আজকের পাঠকের কাছে সাধারণভাবে সংস্কৃত সাহিত্য এবং বিশেষভাবে কালিদাস কতখানি আবেদন-সঞ্চারী তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই মনে হয়, গত বিশ-তিরিশ বছরের মধ্যে বাঙালি পাঠক সংস্কৃত সাহিত্য থেকে ব্যাপক অংশে মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছেন। সংস্কৃত নাকি মৃত ভাষা, পুরোহিতগিরিতে কাজে লাগে কেবল, এরকম অপযুক্তির লেবেল এঁটে জীয়ন্তে সমাধিস্থ করার কাজ চলছে ভাষাটির। ফলে আধুনিক পাঠক উমবার্তো একো পড়েন কিন্তু বাণভট্ট পড়েন না, জাঁ আনুই তার নাটকপাঠের অন্তর্গত হয় কিন্তু ভাস, শূদ্রক অথবা ভবভূতি হন না, শেলি-কিটস-ওয়ার্ডসওয়ার্থ আদৃত হলেও কালিদাস থেকে যান অচ্ছুত।
বিবেচনাটিকে কি যথার্থ বলে মানতে হবে? আজকের পাঠকের কাছে সংস্কৃত সাহিত্য, রামায়ণ-মহাভারত— এ দুটি মহাকাব্যসমেত, সমূলে পরিত্যাজ্য? কবি হিসেবে কালিদাস কতখানি অভিনিবেশ পেতে পারেন, তা না জেনেই আমাদের সামূহিক কাব্যপাঠ সন্তোষজনক হয়ে উঠতে পারে? সাহিত্যের নন্দনতত্ত্ব নিয়ে বিশ্বনাথ কবিরাজ-ভামহ-রাজকেশর-দণ্ডী-বামন-ভরত প্রমুখের মতামতগুলি নিতান্তই তুচ্ছ, ভ্রান্ত, ব্রাত্য?
অথচ বাঙালি মনীষার বিগত দুশো বছরের ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই, তাহলে এমন কোনও স্বনামধন্যের সাক্ষাৎ পাব না, যিনি উত্তম সংস্কৃত জানতেন না, সংস্কৃতের অসীম ভাণ্ডারের কাছে কোনও না কোনওভাবে ঋণী নন। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ… তাঁরা কি যথেষ্ট আধুনিক ছিলেন না? কেবল তো সংস্কৃতই নয়, তার পূর্ববর্তী বৈদিক ভাষা, পরবর্তী পালি ভাষা নিয়েও গভীর চর্চা করে গেছে বাঙালি, ফলে বেদ-উপনিষদ আর ধম্মপদ, জাতক অনূদিত হতে পেরেছে, যা বাঙালির মননচর্চায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আজও সক্রিয়। রমেশচন্দ্র দত্তের বেদের অনুবাদ, কালীপ্রসন্নের মহাভারত, হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের নীলকণ্ঠ টীকা-সমেত মহাভারতের অনুবাদকর্ম, হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের রামায়ণ অনুবাদ, ঈশানচন্দ্র ঘোষের জাতক অনুবাদ, রাজশেখর বসুর রামায়ণ-মহাভারতের সংক্ষেপিত গদ্যানুবাদ, এগুলো সব, সমস্তটাই পুরোহিতবৃত্তি? রবীন্দ্রনাথ আর প্রমথ চৌধুরীর কাদম্বরী ব্যাখ্যা, শকুন্তলা, কুমারসম্ভব, মেঘদূত নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিশ্লেষণ, তারাশঙ্করের তর্করত্ন এবং পরে অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাদম্বরীর বঙ্গানুবাদ, ত্রিপুরারি চক্রবর্তী, সুখময় ভট্টাচার্য, বিমলকৃষ্ণ মতিলাল, সুকুমারী ভট্টাচার্য, বুদ্ধদেব বসু থেকে হালে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর রামায়ণ-মহাভারত ব্যাখ্যা কি নিতান্তই মগজের অথবা বিলাসিতা?
আরও আছে। সত্যজিৎ-ঋত্বিক নিঃসন্দেহে আধুনিক। এঁদের সংস্কৃত অনুশীলন এবং নিজেদের চলচ্চিত্রকর্মে তার প্রয়োগ, কী ভেবে ঘটালেন এঁরা? বা মকবুল ফিদা হুসেন তাঁর চলচ্চিত্রের চরিত্র গজগামিনীতে এত বিপুলভাবে কালিদাস থেকে ধার নিতে গেলেন কেন? ঋত্বিকের কোমল গান্ধার ছবিতে দেখি, শকুন্তলার নাট্যাভিনয়ের মহড়া চলছে। অনসূয়া নামে যে চলচ্চিত্রে চরিত্র, সে শকুন্তলার ভূমিকায় অভিনয় করবে। কিন্তু সে মহড়ায় মনোযোগী হতে পারছে না, শকুন্তলা চরিত্র তাকে টানছেই না। অমনি ঋত্বিক অন্য এক চরিত্রের সংলাপের মধ্য দিয়ে তুলে ধরলেন, উদ্বাস্তু অনসূয়ার সঙ্গে কালিদাসের শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রার সমমাত্রিকতা, দুজনেই