গঙ্গাসাগর ঢাকা পড়েছে মানবসাগরে। যতদূর চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। জলের ধার থেকেও ঘুরে এসেছে হরিপদ। জল দেখেছে আর কতটুকু! গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে স্নান করছে মানুষ। তাদের চারপাশে থাকা যৎসামান্য ফাঁকফোকরে যতটুকু জল— তাও ভরে আছে ফুল-বেলপাতায়। পুণ্যলোভে উৎসর্গের নামে সরকারি বারণ সত্ত্বেও যে যা পারছে ভাসিয়ে বা ছুড়ে দিয়ে যাচ্ছে শ্রী শ্রী গঙ্গামাতা এবং মহাসাগরের মিলনভূমিতে। কুল, আতা, নোনা, কলা, কাঁচা আম, ডালিমও দেখা যাচ্ছে ভাসতে।
জাল, দড়ি, লোহার শিকল দিয়ে ব্যারিকেড করে দিয়েছে জলপুলিশ। স্নান করতে হবে এই সীমানার মধ্যে। তার বাইরে তাদের রাজ্যপাট। পাহারার স্পিডবোট থেকে পুলিশি লঞ্চ, লাইফবোটের ছড়াছড়ি। ভাসছে মেডিক্যাল টিমের লঞ্চ। কিনারা বা জলে নেমেও মানুষ তাই বিশুদ্ধ গঙ্গা বা সাগর দেখতে পাচ্ছে না। খানিক দাঁড়িয়ে গঙ্গা কিংবা সাগর খুঁজে পিছন ফিরে মনুষ্যসাগরে ঢুকে পড়ল হরিপদ। আদিগন্ত পুণ্যসলিল দেখতে না পাওয়ায় তার অবশ্য কোনও ক্ষোভ নেই। গঙ্গা কিংবা সাগর দেখতে সে এখানে আসেনি। কপিল মুনির আশ্রম বা মানবসাগর দেখতেও না। তবে মেলায় উপচানো ভিড় হয়েছে দেখেই তার আহ্লাদ হয়েছে। ভিড়েই তার কাজ। তাই তা যত বেশি হয়— মঙ্গল। হরিপদ হাঁক দিল, ‘চাই কবচ— স্বপ্নজ্যোতি মাদুলি—। হাঁপানি আছে? অ্যালার্জি? পুরনো কাশি? বাত-বেদনা? ধারণেই নির্মূল হয়ে যাবে সব। চাই কবচ— স্বপ্নজ্যোতি মাদুলি—।’
ব্যবসাটাই গলা ফাটাবার। যত কড়া বক্তব্য রাখা যাবে— বিক্রি হবে তত বেশি। ব্যথা বেদনা, হাঁপানি, চুলকানি, কাশির কোনও না কোনওটা নেই কার শরীরে! গলা খুললেই ঘিরে ধরছে লোকজন।
এই মুহূর্তে হরিপদকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে চার-পাঁচজন। কৌতূহল দেখাচ্ছে খুব। তবে কিনবে কিনা তারাই জানে। টিনের মাঝারি বাক্সটা আধখোলা করে বাঁহাতে পাঁজাকোলা করে ধরে মাদুলি কবচ দেখাচ্ছে হরিপদ।
হরিপদ গাঙ্গুলি। বয়স আটচল্লিশ। বাবার নাম ঈশ্বর যদুনাথ গাঙ্গুলি। বছর দুই আগে গত হয়েছে মা— মীরারানি গাঙ্গুলি। হরিপদ তিন সন্তানের জনক। বাড়িতে সেলাই মেশিন আছে। স্ত্রী তারামণি গাঙ্গুলি সব সময়ই ঝুঁকে থাকে তার ওপর। ভারে ভারে সেলাই করে যাচ্ছে অর্ডারি ব্লাউজ। ইদানীং হরিপদ একদিন একশো টাকা আয় করে আনে তো পরের দিন হয়তো পঞ্চাশ টাকা। অনেক দিন কোনও মাল বিক্রি না হলে একদিন তা কম দামে দিয়েও ঘাড়ে লোকসান নিয়ে ফিরতে হয় বইকী। সংসারে তার আয়ের ওপর তাই ভরসা কী! ট্রেন লাইনের হকার সে। কখনও ধরছে বনগাঁর গাড়ি, কখনও বা ব্যারাকপুর, রানাঘাট। মাঝে মাঝে ডানকুনিও ধরে। কখনও বেচে নদিয়ার গজা, দিলখুশ। কখনও আগরপাড়ার ডালমুট। কখনওবা মছলন্দপুরের ঘোষবাবুর চানাচুর। জয়নগরের বেচুরামের মোয়া। বড়বাজারের আচার-চাটনিও বেচে।
