Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

বিভূতিসাহিত্য: পুনর্বিবেচনা

‘তোমার দিকে চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের অন্ত নাই’, বলেছিলেন শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে। কথাটা বিভূতিভূষণ সম্পর্কেও বলা যায়। সাধারণভাবে তিনি প্রকৃতিপ্রেমিক, গ্রামবাংলার কথাকাররূপে চিত্রিত। প্রথম উপন‍্যাস ‘পথের পাঁচালী’ লিখেই তিনি বাংলাসাহিত‍্যে স্থায়ী আসন করে নিতে পেরেছেন, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ‘পরিচয়’ পত্রিকায় সে-গ্রন্থটি আলোচনাপ্রসঙ্গে ইতিবাচক ছিলেন। ইউনেস্কোর উদ‍্যোগে পরবর্তীকালে উপন‍্যাসটি একাধিক ইওরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাছাড়া সত‍্যজিৎ রায় উপন‍্যাসটির চিত্ররূপ দেওয়াতে উপন‍্যাসটি আরও বহু মানুষের কাছে অনায়াসে পৌঁছতে পেরেছে।

এটা গেল লেখকের একটি দিক। ব‍্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন আডভেঞ্চারপ্রিয়, তুখোড় ঘোড়সওয়ার, নক্ষত্রবিদ, যিনি রাতের পর রাত তারা দেখে বেড়াতেন, অরণ‍্যবাসের দিনগুলিতে ইম্পিরিয়াল লাইব্ররির ব‍ই ডাকযোগে আনিয়ে পড়তেন, আর যেখানেই যেতেন; মানুষকে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ করতেন।

সামগ্রিকভাবে তাঁর সাহিত‍্যকৃতি আলোচনা করতে গেলে দেখা যাবে, বয়স্কপাঠ‍্য রচনার পাশাপাশি ছোটদের জন‍্যও উদারহস্তে লিখে গিয়েছেন তিনি, গল্প ও উপন‍্যাস।

তবে বাংলা সাহিত‍্যাঙ্গনে ডায়েরিলেখক বিভূতিভূষণ স্বাতন্ত্র‍্যচিহ্নিত। তরুণ বয়স থেকেই তাঁর ডায়েরি লেখার সূত্রপাত, যা প্রায় আজীবন বহাল ছিল। বাংলাসাহিত‍্যের অনেক প্রথিতযশা লেখকই ডায়েরি লিখতেন, যেমন সতীনাথ ভাদুড়ী, বনফুল, মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় প্রমুখ। কিন্তু কেউই বিভূতিভূষণের মত নিবিড় ডায়েরিপ্রেমী ছিলেন না। আমাদের ভাবতে অবাক লাগে, বিভূতিভূষণের বাবা মহানন্দ-ও ডায়েরি লিখেছেন। সে ডায়েরি বিভূতিভূষণের সঙ্গে থাকত সর্বদা। পিতার ডায়েরির কথা পুত্র বিভূতিভূষণের ডায়েরিতে একাধিকবার উল্লিখিত হয়েছে।

আমরা আপাতত বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’-র একটি কৌতূহলী দিক নিয়ে আলোচনা করব। সেটি হল উপন‍্যাসটির প্রধান প্রধান চরিত্রের নামকরণ। এই নামকরণের পেছনে কি লেখকের গৃঢ় কোনও অভিপ্রায় ছিল? আমাদের বিশ্বাস, ছিল।

সাধারণত গল্প-উপন‍্যাসের নামকরণে লেখকদের সুন্দরতা ও অভিনবত্বের কথা ভাবতে হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের কুন্দনন্দিনী, কপালকুণ্ডলা, তিলোত্তমা, শৈবলিনী থেকে রবীন্দ্রনাথের লাবণ‍্য বা নন্দিনী; এসবে তার প্রমাণ মিলবে। পরবর্তীতে শরৎচন্দ্রের নায়ক-নায়িকারা আটপৌরে নামের,— শ্রীকান্ত, রমেশ, রমা, অচলা।

বিভৃতিভূষণে পাচ্ছি দেবনাম,‍ আর তা অদ্ভুতভাবে। হরিহর, সর্বজয়া, ইন্দির (ইন্দিরা, অর্থাৎ লক্ষ্মী), দুর্গা। ইন্দিরের একটি মেয়েও ছিল। তার নাম বিশ্বেশ্বরী। তার কাছেই ইন্দির গোড়ায় থাকত। মেয়ের অকালমৃত‍্যুর পর সে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে হরিহরের সংসারে আশ্রয় নেয়।

এই নামগুলোর সঙ্গে আমরা আরও একটি নাম যোগ করতে চাই— অপর্ণা, যদিও সে ‘অপরাজিত’ উপন‍্যাসের। কিন্তু কেবল দেবনাম হিসেবেই নয়, আরও গভীর কারণে এই নামটি দরকার হবে আমাদের।

দেবতার নাম, কিন্তু নামগুলোতে বৈশিষ্ট্য আছে, রয়েছে নামকরণের পেছনে গূঢ়ৈষা। উপন‍্যাসটি যেসময়কালকে ঘিরে লেখা, তখন গ্রামগঞ্জে দেবতার নামে নাম রাখবার চল ছিল। তার পেছনে একদিকে ঠাকুরদেবতার প্রতি ভক্তি প্রকাশিত হত যেমন, তেমনই আরও এক সুপ্ত বাসনা কাজ করত। ভক্তিপরায়ণ মানুষের বিশ্বাস, মৃত‍্যুকালে ঈশ্বরের নাম নিলে মৃত‍্যুর পর স্বর্গবাস সুনিশ্চিত। পুত্রকন‍্যার নাম যদি শিব বা কালী হয়, অথবা ধূর্জটি অথবা প্রহ্লাদ, (দৈত‍্যকুলে জন্মালেও ঈশ্বরোপম, দেব-আরাধনার জন‍্য), তাহলে পুত্রকন‍্যার নাম অন্তিমে নেবার ফলেও বৈকুণ্ঠবাসের নিশ্চিন্তি!

আবার বাঙালি হিন্দুদের রাশনাম রাখার রেওয়াজ ছিল। বৈষ্ণববাড়িতে ছেলেমেয়েকে একধরনের নাম দেওয়া হত, যেমন কানাই, বংশীবদন, রাধা ইত‍্যাদি। শাক্তবাড়িতে তেমনি শক্তিধর, কালী। অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন‍্যাসের চরিত্রগুলির নাম বৈষ্ণবীয়,— অনন্ত, কিশোর, সুবল, বাসন্তী, তিলক, বাঁশিরাম, ইত‍্যাদি। এতে বোঝা যায়, মল্লবর্মণ-বর্ণিত মালোসমাজ ধর্মের দিক দিয়ে বৈষ্ণব।

বিভূতিভূষণের উপন‍্যাসটিতে কিন্তু এমন অভিপ্রায় নেই। হরিহর নামটি বাঙালিসমাজে খুব একটা ব‍্যবহৃত না হলেও চণ্ডীতে হরিহরের (হরি= কৃষ্ণ, হর= শিব)-এর সুখালাপনের কথা আছে। ‘হরিহর আত্মা’ শব্দটি বাংলায় গভীর হৃদ‍্যতা বোঝাতে ব‍্যবহৃত হয়। অন‍্যদিকে ‘একযাত্রায় পৃথক ফল’ বোঝাতেও কিন্তু ভারতীয় পুরাণে একটি সুন্দর গল্প আছে। সমুদ্রমন্থনকালে দুজনের দুরকম প্রাপ্তি,— ‘হরি লক্ষ্মীঃ, হরো বিষম্’, কিনা সমুদ্র থেকে লক্ষ্মী উঠে এলে তাকে বিয়ে করলেন হরি, কি না বিষ্ণু। আর সমুদ্রমন্থনে যে বিষ উঠে এসেছিল, তা কণ্ঠে ধারণ করতে হল শিব, অর্থাৎ হর-কে।

হরিহর নামটি কিন্তু বাঙালিদের মধ‍্যে খুব একটা দেখা যায় না। না, ট‍্যাবু নেই এ-নামে, যেমন আছে দুর্যোধন, দুঃশাসন, সরমা বা এরকম কিছু কিছু নামে (আছে কংস নামেও। কিন্তু তবু বাংলায় তেভাগা আন্দোলনের এক নেতার নাম হতে পেরেছিল কংসারি)। মহাকাব‍্যের নিতান্তই সাধারণ চরিত্র শত্রুঘ্ন। সে-নামকরণও আছে, এবং তা জনপ্রিয় হিন্দি ছবির নায়কের থেকেও শতাব্দীপ্রাচীন,— ঈশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যাসাগরের শ্বশুরমশাইয়ের ওই নাম ছিল।

