে প্রকৃতি-প্রেম, আত্মসমর্পণের দীনতা আর আছে মনের মানুষকে পাবার দুর্মর বাসনা ও ব্যাকুলতা। প্রতিদিনের মত সেদিনও সেবার আয়োজন করা হয়েছে। সকালের আহার। আর তখনই ছেঁউড়িয়ার ঘাটে ভিড়ছে পালতোলা নৌকা। লালনের পরমবন্ধু কাঙাল হরিনাথও সেই বহরের সঙ্গে আছেন। সঙ্গে কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। ঠাকুর এস্টেটের দেওয়ান রাজেন মিত্রও আছেন এই দলে। পদ্মার পাড় লাগোয়া শিলাইদহে ঠাকুরদের কাছারিবাড়ি। কলকাতা থেকে এসে কাছারিবাড়িতে ঠাকুরবাড়ির হর্তাকর্তারা রাত্রিযাপন করেন। পদ্মায় বজরা ভাসিয়ে এলাকায় জমিদারি তদারকি করেন ঠাকুর পরিবারের সদস্যরা। কখনও কখনও বজরাতেই রাত্রিযাপন করেন। শিলাইদহ গ্রামটি কলকাতা থেকে জলপথে খুব দূরে নয়। গ্রামটি নিয়ে বেশ মজার মজার কাহিনি রয়েছে। বিরাহিমপুর পরগনার অন্তর্গত এই গ্রামটির নাম এককালে ছিল খোরশেদপুর। খোরশেদ নামের এক মরমী সাধক এই গ্রামে বাস করতেন, তাঁর নামেই গ্রামের নামকরণ করা হয় খোরশেদপুর। কোম্পানি আমলে শেলি নামের এক সাহেব মোটা টাকা ব্যয় করে গ্রামটি কিনে নিয়ে কুঠি স্থাপন করেন এবং তখন থেকে সাধক খোরশেদ ফকিরের নাম মুছে যায়। নীলকর সাহেবের নামানুসারে গ্রামটির নতুন নাম হয় শেলির দহ, তা থেকে একটু একটু বদলে গিয়ে হয়েছে শিলাইদহ। নীলকর শেলি সাহেবের কুঠিবাড়িটি একসময় প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর কিনে নেন। কয়া, জানিপুর, পান্টি-সহ কুমারখালির কাছাকাছি আরও তিনটি মহাল কিনে নিয়ে বিরাহিমপুর পরগনায় বিশাল জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্রদের মধ্যে প্রবল প্রতাপশালী ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পিতার জীবৎকালেই জমিদারি দেখভালের দায়িত্ব বর্তায় দেবেন্দ্রনাথের ওপর। পরবর্তীতে শিলাইদহের জমিদারি দেখাশোনার ভার পান কখনও তাঁর বড়ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কখনও-বা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর।
প্রতাপশালী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চৌদ্দটি সন্তানের মধ্যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যেমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন তেমনি শারীরিকভাবে সুঠাম, রূপে-গুণে অনন্য। সেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একদিন লালনকে আমন্ত্রণ জানান সাহিত্যসেবী কাঙাল হরিনাথের মাধ্যমে। কাঙাল বললেন, ‘ফকির, তোমার ভাগ্যের দুয়ার খুলে গেল। স্বয়ং জমিদার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তোমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। তিনি তোমার গানের গুণগ্রাহী। তুমি কবে যাবে তাঁর বজরাতে? তিনি তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকবেন।’
আমন্ত্রণটি অবশ্যই লালনের মত একজন দীনহীন ফকিরের জন্য মর্যাদাপূর্ণ। কারণ তিনি ভালভাবেই জানেন, তিনি যে নিভৃত-দুর্গম এলাকায় আখড়াবাড়ি বানিয়েছেন, সেটি ঠাকুর এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত। আর তার হর্তাকর্তা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই জ্যোতিবাবু কিনা লালনকে নেমন্তন্ন করেছেন! এ কি যা-তা কথা! এমন প্রস্তাব অন্য কেউ পেলে এখনই জমিদারের শ্রীচরণে হুমড়ি খেয়ে পড়ত। আবেগে গদগদ হয়ে বলত, ‘বাবু, আপনি আমাদের মা-বাবা, আপনি আমাদের ভগবান। আপনি ছাড়া এই ত্রিভুবনে আমার কেউ নেই! এই দীনহীন ফকিরের ভিটেমাটি যেন নষ্ট করবেন না। কত কষ্ট করে আমরা এটি বানিয়েছি। আমাদের কেউ নেই, আমরা বড় অসহায়। আপনি যদি তাড়িয়ে দেন আমরা কোথায় যাব?’
