মাইকেল মধসূদন আর অমিত্রাক্ষর একসূত্রে গাঁথা হয়ে আছে। মাইকেলের কবিপ্রতিভার এমনই লাঞ্ছনচিহ্ন ওটা যে, নীরদ সি চৌধুরী তাঁর ‘Autobiography of an Unknown Indian’-এ উল্লেখ করেছেন, শৈশব-কৈশোরে নিজভূমি কিশোরগঞ্জে দেখেছেন, ‘মেঘনাদবধ’ নির্ভুল যতিচিহ্নসহ পড়তে পারলে তাকেই যথার্থ শিক্ষিত বলে গণ্য করা হত। ‘স্বামী শিষ্য সংবাদ’-এর সাক্ষ্য মোতাবেক স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর শিষ্য শরচ্চন্দ্রকে ভর্ৎসনা করে কাব্যটির সঠিক আবৃত্তি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বাড়ির কাগজ ‘তত্ত্ববোধিনী’-তে কাব্যটি প্রকাশিত হওয়ার সময় রবীন্দ্রনাথ জন্মাননি। মেঘনাদ-এর পুস্তকাকারে প্রকাশ রবীন্দ্রনাথের জন্মবছরে, আর মাত্র পনেরো বছরের রবীন্দ্রনাথ কাব্যটির তীব্র বিরূপ ও বৈরী সমালোচনা লিখেছিলেন ওই তত্ত্ববোধিনী-তেই। দীর্ঘকাল পরে অবশ্য তিনি তাঁর মত পরিহার করে কাব্যটির ভূয়সী প্রশংসা করেন।
মাইকেল কেবল তো অমিত্রাক্ষরের নন, আরও বহু কিছু।
মাত্র উনপঞ্চাশ বছরের জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যকে যা দিয়ে গিয়েছেন, তার মূল্যায়ন করতে বসলে আমরা হতবাক না হয়ে পারি না। সবচেয়ে বড় কথা, সাহিত্যের যে যে অঙ্গনে তাঁর বিচরণ ছিল, সব জায়গাতেই তিনি অভিনব এবং অগ্রদূত ও প্রতিভাদীপ্ত। আরও উল্লেখ্য, বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষরের এই প্রতিভূ মিত্রাক্ষরেও যৎপরোনাস্তি মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। পাশাপাশি এ-ও লক্ষ্যণীয়, তাঁর সমগ্র জীবনটাই ছিল মিত্রাক্ষর-অমিত্রাক্ষরের যুগলবন্দী ও সার্থকতা-ব্যর্থতাময়।
আগে আমরা তাঁর লেখকজীবনের সালতামামি নিয়ে নিই। বহুভাষাবিদ ছিলেন তিনি। তেরো বছর বয়স পর্যন্ত স্বভূমি সাগরদাঁড়িতে কাটানোর সময় মায়ের কাছে রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনি শোনার মধ্য দিয়ে শৈশবেই ধ্রুপদী আবহে স্নাত হওয়ার সুযোগ ঘটে তাঁর। পাশাপাশি আরবি ও ফার্সি ভাষার তালিম নেন তিনি নিজগ্রামে, ইমাম মুফতি লুৎফুল হকের কাছে। পরবর্তীকালে রিচার্ডসনের কাছে ইংরেজি সাহিত্যপাঠ, বিশেষ করে শেক্সপিয়রে অবগাহন তাঁর সাহিত্যবোধকে অনন্য মাত্রা দেয়। শিক্ষক রিচার্ডসনকে এতটাই ভক্তি করতেন মধুসূদন যে, তিনি গুরুর দুর্বোধ্য হাতের লেখা পর্যন্ত নকল করতেন!
এরপর এল তাঁর মিত্রাক্ষর ছেড়ে অমিত্রাক্ষর জীবনপর্ব। সাহিত্যে খ্যাতিমান হবেন যিনি, তিনি চললেন মাদ্রাজ। তার আগে উনিশ বছর বয়সে নিলেন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা। মিত্রাক্ষর শুরু হয়ে গেছে তাঁর, কবিতায়। কেবল মিত্রাক্ষর-ই নয়, তিনি তাঁর বন্ধু গৌরদাস বসাককে নিয়ে যে কবিতাটি লিখলেন এসময়ে, সেটির অভিনবত্ব লক্ষ্যণীয়। এটি বিশেষ আঙ্গিকে লেখা কবিতা। আট লাইনের কবিতাটির প্রত্যেক লাইনের প্রথম অক্ষর ধরে পড়লে ‘গউরদাসবসাক’ পাব আমরা। একে বলে ACROSTIC কবিতা, প্রাচীন হিব্রু (OLD TESTAMENT) থেকে উদ্ভূত হয়ে গ্রিক-ল্যাটিনের হাত ধরে ইংরেজি ভাষায় প্রসারিত। বলেছিলাম অভিনব। বিসমিল্লাতেই প্রমাণ দিলেন তিনি। এটি কিন্তু মিত্রাক্ষর কবিতা।
মাদ্রাজপর্বে স্কুলমাস্টারি, MODERN CHRONICLER-সহ আরও বিভিন্ন পত্রিকা সম্পাদনা, প্রথমে রেবেকা ম্যাকটাভিসকে বিয়ে ও আটবছরের দাম্পত্য, চার পুত্র-কন্যার জনক হওয়া, পরে রেবেকার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি ও হেনরিয়েটা সোফিয়া হোয়াইটের সঙ্গে আজীবন সহবাস (রেবেকার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি তাঁর। অতএব হেনরিয়েটা তাঁর বিবাহিতা স্ত্রী ছিলেন না।), বাঙালির Live in জীবনযাপনের অগ্রদূত-ও তাই শ্রীমধুসূদন!
মাদ্রাজপর্ব সেরে কলকাতায় ফিরবেন যখন, ততদিনে লেখক অভিধা জুটে গেছে তাঁর। একাধিক গ্রন্থপ্রণেতা মাইকেল জানলেন, মাতৃভাষা ছাড়া জয় বৃথা। মাতৃভাষা-রূপ খনি আবিষ্কারের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তামিল-তেলুগু শিখে, কেন না তাঁর মহাকাব্যে প্রভাব পড়বে দক্ষিণের বাল্মীকি বলে প্রসিদ্ধ কম্বনের। বিশপস কলেজ পর্বে (খ্রিস্টান হওয়ার পর হিন্দু কলেজ ছেড়ে ওখানেই পঠনপাঠন তাঁর) শিখে নিয়েছিলেন গ্রিক, যে ভাষা থেকে শেষবয়সে হাত দেন হোমার-কৃত ইলিয়াড অনুবাদে। তা ছাড়া সংস্কৃত ও ল্যাটিন। এমন প্রস্তুতি নিয়ে সৃজনশীল সাহিত্যরচনা বাংলা ভাষায় নেই।
১৮৫৮-৬২ জুড়ে জয়ধ্বজা ওড়ালেন তিনি। কালবৈশাখী, না কি চিরহরিৎ বৃক্ষ তার একের পর এক দুটি প্রহসন, দুটি নাটক, তিলোত্তমাসম্ভব আর মেঘনাদবধ, ব্রজাঙ্গনা, বীরাঙ্গনা কাব্য! প্রহসন, মহাকাব্য, পত্রকাব্য, সবেতেই অগ্রগামী। সাধে কি বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘সুপবন বহিতেছে। পতাকা উড়াইয়া দাও। তাহাতে নাম লিখ, শ্রীমধুসূদন’।
মাইকেলের মাথায় আর-এক পালক, যেটি লক্ষ্যই করি না আমরা, সেটিও সসম্ভ্রমে উল্লেখ করার মত। সেটি হল সুলতানা রাজিয়াকে নিয়ে তাঁর লেখা ‘Razia, the Empress of Inde’। এই লেখাটি নিয়ে জনৈক সমালোচকের উক্তি, ‘Here was India’s first dramatist to write about Muslim society.’ ইংরেজিতে লেখা এ নাটকটির বঙ্গানুবাদ করার ইচ্ছে ছিল তাঁর। বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হোক, চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ নাকচ করে সে প্রস্তাব। কারণ? মুসলিম নাম নাকি দর্শকদের কাছে বেখাপ্পা শোনাবে!