হরিহর নামটি কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গল্পের একটি চরিত্ররূপে বাংলাসাহিত‍্যে পূর্বেই বহাল। তার ‘ত‍্যাগ’ গল্পে পুরাণের দুর্বাসা মুনির প্রকল্পে অঙ্কিত এই মুখোপাধ‍্যায়মহোদয়, আবির্ভাবমাত্রই যিনি স্বপুত্র হেমন্তকে ক্রুদ্ধ গর্জনে আদেশ দেন, ‘হেমন্ত, বউকে এখনই বাড়ি হইতে দূর করিয়া দাও।’ এ-গল্প ১৮৯২-এর। বিভূতিভূষণের জন্ম নিতে তখন আরও দুবছর বাকি।

রবীন্দ্রনাথের হরিহরকে আমরা মনে রাখিনি। বিভূতিভূষণের হরিহর বাঙালি পাঠকের কাছে চির-জাগরূক।

সর্বজয়া শব্দটি দুর্গার আদিরূপ হিসেবে ব‍্যবহৃত হতে দেখা যায়। দেবী দুর্গার যে আদি ধারণা, তার উদ্ভব উপনিষদ থেকে, উমা নামে, যে-নাম কালিদাসও ব‍্যবহার করেছেন ‘কুমারসম্ভবম্’ কাব‍্যে। পরবর্তীতে শাকম্ভরী, অন্নপূর্ণা ইত‍্যাদি বিবর্তনের মধ‍্য দিয়ে দুর্গা ও দশমাতৃকায় বিবর্তিত। সহস্র থেকে দশ হাতে বিবর্তিত। বিভূতিভূষণে নামটি কী অপরূপতায় বিবর্তিত সর্বজয়া-দুর্গা-অপর্ণায়, সেটাই অনুধাবনের প্রয়াস আমাদের। প্রসঙ্গত, এ-নাম বাঙালিসমাজে ক্বচিৎ ব‍্যবহৃত হতে দেখি। শ্রীরামকৃষ্ণের ভ্রাতৃজায়ার নামটিই আমাদের জানামতে এ-নামের একমেবাদ্বৈতম উদাহরণ।

হরিহরের সর্বাবস্থায় প্রসন্নতা, ধীরে ধীরে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে পড়েও মনের শান্তি বিন্দুমাত্র না হারানো চরিত্রটিকে মহিমান্বিত করেছে। জীবনের যাবতীয় দুর্ভাগ্যকে অনায়াসে মেনে নেয় সে, যেন গীতায় কথিত শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ তার জীবনের ধ্রবপদ,— ‘দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনাঃ’, অর্থাৎ দুঃখে উদ্বিগ্ন না হওয়া। এমন আচরণ দেবতাতেই সম্ভব।

সর্বজয়া হরিহরের পরিবারের সবকিছুই সামলাচ্ছে অলৌকিকভাবে। মাসের পর মাস স্বামী অর্থ-অন্বেষণে বাইরে, ন’মাসে-ছ’মাসে সামান্য কিছু অর্থ পাঠায়, তারপর দীর্ঘদিনের নীরবতা। এ-ও তো ঈশ্বরপ্রতিমা, যেভাবে সে বছরের পর বছর ঘর সামলেছে।

আর ইন্দির? পুরাণের লক্ষ্মী যেন বিপ্রতীপরূপে আবির্ভূত এখানে। ধনবতী না, নিতান্তই ধনহীনা! যে-দেবী সবার আরাধ‍্যা, সর্বজয়ার কাছে সে-ই অবাঞ্ছিত, অসহনীয় ও এমনকি ঘৃণিত।

এবং দুর্গা। পুরাণের দুর্গা অসুরনাশিনী, কিন্তু এখানে দারিদ্র‍্য, মেয়ে হয়ে জন্মে তার পাঠশালায় যেতে না-পারা, হৃদয়ে অপার উদারতা-সমমর্মিতা-পরদুঃখকাতরতা নিয়েও পিসির বেদনা, মায়ের দুর্দশা আর ভাই অপুর অভাবমোচনে অপারগ এক বালিকা, যার কচি বুকে ভালবাসার স্পন্দন জেগেছিল, যা তার গ্রামদেবীর কাছে প্রার্থনায় ব‍্যক্ত! আর অন্তিমে অসুরদলনী না, দুর্গাকে মৃত‍্যু উপহার দিয়ে চরিত্রটির নির্মাণ শেষ করেন লেখক।

এতসব দেবতা, আর তার পাশে অপূর্ব। কোনও দেবতার নামেই লেখক তার নামকরণ করেননি। অথচ তেত্রিশ কোটি দেবতার দেশে দেবনামাবলি তো নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, এমন নয়। কী কারণ থাকতে পারে এর পেছনে, কোন গূঢ় তাৎপর্য? না কি কেবল আকস্মিকতা, কোনওই উদ্দেশ্য লেখকের ছিল না উপন‍্যাসে বর্ণিত চরিত্রগুলির নামকরণের ক্ষেত্রে? তা যে ছিল,— উদ্দ‍েশ‍্য, অভিপ্রায়, এষণা যা কিছু, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ নিহিত আছে অপূর্ব তথা অপুর স্ত্রীর নামকরণের মধ‍্যে।

অপর্ণা। তার নামকরণ সমধিক তাৎপর্যপূর্ণ। আগেই বলেছি, অপর্ণাকে ‘পথের পাঁচালী’ নয়, পাই সে-উপন‍্যাসের পরবর্তী অধ‍্যায় ‘অপরাজিত’-তে। নামটি দুর্গার। হিমালয়কন‍্যা পার্বতী শিবকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার জন‍্য কঠোর তপস‍্যা করেন। শিবের ধ‍্যানভঙ্গের জন‍্য দেবতাদের পরামর্শে কামের দেবতা মদন একদিকে পার্বতীকে অনিন্দ‍্যকান্তিতে গড়ে তুললেন, অন‍্যদিকে নিয়ে এলেন অকালবসন্ত। এর প্রভাবে শিবের ধ‍্যানভঙ্গ হল। কিন্তু মুহূর্তেই শিব মদনের প্রকল্পটি ধরে ফেললেন। রোষকষায়িত চোখে তাকালেন মদনের দিকে, আর মহাদেবের রোষনেত্রপাতে মদন ভস্ম হয়ে গেল।

রূপের গর্ব ছিল পার্বতী তথা উমা তথা দুর্গার, যিনি ছিলেন আবার ‘ভবপূর্বপত্নী’, অর্থাৎ পূর্বজন্মে সতীরূপে শিবজায়া। শিবনিন্দা সহ্য করতে পারেননি বলেই দেহত‍্যাগ করেন। সেই সতীকে নিয়ে অতঃপর শিবের তাণ্ডবনাচ, শ্রীকৃষ্ণকর্তৃক সুদর্শনচক্রে সতীর অঙ্গচ্ছেদ ও তা উপমহাদেশের একান্নটা স্থানে পড়ায় একান্নপীঠ গড়ে ওঠা, সেসব অন‍্য প্রসঙ্গ।

তপস‍্যারত পার্বতীর উপলব্ধি, অকালবসন্ত বা নারীর পুরুষকে রূপে ভোলানোর মধ‍্যে আসলে কোনওই সারবত্তা নেই। তাই এই পর্যায়ে কালিদাস ‘কুমারসম্ভব’ কাব‍্যে পার্বতীকে দিয়ে রূপের তুচ্ছতা ব‍্যক্ত করিয়েছেন, ‘নিনিন্দ রূপং হৃদয়েন পার্বতী’,— পার্বতী নিজরূপকে নিন্দা করলেন (তুলনীয়, ‘আমি রূপে তোমায় ভোলাবো না’,— রবীন্দ্রনাথ)।

এরপর শিবকে পতিরূপে পাওয়ার জন‍্য কঠোর তপস‍্যা শুরু করেন পার্বতী। একপর্যায়ে সে-কঠোরতা এতদূর গেল যে আহার তো বন্ধ করলেনই, পার্বতী এমনকি গাছের একটি পাতাও খেতেন না বলে নাম হল অপর্ণা (পর্ণ= পাতা)। শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ উপন‍্যাসে যে পার্বতী, তার মধ‍্যেও কি পুরাণের পার্বতী পুরে দেওয়া আছে একটু, বিশেষ করে তার প্রতি দেবদাসের ঔদাস‍্যের পাশাপাশি যখন পার্বতীর একনিষ্ঠ দেবদাস-প্রীতি লক্ষ‍্য করি?)

বিভূতিভূষণের অপর্ণা পুরাণেরই বিনির্মাণ। তার অপর্ণাকে কঠোর সাধনার মধ‍্য দিয়ে তো যেতে হয়ইনি, বরং অতি আকস্মিক আর নাটকীয়ভাবে অপুর সঙ্গে বিয়ে হয় তার। অপর্ণাকে কী আপাত-নির্লিপ্ততা দিয়েই না নির্মাণ করলেন বিভূতিভূষণ!

আমরা বলেছি, অপর্ণা নামটি সমধিক তাৎপর্যপূর্ণ। কেন? কারণ, নামটির সঙ্গে সর্বজয়া-দুর্গা অন্বিত হল। ফলে এই তিন নারীর মধ‍্যে, অপুর দৃষ্টিতে একটি অখণ্ড নারীসত্তা,— Eternal Motherhood-এর উপলব্ধি এল। পাঠকের দৃষ্টিতেও।

আরও অধিক যা, তা হল, এইখানে এসে অপু ও বিভূতিভূষণে মিলে যাওয়া। আমরা জানি, কলেজজীবনেই বিয়ে করেছিলেন বিভূতিভূষণ। মাত্র দেড়বছর আয়ুষ্কাল ছিল সে-বিয়ের। আমরা জানি, বিভূতিভূষণ ‘অপরাজিত’ উৎসর্গ করেন তাঁর এই অকালপ্রয়াত স্ত্রীকে। ঘাটশিলায় বিভূতিভূষণের বাড়িটির নামও সেই স্ত্রীর নামে— ‘গৌরীকুঞ্জ’। গৌরী, অর্থাৎ দুর্গা।

বিভূতিভূষণের প্রকল্প কি স্পষ্ট হচ্ছে না প্রখরভাবে?

অপু নামটি মনে হয়, দেবনামাবলির পাশে মানুষের নাম এজ‍ন‍্যই যে দেবতা না, মানুষই শেষপর্যন্ত অপরাজিত থাকে।

উপন‍্যাসের আরও একটি প্রধান চরিত্রের নাম আলোছায়াময়,— লীলা। এ লীলা নিশ্চিন্দিপুরে রাণুদির বোন না, যে ছিল অপুর লীলাদি। লীলা, অপু যার সম্পর্কে বলে, বিভূতিভূষণের বয়ানে, ‘এত ভালবাসে নাই সে লীলাকে আর কোনোদিন আজ যত বাসিয়াছে’ (লীলা আত্মহত‍্যা করার দিন তিনেক আগের উপলব্ধি অপুর, যেদিন লীলা ‘…তাহার বক্ষে মুখ লুকাইয়াছিল’)।

লীলা-অপুর প্রেম এক অপরূপ গাথা। আপাতত তা আমাদের আলোচ‍্য নয়। অপুর মত সে-ও অপরাজিত। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ব‍্যর্থ, বিবাহিত জীবন ব‍্যর্থ, অপুর সঙ্গে তার বিয়ে হলে কী ভালই না হত! লেখক তা হতে না দিয়ে লীলার জীবনে ব‍্যর্থতার আরও এক মাত্রা যোগ করলেন (বিয়ে হলে অপু-লীলা বড্ড সাধারণ হয়ে যেত। লীলাকে নিয়ে অপুর যে উচ্চারণ, তা ফিকে শোনাত, ‘আমরা কেউ কাউকে ভুলবো না— কোনো অবস্থাতেই না’। তবু লীলা অপরাজিত। তার মাধুর্যে, অপুর প্রতি তার অন্তশ্চারী প্রেমে, অপুর সঙ্গে তার শেষ সাক্ষাতের দিনটিতে অপুর মুখে ‘আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী’ গানটি শুনতে চাওয়ার নান্দনিক বোধ আর গানটি শুনতে শুনতে লীলার জানালার বাইরে মুখ রেখে গানটি শোনার সুদূরের প্রতি তার আকুলতার বৈভবে।

অপু আর লীলা, দুজনেই অপরাজিত। লীলার অবস্থান দেবতা ও মানুষ, এই উভয়ের মধ‍্যবর্তীতে।

চিত্র: গুগল
5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
মোহাম্মদ কাজী মামুন
মোহাম্মদ কাজী মামুন
2 years ago

কী অসাধারণ বিশ্লেষণ! খুব খুব উপভোগ করেছি।

Siddhartha Majumdar
Siddhartha Majumdar
2 years ago

ঋদ্ধ হলাম লেখাটি পড়ে

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »