Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

সবুজ মিডাসের ছোঁয়া

লোকটা দুধ বেচে খায়। কাঠের তক্তার ত্যাড়াব্যাঁকা আদিবাসী কুটির। জংপড়া সাইকেল দাঁড়িয়ে আছে নির্জন কুয়োতলায়। বাঁশের বাখারির রেলিংয়ে শুকোচ্ছে বাচ্চাদের লাল-নীল জামা। কাপড় উড়ছে বাতাসে। সাইকেলের হ্যান্ডেলে কাপড়ের পুঁটলিতে বাঁধা গাছের বীজ, চারাগাছ, বালতি, শাবল, খাবারদাবার। ভোর থেকে উঠে কারখানা শ্রমিক বা অফিসযাত্রীর মতই তাঁর নিজস্ব জঙ্গলে যাবার প্রস্তুতি। বউ মেয়ে ছেলে সবাই সেই যোগাড়ে ব্যস্ত। সাইকেলে নদীর পাড়, ভটভটি, তারপর সাত কিলোমিটার হেঁটে সেই জঙ্গলে যেতে হয় তাঁকে রোজ। বড় গাছ সামলানো মুশকিল, মানুষের নজর পড়ে। কাঠ বেচে পয়সা হয়। চোখে চোখে রাখতে হয় পোচারদের। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদী দ্বীপ মাজুলি। প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বাস করে। নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, গাছ না লাগালে ১৫-২০ বছরের মধ্যে মাজুলি বিলীন হয়ে যাবে।

কে এই লোকটা?

যাদব পায়েং। সবাই জানেন। আসামের মিসিং উপজাতির মানুষ। ব্রহ্মপুত্রের মাজুলি দ্বীপের অনাবাদী রুক্ষ নিষ্ফলা চরায় গরম বালি অঞ্চলকে গভীর অরণ্যে পরিণত করে দিয়েছেন একা। সেই সময় জোড়হাটের ফরেস্ট ডিভিশান কোইলামুখ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অরুণাচাপুরি দ্বীপে ২০০ হেক্টর জমিতে গাছ লাগানোর একটা প্রকল্প চালু করে। যাদব সেখানে অরণ্যকর্মী হিসেবে পাঁচ বছর গাছ লাগিয়েছিলেন। প্রজেক্টটি সম্পূর্ণ হবার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। যাদব কিন্তু সরে আসেননি। ১৯৭৮ সালে তাঁর বয়স ষোলো বছর। উদ্ভিদশূন্য প্রচণ্ড গরম বালিতে তিনি পড়ে থাকতে দেখেন অসংখ্য মৃত সাপ। ব্রহ্মপুত্রের বন্যার জলে ভেসে এসেছে। আজ সাপ মরেছে, কাল মানুষ মরবে। যাদব বুঝেছিলেন।

একজন মানুষের একার বানানো এক হাজার তিনশো ষাট একরের গভীর অরণ্য। মোইলা ফরেস্ট নাম তার। বাঘ, গণ্ডার, ১০০-র ওপর হরিণ, খরগোশ, নানা বিচিত্র প্রজাতির পাখি, দেড়শো শকুন সেই অরণ্যে বাস করে। হাজারের ওপর গাছের বৈচিত্র্য আছে এখানে। বাঁশ, নারকোল, অর্জুন ভালকোল, ইজার, গুলমোহর, করুই, মোজ, হিমোলু, বাঁশঝাড়, কলাঝাড়, হলুদ, গোমারি, জারুল, শিমুল। ৩০ বছর ধরে একটা মানুষ একা পুঁতেছেন তা নয়, শুধু সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাটিয়েছেন তাদের সঙ্গে।

