নীল জামা
মাঝে মাঝেই সে আসে
সুপুরির বন আমের বীথির ছায়ায়
আর নীল নূপুরের মায়ায়
কীসের যেন কুয়াশায়
চাঁদনিরাতের ওড়না দিয়ে সে ঢাকে আমার মুখ
তার চিবুক দেখি, হিরে মোতির মত তার বুক দেখি।
সে অবসর পায়, বাঁধে আমায় চিকন জরির নাগপাশে।
বাতাসে তখন শাল পিয়াশাল মহুয়ার গন্ধ ভাসে
এবং আকাশে দ্যুতিময় সব তারা, আমি যেন
পথহারা হয়ে যাই আর সেই অবকাশে
সে আসে, তার জোড়া নূপুরের সুর তোলে আমার দরজায়।
হিরেমন টিয়ামন লালমোহন পাখিরা সবাই ঘর যায়।
সে এসে দাঁড়ায় আমার দরজায় আর ডাকে ‘তুতুল’
যদিও কস্মিনকালেই আমার নাম তুতুল নয়
মায়ের বুকের দুধসাদা জ্যোৎস্না ছড়িয়ে থাকে মাঠময়
মাথার ওপরের চাঁদোয়ায় পেঁজাতুলো মেঘ;
কিন্তু আমার ঘরে কেউ নেই যে
সেরকম আবেগ নিয়ে একাই খেলবে পুতুল,
কেউই নেই, যক্ষপুরী আগলে আমি একাই
বসে আছি, কিন্তু সে শোনে না
মেলে ধরে চোখের সামনে একটা নীল জামা,
সে নাকি এসেছে আমার কাছে চাইতে ক্ষমা।
কবে নাকি সে চুরি করেছিল নীল জামাটা
সলমাচুমকির ঝলমলে কাজ তাতে, ভেলভেটের মত নরম,
আর কী তার ওম,
হিমঝরা রাতে লেপের তলায় নীলপরীদের বুক যেমন গরম থাকে।
আমি বলি এ তো পরীর জামা, এ আমার নয়।
আমার গোলাপ ডালিয়া বাগানে সে দেয় জলের ঝারি
আর বলে, ‘এ তোমারই’, আমি শুনি না, আমার হতাশ লাগে,
তা কি হিরে মুক্তোর বদলে শুধুই ঝিনুক দিচ্ছে বলে!
তবু বসে থাকি উৎসুক হয়ে
যদিই এখনও কিছু সোনা বাকি থাকে,
অথচ তার হাতে শুধুই জরি
ঠিনঠিন করে চুড়ি, সে বলে ‘ভালবাসা নিয়ে ভালবাসা দিয়ে
জামাটা তোমায় জড়িয়ে রাখবে, জানো না
ভালবাসার রং নীল হয়!’
এপক্ষে শুধু সন্দেহ ভয়, কেন না নীল তো হয় বিষও।
চার দেওয়ালে চারটে প্রতিধ্বনি ঠিকরে ওঠে,
মিশো না মিশো না ওদিকে যেয়ো না,
হোক না আঙুল চাঁপাকলি
আমি বলি জামাটা অনেক অনেক ছোট
হবে না আমার গায়ে।
তবু সে এগোয় পায়ে পায়ে।
রাগ হয়ে যায়, ঠেলে দিই ওকে, আর বলে উঠি, যাও তো,
বলছি না ওটা মাপের থেকে ছোট,
কখনও এসো না আর যদি ভাল চাও তো,
যেন কঁকিয়ে ওঠে তার চুড়ি, ঝিরঝির করে ইলশেগুঁড়ি
বৃষ্টি পড়ে, সে ফিরে যায়, চায়ের পাতার ছায়ায় ছায়ায়
একা একাই… একেবারে একাই।
*
লোলজিহ্বা মেলে ধরো
নির্লিপ্ত সংসারত্যাগী দৃষ্টি মেলে বসেছ যোগিনী:
রুদ্রাক্ষের রুদ্র তেজে কত আতঙ্কের স্পর্শ, শেষ বরাভয়
ত্যাগমন্ত্রে দীক্ষা নেয়, ব্যাপ্ত করো ভিক্ষাবৃত্তি, তিতিক্ষা আশ্রয়
করেও তো নেশাগ্রস্ত, জলদগম্ভীর শব্দে গুপ্ত অক্ষৌহিণী
নেচেছে শৈথিল্যে, তা-ও ইচ্ছাকৃত অপরাধ, সব আবর্জনা
প্রেতের তাণ্ডবে মুছে শুদ্ধ হবে উপত্যকা, গভীর প্রপাত
দৈন্যকে প্রকট করে আরো প্রসারিত হয়, সৈন্যের সংঘাত
উরুতে গুরুত্বহীন, ভিক্ষুণী ভৈরবী বেশে ছল প্রতারণা
অসঙ্গত অবান্তর, লোলজিহ্বা মেলে ধরো অবনতস্তনী
সুস্থির প্রত্যয়ে, তবু নিছক লাবণ্যময়ী বলেই কবিরা
বর্ণনা করেছে, রোমে সঞ্চিত উষ্ণতা আছে, সেবারে তো স্তন
মাধুর্যে মণ্ডিত ছিল, আধারবিহীনভাবে বিষাদ মদিরা
সযত্নে করাও পান সেবাশ্রমে, তার সঙ্গে জড়িত লবণ
স্তন থেকে ঝরে পড়ে, বৈরাগ্যের সুরে উরুসন্ধিতে খঞ্জনি।
*
সন্ধানী
গল্পটল্প হচ্ছিল বেশ, সঙ্গে অনেক গান
গোলপাতারই ছাউনিঘেরা, দরমা দেওয়া চাঁচের বেড়া
নীল চাঁদোয়ার নিচে বসে মধুর এ সুখটান
বন্দুকেরই ঝলসানিতে হঠাৎ কাটা তান
গিলতে আসে ঘরপোড়ানো আগুন লেলিহান
দিবারাত্রির কাব্য মলিন, ধূসর হল সোনালি দিন
অলক্ষিতে সদ্য কাটা খালে জলের বান
সবুজবরণ গাছের গায়ে রিক্ত সাদা থান
বিষমাখানো তিরের ফলায় স্তব্ধ মাঠের গান
চখাচখির মেলা ভাঙা, নদীর পারে শুকনো ডাঙা
অন্য পারে দিচ্ছে ওরা ছুরির ধারে শান
হৃৎপিণ্ড এফোঁড় ওফোঁড়, অব্যর্থ বাণ।
*
বিবর্তন
আগুন ঘিরে সেই আমাদের প্রথম অঙ্গীকার
সপ্তপদী ভালবাসার রেশমি মায়াজাল
অটুট থাকবে সারাজীবন, স্বচ্ছ অমলিন
সুখের দিনে বৃষ্টি স্নেহের, দুঃখ রোখার ঢাল
পাখির পালক জীবন তখন, দিনগুলি মসৃণ
রোজই তখন শুক্লপক্ষ, জ্যোৎস্না সারারাত
চাঁপার সুবাস চতুর্দিকে, বাতাস ছুঁয়ে উড়ি
জানতাম না প্রস্তুতিতে অদূরে আঘাত
প্রেমের রঙে ঘর রাঙানোর সেই যে প্রতিশ্রুতি
দিয়েছিলাম তা ভুলিনি, মনোহারী কথা
রাতপোশাকে সাজিয়ে রাখি, হয়নি কোনো ত্রুটি
তবে কেন এখন ঘরে পাষাণ নীরবতা
শরীর দিয়ে প্রদীপ জ্বেলে উষ্ণ নিবেদনে
অর্ঘ্য দিতাম, আঁচলভরে স্নিগ্ধ যে মমতা
তার কথা কি ভুলেই গেলে, আর পড়ে না মনে!
ফুল শুকিয়ে বাগান জুড়ে কেবল কাঁটালতা
হিমেল বাতাস ছড়াও শুধু, উষ্ণতা নেই ঘরে
মনের মধ্যে পাথর জমে, সাহায্য হাত তুমি
বাড়াও না তাই যাতনাময় ভালবাসার ঝড়ে
হ্রদ শুকোল, বাড়ি এখন রিক্ত বনভূমি
পুরোনো সেই বিদেশি গান সত্যি হল তবে
একবারটি বুঝতে দিলে কি আর হত ক্ষতি
কোথায় মধুর ভালবাসা, হারিয়ে গেল কবে
ফেরানো কি যায় না তাকে, এই শুধু মিনতি।
আমার প্রিয় কবি সুজিত বসুর কবিতাগুচ্ছ থেকে আবারও ছন্দেভরা, অর্থপূর্ণ কবির লেখা কবিতা নীল জামা, লোল জিহ্বা মেলে ধরো, সন্ধানী, বিবর্তন আমার খুবই ভালো লেগেছে। কবির এই সুন্দর সুন্দর কবিতা পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আবারও ভালভাষাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
অমিতাভ ভট্টাচার্য কলকাতা,
কবি শ্রী সুজিত বসুর নীল জামা, সন্ধানী, বিবর্তন এই কবিতা গুচ্ছ থেকে পড়ে খুব খুব ভালো লাগলো. কবিতা গুলি ওনার সুন্দর ছন্দে লেখা. “ভাল বাসা” কে ধন্যবাদ আমার এই প্রিয় কবি সুজিত বসুর এই কবিতা গুলো উপহার দেয়ার জন্য. খুব ভালো লাগলো. কবিকে ধন্যবাদ এবং আরও অনেক এরকম কবিতা আসায় থাকব.
অসাধারণ কবিতাগুচ্ছ। ভালভাষাকে ধন্যবাদ; প্রিয় কবির কবিতা আমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। সুজিত বসুর সেই অনন্য মুন্সিয়ানা যা মুহূর্তে বদলে ফেলতে পারে কবিতার চলন, দীর্ঘ কবিতায় ছন্দ ভেঙে চুরে বিষয়কে বিশিষ্ট করে তোলেন, তেমনই সাবলীল ছন্দে ছুটে যান বিষয়ান্তরে; ঠিক তেমন অনায়াস ছন্দ আর বিষয় নিয়ে খেলা করেছেন এই কবিতাগুচ্ছে। অথচ সব বৈচিত্র্য ছুঁয়ে থাকে এক গভীর জীবনবোধ আর যেন জেগে থাকে চিরবিরহী কোনো মন। হাজার সালাম কবিকে।