নিরুপায় ও বাধ্য, হরিণশিশুর মায়া ত্যাগ করে, বৃক্ষ-লতা-বনানীর চির-অভ্যস্ততার বাইরে চলে যেতে হচ্ছে, হয়েছে দুজনকেই। বিস্ময়কর প্যারাডাইম! কালিদাসকে মোক্ষম কাজে লাগালেন এইভাবে ঋত্বিক। কেবল তাই নয়, কোমল গান্ধার-এ শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রার অংশটুকু রাখলেন ঋত্বিক, যা বহুতল মাত্রা নিয়ে এসেছে ছবিটিতে। সুবর্ণরেখায় তেমনি কালি, ‘The terrible mother’-এর প্রয়োগ, যার সম্পর্কে ঋত্বিক লিখছেন তাঁর ‘সুবর্ণরেখা প্রসঙ্গে’ নিবন্ধে, ‘আজ সব সভ্যতার জীবন মনন সমস্যা ঐ Confrontation-এর ওপরে… ভালো করে অনুধাবন করতে বলি ছবিতে ব্যবহৃত বেদ ও উপনিষদের শ্লোকগুলি। অনেক ভেবে, অনেক বাছাই করে ঐ কটিকে আমি গ্রহণ করেছিলাম। তাদের প্রত্যেকটির বিশেষ ব্যঞ্জনা আছে এবং আমার অর্থপ্রকাশের পক্ষে তারা খুবই সাহায্য করেছে।’
সত্যজিতেও রয়েছে সংস্কৃতের ঋণ, যা তিনি তাঁর ‘ডিটেলস সম্পর্কে দু চার কথা’ প্রবন্ধে ব্যক্ত করেছেন। তিনি লিখছেন, ‘আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে উপমার প্রাচুর্যের কথা সকলেই জানেন। এই উপমা জিনিসটা নেহাৎই সাহিত্যের বস্তু।’ তারপর প্রসঙ্গত তিনি কালিদাসের উদাহরণ দিয়ে তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট করে তুলেছেন, যেখানে ইন্দুমতির স্বয়ম্বর সভা তাঁর কাছে মনে হয়েছে চিত্রধর্মী। এরপর তিনি চলে যান রামায়ণ-মহাভারতে, ‘রামায়ণ-মহাভারত ইত্যাদি মহাকাব্যের বিপুল আয়তনের একটা প্রধান কারণ হল ডিটেলের প্রাচুর্য। বিশেষত মহাভারতকে চলচ্চিত্রসুলভ ডিটেলের স্বর্ণখনি বলা চলে।’ এরপর সত্যজিৎ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষে গান্ধারী তাঁর দিব্যচক্ষু দিয়ে রণভূমির অবস্থা দেখে কৃষ্ণকে যা বলেছিলেন, তা উদ্ধার করে পাঠককে দেখিয়েছেন। সত্যজিতের যাবতীয় শিল্পকর্ম, আমরা জানি ডিটেলের স্বর্ণখনি; আর যে-সব ছবির নির্মাণ ভাবনায়, অন্যান্য বহু আকরিকের মত সংস্কৃত সাহিত্য পাঠও একটি বিশিষ্ট ভূমিকা নিয়েছিল, এ-কথা মানতে বোধহয় আর আপত্তি থাকার কথা নয়। সত্যজিতের ইচ্ছে ছিল, মহাভারতের পাশাখেলার নাটকীয়তা নিয়ে ছবি তৈরি করবেন। ব্যাসে-সত্যজিতে সেই দুর্লভ সংযোগটি আর ঘটে উঠল না শেষ পর্যন্ত, তবে সত্যজিতের এ-জাতীয় ভাবনাটিই কি সংস্কৃতের প্রতি, এই ভাষায় লেখা মহাকাব্যটির প্রতি তাঁর সম্ভ্রমবোধের নিদর্শন নয়?
অতএব দেখতে পাচ্ছি, সংস্কৃতের প্রতি আমাদের আজানুলম্বিত ঋণ। পরশুরাম তাঁর ‘ভূশণ্ডীর মাঠে’ গল্পে মেঘদূতের অনুষঙ্গ নিয়ে আসেন, শকুন্তলাকে বাঙালি পাঠকের উপযোগী করে তোলেন, বিদ্যাসাগর আর অবনীন্দ্রনাথ, শরদিন্দু থেকে সুকুমার সেন সংস্কৃত থেকে নির্যাস সংগ্রহ করে তাঁদের লেখায় বুনে দেন, কালিদাসের বৌদ্ধবিদ্বেষ বনাম শেকসপিয়রের ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে তুমুল-তর্ক হয়, বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলায় ‘দুরাদয়শ্চক্র’ ছাড়াও একাধিক অধ্যায়ারম্ভে কালিদাস-সুভাষিতের ব্যবহার, রঙ্গলাল থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সেলিম আলদীন পর্যন্ত কালিদাসের বিনির্মাণ, এই বিচ্ছিন্ন উদাহরণগুলো আমাদের এই সাহসী সিদ্ধান্তে উপনীত করায়, সংস্কৃত সাহিত্যপাঠ ছাড়া একজন আধুনিক সাহিত্যপাঠকের সাহিত্যপাঠ অসম্পূর্ণ থাকতে বাধ্য।
দুই