দ্য ফরেস্ট ম্যান যাদব পায়েং-এর নাম সারা পৃথিবী জানে। হাতিরা এসেছে, থাকতে শুরু করেছে, ধীরে ধীরে বংশবৃদ্ধি করেছে। খাঁটি রয়েল বেঙ্গল এসে জুটেছে। যাদবের নিজের ১০০ গরু-মোষ তিরিশ বছরে বাঘের পেটে গেছে। যাদব বোঝেন অরণ্য বানাতে গেলে খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বায়ো সিস্টেমকে মানতে হবে। মানুষ তার ও প্রকৃতির মাঝখানে আর একটা জগৎ সৃষ্টি করেছে প্রকৃতির সঙ্গে যার যোগ নেই। খরচের খাতায় বিপুল ব্যয়। জমার খাতা শূন্য। হিমালয়ের হিমবাহগুলোর উপরিভাগ ৫০ সেন্টিমিটার হারে গলে যাচ্ছে। ফলে জলস্তর উষ্ণ হয়ে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ছে বার বার। বিপন্ন মৌমাছির মত পতঙ্গরাও শেষ হচ্ছে, যারা পরাগ মিলন দিয়ে এই বাস্তুতন্ত্রকে সচল রাখে।

আমাদের কাছে ধূধূ বিস্তৃত ব্রাহ্মপুত্রের চরা নেই। তাই আমাদের করার কিছু নেই। কিন্তু বাড়ির পাশে ছোট্ট একটু জায়গা তো আছে। ছেঁড়া ন্যাকড়া, প্লাস্টিকের প্যাকেট, এঁটো পাতা, তরকারির খোসার স্তূপীকৃত দুর্গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে সেখানে। ওইটুকু জায়গায় তৈরি করা যায় ছোট অরণ্য।

শুভেন্দু সরকার জাপানে। টোয়োটা গাড়ির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। জাকিরা মিয়াওয়াকি নামে একজন বটানিস্ট, প্ল্যান্ট টেকনোলজিস্টের সঙ্গে তার আলাপ হয়। পতিত, অনাবাদী, ওয়েটল্যান্ডকে কীভাবে অরণ্যরূপ দেওয়া যায়, সামান্য ছোট জায়গার মধ্যে এটাই তাঁর গবেষণার বিষয়। নগরায়ণ, রেডিও অ্যাক্টিভিটি, দূষণ, অদ্ভুতভাবে ব্যালেন্স হয়। চলিত বা প্রচলিত প্রকৃতিনির্ভর পদ্ধতির বাইরে পছন্দমত গাছ রোপণ করে অনেক কম সময়ে, বাড়বাড়ন্ত জঙ্গল তৈরি করা সম্ভব। (ইউটিউবে সার্চ করলে ভিডিওটি দেখা যায়)। এতে আঞ্চলিক তাপমাত্রা অনেক কমে যায়। বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ে। ছ’টা টোয়োটা গাড়ি রাখার জায়গায় ৩০০ গাছ প্রস্তুত করে দেওয়া যায়। বিভিন্ন কারখানা সংলগ্ন জমিতে এই ধরনের জঙ্গল তৈরি করা যায়। তা যথেষ্ঠ গভীরও হয়। তবে এদেশে নির্জন জঙ্গল স্থান অচিরেই মদের ঠেক, খুন, অনৈতিক কাজের মোক্ষম আবাসস্থল হয়ে ওঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনা। ওয়েবসাইটে কীভাবে কম খরচে অল্প সময়ে স্তরে স্তরে জঙ্গল বানাতে হয়, তার ইনফরমেশন পরামর্শ পাওয়া যায়। শুভেন্দু বাড়ির পেছনে এদের মেথড অনুযায়ী গাছ লাগিয়েছিলেন, তিন বছরে তা ঘন জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।

সার্ভে ক্যাম্প থেকে ফিরবার পথে একদিন হ্রদের তীরের বনপথ দিয়ে আস্তে আস্তে আসছিলেন সত্যচরণ। বনের মধ্যে দেখেন একজন লোক মাটি খুঁড়ে কী যেন করছে। প্রথমে ভাবলেন, লোকটা ভুঁইকুমড়ো তুলতে এসেছেন, ঘোড়া থেকে নেমে কাছে গেলেন, দেখলেন ভুঁইকুমড়ো নয়, কিছু নয়, লোকটা কীসের যেন বীজ পুঁতে দিচ্ছেন।

কৌতুহল বাড়ল, বললেন, কী পুঁতছ ওখানে?

লোকটা বোধহয় গোপনে কাজটা করছিলেন। ধরা পড়ে লাজুক ও অপ্রভিত হয়ে গিয়েছেন এমন সুরে বলল, এই একটা গাছের বীজ…।

সত্যচরণ আশ্চর্য হয়েছিলেন। কী গাছের বীজ, ওর নিজের জমি নয়, এই ঘোর জঙ্গল, এর মাটিতে কী গাছের বীজ ছড়াচ্ছেন? তার সার্থকতাই বা কী?… লোকটা সম্পূর্ণ বিনা স্বার্থে বিস্তৃত বন্যভূমির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য সময় ও পয়সা ব্যয় করছেন। যে বনে তার ভূস্বত্ব কিছুই নেই। কী অদ্ভুত লোকটা।

সেই অদ্ভুত লোকগুলো কিন্তু দু-একজন আজও এই পৃথিবীতে বাস করেন।

Advertisement
চিত্রণ: নিশিতা নাথ

কচুরি

সাধু

কারখানা বিরিয়ানি

লিটল বুদ্ধ

বাংলা আওয়াজ

শেরপা

ঘুষ

জুতো

মাদারি কা খেল

সিঁড়ি

ইসবগুল

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × five =

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনচক্রের মহাকাব্য নবান্ন: শ্রম, প্রকৃতি ও নবজন্মের দ্বান্দ্বিকতা

নবান্ন। এটি কেবল একটি ঋতুভিত্তিক পার্বণ নয়; এটি সেই বৈদিক পূর্ব কাল থেকে ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় (যা প্রাচীন পুথি ও পাল আমলের লোক-আচারে চিত্রিত) এই সুবিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের ‘অন্নময় ব্রহ্মের’ প্রতি নিবেদিত এক গভীর নান্দনিক অর্ঘ্য, যেখানে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে শস্যের অধিষ্ঠাত্রী লোকদেবতার আহ্বানও লুকিয়ে থাকে। নবান্ন হল জীবন ও প্রকৃতির এক বিশাল মহাকাব্য, যা মানুষ, তার ধৈর্য, শ্রম এবং প্রকৃতির উদারতাকে এক মঞ্চে তুলে ধরে মানব-অস্তিত্বের শ্রম-মহিমা ঘোষণা করে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব বসু: কালে কালান্তরে

বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম অবদান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Literature) বিষয়টির প্রবর্তন। সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়-মানে এ বিষয়ে পড়ানোর সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তিনি যে বেশ কয়েকজন সার্থক আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরি করেছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বহু ধ্রুপদী রচনা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা অনুবাদসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অনুবাদকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব।

Read More »
দেবময় ঘোষ

দেবময় ঘোষের ছোটগল্প

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

Read More »
সব্যসাচী সরকার

তালিবানি কবিতাগুচ্ছ

তালিবান। জঙ্গিগোষ্ঠী বলেই দুনিয়াজোড়া ডাক। আফগানিস্তানের ঊষর মরুভূমি, সশস্ত্র যোদ্ধা চলেছে হননের উদ্দেশ্যে। মানে, স্বাধীন হতে… দিনান্তে তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। ২০১২ সালে লন্ডনের প্রকাশনা C. Hurst & Co Publishers Ltd প্রথম সংকলন প্রকাশ করে ‘Poetry of the Taliban’। সেই সম্ভার থেকে নির্বাচিত তিনটি কবিতার অনুবাদ।

Read More »
নিখিল চিত্রকর

নিখিল চিত্রকরের কবিতাগুচ্ছ

দূর পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে/ বসে আছে একটুকরো মেঘ। বৈরাগী প্রজাপতি।/ সন্ন্যাস-মৌনতা ভেঙে যে পাহাড় একদিন/ অশ্রাব্য-মুখর হবে, ছল-কোলাহলে ভেসে যাবে তার/ ভার্জিন-ফুলগোছা, হয়তো বা কোনও খরস্রোতা/ শুকিয়ে শুকিয়ে হবে কাঠ,/ অনভিপ্রেত প্রত্যয়-অসদ্গতি!

Read More »
শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »