মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আধুনিক বাংলা উপন্যাস ও ছোটগল্পের জগতে এক বিশিষ্ট নাম। মাত্র আটচল্লিশ বছরের জীবনে তিনি তিরিশটি উপন্যাস ও তিনশোর ওপর গল্প লিখে গেছেন। ঘটিয়েছেন কথাসাহিত্যে তুমুল পালাবদল। একদিকে ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ব ও অন্যদিকে মার্ক্সবাদী শ্রেণীদ্বন্দ্বের প্রায়োগিক ব্যবহার তাঁর লেখাকে অনন্য মাত্রা দিয়েছে।
প্রথম-যৌবনে প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়নে অনার্স পড়াকালীন তিনি ‘অতসীমামী’ গল্প নিয়ে বাংলাসাহিত্যে আবির্ভূত হন। গল্পটি বেরিয়েছিল রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রবাসী’-তে। উল্লেখ্য, বিভূতিভূষণের-ও গল্পে হাতেখড়ি ওই পত্রিকাতে ‘উপেক্ষিতা’ গল্পরচনার মাধ্যমে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখালেখি শুরু হয় যখন, তখন বাংলা সাহিত্যে কল্লোল যুগ। ১৯২৩-এ প্রকাশিত এ-পত্রিকার নিয়মিত লেখক হিসেবে দেখা যেত প্রেমেন্দ্র মিত্র ও অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের সঙ্গে মাঝে মাঝে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। কবিতায় ছিলেন জীবনানন্দ ও পনেরো বছরের বুদ্ধদেব বসু। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘শুধু কেরানী’ বা ‘পাঁক’ এবং অচিন্ত্যকুমারের ‘বেদে’ ও ‘বিবাহের চেয়ে বড়ো’ তখন পাঠকমহলে তুমুল আলোড়ন তুলছে। এর মাঝেই আবার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে বিভূতিভূষণ ও মানিক। দুই মেরুর দুই অবিস্মরণীয় লেখক! মানিকের প্রথম উপন্যাস ‘দিবারাত্রির কাব্য’ তাঁর মাত্র আঠারো বছর বয়সে প্রকাশিত হয়েছিল।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯০৮-এর ১৯-এ মে। বিহারের দুমকায়। তবে তাঁদের পূর্বপুরুষের বাস ঢাকা জেলায়। স্কুল ও কলেজজীবনে কৃতী ছাত্র ছিলেন। সেইসঙ্গে দেশিবিদেশি সাহিত্যের ছিলেন আগ্রাসী পাঠক। তাঁর কৈশোর ও যৌবনে রবীন্দ্রনাথ জুড়ে ছিলেন বাংলা সাহিত্যের দিগন্ত। ‘রক্তকরবী’ আর ‘শেষের কবিতা’ ও ‘কালান্তর’ আর ‘রাশিয়ার চিঠি’ বেরোচ্ছে যখন, ঠিক সে সময়টিতে মানিকের গঠনপর্ব। শরৎচন্দ্র গল্প-উপন্যাসে দ্যুতি আর বিভা ছড়াচ্ছেন। আবির্ভাব ঘটে গেছে বিভূতিভূষণ তারাশঙ্কর শরদিন্দুর। বিহারপ্রদেশে বসে পূর্ণিয়ায় সতীনাথ ভাদুড়ী এবং মুজফফরপুরে বিভূতিভূযণ মুখোপাধ্যায় সমৃদ্ধ করে চলেছেন বাংলা সাহিত্যকে। প্রগতি, কালিকলম, চতুরঙ্গ, পরিচয়, পূর্বাশা-র মতো পত্রিকা নতুন নতুন লেখকদের স্বাগত জানাচ্ছে। অসহযোগ আন্দোলন আর সত্যাগ্রহ। রাওলাট আইন ও জালিয়ানওয়ালাবাগ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভারত ছাড়ো আন্দোলন। পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ। মেদিনীপুরের ভয়াবহ বন্যা। ছেচল্লিশের দাঙ্গা। উপমহাদেশের স্বাধীনতা ও নির্মম দেশভাগের বিমর্ষ অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে কেটেছে তাঁর জীবন। আর তাঁর গল্প-উপন্যাসে তিনি এই ইতিহাসের রূপকার।
নিজের যুগকে তিনি ছুঁয়েছেন নির্মম ভয়াবহতায়। ভাবালুতা ও রোমান্স নয়, কট্টর বাস্তবধর্মিতা মানিকের যাবতীয় রচনার প্রেক্ষিত ও আবহ। এদিক দিয়ে তিনি তাঁর যুগের চূড়ান্ত ব্যতিক্রম। তাঁর বৌ-সিরিজের গল্পসমূহ আর শরদিন্দুর জাতিস্মর সিরিজ পাশাপাশি রেখে পড়লে মানিকের বাস্তবধর্মিতা ও মনুষ্যমনস্তত্ত্বের নিগূঢ়তায় অবগাহন করা যায়।