কিন্তু কোনওটাই সে পাবলিককে খাওয়াতে পারছে না ঠিকমত। ফলে হাল তার বেহালই। শুধু তার নয়, এক-আধজন ছাড়া প্রায় সকলেরই অবস্থা এই। করোনার কারণে লকডাউনের পর থেকে মানুষের খাদ্যাভ্যাস বদলে গেছে অনেকটাই। অধিকাংশ মানুষই যেখানে খুশি, যখন-তখন খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। এমনিতেই ট্রেনের পণ্যসামগ্রী বা খাবার-দাবারের একটা বদনাম ছিলই। ট্রেনের জিনিস? ও ভাল হয় না। সেই বদনামের পরিমাণ এখন অনেকটাই বেড়েছে। তাই ট্রেনে এই জাতীয় খাবার বিক্রি করা হকারদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। এই ব্যবসা ছেড়েই দেবে ভাবছিল হরিপদ। কিন্তু তারপর কী করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছিল না। এ সময়ই পরামর্শটা দেয় বন্ধু হরেকৃষ্ণ।
সোদপুরের হরেকৃষ্ণ বনগাঁ লাইনে বেচে বিষহরি তেল। সেই তাকে বলে, ‘যদি পারিস বারাসতে নেমে চলে যা কাঞ্চনতলায়। বাসে ঘণ্টাদুয়েকের পথ। কালীবাড়ি যাব বললেই যে কেউ দেখিয়ে দেবে। ওখানকার কালী মায়ের সেবাইত জ্যোতি ঠাকুর মায়ের থানে খালি মাদুলি আর এগারো টাকা জমা রাখলেই তার স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ ভরে দেবে মাদুলিতে। যত মাদুলি— তত এগারো টাকা। কবচ হলে একুশ টাকা। মাদুলি হোক বা কবচ সবই নিয়ে যেতে হবে তামার। একটা-দুটো হলে দিনের দিনই দিয়ে দেবে। পঁচিশটার বেশি ভরাতে হলে সময় দিতে হবে তিনদিন। জমা দেওয়া এবং আনতে যাওয়ার দু’দিনই থাকতে হবে উপোস করে। মাদুলি ভরাবার জন্যে লাইন পড়ে। তাই ভোরের বাস না ধরলে দিনের কাজ দিনে মিটবে না। তবে কষ্ট করে একবার ভরাতে পারলে মাদুলি কিন্তু কথা শোনে। যে কোনও রকম বাত-বেদনা, হাঁপানি, চুলকানি, পুরনো কাশি যা ডাক্তার সারাতে পারেনি— তাদের যে কোনও একটার নাম করে ধারণ করলেই ফল দেবে জাদুমন্ত্রের মত। কাজ শুরু হয়ে যাবে এক সপ্তাহের মধ্যে। যত পুরনো রোগই হোক— দু’সপ্তাহের মধ্যে ফিনিস। মাদুলি বিক্রি হবে একান্ন টাকা করে। কবচ একশো এক টাকা। বসিরহাটের লাইনে দু’জন, একজন বাসে একজন ট্রেনে এই বেচেই তো বড়লোক হয়ে গেছে।’
হরিপদ জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তাহলে তুই সেটাই করছিস নে কেন?’