উপরের বিশদ গৌরচন্দ্রিকাটি করে নেওয়া গেল এ-কারণেই, যাতে কালিদাসের মেঘদূত আলোচনা আজকের দিনে সামঞ্জস্যহীন ও অযথা না ঠেকে। একশো কুড়ি-বাইশ শ্লোকে মন্দাক্রান্তা ছন্দে মেঘদূত কালিদাসের অন্যান্য যাবতীয় রচনার তুলনায় অধিক জনপ্রিয়। এ-কাব্যের টীকা রচনা করেছেন মল্লিনাথ থেকে শুরু করে আরও অন্তত পঞ্চাশজন। কেবল বাংলাভাষাতেই মেঘদূত অনূদিত হয়েছে শতাধিকবার। অনুবাদকের মধ্যে প্রধানরা হলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজশেখর বসু, হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, পার্বতীচরণ ভট্টাচার্য, শক্তি চট্টোপাধ্যায়। কাব্যটির তিব্বতি ও চিনা অনুবাদের সংবাদও জানা যায়। ‘দূতকাব্য’ অভিধায় ভূষিত এই কাব্যের জনপ্রিয়তা ছিল এমন তুঙ্গে যে, এর অনুকরণে ‘দূতকাব্য’-এর জন্ম হল, আর লেখা হতে লাগল হংসদূত, ইন্দ্ৰদূত, কাকদূত নামে একের পর এক দূতকাব্য। কোনও দূতকাব্যই কালিদাসের কবিকৃতির ত্রিসীমানায় আসতে পারেনি, একমাত্র ধোয়ী-রচিত পবনদূত কালিদাসের সুদূরপ্রসারী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে আজও কিঞ্চিৎ পঠিত হয়ে থাকে।
অথচ কাব্যটির উৎসে কিন্তু কালিদাসের স্বকীয়তা রয়েছে একথা বলা যাবে না। রামায়ণে হনুমানকে রামের দূত করে অশোকবনে সীতার কাছে পাঠানো হয়েছিল। মহাভারতেও দেখি, নল হংসকে দূত পাঠাচ্ছেন দময়ন্তীর কাছে। শ্রীহর্ষ-রচিত নৈষধীয়চরিতম্-এও রয়েছে হংসদূতের বিদগ্ধ ক্রিয়াকলাপ। এমনকি কালিদাসের রঘুবংশম্-এর ১৩শ সর্গে যে রাম-সীতার বিমান ভ্রমণ, লংকা থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত ভারতবর্ষের ভূগোল সুস্পষ্ট যাথার্থ্যতায় উঠে এসেছে,— এও তো একধরনের দূতকাব্যেরই প্রকারভেদ। তবু মেঘদূত রামায়ণ-মহাভারতের কাছে অধমর্ণতা নিয়েও অনন্যতায় সংস্কৃত সাহিত্যে সম্পূর্ণ একক, তুলনারহিত আর অপূর্ব এক খণ্ডকাব্য।
হ্যাঁ, সংজ্ঞা অনুযায়ী কাব্যটিকে ‘খণ্ডকাব্য’ নামেই আখ্যায়িত করেন আলংকারিকেরা। মহাকাব্যের প্রতিতুলনায় খণ্ডকাব্য, কেন-না তা মহাকাব্যের জটিল শাখা-প্রশাখায় বেড়ে ওঠে না, অতিঅল্প বিস্তার। সংস্কৃতে অমরুশতক, শৃঙ্গারশতক, বৈরাগ্যশতক নামে শতককাব্যগুলো এই ধারার অন্তর্গত। এ-জাতীয় কাব্য স্বভাবতই লিরিকধর্মী, যেখানে ব্যক্তিহৃদয়ের প্রতিফলন উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হয়ে দেখা দেয়। আবার, মেঘকে দূত করে পাঠানো হয়েছে বলে এর অন্য নাম সন্দেশ-কাব্য।
মেঘদূত কাব্যের মূল সুর বিরহের। বাঙালি পাঠকের অভ্যস্ত পাঠ-পরিমণ্ডলে প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ বা মিলন— এসবের সঙ্গে তার প্রভূত পরিচয় আছে। একদিকে বৈষ্ণব-কবিতা এবং তার পাশাপাশি মৈমনসিংহগীতিকায় আদিরসের বহুবিচিত্র মানচিত্রের সঙ্গে পাঠকমাত্রেই পরিচিত। শিক্ষিত বাঙালিমাত্রের কাছে শেকসপিয়র, ইংরেজ রোমান্টিক কবিরা, এমনকি আধুনিক ইংরেজ কবিদের, ভিক্টেরিও, জর্জীয়, প্রি-রাফালোইট থেকে সাম্প্রতিকতম কবিরা বহুল আদৃত। এ-বাবদে মিসিং লিংক হিসেবে রয়ে গেছেন সংস্কৃত আর ফার্সি কবিরা, যেমন জয়দেব তেমন রুদকি, যেমন কালিদাস তেমনি রুমি, যেমন বাণভট্ট তেমনি হাফেজ।
বলা হল, মেঘদূত বিরহের কাব্য। স্বভাবত প্রেমের কাব্যও, কেন না, প্রেমের প্রাক-শর্ত না থাকলে বিরহের তাৎপর্য থাকে না। এ-কাব্যের কাহিনি-অংশ খুবই ছোট। কুবেরের ভৃত্য এক যক্ষ কাজে অবহেলা করেছিল বলে তার একবছরের সাজা হল, স্বর্গ ছেড়ে স্ত্রীবিরহিত হয়ে তাকে থাকতে হবে পৃথিবীর রামগিরি পাহাড়ে। শাপগ্রস্ত যক্ষের নির্বাসনকালের আট মাস কেটে গেল, বাকি আর চার মাস। এ-সময়ে আষাঢ়ের প্রথম দিবসে মেঘের আবির্ভাব দেখে যক্ষের বিরহবোধ তীব্র হয়ে উঠল। স্ত্রীর চিন্তায় ব্যাকুল যক্ষ মেঘকে অলকায় গিয়ে তার কুশলসংবাদ জানাতে বলল। মেঘ রামগিরি থেকে যে যে পথ ধরে অলকায় যাবে, যক্ষ তার পথনির্দেশও দিয়ে দিল। প্রাচীন ভারতের নদনদী পাহাড়পর্বত নগর-জনপদ পশুপাখি মানুষজন ফুলফলের চিত্রমালা এর মাধ্যমে কালিদাস আমাদের উন্মোচন করে দেখান, দেখান লোকাচার, লোকসংস্কার, নগর ও গ্রামের বৈচিত্র্য ও অনন্যতা।
কাব্যটির দুটি অংশ, পূর্বমেঘ ও উত্তরমেঘ। পূর্বমেঘ অংশকে আলংকারিকরা বলেন ‘প্রয়াণ’, উত্তরমেঘকে বলেন ‘প্রাপ্তি’। উত্তরমেঘে তাহলে প্রাপ্তি কী? প্রাপ্তি অলকা, তার সৌন্দর্য, এবং সেখানে অবস্থিত বিরহতাপিত যক্ষপত্নী, সন্তানহীনা যে নারী দ্বারপ্রান্তের তরুণ মন্দারকে পুত্রস্নেহে সমাদর করে।
বিরহই মেঘদূতের মূল সুর। সন্ত কবীর যে বলেছিলেন, ‘বিরহ হ্যায় এক সুলতান’, সেই সুলতানের বিধুর ও অব্যয় সুলতানিয়াতে বাস করি আমরা। যক্ষের প্রতিটি বাক্যের বেদনায় দীর্ণ না হয়ে পারি না। আট মাস প্রিয়াবিরহে কাতর যক্ষের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে কালিদাস লেখেন, যক্ষ ‘কনকবলয়ভ্রংশরিক্তপ্রকোষ্ঠঃ’: অর্থাৎ তার হাতের বলয় ঢিলে হয়ে গেছে, ব্যাস, এইটুকু। অথচ এইটুকুতেই ধরা দেয় প্রকৃত প্রেমিকের যাবতীয় বিধুরতা, তার অস্থিসার দেহ ফুটে ওঠে আমাদের সামনে। কান্তা বিরহে আটমাস দীর্ঘ, সুদীর্ঘ সময়, যখন Dryden আমাদের স্মরণ করান, ‘Love reckons hours for months and days for years, and every little absence is an age’।
আট মাস যক্ষের সহনীয় হল কোনওক্রমে, কিন্তু পয়লা আষাঢ় যখন বর্ষা নামল, তখন স্মৃতিবিধুরতায় নিতান্ত কাতর সে। কিন্তু কেন? বর্ষাগমে কেন অবধারিতভাবে স্মৃতি এসে ভিড় করে? বৃষ্টি নিজেই তো সুদূরে পাড়ি দেবার পর অন্তিমে ঝরে পড়ে মাটিতে, এই অবনমন ও তার আগেকার নভোপরিক্রমার কি কোনও সাজুয্য রয়েছে মানুষের মনের সঙ্গে? দেখা গেছে, আকাশে মেঘ সঞ্চারের সঙ্গে সঙ্গেই যেন মনের পুরনো দুয়ার একটু একটু করে খুলে যেতে থাকে। আবার সুখের স্মৃতি কিন্তু নয়, মন কেন যেন নির্বাচন করে দুঃখের স্মৃতি, কিংবা এমন সুখকর অতীত, যা আর ফিরে আসবার কোনও সম্ভাবনা নেই। রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখেছিলেন, ‘বাদলা দিনের দীর্ঘশ্বাসে জানায় আমায় ফিরবে না, ফিরবে না, ফিরবে না সে’। বুকভরা বিফল হাহাকার মর্মবিদ্ধ করে তোলে, তবু বিরহীমন তা উপভোগ করে, করতে ভালবাসে। দুঃখের স্মরণে কী লাভ মানুষের? দুঃখ তাকে প্রকৃত কী দেয়?
দেয়। দুঃখের অভিঘাত এমনই স্থায়ী ও গাঢ় বোধ, যা তাকে খাঁটি সোনা করে, নিটোল করে, তাকে জাগিয়ে দেয়। অন্যদিকে সুখ মানুষকে ভুলিয়ে রাখে, মানুষের পদবী থেকে তাকে বিচ্যুত করে ক্ষণিক, আত্মস্থ হতে দেয় না তাকে। সুখে তাই আমরা ভেসে যাই, দুঃখে হই আত্মস্থ। হ্যাঁ, দুঃখও আমাদের অভিভূত করে আমাদের নিজস্ব বলয় থেকে উন্মার্গে নিয়ে যেতে পারে। এবং তা যায়ও। কিন্তু যেহেতু মানুষ সর্বদা স্বভাবতই নিজের মঙ্গল চায়, দুঃখকে অতিক্রম করার প্রণোদনাটিও রয়ে গেছে তার মধ্যে। তার শিক্ষাও দেওয়া হয়েছে আমাদের শাস্ত্রে, ‘সুখেদুঃখে সমেকৃত্বা’। কিন্তু এইভাবে সমে আনবার পরে, সমীকৃত করবার পরে, স্মৃতিতে যখন দুঃখের পুনরাবর্তন ঘটে, তার সেই আবর্তন দুঃখের ওপারে নিয়ে ফেলে। বস্তুত তা মানুষকে আনন্দই দেয়। উপনিষদীয় অর্থে আনন্দ, যাকে অ্যারিস্টটলের ব্যাখ্যায় Cathersis বলতে পারি।