মানিকের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ বাংলাসাহিত্যে দ্বিতীয়রহিত। বাংলাভাষায় নদীনির্ভর উপন্যাস লেখা হয়েছে প্রচুর। অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’; বিভূতিভূযণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইছামতী’; সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’; লোকনাথ ভট্টাচার্যের ‘বাবুঘাটের কুমারী মাছ’; শওকত ওসমানের ‘কর্ণফুলি’; আবু ইসহাকের ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’; তাছাড়া আছে হরিশঙ্কর জলদাসের একাধিক উপন্যাস। এসমস্ত উপন্যাসসমূহকে মনে রেখেও মানিকের উপন্যাসটি নানাকারণেই স্বাতন্ত্র্যে চিহ্নিত। ভারতীয় এমনকি বিশ্বসাহিত্যের যে অমূল্য নদী ও সমুদ্রসংশ্লিষ্ট গল্প-উপন্যাস যেমন তাকাষি শিবশঙ্কর পিল্লাইয়ের তামিলভাষায় লেখা ‘চেম্মিন’; মিখাইল শলোকভের ‘And Quiet Flows the Don’; আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘The Old Man and the Sea’-এর পাশেও মানিকের এই উপন্যাসটিকে দাঁড় করানো চলে। মানিকের জীবিতকালেই উর্দুভাষায় এর চলচ্চিত্ররূপ দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানে। নাম ছিল ‘ধরতী কি লাল’। এ ছবির নায়িকার ভূমিকায় ছিলেন তৃপ্তি মিত্র। পরে গৌতম ঘোষ এটির চলচ্চিত্রায়ন করেন। এবারেও ছবিটি কলকাতায় নয় বাংলাদেশের উদ্যোগে বাংলাদেশের জনাব হাবিবুর রহমানের প্রযোজনায় নির্মিত হয়েছিল।
সমাজবাস্তবতা ও মানুষের ভিতরকার অন্তর্দ্বন্দ্বই মানিকের লেখার মুখ্য আশ্রয়। যথার্থ এক আধুনিক সাহিত্যিকের মতোই তিনি সমসময়কে তাঁর লেখায় তুলে আনেন। আবার শাশ্বত প্রেম বিরহ ঈর্ষা কাম রিরংসাও তাঁর লেখার উপজীব্য। এই কারণে তাঁর ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’, ‘জননী’, ‘ইতিকথার পরের কথা’ বাংলাসাহিত্যে চিরস্থায়ী। বা গল্পগ্রন্থ ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’। পরবর্তীকালে মহাশ্বেতা দেবী, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, সোমনাথ লাহিড়ী, সমরেশ বসু, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মধ্যে এর অনুরণন দেখতে পাই। এঁরা অনেকেই মানিকের কাছে তাঁদের ঋণ স্বীকার করে গেছেন।
মানিকের কিছু কবিতাও আছে। এবং তা নিজস্বতার পরিচয়বাহী। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জামাতা যুগান্তর চক্রবর্তীর সম্পাদনায় তা প্রকাশিত হয়।
এছাড়া রয়েছে তাঁর ডায়েরি। বিভূতিভূষণ, বনফুল, সতীনাথ ভাদুড়ীর মতো তিনিও ডায়েরি লিখতেন। এ ডায়েরি অন্য এক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে এনে দাঁড় করায়। মদ্যাসক্ত মানিক হাসপাতালে লুকিয়ে রাখছেন মদের বোতল। ডাক্তার-নার্সকে লুকিয়ে মদ খাচ্ছেন। আর বাঁচার আকুলতায় মার্ক্সবাদী মানিক কালীর নাম জপ করছেন! তবু যদি শেষরক্ষা হত! মধুসূদন ও ঋত্বিক যেমন, ঠিক তেমন করেই অতিরিক্ত মদ্যপান তাঁর অকালমৃত্যু ডেকে আনল!
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর অতি প্রিয় ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে তিনি একটি কবিতায় লেখেন ‘বসন্তে কোকিল কেশে কেশে রক্ত তুলবে সে কীসের বসন্ত?’ মানিক সুকান্তকে এতটাই ভালবাসতেন যে নিজের ছেলের নাম রাখেন সুকান্ত। এ এক অনন্য নজির। না। তা নয়। বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ আর মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ছিলেন হরিহরাত্মা। আশুতোষ তাঁর ছেলের নাম রাখেন শ্যামাপ্রসাদ। প্রসাদটুকু বন্ধুত্বের স্মারক। অন্যদিকে হরপ্রসাদের বন্ধুত্বের স্মারক নিজ সন্তানের নাম বিনয়তোষ রাখার মধ্যে।