হরেকৃষ্ণ বলেছিল, ‘বিষহরি বেচেই তো বেঁচে আছি এতকাল। আমার কত পুরনো কাস্টমার আছে জানিস? এ আমি ছাড়তে পারি! তোর ব্যবসা ভাল চলছে না বলছিস— তাই বললাম।’
‘দেখি তাহলে।’
‘দেখি না, কর এটা। বেঁচে যাবি। নতুন থান হয়েছে। এখনও প্রায় কেউই জানে না। অনাচার হয়নি— মা তাই খুব জাগ্রত।’
‘বেশ খরুচে ব্যাপার। যেতেও হবে অনেকটা।’
‘তা তো হবেই। তবে মালের দামও তো তুমি কম কিছু রাখছ না। একান্ন বা একশো এক টাকা কম হল! আর রোজ তো তুমি যাচ্ছ না। একসঙ্গে বেশি করে ভরিয়ে নিয়ে আসবে, তাহলেই হল।’
হরিপদ বলেছিল, ‘যাবকুনি তাহলে।’
জোর দিয়েছিল হরেকৃষ্ণ, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ চলে যা। জয় মা বলে বেরিয়ে পড়। সামনে গঙ্গাসাগরের মেলা আসছে। চলে যেতে পারিস। প্রচুর বেচাকেনা হবে। স্থানমাহাত্ম্য সম্পর্কে একটু যদি জেনে যেতে পারিস— তাহলে তো কথাই নেই।’
তার শেষের এই কথাটা খুব মনে লেগেছিল হরিপদও। ট্রেনে আর ক’জন লোক চলাফেরা করে! মেলা মানেই অনেক লোক। আর সাগর মেলার কথা যেখানে— সেখানে তো লক্ষ লক্ষ লোকের ব্যাপার। কিনবে না কিনবে না করেও যদি লোক কেনে— উঃ, লাল হয়ে যাবে সে। হরিপদ হিসেব করতে শুরু করেছিল, কত মাদুলি সে নেবে। তামার মাদুলি, কবচ এবং যাতায়াত খরচা দিয়ে মাদুলি বা কবচ-পিছু কত টাকাই বা খরচা পড়বে। সে শ্যামবাজারের লোক। দমদম হয়ে বারাসতে গিয়ে সেখান থেকে বাসে দু’ঘণ্টা যাওয়া মানে কম পথ তো নয়। সেই অনুযায়ী ভাড়াও পড়বে। তার উপরে অনেক মাদুলি, মানে মেলায় যেতে হলে কমপক্ষে শ’দুয়েক তো নিতেই হবে। সেই সঙ্গে কবচ গোটা পঞ্চাশ। মেলায় যাওয়া-আসার খরচা আছে। তিন-চার দিনের খাইখরচাও। সব মিলিয়ে পড়ে যাবে—
হরেকৃষ্ণর পরামর্শমত মাদুলির দাম একান্ন টাকাই রেখেছে হরিপদ। কবজের দামটা একটু বাড়িয়েছে, একশো পঁচিশ টাকা। তা হচ্ছে। হচ্ছে বিক্রিবাটা। এই মুহূর্তে চারটে বিক্রি হয়ে গেল। একদল গ্রামীণ ভক্তমানুষ ঘিরে ধরেছে। একজনের বউ খুব কাশছে। একজনের বুড়ি মা কাতরাচ্ছে রাতের ব্যথায়। তৈরি হয়েই এসেছে হরিপদ। শুরু করল ভাষণ:
‘সগর রাজার নাম শোনা আছে?’
একজন বলল, ‘সাগর? ওই তো।’
মাথা নাড়ল হরিপদ। ‘না না। ও তো সাগর, মানে সমুদ্র। আমি সগর রাজার কথা বলছি। স-গর।’
মাথা নেড়ে ‘না’ জানাল লোকটা। তারই বউ কাশছে ঘ্যাং— ঘ্যাং—। জিজ্ঞেস করল, ‘এ মাদুলি তারই তৈরি?’
হরিপদ গুটিয়ে নিল নিজেকে। এদের কাছে বলে গলা শুকাবার দরকার হবে বলে মনে হচ্ছে না। কাজ হয়ে যাকে এমনিতেই। মিষ্টি হেসে বলল, ‘না। এ মাদুলি বারাসতের কাঞ্চনতলা কালীবাড়ির পুরোহিত শ্রী শ্রী জ্যোতি ঠাকুর মহারাজের তৈরি।’
‘কাশিকুশি সারবে এতে?’
‘সারবে মানে! ধারণ করলেই এক সপ্তায় কাজ হয়ে যাবে।’
‘খুব পুরনো কাশি কিন্তুক।’
‘বড়জোর দু’সপ্তা লাগবে।’
‘হবে তো?’
‘হবেই। ধন্বন্তরি মাদুলি।’
‘দাম কত?’
‘একান্ন টাকা।’
‘ওরে বাপরে, সে তো অনেক!’
‘কী বলছেন কাকাবাবু! অ্যালাপাথির এক ফাইল কাশির সিরাফের দাম কত? তাতেও তো আপনার কাজ হবে না। হয়েছে?’
‘নাঃ, কত খাবাইছি। ওই দুচ্চারদিন এট্টু নরম মতন পড়ে। শেষের দিকি তাও আর পড়ত না!’
‘তাহলে?’
‘এতে কাজ হয়ে যাবে বলচেন?’
‘নিয়ে যান। ধারণ না করলে তো বুঝতে পারবেন না। নিয়ে যান।’
গাঁট খুলছে লোকটা। নিল। পরের জনও সাইড ব্যাগ হাতড়াচ্ছে। জিজ্ঞেস করল, ‘বাতের ব্যথা সারবে?’
‘খুব সারবে। কার?’
তার সঙ্গের বুড়ি মা ততক্ষণে মাটিতে বসে পড়েছে থেবড়ে। লুটোপুটি খাচ্ছে গায়ের কম্বল। লোকটা তাকে দেখিয়ে বলল, ‘এই যে আমার মা, এনার। কোমরে ব্যথা, হাঁটুও যন্তোরনা করে। থেকে থেকেই বসে পড়ে। এই দ্যাকো।’
‘গেঁটে বাত। কোনও চিন্তা নেই। একদম সেরে যাবে।’
‘দ্যাকেন, কাঞ্চনতলা আমি জানি নে। আপনার কতাবাত্তারা ভাল। তাই আপনারে বিশ্বেস করে নোব। আপনি বলচেন তো সারবে?’
‘সারবে সারবে। বলছি তো।’
‘দ্যান তালি এট্টা। কীভাবে ধারণ কত্তি হবে?’
‘বলছি সব। কী নেবেন? মাদুলি না কবজ?’
‘দুটোর ফারাক কী?’
‘মাদুলি নিলে পরে আবার রোগটা হতেও পারে। কবচ ধারণ করলে আর হবেই না।’
‘বাঃ। কবচের দাম কত?’
‘একশো পঁচিশ।’
‘ওরে বাবা! এট্টু কমসম করে নেন।’
‘পারব না কাকু। তামার আজকাল দাম কত বলুন দেখি! এ কবজ একেবারে খাঁটি তামার তৈরি। তাছাড়া ভিতরে যা আছে সে তো অমূল্য জিনিস!’
‘তালি আর বলি কী?’ কাঁধের সাইড ব্যাগ থেকে ফোমের একটা মানিব্যাগ বের করল লোকটা। কবচ নিল। জিজ্ঞেস করল, ‘বলেন এইবার, ধারণের কী নিয়মবিধি?’
‘যে কোনও দিনই ধারণ করতে পারবেন। যেদিন ধারণ করবেন, একবেলা উপোস করে থাকবেন। ব্যাস, আর কিছু না।’
‘ঠিক আছে। কালই ধারণ করায়ে দোবানি।’
‘করাবেন। সোমবার আছে, ভাল দিন।’
দুশো মাদুলি এনেছে হরিপদ। পঞ্চাশটা কবচ। দু’একদিনের মধ্যেই সব বেচে ফেলার ইচ্ছে তার। অনর্গল তাই ঘোরাঘুরি করছিল। তার পরনে প্যান্ট-শার্ট। গায়ে হাফ সোয়েটার। বাইরে এখন হু হু ঠান্ডা। মেলায় ভিড়ের চোটে আর সাগর-হাওয়ার কারণে শীতই লাগছিল না। ভিড়ও তো ঠেলছিল সে। কী মেলা! কী মেলা! এক এক বার দাঁড়িয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকছিল অনন্ত এই মেলার দিকে। একমাস আগে থেকেই নাকি শুরু হয়েছে প্রস্তুতি। তীর্থযাত্রীদের থাকার জন্যে কম করেও নয়-দশ বিঘা জমির ওপর, কপিল মুনির আশ্রমের সমুদ্রতটে, সারি সারি তৈরি হয়েছে হোগলার ঘর। হয়েছে অস্থায়ী কল, পায়খানা, ইলেকট্রিকের ব্যবস্থা। বসেছে দোকানপাট, সরকারি মেডিক্যাল ক্যাম্প। পৌষসংক্রান্তির ক’দিন আগে থেকে শুরু হয়েছে এই মেলা। চলবে আরও কয়েক দিন। তবে যা শুনতে পাচ্ছে আজকের মত ভিড় হবে না কোনও দিনই। মকর সংক্রান্তির পুণ্যস্নান আজ। গোটা ভারত যেন ভেঙে পড়েছে মেলায়। কে নেই! বাঙালি থেকে অবাঙালি, গৃহী মানুষ থেকে নাগা সন্ন্যাসী। সকলেরই ধুন্ধুমার স্নান চলছে সেই একপোয়া রাত থেকে।
মেলায় আজ তিনদিন হরিপদ। গত পরশু কলকাতার শহিদ মিনার থেকে বাসে চেপে হারউড পয়েন্ট ৮ নম্বর লট ঘাটে নেমেছিল। ফেরি ভেসেলে গঙ্গা পেরিয়ে কচুবেড়িয়া। সেখান থেকে ভূতল পরিবহণে ৩০ কিমি পথ পেরিয়ে এসেছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার এই সাগর মেলায়। যে কোনও পরিবহণেই আজকাল খরচ বেড়েছে তিনগুণ। আসা-যাওয়ায় অনেকগুলো পয়সা তাই খরচ হয়ে গেছে এবং যাবেও ফেরার দিন। সুদে-আসলে সব তুলে নিয়ে যেতে হবে মাদুলি বেচে।
তা হচ্ছে। ভালই হচ্ছে বেচাবেচি। হকারি করতে করতে মন্দ রপ্ত করেনি ভাষণ দেওয়াটা। নাগা সন্ন্যাসী, গৃহী মানুষ, পথভোলা, ভক্তজন, চাষাভুষো, শিক্ষিত যে যেমন লোক— তার সঙ্গে আলাপ করছে সেইভাবে।
ঘুরতে ঘুরতে মন্দিরের সামনে এসে পড়ল হরিপদ। সাদা আর গেরুয়া রঙের মন্দির। খুব ইচ্ছা হচ্ছিল একবার ভিতরে ঢোকার। হল না। আজ প্রচুর পুলিশি ব্যবস্থা। স্বেচ্ছাসেবকও আছে অগুন্তি। হাতে এতবড় বাক্স দেখে তারাই তেড়ে এল মার মার করে। একদণ্ডও দাঁড়ানোর অবস্থা নেই এখানে। পুণ্যার্থীদের ভিড়ে এক এক বার যেন জোয়ার আসছে। আওয়াজ হচ্ছে হুম— হুম— গোঁ গোঁ—। ধ্বনি উঠছে, ‘জয়— গঙ্গা মাঈই কী জয়— সাগর মাতা কী— জয়। কপিলমুনি কী জয়— জয় হনুমানজি কী জয়—’।
মনুষ্য জোয়ারের বাইরে এসে বাক্স দু’পায়ের ফাঁকে রাখল হরিপদ। মন্দিরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হাতজোড় করে। ভিড়ের দাপট সামলাতে না পেরে তারই মত ছিটকে এসে পড়েছে সোদপুরের মোহনদাস কলোনির কিছু মানুষ। এত কষ্ট করে এসেও মন্দিরে ঢুকতে না পারার জন্যে আফসোস করছিল বারবার। হরিপদ হাতজোড় করে বলল, ‘ভিতরে কোন কোন দেবতার অধিষ্ঠান— তা আমি আপনাদের বর্ণনা করতে পারি। শ্রবণেও পুণ্যসঞ্চয় হয়। তাই তো আমরা রামায়ণ মহাভারত পাঠ শুনি। মন্দির অভ্যন্তরের কথা আমি আপনাদের শোনাতে পারি। শুনবেন আপনারা?’
একজন জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি এখানকার পাণ্ডা?’
হরিপদ সবিনয়ে বলল, ‘না। আমিও আপনাদের মত সাধারণ একজন। বলি মন্দিরকথা?’
সাগ্রহে রাজি হয়ে গেল পুণ্যার্থীরা।
এখানে আসবে বলে স্থান বিষয়ে জানতে বইবিক্রেতা এক হকারবন্ধুর কাছ থেকে ক’দিন আগে অল্প দামে কিনেছিল একখানা বই, ভ্রমণসঙ্গী। তা থেকে বলতে শুরু করল হরিপদ। ‘ভিতরে যোগাসনে বসে আছেন সুদূর মিথিলা থেকে আসা মহামুনি মনুর দৌহিত্র মানে দুহিতা বা কন্যার পুত্র সাংখ্য দর্শন প্রণেতা কপিলমুনি। তাঁর ডান হাতে জপমালা, বাম হাতে কমুণ্ডল। মুনিবরের ডান দিকে আছেন মকরবাহিনী চতুর্ভুজা গঙ্গাদেবী। কোলে আছেন ভগীরথ। যাঁর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মর্ত্যে এসেছিলেন গঙ্গা। গদা হাতে তাঁর কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন পবনপুত্র হনুমান। আছেন সগর রাজা, সিংহবাহিনী অষ্টভুজা দেবী বিশালাক্ষী, ইন্দ্রদেব আর শ্যামকর্ণ ঘোড়া।’
একজন জিজ্ঞেস করল, ‘শ্যামকর্ণ ঘোড়া কী?’
আর একজন জিজ্ঞেস করল, ‘সগর রাজা কে?’
হরিপদ হাতজোড় করল আবারও। বিনীত হেসে বলল, ‘তাহলে গোড়া থেকেই বলতে হয়।’
আগ্রহী হয়ে উঠেছে শ্রোতারা। একবাক্যে বলল, ‘বলুন না, বলুন। শাস্ত্রকথা আপনি তো বেশ ভাল জানেন দেখছি! আগে আপনি অনেকবার মন্দিরে ঢুকেছেন বুঝি?’
হরিপদ অম্লানবদনে বলে দিল, ‘তা ঢুকেছি বইকী।’
‘আপনি পাণ্ডা তো না?’
হরিপদ হাসল। ‘না। পাণ্ডায় আপনাদের খুব ভয়, না?’
‘খুব। ওরা দু’কথা শুনিয়েই পয়সা চায়।’
‘আমি পয়সা চাইব না, তবে আমার একটা আর্জি আছে। সে আপনারা শুনতেও পারেন, নাও শুনতে পারেন।’
‘কী আর্জি? বই আছে নাকি আপনার বাক্সে? বই কিনতে হবে?’
হরিপদ অমায়িক হেসে বলল, ‘না। তবে এমন কিছু আছে— যা আপনাদের কাজে লাগবে। তবে তা আপনাদের নিতেই হবে— এমন কোনওই কথা নেই। ছাড়ুন ওসব। পরে দেখা যাবে। শাস্ত্রকথা শুনেই শুধু পুণ্য হয় না, শুনিয়েও পুণ্য হয়। আপনাদেরকে পুরাণকথা শুনিয়ে আমার না হয় সেই পুণ্যটুকুই সঞ্চয় হবে। বলি আমি।’
এই মুহূর্তে তাকে ঘিরে ধরেছে আরও অনেকেই। বলে উঠল সকলে, ‘বলুন— বলুন আপনি। আমরা শুনব।’
খানিকটা নিজের মন, খানিকটা ভ্রমণসঙ্গী থেকে হরিপদ আওড়াতে থাকল পুরাণকথা।
‘বহুকাল আগে এই ভারতবর্ষে কপিল নামের এক মুনি ছিলেন। বহু দিগদিগন্ত, পাহাড়-কন্দর পরিভ্রমণ করে এসে এখানকার এই নির্জন সমুদ্রতট তাঁর ভারী পছন্দ হয়ে যায়। এখানে আশ্রম করেন তিনি। ডুবে যান গভীর তপস্যায়। তখন অযোধ্যার রাজা ছিলেন সগর। কে তিনি? তিনি ছিলেন ইক্ষাকু বংশের শ্রী শ্রী রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ। তাঁর ইচ্ছা হয়েছিল শততম অশ্বমেধ যজ্ঞ করবেন তিনি। সেইমত প্রস্তুতি নিতে থাকেন সগররাজ। খবর ওড়ে হাওয়ায়। একদিন সেই খবর পৌঁছায় স্বর্গে। চটে যান দেবরাজ ইন্দ্র। কী, এত বড় স্পর্ধা ওই সামান্য রাজার! ও অধিকার তো কেবল আমারই আছে।
