১২০২ বঙ্গাব্দ (১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দ)। চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ। কোম্পানির শাসনে বিধ্বস্ত গ্রামবাংলা, তার পরও গঙ্গাতীরবর্তী কোনও কোনও গ্রামে চলছে বারুণী তিথির মেলা। বাতাসে তখনও হালকা শীতের আমেজ। নদীয়া জেলার কুষ্টিয়ার অনতিদূরে কালীগঙ্গা নদীর দুপাড়ের মুসলমান পাড়ায় ফজরের নামাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু তখনও প্রভাতের আলো ফোটেনি। পাখিরা সবেমাত্র ডাকাডাকি শুরু করেছে। গ্রামবাসী প্রতীক্ষা করছেন একমুঠো উজ্জ্বল রৌদ্রালোকের জন্য। ভোরের আঁধার ভেদ করে সূর্যরাজ আসরে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু কালীগঙ্গার তীরে এত লোকজন কেন? কী হয়েছে? ব্যাপার কী? কোনও লাশ ভেসে এসেছে নাকি? হ্যাঁ, লাশই বটে! এক অচেনা যুবকের সংজ্ঞাহীন-মৃতপ্রায় দেহ পড়ে আছে কালীগঙ্গার পাড় ঘেঁষে। তার শরীরটার অর্ধেক জলমগ্ন এবং সর্বাঙ্গে গুটিবসন্তের চিহ্ন। বেঁচে আছে কিনা, কে জানে?
না, তখনও সে মরেনি। বেঁচে আছে, অর্ধমৃত হয়ে বেঁচে আছে। কিন্তু তার চোখে-মুখে লেগে আছে আধো ঘুম-আধো জাগরণের আচ্ছন্নতা। সেই আচ্ছন্নতা নিয়েই অতিকষ্টে সে একবার চোখ মেলে তাকাল একবার নিজের দিকে, একবার আকাশের দিকে। চারদিকের ফসলের মাঠ, পালতোলা নৌকা, প্রকৃতির অনুপম শোভা, প্রাতঃস্নানরত রমণীদের কলরোল, কিন্তু কোনওকিছুই তাকে বিন্দুমাত্র আলোড়িত করতে পারল না। পারবেই-বা কী করে! বড় ক্লান্ত-শ্রান্ত সে, অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে ভাসতে ভাসতে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে সে। কিছু জলও তার পেটে ঢুকেছে, দারুণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার। দেখে মনে হচ্ছে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু কী আশ্চর্য! কী প্রবল আত্মশক্তি! এত ধকলের পরও পরম করুণাময় ঈশ্বরের কৃপায় অথবা আল্লাহর অশেষ রহমতে সে এখনও দিব্বি বেঁচে আছে। অথচ এমনটি হবার কথা ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে কেউ বাঁচে না। কিন্তু, অলৌকিকভাবেই সে বেঁচে আছে। তখন পর্যন্ত কেউ-ই জানেন না তার জাতি-পরিচয়— সে হিন্দু, না মুসলমান। চোখ মেলে কাতরকণ্ঠে সে বলল, ‘মা, বড্ড খিদে!’ হ্যাঁ, সে ক্ষুধার্ত, ভীষণ ক্ষুধার্ত। কিন্তু কে তাকে খাবার দেবে! কেউ কি সেদিন কালীগঙ্গার তীরে ছিলেন? কোনও স্নেহশীলা রমণী? ছিলেন। এক স্নেহশীলা-মমতাময়ী মুসলমান নারী, যিনি এই নামগোত্রহীন যুবকটির প্রতি গভীর মমতায় আপ্লুত হয়েছিলেন। তার মধ্যে জেগে ওঠে চিরন্তন মাতৃভাব। এই স্নেহশীলা রমণীর নাম মতিজান বিবি। বিপন্ন ও অসহায় মানুষের করুণ আকুতি কখনও কখনও মানুষের মধ্যে জাগিয়ে তোলে প্রবল প্রেম ও মানবিকতা। যুবকের অসহায়তা মধ্যবয়সী, সন্তানহীনা মতিজান বিবির বুকের মধ্যেও জাগিয়ে তোলে মানবিকতার বাঁধভাঙা জোয়ার। বসন্তরোগে আক্রান্ত এই যুবকটিকে তিনি বাড়ি নিয়ে এলেন। কবিরাজ দিয়ে পরীক্ষা করালেন। এই রমণীর নিবিড় পরিচর্যায় পুনর্জীবিত হয়ে সে ফিরে পেল নতুন জীবন, এক দুর্লভ মানবজীবন।
বেচারি মতিজান এক দরিদ্র-পরিবারের সন্তানহীনা গৃহবধূ। তার স্বামী মলম কারিকর ছিলেন পেশায় তাঁত বোনানো জোলা। বড় ভালমানুষ, সাত-পাঁচে থাকেন না। কুষ্টিয়া-কুমারখালির মত অজপাড়াগাঁয়ের সামান্য জোলা, তাঁত বুনে কি সংসার চালানো যায়! মলম কারিকরের সংসারে অভাব ছিল— নিদারুণ অভাব, নুন আনতে পান্তা ফুরোত। কিন্তু দাম্পত্যজীবনে সুখী ছিলেন, রুচিশীলা ও রূপবতী মতিজানকে নিয়ে। মলম কারিকর ধর্ম বিশ্বাস করতেন, নিয়মিত নামাজ পড়তেন, রোজা রাখতেন। ভাগ্য মানতেন। গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, আল্লাহর সঙ্গে পাল্লা দেয়া যায় না। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, ভাগ্যনিয়ন্তা— তাঁর ইচ্ছার বাইরে কোনও কিছুই হয় না, এমনকি গাছের পাতাটিও নড়ে না। মলম কারিকর বিশ্বাস করতেন, আল্লাহর দুনিয়ায় সবকিছু পূর্বনির্ধারিত। তাই এত অভাব-অনটন, দুঃখ-দারিদ্র্য, অপ্রাপ্তির মধ্যেও তিনি নিজেকে সুখী মনে করতেন। কিন্তু মতিজান বিবির বুকটা সব সময় খাঁ খাঁ করত। একটি সন্তানপ্রাপ্তির আকুলতায় শরীর-মনে দিবানিশি জ্বলত কাঠ-কয়লার অনির্বাপণীয় আগুন। কালীগঙ্গার তীরে এই বসন্তের সকালে যন্ত্রণায় কাতর, অর্ধচেতন যুবকটির দিকে তাকিয়ে তার বুকের ভেতরের আগুনটা আবারও যেন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। হৃদয়ের অতলান্ত থেকে জেগে উঠল সহজাত মাতৃভাব। মতিজান ভাবলেন, ‘না না, এই অসহায় মানুষটিকে এখানে এভাবে ফেলে রেখে আমি যেতে পারি না। আমি নারী, আমি একজনের স্ত্রী। আমিও তো ওর মাও হতে পারতাম! মায়ের কি কোনও জাত আছে! মায়ের কোনও জাত নেই, জাতধর্ম থাকতে নেই। আমি জাতকুল মানি না, মুসলমান ধর্মে জাতপাত নেই। হিন্দু-খ্রিস্টান বুঝি না। একটা মানুষ মরতে বসেছে, আর তাকে আমি ফেলে যাব? না, তা আমি পারব না, কক্ষনো না। তোমরা যতই আমাকে অপমান করো, গাঁ থেকে তাড়িয়ে দাও কিংবা আমার স্বামীকে একঘরে করো, আমি এই ছেলেটাকে আমার কাছে রাখব। তোমরা কেউ বাধা দিতে পারবে না।’ বাধার পাহাড় ঠেলে এই জাত-কুলহীন যুবকটিকে মতিজান বিবি নিজ গৃহের তাঁতঘরের পাশে ঠাঁই দিলেন। কবিরাজ দিয়ে চিকিৎসা করালেন। ধীরে ধীরে সে সুস্থ হয়ে উঠছে। তারপর সময় বয়ে যায়। সকাল-দুপুর গড়িয়ে নামে সন্ধ্যা। যুবক যখন চোখ মেলছে তখন মধ্যরাত, চারদিকে গভীর আঁধারে আচ্ছন্ন। কালীগঙ্গার জলে ঢেউ লেগেছে। উথাল-পাথাল ঢেউ! আকাশ থেকে ঝরছে ধবল জ্যোৎস্না। তিথি-নক্ষত্র ভুলে গেছে সে। এখনও সে স্মৃতিভ্রষ্ট। কিন্তু স্মৃতির জানালা দিয়ে ভেসে আসছে দুজন নারীর মুখচ্ছবি, একজন তার মা আর অন্যজন তার নবপরিণীতা-বধূ। সে অনেক কিছুই মনে করতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। কারণ সে ঘোরের মধ্যে, আচ্ছন্নতার মধ্যে আছে, কিছুতেই এই ঘোরলাগা-আচ্ছন্নতা কাটতে চাইছে না। আবারও নেমে আসছে ঘন আঁধার; গাঢ় অমানিশা। তারপরও কেবলই তার মনে হচ্ছে, ‘আমি কে? আমি এখন কোথায়? কীভাবে এখানে আসলাম?’
হঠাৎ অস্ফুটকণ্ঠে সে বলে উঠল, ‘মা, বড় তেষ্টা, একটু জল দেবে?’ এই ‘জল’ শব্দটা শুনে কেঁপে উঠল মতিজানের বুকটা। জল! তার মানে? এ হিন্দু ঘরের ছেলে? আমি তো একে আটকিয়ে রাখতে পারব না। একদিন একে ছেড়ে দিতেই হবে। কালীগঙ্গার তীরে আল্লাহর অশেষ রহমতে যে অচিন মানুষটিকে সে পেয়েছে, তাকে বোধ হয় আর আটকে রাখা যাবে না। এবার বুঝি, তার যাবার পালা! তাছাড়া ভান্ডারা-চাপড়ার কুলীন মোল্লা-মৌলভী, সৈয়দ-গাজিরা মুসলমানের ঘরে মূর্তিপূজারী, কাফের হিন্দুর ছেলে অবস্থান করবে, এটা কোনওভাবেই মেনে নেবে না। উচ্চবর্গীয় অভিজাত মুসলমানদের চোখে, যুগী, কলু, ধোপা, মাঝি, পাটনি, কাহারদের মতই মুসলমান জোলারাও নীচজাত! W W Hunter-এর ‘A Statistical Account of Bengal’ (1875) গ্রন্থে নদীয়া জেলার জনবিন্যাসে মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত নিকিরি, নলুয়া, কলু ও জোলাদের নিম্নবর্গীয় হিসেবে দেখানো হয়েছে। আঠারো শতকের শেষার্ধ থেকেই নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া-কুমারখালি অঞ্চলে ছোট-বড় নানা বৃত্তিজীবী লোকজন বসবাস করতেন, এরা ছিলেন পরস্পর-নির্ভরশীল। এরা কায়িক শ্রম দিয়ে সমাজের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতেন, আবার উচ্চবর্গীয় অভিজাতদের দ্বারা নিগৃহীত-পীড়িত হতেন সমানভাবে। মলম কারিকর ও তার ভাই কলম-তিলমরাও মুসলমান উচ্চবর্গের চোখে ছিলেন ব্রাত্য। তাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন যুগযুগান্তরের শোষিত-শাসিত, সেই অর্থে তারাও নিপীড়িত-নিগৃহীত এবং নিম্নবর্গীয় সমাজের প্রতিনিধি।
মলমের স্ত্রী মতিজানের হাতে জল পান করে আকাশের দিকে চোখ মেলল যুবক। নতুন দিনের নতুন আলোর পরশে তার মনটা ভরে গেল। কালীগঙ্গা তীরবর্তী জোলাপাড়ার প্রায় সবাই মুসলমান, তবে এরা কেউ-ই খানদান মুসলমান নন। এরা কেউ তাঁত বোনেন, কেউ মাছ ধরেন, কেউ জন খাটেন। কেউ আবার কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। রাখাল ছেলেরা কালীগঙ্গার তীরে গোরু চরায় আর বাঁশি বাজায়। এখানে কেউ জাত নিয়ে, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িও করেন না। অনেকেই অবশ্য এই অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের নামধাম, জাতিপরিচয় জানতে চেয়েছেন, কিন্তু সে বলতে পারেনি। হয়তো-বা স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে গেছে কিংবা ইচ্ছে করেই সে জাতি-পরিচয় গোপন করতে চাইছে। স্মৃতি ফিরে এলে হয়তো তার নাম, ধাম, জাতধর্ম ও পারিবারিক পরিচয় জানা যাবে। হয়তো সে আবার ফিরে যাবে নিজ গৃহে আপনজনের কাছে। কিন্তু না। এক অপ্রত্যাশিতভাবে সুস্থ হয়েও তার বাড়ি ফেরা হল না। ইনিই আমাদের লালন। জোলাপাড়াতেই দীক্ষা গ্রহণ করলেন তিনি মুসলমান দরবেশ সিরাজ সাঁইয়ের নিকট।
সিরাজ সাঁই? তিনি আবার কে? সিরাজ সাঁই চিশতিয়া তরিকার এক লোকায়ত সাধক। তিনি ইসলামি প্রবর্তনার সুফিসাধক হলেও হিন্দু-মুসলমানকে সমান চোখে দেখেন। তাঁর গুরুর নাম শাহ আকবার মানিক, তাঁর গুরুর নাম শাহ আমানতউল্লাহ। সিরাজ সাঁইয়ের নিবাস যশোর জেলার ফুলবাড়ি। মোটাসোটা চেহারা, ভরাট কণ্ঠ, একতারা বাজিয়ে আখড়া-আশ্রমে গান করেন। গ্রামে-পাড়ায় গান করেন, গান করেন মরমীদের সাধুসঙ্গে, সচ্ছল গৃহস্থের আঙিনায়। সিরাজের গলায় একধরনের জাদু আছে, তাঁর গান শুনলে ভেতর থেকে প্রশ্ন ও ভক্তি দুই-ই জেগে ওঠে। নদীয়া-যশোরের মানুষজন যুক্তিপ্রবণ হলেও বেশ ভক্তিমান। দেব-দ্বিজে বিশ্বাস করেন, সাধু-গুরু ও মুর্শিদদের বেশ খাতির করেন, মান্য করেন। তারা গান ভালবাসেন, গান দিয়েই তারা পরমাত্মার তালাশ করেন। তাই সিরাজের গান শুনলে হৃৎকমলে আনন্দ ও ভাবুকতা জেগে ওঠে। জেগে ওঠে কল্যাণচিন্তা, আধ্যাত্মিকতা ও মানবপ্রীতি। ভাবরসে, তত্ত্ব বিশ্লেষণে এক অসাধারণ মানুষ তিনি। কালীগঙ্গা তীরের জোলাপাড়ার মোমিন সম্প্রদায়ভুক্ত তন্তুবায়রা সিরাজ সাঁইকে বেশ পছন্দ করেন। তিনি যখন জোলাপাড়ায় আসেন, তখন কারিকররা আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন, অন্তত একদিনের জন্য হলেও ভাবগানের আসর