অতএব দুঃখও আমাদের আনন্দ ফিরে দিতে পারে। তা কী করে সম্ভব? সুখ আর দুঃখ মানুষের কাছে পরিযায়ীভাবে আসে। এর ঔপনিষদিক ব্যাখ্যা আছে, আছে বৌদ্ধশাস্ত্রেও ব্যাখ্যা। বুদ্ধদেব মানবজীবনে দুঃখের কারণ হিসেবে তনহা বা তৃষ্ণাকে দায়ী করেছেন। রূপতৃষ্ণা, অৰ্থতৃষ্ণা, যশের তৃষ্ণা, আরও। আর সেটাই অন্য দর্শনমতে কাম। সাবধান করে দেওয়া হয়েছে ‘ন জাতু কামঃ কামানামুপভোগেন-শাম্যতি’ বলে, কামের দ্বারা কাম শান্ত হয় না, আগুনে ঘি পড়লে যেমন আগুন নেভে না, তেমনি। বুদ্ধের প্রতীত্যসমুৎপাততত্ত্ব হচ্ছে সেই অলাতচক্র, যার মোহে মানুষ শ্রেয় ভুলে প্রেয়কে জীবনে বৃত করে, দুঃখের সূতিকাগার যেটি। পৃথিবীতে এমন কোনও দুঃখ নেই বা সুখ নেই, যাতে কাম, Satan, ইবলিস, মার বা তনহার নেপথ্যের ভূমিকা অনুপস্থিত। সুখ আর আনন্দ, পুনরুক্তি করছি, কখনওই এক নয়।
আনন্দ তবে কী? মেঘদূতে যক্ষ যখন বিদিশা বা উজ্জয়িনীর কথা বলে, যখন মহাদেবের অলকার বাগানে শয়ানমূর্তির ছবি তুলে ধরে, যখন নগরবধূদের ভ্রূবিলাসের বর্ণনা দেয়, তার সংলাপে যখন দীর্ঘযামা ত্রিযামাদের আমরা চাক্ষুষ করি, বা যক্ষপ্রিয়ার কান্তিময় শরীরে আমরা আমাদের সমগ্র সৌন্দর্যবোধেরই যেন সারাৎসার পেয়ে যাই (পাঠককে ‘তন্বী শ্যামা শিখরি-দশনা পক্ববিম্বাধরোষ্ঠী’ শ্লোকটি বারবার পড়তে অনুরোধ করি, এর বঙ্গানুবাদ তো রয়েছেই, বুঝতে তাই অসুবিধে হবার কথা নয়), দুঃখসুখের ওপারে গিয়ে বর্ণনাকারী যক্ষ তখন প্রকৃত অর্থে আনন্দিত। আনন্দ তাই দুঃখ ও সুখের অতীত একটি অবস্থা। দুঃখের সঙ্গী বেদনা, আর সুখের সঙ্গী সম্ভোগ। আর দুঃখ বা সুখের অভিজ্ঞতা যদি শান্তি আনতে পারে তবে তা আনন্দ। শম্ থেকে শান্তি। প্রবল দুঃখ, যেমন প্রিয়জনের মৃত্যু, প্রাথমিকভাবে আনল বেদনার্ত অভিভব, পর্ণমোচী বৃক্ষের একাকী পত্রহীন হয়ে যাবার মতই যা বিধুরতাময়, সেটা দুঃখ। আর তার থেকে জাত হল যে উপলব্ধি, অর্থাৎ এই পৃথিবী নশ্বর, জীবজগৎ নশ্বর, ‘সংসরতি ইতি সংসারঃ’, সেটা আনন্দ। তাই দুঃখের প্রদীপ জ্বলে আনন্দের আবাহনের অন্তিমকে লক্ষ রেখেই। তবে আনন্দ পর্যন্ত পৌঁছনো চাই দুঃখের। এজন্য ‘ন কর্ম লিপ্ততে নরে’ হতে হয়, যক্ষ যা হতে পেরেছিল। নইলে তো দুঃখেই অবগাহন জীবনভর। কর্মের বন্ধন, অসংখ্য বন্ধন, যা আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে। দুঃখের স্ফুলিঙ্গ নইলে তো পৃথিবীর সর্বাঙ্গ সোনা হয়ে যাবার কথা।
মেঘদূত বিরহের কাব্য, বিচ্ছেদের নয়। বিরহ আসলে কী? যা আমার প্রত্যহের ও কাঙ্ক্ষিত, তার আপাত অনুপস্থিতিই বিরহ। তাই বিরহের শেষে কাম্যবস্তুটি পাবার সম্ভাবনাটি রয়ে যায়। কিন্তু যা জন্মের মত হারায়? তাকে বলব বিচ্ছেদ। বিরহে সন্তাপ, বিচ্ছেদে শোক। বিরহকে আমরা মিলন ও পুনর্মিলনের মধ্যবর্তী সময়, interregnum হিসেবে গণ্য করতে পারি। কালিদাসের যক্ষ তাই বিরহী। যখন তার নির্বাসনদণ্ড ঘটল রামগিরিতে, তার জীবনে প্রিয়াবিরহিত সন্তাপ যুক্ত হল। প্রিয়া ও স্ত্রী একই সঙ্গে, একই অঙ্গে। যক্ষকে নির্বাসন দেওয়া হল রামগিরিতে, যেজন্য বিরহের মাত্রা আর-একটু যুক্ত হল। এটি কিন্তু কবিরই প্রকল্প, পাঠককে অতিরিক্ত বেদনা দেবার জন্য। যক্ষ তাতে রিঅ্যাক্ট করেছে, কাব্যে তার প্রমাণ নেই। কেবল পাঠক হিসেবে আমাদের আক্ষেপ জন্মায়: আহা! শেষপর্যন্ত রামগিরি! সেখানকার স্মৃতিমুখরতা রামসীতার বনবাসপর্বকে ঘিরে, কঠোর নির্বাসনও এখানে সহনীয় হয়ে উঠেছিল যাদের কাছে, কেন-না সেখানে তাদের দাম্পত্য বিঘ্নিত হয়নি। এখানেই কালিদাসের শিল্পিতা।
যক্ষ নিজে কোন উত্তুঙ্গ দাম্পত্যে অন্বিত ছিল, তার প্রকাশ দেখিয়েছেন কবি যক্ষের উপলব্ধি আর অনুভূতিতে। মেঘের যাত্রাপথের যে নির্দেশ যক্ষ দিয়েছে, তাতেই তাকে প্রেমিক হিসেবে চিনিয়ে দেয়। প্রেম তাকে সুন্দর করে বাঁচতে শিখিয়েছে, তাই তার সংলাপ এত লাবণ্যমণ্ডিত, বর্ণময়, কাব্যসম্মত, সংযত এবং ওষধির মতই নিরাময়কারী। অক্ষয় প্রেমিকের দৃষ্টিতে সে জগৎসংসারকে অনুভব করে বলেই তার কাছে অলকা শুভ্রতার ঝলক নিয়ে আসে, ‘বাহ্যোদ্যানস্থিত হরশিরশ্চন্দ্রিকাধৌতহর্ম্যাঃ’। কাব্যের আদ্যন্ত এরকম সুন্দরের ধ্যান ছড়িয়ে আছে, বিরহী যক্ষের উচ্চারণে। এইখানেই তো বিরহ সুলতান। দয়িতাকে ভালবাসে বলেই তার প্রভুর কাজে বিঘ্ন ঘটে, বিরহ যক্ষের সৌন্দর্যবোধকে ম্লান করতে পারে না, কেন-না তার হৃদয়ে জ্বলছে সৌন্দর্যের দীপ। বৈষ্ণব কবির প্রেমবৈচিত্তের চেয়েও গাঢ়তর এই উপলব্ধি। একই সঙ্গে ক্ষমাশীল ও সৌন্দর্যময়। কাব্যের অন্তিমে যে প্রার্থনা, আশীর্বচন, শুভৈষা ছিল যক্ষের, মেঘের সঙ্গে যেন বিদ্যুতের কদাপি বিচ্ছেদ না ঘটে— অন্যতম অভিজ্ঞান বিরহীর সুলতানিয়াতের। নিজে এ-মুহূর্তে দুঃখার্ত, কিন্তু জগৎ যেন কখনও দাম্পত্যে আহত না হয়।
বাগর্থামিব সম্পৃক্তৌ যারা, তাদের অন্যতম শিব যা পারেনি, যক্ষ তা পারল। এবং তা বিরহী বলেই। সতীর মত মৃত্যু বিচ্ছেদ ঘটালে মহাদেবের প্রলয় নাচ নাচতেই হয়, কেন-না তা বিরহ নয়, বিচ্ছেদ। এইখানেই দুয়ের পার্থক্য।
বিচ্ছেদ কেবল তাণ্ডবনৃত্যই ঘটায় না, শ্রীরাধিকার মত ভাবসম্মিলনেরও জন্ম দেয়। রাধা জানতেন, কৃষ্ণ আর বৃন্দাবনে ফিরে আসতে পারবেন না। মাথুর কৃষ্ণের আকাঙ্ক্ষায় থেকে থেকে রাধা নিজেকে প্রেমবৈচিত্তের উজানে স্থাপন করলেন; মনে করলেন, কৃষ্ণ প্রত্যাগত। শিবের শোকাভিভবকেও হার মানাল রাধার এই ভাবসম্মিলনের হ্যালুসিনেশন, তারই প্রগাঢ়তায় রাধার উক্তি, ‘এতদিন পরে বঁধুয়া এলে, দেখা না হইত পরাণ গেলে!’ শুনে আমাদেরই পরাণ যায় যায়! যত অন্তরঙ্গতা ও শারীরিকতায় রাধা কৃষ্ণকে পেয়েছিলেন, ততখানি হার্দ্য আর শরীরতন্ময়তা ছিলই তো না শিব-শিবানীর। অর্ধনারীশ্বর হয়েও। সতীর সঙ্গে শিবের শরীরমিলন কল্পনার বিষয় আমাদের। হরপার্বতী, দেবতাদের পরামর্শক্রমে বিয়ে হয় কুমার অর্থাৎ কার্তিকেয়র জন্মের জন্য। কুমার কিন্তু বিধিবদ্ধ উপায়ে জন্মায়নি, শিবের বীর্য আগুনে পড়ে সেই বীর্য থেকে; কার্তিকেয়র যে-জন্য পাবকি নাম। আর গণেশের জন্ম পার্বতীর গাত্রমল থেকে। শিব ও রাধা, দুজনেরই সতী/ কৃষ্ণ বিচ্ছেদ যে দু’রকম অভিঘাত নিয়ে এল, তা কি উভয়ে যথাক্রমে পুরুষ এবং নারী বলে? নাকি শরীরমিলনের যে শান্তি, তারই উপঢৌকন রাধার রোমান্টিক ভাবসম্মিলন, হয়তো পরিণামে তা ভাব-শৃঙ্গারই হয়ে দাঁড়াবে। আর শিব তো জানলেনই না নারীশরীরের মাহাত্ম্য ও রঞ্জকতা, তাই সতীর মৃত্যুতে একমেব ক্রোধই তাঁর আশ্রয়। মৃতা স্ত্রী, তবু বেদনা জাগল না তাঁর। নারায়ণ যখন ছিন্নভিন্ন করে ফেলছেন সতীর দেহ। একান্ন অংশে। যার মধ্যে সতীর জঙ্ঘা, যোনি এমনকি রয়েছে হৃদয়ও। না, শিব বিমনা হন না সতীর দেহখণ্ড যখন এক এক স্থানে গিয়ে পড়ে, কেন-না শিবের তো সতীর দেহসম্ভোগের কোনও স্মৃতি নেই। সতী শূন্যতায় মিলিয়ে গেলে তিনি শান্ত হন কেবল।
বিচ্ছেদ চিরশূন্যতা, অন্যদিকে বিরহের মধ্যে প্যান্ডোরার বাক্সের আশাদেবী হাতছানি দেন। তাই বিরহঋতুতে আমরা অতি উত্তুঙ্গতায় মনকে স্থাপন করতে পারি। এবং সে অনুভব দুঃখের হলেও স্মৃতির নিদ্ধ সঙ্ঘারামে বাস করার নির্বৃতি।
মেঘদূত পাঠান্তে কিন্তু কালিদাসকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেও ইচ্ছে করে কিঞ্চিৎ। আচ্ছা, যক্ষের কী এমন অপরাধ ছিল যার জন্য তার একবছর ধরে কান্তাবিরহের শাস্তি? সে ছিল নাকি কুবেরের উদ্যানপালক। কর্মে অবহেলা ঘটেছিল তার। উদ্যানপালন এমন কোনও কর্ম নয়, মুমূর্ষু রোগীকে শুশ্রূষাদানের মত দুরূহ, যাতে একটু অবহেলায় বাগানের ফলফুলের প্রাণ একেবারে ওষ্ঠাগত হবে। কাব্যে বিশদ বলা নেই, তবে অনুমান, যক্ষের ওই পেশা। তো ফুলগাছের পরিচর্যা করতে করতে, পুষ্পবিতান দেখতে দেখতে তার বুঝি ওই ফুলেরই অনুষঙ্গে স্ত্রীর কথা মনে আনতে নেই, আর অন্যমনস্কতার কারণ যে অবধারিতভাবে স্ত্রীকে নিয়ে ভাবতে বসা, তা-ই বা কুবের জানল কী করে? কৈলাসে বাস করলেও কুবের তো অন্তর্যামী নয়। তার সেখানে বসবাস স্রেফ অর্থের জোরে, অন্যথায় দেবতার চেয়ে তার পদবী নিচুতে। যক্ষ পরনারীর কথা চিন্তা করলেও না হয় কথা ছিল; মেনকা, ঘৃতাচী, রম্ভা অথবা উর্বশীর প্রতি যক্ষের কোনও সংশ্লেষ দেখি না, তার কেবল স্ত্রীকে মনে পড়া। কালিদাস এটি জাস্টিফাই করতে পারলেন না। একমাত্র সামন্ত মানসিকতা ছাড়া এর ব্যাখ্যা মেলে না। কালিদাস অবশ্যই সামন্ততান্ত্রিক। তার প্রমাণ রঘুবংশের বিখ্যাত উক্তিটি, ‘সহস্রগুণমুস্রষ্টম্ আদত্তেহি রসং রবিঃ’,— হাজার গুণ ফিরিয়ে দিতেই সূর্য পৃথিবী থেকে রস, অর্থাৎ জল গ্রহণ করে। রাজার কর আদায়কে সমর্থন করতে তিনি একথা লিখেছেন। তুলনাটা ক্লাসিক নিঃসন্দেহে। কিন্তু সূর্য পৃথিবী থেকে রস গ্রহণ করে, তার পেছনে রসদাতার কোনও শ্রম নেই, পুরোটাই প্রাকৃতিক পদ্ধতি! আর সেই রসে, জলে সূর্যের ব্যক্তিগত প্রয়োজনও নেই। কিন্তু প্রজাদের কাছ থেকে রস নিংড়ে নেওয়া রাজার রাজত্ব ও রাজাত্বকে যে সম্ভব করে তোলে, সে-সত্যটিকে উপমার মাধ্যমে কি লুকিয়ে ফেলা হল না? রাজার প্রাসাদ, রাজমুকুট, দাসদাসী, অসংখ্য স্ত্রী, অনুচর তো নেই উদ্বৃত্তি মূল্যতত্ত্বের হাত ধরেই আসে, আর প্রজা তার রসদ যুগিয়ে ফতুর হয়। না, কালিদাস একজন পার্টিজান।
এর প্রমাণ তো মালবিকাগ্নিমিত্রম্ নাটকেও রয়েছে, কালিদাসের সামন্ততান্ত্রিকতা। রাজ-অন্তঃপুরের পরিচারিকা মালবিকার সঙ্গে বিদিশারাজ অগ্নিমিত্রের প্রণয়ে আমরা আপ্লুত বোধ করি। বিদূষকের সহায়তায় সে-প্রেম ক্রমশ কণ্টকবর্জিত হয়ে আসে, অবশেষে সফলও হয়। আর জানা যায়, মালবিকা আসলে রাজকন্যা, দস্যুহস্তে পড়ে ঘটনাচক্রে রাজ-অন্তঃপুরে স্থান পেয়েছে। এ-নাটকে মালবিকা চরিত্রে কৌলিন্যসঞ্চার করে এইভাবে তাকে অগ্নিমিত্রের যোগ্য করে তোলা হল। মালবিকা সত্যি সত্যি পরিচারিকা হলে এ-হেন বিষমবিবাহে অগ্নিমিত্রের চরিত্র কলুষিত হত। আর মালবিকা ও অগ্নিমিত্রের পাশে অগ্নিমিত্রের স্ত্রীর হাহাকার আর বেদনাকে আমলই দেওয়া হল না। সমস্ত নাটকটিতে রানির বিরুদ্ধে যে ছক পাতল বিদূষক আর রাজা, তা যেন প্রকৃত বাহবারই যোগ্য। এটি নিপাট সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব।
আমি ভুলে যাচ্ছি না কালিদাস একজন মহান কবি, যুগন্ধর এবং অপূর্বনির্মাণক্ষম। ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের আগে পর্যন্ত একমেবাদ্বিতীয়, কবিতায় স্বরাট। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই তো কালিদাসের কাছে বহুভাবে ঋণী। কবিত্বের উত্তুঙ্গতা বাদ দিয়েও আমাদের মুগ্ধ, বিস্ময়াবিষ্ট করে তাঁর শব্দচয়ন, বাক্যগঠন প্রক্রিয়া, উপমার সরোবরে স্নিগ্ধ স্নান করিয়ে আনেন তিনি আমাদের, যাঁর প্রত্যেক বাক্যগঠনে রয়েছে সৌন্দর্যের অবস্থান, ছন্দের শাসন মান্য করে। সংস্কৃত ছন্দের অনুশাসন কী তীব্র, তার একটু ব্যাখ্যা করা যাক। এই যে মন্দাক্রান্তা ছন্দ, যে-ছন্দে আদ্যন্ত লেখা হয়েছে মেঘদূত, তার প্রত্যেকটি চরণের প্রথম চার অক্ষরকে ব্যত্যয়হীনভাবে হতে হবে দীর্ঘস্বর। সংস্কৃত ছন্দ কেবল মাত্রা-গুণে চলে না, বিভিন্ন ছন্দের নির্দিষ্ট মাত্রা ছাড়াও রয়েছে অক্ষরের বিন্যাস। হ্রস্ব-দীর্ঘ ঠিক কীভাবে হবে, তার নিপুণ নির্দেশ রয়ে গেছে। মন্দাক্রান্তায় অক্ষর থাকবে প্রতি চরণে সতেরটি, কিন্তু ‘মন্দাক্রান্তাম্বুধিরসনগৈর্মৌভনৌগ্ন য যুগ্মম্’ বিধান অনুযায়ী অক্ষরের ১, ২, ৩, ৪, ১০, ১১, ১৩, ১৫-তম অক্ষরকে অবশ্যই হতে হবে দীর্ঘস্বর, বাকিগুলিকে হ্রস্ব। কত শব্দকে, বিভক্তিকে পরিহার করতে করতে এগোতে হয় মন্দাক্রান্তার (অন্যান্য সংস্কৃত ছন্দেরও) চরণনির্মাণে। এতে কৃত্রিমতা আসারও সমূহ সম্ভাবনা। কিন্তু কাব্যটি পাঠ করতে গিয়ে এর মাধুর্যে আমরা এমন মজে যাই যে, এর পেছনে কবির শ্রম আমাদের মনেই থাকে না।