মাইকেল মহরমের মিছিল দেখে বন্ধু রাজনারায়ণকে বলেছিলেন, কোনও মুসলমান লেখক কারবালার কাহিনীনি নিয়ে সাহিত্য রচনা করলে তা আদৃত হবে। পরবর্তীকালে মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদসিন্ধু’ তাঁর এই স্বপ্ন সফল করেছিল।
সাফল্য যখন চূড়ায়, তখন নিজ মুদ্রাদোষে বিলেত যাওয়ার সাধ হল তাঁর। ব্যারিস্টার হবেন, বাসনা। হয়েছিলেন। কিন্তু কী নাটকীয়তার মধ্য দিয়েই না! প্রায় জেলে যেতে বসেছিলেন বাড়িভাড়া না দিতে পারায়। আক্ষরিকভাবেই ভিক্ষাবৃত্তি করতে হয়েছিল তাঁকে। অথচ লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ানোর সূচনালগ্নে লোভনীয় মাইনেতে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে বলা হল যখন, নিলেন না সে-কাজ। বদলে সনেটের ধারাস্রোত বওয়ালেন, বাংলা ভাষায় অভিনব। মিত্রাক্ষরের সাধনা এখন, জীবন যদিও অমিত্রাক্ষরে বইছে। কলকাতায় ফিরে আসবেন এবার।
ব্যারিস্টারি-কোর্টে অনুবাদকের কাজ-চাকরি নিয়ে পুরুলিয়ার পঞ্চগড়ে একবার, ফের ঢাকায়, কী অসমমাত্রিক জীবন! সে-আমলে কোর্টে অনুবাদকের চাকরিতে এক হাজার টাকা বেতন পেতেন। সেসব ফেলে পুরুলিয়া! লিখছেন ‘মায়াকানন’। জীবনটা তাঁর মায়াকানন-ই বটে।
উল্লেখ্য, মধুসূদন অমিত্রাক্ষরের প্রথম প্রয়োগ করেন তাঁর ‘পদ্মাবতী’ নাটকে, ১৮৬০-এ। তারপর ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্যে, এবং অবশেষে ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্যে।
আমরা অন্তিমে বলব, মধুকবির জীবন ও রচনাবলি মিত্রাক্ষর-অমিত্রাক্ষরের দ্বন্দ্বসমাস যেন।
মাইকেলের প্রিয় কবি লর্ড বায়রন নিজের সমাধিতে খোদিত হওয়ার জন্য কোনও এপিটাফ লিখে যাননি (এটি এক সমাপতন যে, ১৮২৪- এ মধুসূদনের জন্ম আর বায়রনের মৃত্যু), যদিও তাঁর প্রিয় কুকুর Boatswain-কে নিয়ে লিখেছিলেন। সেটি ছিল মিত্রাক্ষরে। মাইকেল লিখলেন (এক্ষেত্রেও সর্বপ্রথম!) অমিত্রাক্ষরে। তিনি কি নিজে জানতেন, গাঢ় উপলব্ধি ছিল তাঁর, জীবন আসলে, শেক্সপিয়রের ভাষায়, ‘Life’s but a walking shadow, a poor player/ That struts and frets his hour upon the stage/ And then is heard no more; it is a tale/ Told by an idiot, full of sound and fury,/ Signifying nothing.’
ভালো লাগল
খুব ভালো লেখা।