বসান। সারারাত গান হয়, তত্ত্ব আলাপ হয়। আপ্লুত হয় আবালবৃদ্ধবণিতা। মলম কারিকর পরহেজগার মুসলমান হলেও ভাবগানের আসর তার বেশ ভাল লাগে। মাঝে মাঝে ভাবগানের তর্ক-প্রতর্ক ও আলাপচারিতায় হাজির হন। একদিন এক আসরে সিরাজ সাঁই গাইছেন এক দিলজাগানো, মন-উচাটন করা গান। ‘বল খোদা বল খোদা বল, জলের ওপর পানি, নাকি পানির ওপর জল’— লালন ও উপস্থিত শ্রোতারা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন, শক্ত বাঁধনের মধ্যে নিজেদের আটকে রাখতে পারছেন না তারা। আর শিষ্যরা একতারা বাজিয়ে ধুয়া তুলেছেন। গান শুনে মতিজানের চোখে জল, মলম কারিকর হতবিহ্বল। লালনের ভেতরটা কেমন যেন দুমড়েমুচড়ে ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। তার ভাবুক-মনটা আরও ভাবুক হয়ে উঠেছে, হাজারো প্রশ্নবাণে জর্জরিত হচ্ছে ভেতরে ভেতরে। এই মহেন্দ্রক্ষণে নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে অনুভব করলেন এক গভীর দার্শনিক উপলব্ধি এবং নিদারুণ নিঃসঙ্গতা। তাঁর কেবলই মনে হতে লাগল, এই জগৎসংসারে কেউ কারও আপন নয়, আবার পরও নয়। দারা-পুত্রকন্যা পরিবৃত হয়ে চার দেয়ালের খোপে আটকে থাকলে চলবে না। বিশ্বনিখিলের সবখানে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে হবে। মায়ার সংসার ছেড়ে একাত্ম হতে হবে মানুষের সঙ্গে, বিশ্ববিধাতার সঙ্গে। জানতে হবে জগৎ-জীবনের গভীর সত্যকে। বেছে নিতে হবে সত্য সুপথ, তবেই তো মানবজীবন ধন্য হবে। কিন্তু কেমন করে বিশ্ববিধাতার সান্নিধ্য লাভ করা যায়? কেমন করে বিশ্বনিখিলের সঙ্গে একাত্ম হওয়া যাবে? কেমন করে সত্য-সুপথের সন্ধান মিলবে? সংসার ছেড়ে কি মানবজীবনের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়? নানা প্রশ্নবাণে বুকের ভেতরটা জর্জরিত হয়ে উঠল। এ সব প্রশ্নের জবাব সম্ভবত সিরাজ সাঁইয়ের কাছেই পাওয়া যেতে পারে।
লালনের মনে হল, সিরাজ উন্নত আদর্শের মর্মজ্ঞ ব্যক্তি, দরদী ব্যক্তি। ইস্কুল-পাঠশালার পণ্ডিতমশাইদের কাছে তিনি পাঠ নেননি বটে, কিন্তু পৃথিবী ও প্রকৃতির চিরন্তন পাঠশালায় পাঠ নিয়েছেন বিপুল পরিমাণে। শাস্ত্র-কিতাব না জানলেও তিনিই পারবেন জগৎ-জীবনের ব্যাখ্যা দিতে। দিলদরিয়ার মধ্যে তিনিই পারবেন যুক্তি ও বিশ্বাসের ছবি এঁকে দিতে। তিনিই পারবেন জন্ম-জন্মান্তরের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির পথ বাতলে দিতে, কুপথ থেকে সুপথে চালিত করতে। পারবেন উজ্জ্বল নীতিনিষ্ঠ জীবন-পথের নিশানা দেখাতে। তাঁর গানের সুরে-বাণীতে রয়েছে জীবন-অভিজ্ঞতার ছাপ, তেমনি রয়েছে মরমী ভাবুকতা। আছে মাটি আকাশ জল হাওয়া, কাম-প্রেম, জোয়ার-ভাটা, আছে জমি ও কর্ষণের কথা। আছে গোলাপের সুগন্ধ মাখানো সুফিবাদ, আছে বাংলার জল-হাওয়াছোঁয়া রাধাকৃষ্ণের লীলারস। আছে প্রেম-মানবিকতা ও মহব্বতের কথা, আছে বলিষ্ঠ ও স্বচ্ছ জীবনপ্রত্যয়ের ঘোষণা। এই পদাবলির ভাঁজে ভাঁজে কত যে ব্যথা-বেদনা-বঞ্চনার মর্মস্পর্শী বয়ান লুকিয়ে আছে, তা কেবল মরমী রসিকজন ছাড়া অন্য কেউ বুঝবেন না। সে কারণে এই গান গেয়ে কোনও গায়ক ক্লান্ত হন না; শুনেও বিরক্তি জাগে না শ্রোতা-ভক্তের অন্তরে। রাতের পর রাত জেগে অক্লেশে এ গান যেমন গাওয়া যায়, তেমনি শোনাও যায়। রূপকে-প্রতীকে মোড়া এমন দুর্মর জীবনসত্যের গান মুমুক্ষু মানুষদের তো কাছে টানবেই! ভিনদেশি ভাষায় রচিত দুর্বোধ্য শাস্ত্রকথা কিংবা মহাপুরুষদের আপ্তবাক্য মানুষ বুঝতে পারে না। কিংবা বুঝলেও আত্মস্থ করতে পারে না। এ কারণেই সম্ভবত জোলাপাড়ার গরিবগুলো সিরাজ সাঁইয়ের গান শোনেন এবং জেনে না-জেনে তাঁর কাছে দীক্ষা নিয়েছেন— মানবিক অধ্যাত্মবাদের দীক্ষা। লালনও দুঃখময় জীবন-যন্ত্রণা ও সমাজজীবনের বঞ্চনা থেকে মুক্তি ও সান্ত্বনা পেতে সিরাজের কাছে এই নতুন ধর্মপ্রত্যয়ে দীক্ষাগ্রহণ করতে চান। এক দীনহীন ভক্ত হিসেবে শাস্ত্রের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে এমন এক মানবগুরুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে চান যিনি সর্বজনীন ঈশ্বর তথা সর্বশক্তিমান আল্লাহর স্বরূপ বুঝতে হিল্লা হয়ে দাঁড়াবেন। বিশ্ববিধাতার বিশ্ব-বিধানের কাছে নতজানু হতে শেখাবেন। তাঁর কেবলই চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, ঈশ্বর কিংবা আল্লাহ ধর্মধ্বজীদের নিজস্ব পৈতৃক সম্পত্তি নয়। প্রথাগত ধর্মের বাইরে দাঁড়িয়ে ঈশ্বরের স্বরূপ সন্ধান করা যায়। কেবল ধর্ম নয়, মানবিক অধ্যাত্মবাদের পথ ধরেও জীবনদেবতা, ঈশ্বর-আল্লাহকে উপলব্ধি করা যায়। লালন যে মানবিক অধ্যাত্মবাদের আকৈশোর ভেবেছেন তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আসলে শাস্ত্র-কেতাবে নেই, আলেম-মাশায়েখ-পুরোহিতদের কাছে নেই— এর ভেদ জানা যাবে কেবলই মর্মজ্ঞ মরমী ও রসিকজনের কাছে বায়াত গ্রহণ করে। তিনি হতে পারেন দরবেশ সিরাজ সাঁই কিংবা তাঁর-ই মত অন্য কোনও মরমী সাধক।
পড়তে খু্ব ভালো লাগল, সাবলীল পুনর্গঠন আর অসাধারণ রচনাশৈলী দুইয়ে মিলে পড়তে খুব তৃপ্তি দিয়েছে! ছোট্ট একটা টাইপো আছে হয়তো, ‘শুনেও বিরক্তি জাগে না শ্রোতা-ভক্তের অন্তরে’ হবে মনে হয়।
অশেষ ধন্যবাদ