কিন্তু লালন একেবারে অন্য ধাতুর গড়া মানুষ। তিনি কখনও কারও কাছে নতজানু হননি, নত হতে জানেনও না। বিত্ত-বৈভব, জমিজমা, টাকাকড়ির প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ অনুভব করেন না। ভালবাসেন সরল-আটপৌরে জীবনযাপন। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, দীন-দুনিয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ। জগৎ-সংসারে তিনিই একমাত্র জমিদার, অন্য কেউ নন। সেজদা-প্রণাম কেবল তাঁকেই করতে হয়, তাঁর কাছেই কেবল নতজানু হতে হয়। অন্য কারও কাছে নয়। এই আকাশ, এই অন্তরীক্ষ, এই দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ, এই স্রোতস্বিনী নদী, এই অরণ্য, এই পলিবাহিত অববাহিকার মালিক আল্লাহ— যে নামেই তাকে ডাকি না কেন। আর জমিদাররা কেবল মানুষকে বঞ্চিত রেখে আল্লাহর জমিনকে জোর করে গ্রাস করেছে, মানুষে-মানুষে বিভেদ-বৈষম্য সৃষ্টি করেছে।
সেদিন কাঙাল হরিনাথের সঙ্গে আরও যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা প্রায় সবাই রথী-মহারথী। ‘বিষাদসিন্ধু’-র রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেনও ছিলেন। তিনি লালনকে খুব ভালবাসেন এবং তাঁর সম্পর্কে কিছু লিখতে চান তাঁর ‘হিতকরী’ পত্রিকায়। লালনের কাছ থেকে শুনতে চান ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিকথা এবং ফকিরি ধর্মের সারকথা। কিন্তু লালন নিজেকে জাহির করতে চান না। মুখ খুলতে চান না। ‘আপন ভজন কথা না কহিবেক যথাতথা,/ আপনা হইতে আপনি হইবেক সাবধান।’ তিনি নিজেকে মিম হরফের মত আড়াল করে রাখতে চান। তাই লোকালয় ছেড়ে কুমারখালির নিকটবর্তী কালীগঙ্গা তীরের এই দুর্গম এলাকায় বসবাস করছেন। তাঁর অনেক শিষ্য, কিন্তু সবাই ফকিরি ধর্মের সাধনকথা জানে না, জানাতেও চান না তিনি। এদের অনেকেই গান ভালবেসে আখড়ায় জড়ো হয়। গানের আলোয় নিজেদের উজ্জীবিত ও প্রজ্বলিত করে। এদের কাছে লালন নেতা, ত্রাতা ও দিব্যজ্ঞানসম্পন্ন গুরু। কিন্তু লালন নিজের ভজন কথা পরিপক্ব, মর্মজ্ঞ রসিকজন ভিন্ন অন্য কাউকে শোনাতে চান না। সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে সবকিছু যদি আলু-পটলের মত হাট-বাজারে বিকিয়ে দেন, তাহলে ফকিরিতন্ত্র তথা মানবধর্মের বড়ই অবমাননা হয়। তাই সবসময় নিজেকে আড়াল করে রাখেন। ঘর-গৃহস্থালি ছেড়ে সবাই ফকিরি করে বেড়াক এটাও তিনি চান না। তাই মীর মশাররফকে সাফ জানিয়ে দিলেন যে, ‘ফকিরের ভেদ জেনে আপনাদের কী লাভ? আপনারা কি ফকিরি ধর্ম পালন করতে চান? ফকিরি তত্ত্ব আওড়ানো যত সহজ, ফকির হওয়া তত সহজ নয়। ফকির হতে হলে জাতপাত-দুনিয়াদারির ঝকমারি ছাড়তে হয়। নেমে আসতে হয় আকাশ ছেড়ে ধূলির ধরণীতে। আমাদের জানা-বোঝা আর আপনাদের বোঝাপড়ার মধ্যে বহুত ফাঁক ও ফারাক রয়েছে, বাবু। আমি নিরক্ষর দীনহীন ফকির। আপনাদের মত এলেমদার নই। আমাদের সঙ্গে কথা বলে কি আপনারা রস পাবেন?’
লালন ভালভাবেই জানেন যে, মানুষ যত সভ্য-শিক্ষিত হয়, ততই সে কৃত্রিম হয়ে ওঠে। চিন্তা করার স্বাধীনতা সে হারিয়ে ফেলে। তাঁর মুখে লেপ্টে যায় তথাকথিত ভদ্রতার ও শালীনতার মুখোশ। শত চেষ্টা করেও সে আর সত্যিকারের মুখশ্রী ফিরিয়ে আনতে পারে না। সে সহজ-স্বাভাবিক হতে পারে না। নিজেদের সামাজিক অবস্থানগত কারণে জ্যোতিবাবু-কাঙাল-মশাররফরাও ভদ্রতার মেকি প্রলেপ মুছতে পারবেন না। কিন্তু লালন ও তাঁর শিষ্যরা অন্যরকম মানুষ। যেমন সাধাসিধে, তেমনই জীবনরসিক। নিজেদের ধর্ম ও দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত জন্য তাঁরা জাত ছেড়েছেন, শ্রেণি-গোত্র-কুল সব ত্যাগ করেছেন। বানিয়ে নিয়েছেন ভিন্ন রকমের মানবধর্ম। তাঁদের ধর্মে প্রাত্যহিক কায়কর্ম নেই; নেই সাধন-ভজন কিংবা রিচ্যুয়ালসের বাড়াবাড়ি। নেই প্রচলিত আচার-আচরণ, জপতপ কিংবা উপাসনালয় বা এবাদতখানা। সিরাজ সাঁইকে বাদ দিলে লালনের মত-পথে কোনও গুরুপরম্পরা নেই। কোনও প্রচলিত দেব-দেবতার আরাধনাও তাঁরা করেন না। কেবল জীবনকেই তাঁরা সত্য বলে মানেন। জীবনের জন্য যেটা করা দরকারি বলে মনে করেন, সেই সব কায়কর্ম করতে দ্বিধা করেন না এঁরা। মানুষ হিসেবে যেমন প্রাণবন্ত, উচ্ছল তেমনই অতিথিপরায়ণ। লালনের শিষ্য-শাবকদের শহুরে মেকি ঝকমারি আর দুনিয়াদারি ছুঁতে পারেনি। বৈষ্ণবদের মধ্যে ভেজাল থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু লালন-ভক্তদের মধ্যে ভেজাল নেই। লালন স্থিতপ্রাজ্ঞ ও সাহসী মানুষ, তিনি ভয় পান না। আবার যশের কাঙালও নন। মওলানা-মৌলভী কিংবা পণ্ডিতরা তাঁকে বাউল শ্রেণিভুক্ত করলেও তিনি বাউল নন, আবার মুসলমান সুফিও নন। ও সব কিছুই তিনি হতে চাননি। লালন একবারে ভিন্ন ধাতুর, ভিন্ন মেজাজের মানুষ। তবুও কাঙাল হরিনাথ কিংবা মীর মশাররফ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক কিছুই লালন সম্পর্কে জেনে নিতে চান। লালনের গান শহুরে পাঠকসমাজে তুলে ধরতে চান। কিন্তু লালন এ ব্যাপারে আগ্রহী নন। তিনি মনে করেন, এখানে ভিড় হলে সাধন-ভজনে ব্যাঘাত হবে। সহজ সাধনার পথ রুদ্ধ হবে। বেড়া ভেঙে ছাগল ঢোকার মতন অমর্মজ্ঞ, বে-দরদী ধান্ধাবাজরা পিলপিল করে এখানে জড়ো হবে। এতে হৈহল্লা বাড়বে, নষ্ট হবে স্বাভাবিক জীবন ও ফকিরিতন্ত্রের বিশুদ্ধতা। সেই সঙ্গে বাড়বে নানা ধরনের উটকো ঝামেলা। এসব সামলাবে কে?