প্রসঙ্গত, বাংলায় মন্দাক্রান্তা হয় না। অনেক কবি, প্রাবন্ধিক লাফালাফি করেন এ নিয়ে, তবু হয় না। বাংলায় হ্রস্ব-দীর্ঘর বালাই নেই। হ্যাঁ, একমাত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ইচ্ছা সম্যক জগদদরশনে, কিন্তু পাথেয় নাস্তি’, সার্থক উদাহরণ, যেখানে উচ্চারণকে হ্রস্ব-দীর্ঘ করে পড়তে হবে। কিন্তু এই কৃত্রিম উচ্চারণ করব কতক্ষণ?
কালিদাসের সৌন্দর্যচেতনার কথা বলছিলাম। এ নিয়ে আস্ত বই লেখা যায়। ‘রম্যানি বীক্ষ্য মধুরাংশ্চ নিশম্য শব্দান্’,— এইভাবে বাক্যগঠন সম্ভব নয়, যদি নিজের ভেতরে শব্দের, কবিত্বের, সুন্দরের নিয়ত আরাধনা না থাকে। কালিদাসের মাহাত্ম্য অনেকে অনেকভাবে বর্ণনা করেছেন। কোলরিজ শেকসপিয়র সম্পর্কে যেমন বলেন ‘myriad minded man’, বাণভট্ট কালিদাসে তেমনি পান মধুর ভারে আনত তৃপ্তি। কালিদাস-প্রশস্তির শিখরে দাঁড়িয়ে যে গাথাটি, আমি সেটি পুরোপুরি উদ্ধৃত না করে পারছি না:
পুরা কবীনাং গণনাপ্রসঙ্গে
কনীনিকাধিষ্ঠিত কালিদাসঃ।
অদ্যাপি তত্তুল্ল কবেরভাবাৎ
অনামিকা সার্থবতী বভুব।।
এর সঙ্গে তুলনীয় ম্যাথু আর্নল্ডের শেকসপিয়র বন্দনাটি—
Others abide our question.
Thau art free
We ask and ask : thau smilest
and are still,
Out-topping knowledge!
আটমাসের বিরহে যক্ষের রিক্তভ্রংশপ্রকোষ্ঠ হওয়া, এ-জন্যই তো যক্ষকে আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে শাস্তি মকুব করে দেওয়া উচিত ছিল কুবেরের। কিন্তু না, কুবের থেকে আংকল টম থেকে আ কিউ থেকে খোয়াবনামার তমিজ, সাবঅলটার্নের জীবনে স্ত্রী-সংসার, পরিপূর্ণ বৈধ প্রেমকে বাধা দিয়ে আসছে এক অলাতচক্র, প্রভুশক্তির আড়ালে। এর থেকে কোনওদিন মুক্তি নেই অধস্তন ও প্রান্তিক মানুষের। আজকের পাঠক এইভাবেই নিতে পারেন মেঘদূতের পাঠ।
অসাধারণ আলোচনা। সর্মৃদ্ধ হলাম। প্রাবন্ধিক মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়কে অনেক শ্রদ্ধা।
গতকাল থেকে মাথা ঝিম ধরে আছে। পুরো সাইক্লোন তুলে দিয়েছে আমার মাঝে। বিরহ ও বিচ্ছেদের মানে এভাবে বুঝিনি আগে। মেঘদূতের সূত্র ধরে ইতিহাস, দর্শন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব জায়গা ঘুরিয়ে আনলেন লেখক। শেষের কালিদাশ প্রশস্তিটি অনুবাদ করে দেয়া যায়?
লেখাটি ভালো লাগল। কিন্তু কয়েকটি প্রশ্ন রয়ে গেল। ১) কেবলমাত্র নিজের স্ত্রীকে ভালোবাসা মহৎ প্রেমের লক্ষণ না হয়ে সামন্ততন্ত্রের লক্ষণ কেন? ২) মেঘদূতের অসামান্য কাব্যসৌন্দর্য উপভোগ না করে এখনকার মানুষকে তাকে ওপরঅলার অত্যাচারে জীবনে বিরহ আসে–এই বার্তার বাহক হিসেবে পড়তে হবে কেন? সাব-অল্টার্নরা না বুঝলেই কি কোনো কাব্য অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়? ৩) সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘যক্ষের নিবেদন’, যোগীন্দ্রনাথ মজুমদারের মন্দাক্রান্তা ছন্দে মেঘদূত অনুবাদের প্রয়াস এবং মন্দাক্রান্তা সেনের ‘মন্দাক্রান্তা কবিতাগুচ্ছ’ থাকা সত্ত্বেও বাংলায় মন্দাক্রান্তা ছন্দ হয় না–এই মন্তব্য কেন? ধন্যবাদ।