যজ্ঞ-উদ্দেশে ঘোড়া ছেড়েছেন সগর। এরাজ্য সেরাজ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই ঘোড়া। যে আটকাবে— যুদ্ধ করে তার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ফের ছাড়া হবে তাকে। সব রাজ্য ভ্রমণ করে সে স্বরাজ্যে ফিরে এলেই তাকে নিয়ে শুরু হবে মন্ত্রপাঠ। যাগযজ্ঞ। শেষে সেই ঘোড়া বলি দিয়ে শেষ হবে অশ্বেমেধ যজ্ঞ। এমনিই নিয়ম। শাস্ত্রবিধি। টগবগিয়ে চলেছে সগররাজের ঘোড়া। মহাক্রোধে এবং ঈর্ষায় ছুটে এলেন ইন্দ্রদেব। চুরি করলেন ঘোড়া। গোপনে নিয়ে গিয়ে বেঁধে রেখে এলেন কপিল মুনির আশ্রমে। খোঁজ খোঁজ পড়ে গেল অযোধ্যায়। চারিদিকে চর পাঠালেন সগর। তাঁর ষাট হাজার সন্তানও ছুটল হৈহৈ করে। খুঁজতে খুঁজতে কপিল মুনির আশ্রমে ঘোড়া বাঁধা আছে দেখে তাঁকেই চোর সাব্যস্ত করল তারা। যারপরনাই কটূক্তি করতে থাকল।
ধ্যানে ছিলেন মুনি। ধ্যানভঙ্গ হল তাঁর। প্রচণ্ড ক্রোধে জ্বলে উঠল তাঁর চক্ষুদ্বয়। শাপ দিলেন তিনি। পলকে ভস্মীভূত হল সগররাজের ষাট হাজার সন্তান। নরকে পতিত হল তারা। রাজবংশের পুণ্যবান উত্তরপুরুষ ভগীরথ ধ্যানে বসে জানতে পারেন, স্তূপীকৃত এই ভস্মের ওপর পবিত্র গঙ্গাজল ঢালতে পারলে পুনর্বার জীবন ফিরে পাবে এই সন্তানেরা। গঙ্গাদেবীর আরাধনায় নিরত হলেন তিনি। তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হন দেবী। স্বর্গ থেকে সপ্তধারায় নেমে আসেন মর্ত্যে। ভগীরথের পিছু পিছু ধেয়ে এসে সগর-সন্তানদের ভস্মের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়ে বিলীন হয়ে যান সাগরে। জীবন ফিরে পায় সন্তানরা। সেদিন থেকেই এই সাগরতট হয়ে যায় পুণ্যভূমি। অনুমান করা হয় কোনও এক পৌষসংক্রান্তিতেই গঙ্গাদেবী এই শুভকর্মটি করেছিলেন।’
হরিপদকে ঘিরে ধরে থাকারা মোহিত হয়ে শুনছিল পুরাণকথা। সেকথা শেষ হতেই আনন্দে হৈহৈ করে উঠল তারা। অনেকেই হাতজোড় করে প্রণাম করল গঙ্গাদেবী এবং কপিল মুনির মন্দিরের দিকে তাকিয়ে। সুযোগ বুঝে হাতের বাক্সটি এবার শ্রোতাদের সামনে খুলে ধরল হরিপদ। শুরু করল ভাষণ। তার কথা শুনে দেখতে দেখতে অনেকখানিই পাতলা হয়ে গেল ভিড়। কেউ কেউ বলতে থাকল, ‘হ্যাঁ, এতক্ষণে লাইনে এল লোকটা। তাই তো বলি, ফ্রিতে পুরাণকথা শোনাচ্ছে নাকি!’ তবে আশার কথা, প্রথমের শ্রোতারা গেল না। তাদের অনেকেই কিনল হরিপদর হাঁপানি, ব্যথা, কাশির মাদুলি। কবচও নিল।
সারাদিন দৌড়োদৌড়ি করে অনেকটাই বেচে ফেলল হরিপদ। রইল কেবল পাঁচটা কবচ আর গোটা পঞ্চাশেক মাদুলি। পরের দিন দুপুরের আগেই বিক্রি হয়ে গেল সব। অন্য দিন যেমন-তেমন করে খাওয়া সারে। আজ সাগর হোটেলে ঢুকল জমিয়ে খাবে বলে। ডাল-সবজি আর ট্যাংরা মাছ-ফুলকপির তরকারি নিল। গ্রাস-দুই মুখে তুলেছে সবে, ফোন এল বড়ছেলের, ‘বাবা, তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। সকালবেলা মা পড়ে গিয়েছে মাথা ঘুরে। তারপর থেকে আর জ্ঞান আসেনি। তাকে ভর্তি করতে হয়েছে আর জি কর— বাবা, তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো।’
মাথাখারাপ হয়ে গেল হরিপদর। কেন এমন হল তারা-র! ভালমানুষ যে রেখে এল বাড়িতে! তাহলে কি— তাহলে কি এ তারই পাপের ফল? নিশ্চয়ই তাই। ভাতের থালা ঠেলে সরিয়ে পয়সা মিটিয়ে দিয়ে দ্রুত বাইরে এল হরিপদ। বাক্স খুলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল মাদুলি-কবচ বেচা টাকাপয়সার দিকে। এ পাপ। এ সবই তার পাপের অর্জন। নিশ্চয়ই এরই জন্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছে তার বউ। বারাসত হয়ে কাঞ্চনতলায় সে তো যায়নি। মাদুলি-কবজের খোল কিনতেই অনেকগুলো টাকা চলে গেল। যাতায়াতের খরচ এবং ঠাকুরমশাইয়ের মাদুলি ভরার টাকা দিতে গেলে কত আর থাকবে হাতে! হরিপদ তাই এক নির্জন কলাবাগানে ঢুকে কলাঝাড়ের গোড়া থেকে তুলে এনেছিল মাটি। বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নিজেই ভরেছিল সব। মুখগুলো সিল করে দিয়েছিল গালা দিয়ে।
নিজেদের যেমন-তেমন। ছেলেমেয়েগুলোর একটারও ভাল শীতবস্ত্র নেই। ক’দিন আগেই তারামণি বলেছে, ‘আমি তো একা আর সামলাতে পারছি না গো। তুমি একটু দেখো না, যদি কিছু ব্যবস্থা করতে পারো।’ তা বলে সে তো অসৎ হতে বলেনি। হরিপদ নিজেই এসব মতলব এঁটেছিল। ভেবেছিল, এ আর ট্রেনের বেচাকেনা নয়— যে পরের দিনই দেখা হবে খরিদ্দারের সঙ্গে। বেচাবেচি সেরে মেলা থেকে বেরিয়ে আসবে— কে আর পাবে কাকে! মানুষ দু-চারদিন ব্যবহার করবে— তারপরই তো টের পাবে তার গুণাগুণ। হরিপদর মনে হয়, কিন্তু উপরে বসে একজন যে সব দেখছে— একথা তার মনেই হয়নি। তার এই শাস্তির ব্যবস্থা সেই করেছে। সে জানে, তারামণিই তার সব। তারামণিকে কষ্ট দিলেই সবচেয়ে বেশি জব্দ করা যাবে তাকে। তাই তো আজ তারামণি—
কী হবে এখন? যাদের কাছে মাদুলি-কবচ বেচেছে তাদের সে পাবে কোথায়? কী করা উচিত হবে? হরিপদ পথ খুঁজছে। পলকভর। ছুটল মেলার পথে বসে থাকা গরিব দুঃখী, রোগগ্রস্ত, নুলো-ল্যাংড়া ভিখারিদের দিকে। বিলিয়ে দেবে সব। এখুনি। তারপর গঙ্গায় স্নান করে উঠবে। তা না হলে যে তারামণির জ্ঞান ফিরবে না। বাঁচানো যাবে না তাকে!