কাঙাল হরিনাথ ভাবুক হলেও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ। শৈশব থেকেই তিনি নানা ধরনের বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, ফকিরি করে সংসার চালানো যায় না। আখড়ার পানের বরজ থেকে কত-ই বা আয় হয়! তাঁর শিষ্যদের অনেকেই গান গেয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করে, কিন্তু লালন সেটা একেবারেই পছন্দ করেন না। পরজীবিতা, ভিক্ষাবৃত্তি তিনি অপছন্দ করেন। তাই কাঙাল হরিনাথ লালনের জন্য একটি মাসিক মাসোহারার ব্যবস্থা করে দিতে চান, যাতে করে তাঁর চলতে-ফিরতে অসুবিধায় পড়তে না হয়। তাছাড়া সাধুসঙ্গ বাবদ খরচাদিও বাড়ছে। স্বয়ং জমিদার জ্যোতিরিন্দ্রনাথবাবু তাঁর গানের ভক্ত। তিনি লালনকে সহযোগিতা করতে রাজি হয়েছেন। লালন জোতদার-জমিদার ও উচ্চবর্ণবিরোধী। বড়লোকি আচার, ভাব-ভড়ং একদম পছন্দ করেন না। মানুষ হিসেবে তিনি বড় দিলখোলা আর তাঁর দর্শন উঁচুমানের। হিন্দু, মুসলমান কিংবা খ্রিস্টান ধর্মের মত লালনের ফকিরি মতবাদ কোনও ধর্ম বা সম্প্রদায় নয়। স্বধর্মে থেকেও লালনের দলে যে কেউ যোগ দিতে পারেন। এ এক অভিনব জীবনপদ্ধতি। যে কোনও ধর্মের মানুষ নিজ ধর্মের মধ্যে অবস্থান করেও লালনিক মতবাদ পালন করতে পারে। মানবপ্রেম, মনের মানুষের সন্ধান, অতিথিপরায়ণতা ও পরধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখানো— লালন-দর্শনের মূলনীতি। লালন মনুষ্যত্বের পূজারী, মানবিকতার অনুসারী। তিনি হিন্দু-মুসলমানের ভাগ বোঝেন না, কেবল মানুষ বোঝেন। জীবনের বাঁকে বাঁকে দাগা খেয়ে খেয়ে গভীরভাবে জেনেছেন যে, আমরা সবাই মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করি। কিন্তু কিছু স্বার্থান্ধ মানুষ শাস্ত্র, কায়কর্ম, জাতধর্ম ও সম্প্রদায় বানায়। বলে দেয়, ‘তুমি হিন্দু, তোমার দোকানের চাল খাওয়া যাবে না। তুমি মুসলমান কন্যা, তোমার ছোঁয়া জল পান করা যাবে না।’
লালনের লড়াইটা মূলত এই বিভাজন ও ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে— জাতবিচারী ব্যভিচারীদের বিরুদ্ধে। সমাজে জাতাজাতির নামে যা চলছে, তা এক ধরনের বজ্জাতি। এই বজ্জাতি থেকে সমাজকে মুক্ত করার জন্যই তাঁর লড়াই— তাঁর জেহাদ। তাঁর জেহাদ কেবল জাত-জালিয়াত, বজ্জাত মোল্লা-পুরোহিতদের বিরুদ্ধেই নয়, প্রজাপীড়ক-রক্তচোষা জোতদার-জমিদারদের বিরুদ্ধেও তিনি জেহাদ চালিয়ে যেতে চান। এই জেহাদটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা তিনি জানেন না। তবুও তিনি আপস করবেন না, নতজানু হবেন না। এই জীর্ণ, পচাগলা, নিষ্ঠুর সমাজটা তিনি ভেঙে চূর্ণ করে দেবেন। গড়ে তুলবেন ন্যায়ভিত্তিক সুষম সমাজ, মানবিক সমাজ। সব মানুষের মধ্যেই একটি সুন্দর সমাজ গড়ার স্বপ্ন লুকিয়ে আছে। কিন্তু সঠিক পথপ্রদর্শক, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নেতা কিংবা এলেমদার গুরুর সন্ধান না পেলে, মানুষের স্বপ্ন পূরণ হয় না। সদগুরু কিংবা কামেল মুর্শিদের সান্নিধ্য না পেয়ে মানুষ সংকীর্ণ ঘেরটোপের মধ্যে ঘুরপাক খায় জন্তু হয়ে। কিছু মানুষের জন্ম হয় মিথ্যার অন্ধকারে, মৃত্যুও হয় অন্ধকারে। চোখ থাকতেও তারা অন্ধই থেকে যায়, সত্যের আলো দেখতে পায় না। কিন্তু লালন ভিন্ন ধাতুতে গড়া বুদ্ধি-বিভাসিত মানুষ। লালন-ই পারেন আঁধারছেঁড়া গানের বাণী দিয়ে আলোর কুসুম ফোটাতে। পারেন মানুষকে মিথ্যার অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনতে। লালনই পারেন কোরআন-পুরাণের সূক্ষ্ম-সঠিক ব্যাখ্যা দিতে। লালনের মত লোকায়ত চরিত্রের সাধকরাই পারেন হাজার হাজার মুরিদ ও মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে জমিদারতন্ত্র ও ধর্মব্যবসার দুর্গে আঘাত হানতে। তিনিই পারেন সর্বজনগ্রাহ্য মানবিক সমাজের ভিত রচনা করে ভেদাভেদের দেয়ালটা গুঁড়িয়ে দিতে। সম্ভবত এ কারণেই কাঙাল হরিনাথ চান লালনকে বাঁচিয়ে রাখতে। কাঙাল তো এক অর্থে লালনের শ্রেণিভুক্ত। তাঁর জন্মও বিত্ত-বৈভবহীন অকুলীন পরিবারে। লালন শক্তিশালী হলে, তাঁর আশপাশের নিরাপত্তাব্যূহ শক্তিশালী হলে, গরিব-নিঃস্ব, দীনহীন মানুষ শক্তিশালী হবে। এতে করে তাঁর নিজের মর্যাদা বাড়বে, কদর বাড়বে ফিকিরচাঁদ দলের।
ফিকিরচাঁদি লৌকিক গান বানাতে গিয়ে কাঙাল হরিনাথ ফকিরি ধর্ম সম্পর্কে প্রচুর ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন। এবং বুঝতে পেরেছেন যে, এ বিদ্যা সহজে রপ্ত করার নয়। ফকিরি ধর্ম কিংবা দেহতত্ত্বের গান নিয়ে পাতার পর পাতা তত্ত্ব লেখা যায়, তবে রপ্ত করা যায় না। এ এক কঠিন উপলব্ধি। এর জন্য দরদী, মরমী, অনুভবী দিল লাগে। লাগে ত্যাগের সাহস। আর এজন্য সবাই লালন হতে পারেন না; পারবেনও না। তিনি অন্য রকম মানুষ। খাঁচার ভিতরকার অচিন পাখির মতই তিনি রহস্যময়। একজন লালন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে মিশবেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা তত্ত্ব-আলাপ করবেন। কাঙাল ও মীর মশাররফের সঙ্গে গানের অন্দর ও বাহির নিয়ে কথার পর কথামালা সাজাবেন। কিন্তু নিজেকে তাঁদের মধ্যে বিলীন করে দেবেন না। জমিদারতন্ত্র বা নায়েব-গোমস্তাদের কাছে আত্মসমর্পণও করবেন না। শক্তিমানদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে মনুষ্যত্বের অবমাননা হবে। ফিকিরচাঁদের মত লালন দুঃখবাদী-ভাববিলাসী নন। তিনি মনে করেন, মৃত্যু যেমন অনিবার্য, তেমনই জীবনও তুচ্ছ নয়। মৃত্যু যেমন সত্য, তেমনই জীবনও সত্য। জীবনকে অস্বীকার করার অপর নাম পলায়ণবৃত্তি। মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবিতা মেনে নিয়েই জীবনকে সুন্দর করার জন্য এগিয়ে যেতে হয়। হাহাকার আর হতাশা ছড়িয়ে লাভ নেই। ব্যর্থতা-হতাশা ছড়িয়ে বেড়ানো কিংবা সন্ন্যাসজীবন বেছে নেয়াকে তিনি কাজের কাজ মনে করতেন না। তাই তাঁর গানে প্রস্ফূটিত হয়েছে স্বচ্ছ জীবনবেদ, প্রতিবাদ আর প্রশ্ন-জিজ্ঞাসা। কাঙাল হরিনাথের দৃঢ় বিশ্বাস, লালনের ওপর ঈশ্বরের অশেষ কৃপা আছে, একদিন তিনি সাধনমার্গের উচ্চস্তরে পৌঁছুবেনই। কিন্তু হরিনাথ সম্ভবত এটা জানেন না যে, মানুষকে অবহেলা করে কেবল জমিদারবাবুর সঙ্গে সখ্য-সম্পর্ক স্থাপন করে, তাঁর দেয়া অনুকম্পার মুষ্টিচাল ভোগ করে সাধনমার্গের উচ্চস্তরে পৌঁছানো যায় না। সমাজকে পিছনে রেখে উচ্চস্তরের সাধু হওয়া যায় না। সমতাভিত্তিক সমাজ ছাড়া কেউ বড় হতে পারে না। শিষ্য-ভক্ত, সুহৃদ-শুভানুধ্যায়ীদের চিত্তে-বিত্তে দীনহীন রেখে বড়মাপের মানুষ হওয়া যায় না!