Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

বালি ও ফেনা

কাহলিল জিব্রান

ভাষান্তর: অনিন্দিতা মণ্ডল

এই বেলাভূমি ধরে অনন্তকাল হেঁটে চলেছি। বালি ও ফেনার মধ্যবর্তী পথ। ঢেউ এসে আমার পায়ের চিহ্ন মুছে দিয়ে যাচ্ছে, বাতাস এসে উড়িয়ে নিচ্ছে ফেনা। কিন্তু সাগর ও বেলাভূমি অপরিবর্তনীয়, শাশ্বত।

একবার কুয়াশা ভরে নিয়েছিলাম মুঠোয়। হাত খুলে দেখি, ওমা! কুয়াশা তো একটি কীট! মুঠো বন্ধ করে আবার খুললাম, এবার খোলা মুঠোয় একটা পাখি। আবারও মুঠো করা হাত খুললাম, দেখলাম বিষণ্ন এক মানুষ ঊর্ধ্বপানে চেয়ে। বন্ধ করলাম মুঠো, আর এবারে খোলা মুঠোয় কুয়াশা ছাড়া কিছু ছিল না। কিন্তু তার মধ্যে থেকে এক অপূর্ব মধুর সঙ্গীত শুনতে পেলাম।

মাত্র গতকাল আমি নিজেকে খণ্ডিত মনে করেছিলাম। এই জীবনচক্রে যেন ছন্দহীন কেঁপে চলেছি। কিন্তু আজ জেনেছি যে, আমিই জীবনচক্র। আমার মধ্যেই ছন্দবদ্ধ সকল প্রাণের স্পন্দন।

তারা যখন জেগে, তারা বলেছিল— তুমি আর যে বিশ্বে তোমার যাপন, তা আসলে অনাদি সাগরের অনন্ত বেলাভূমির এক কণা বালি। আমি স্বপ্নে তাদের বললাম— আমিই সেই অকূল সাগর এবং সমগ্র বিশ্ব আমারই বেলাভূমির বালুকণা।

একবার মাত্র আমি মূক হয়ে গিয়েছিলাম, যেদিন একজন আমাকে প্রশ্ন করেছিল— তুমি কে?

ঈশ্বরের প্রথম চিন্তা, দেবদূত। ঈশ্বরের প্রথম ধ্বনি, মানুষ।

হাজার হাজার বছর আগে, অরণ্যের বাতাস ও সাগর যতদিন না আমাদের ‘বাক’ দিয়েছে, আমরা বেপথু তৃষ্ণার্ত ও দিশাহারা ছিলাম।

স্ফিংস একবারই কথা বলেছিল। সে বলেছিল, একটি বালুকণাই প্রকৃত প্রস্তাবে মরুভূমি। আর মরুভূমি আসলে একটি বালুকণাই। এবার এসো আমরা নিঃশব্দ হই। আমি স্ফিংসের কথা শুনেছি কিন্তু বুঝিনি।

একবার এক নারীকে দেখেছিলাম। তার মুখের দিকে চেয়ে তার সমস্ত ভাবী সন্তানদের দেখতে পেয়েছিলাম। আর একবার, এক নারী আমাকে দেখেছিল। সে আমার মুখের দিকে চেয়ে তার জন্মের পূর্বেই মৃত আমার সব পূর্বপুরুষকে দেখেছিল।

১০

আমি পূর্ণ হতে চাই। কিন্তু তার আগে আমি বুদ্ধিমান প্রাণীর বিচরণক্ষেত্র একটি গ্রহ হতে চাই। এইই কি মানুষের একমাত্র লক্ষ নয়?

১১

একটি বালুকণাকে ঘিরে বেদনার নির্মাণ হল মুক্তো। কোন সে আকাঙ্ক্ষা যা আমাদের দেহকে নির্মাণ করেছে? আর কোন কণাকে কেন্দ্র করেই বা এই দেহনির্মাণ?

১২

আমি যেন একটি ঢিলের মত নিক্ষিপ্ত হলাম। ঈশ্বর আমাকে এক আশ্চর্য সরোবরে নিক্ষেপ করলেন। আমি প্রচুর তরঙ্গ তুললাম। তারপর দীঘির অতলে পৌঁছে আমি স্থির হয়ে গেলাম।

১৩

আমাকে নৈঃশব্দ্য দাও, আমি রাত্রিকে জয় করব।

১৪

যখন আমার দেহ ও আত্মা পরস্পরকে ভালবাসবে, তাদের মিলন হবে, তখন আমার পুনর্জন্ম হবে।

১৫

আমি একজনকে জানতাম যাঁর শ্রবণশক্তি প্রখর ছিল, কিন্তু তিনি বোবা। যুদ্ধে তাঁর জিভ কাটা পড়েছিল। এখন আমি জানি কী সেই যুদ্ধ, যাতে এই নিস্তব্ধতা আসে। আমি খুশি যে তিনি মৃত। পৃথিবী আমাদের দুজনের থাকবার মত যথেষ্ট বড় নয়।

১৬

অনেক আগে আমি মিশরের ধুলায় পড়ে ছিলাম। কত শত ঋতু আমার শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে। তারপর সূর্য আমাকে জন্ম দিল। আমি উঠে দাঁড়ালাম আর নীলনদের তীরে চলতে শুরু করলাম। আমি দিনের বেলা গান গাইতাম আর রাতে স্বপ্ন দেখতাম। আমি যাতে আবার মিশরের ধুলায় মিশিয়ে যাই, তাই এখন সূর্য তার হাজার পা নিয়ে আমার ওপর চলে।

দাঁড়াও, এই ধন্দ ও যাদুটিকে জানি। যে সূর্য আমায় প্রাণ দিয়েছে, তা আমায় ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারে না। এখনও আমি সিধে দাঁড়িয়ে আছি। এখনও নীলের তীর ধরে হেঁটে যাব গভীর প্রত্যয়ে।

১৭

স্মৃতিচারণ এক প্রকার সাক্ষাৎ।

১৮

বিস্মরণ স্বাধীনতা।

১৯

আমরা অনন্ত সূর্যের চলাচল থেকে কালনির্ণয় করি। ওরা ওদের পকেটে রাখা ছোট্ট যন্ত্রটি থেকে কাল মাপে। তাহলে কী করে আমরা একই স্থানে পরস্পরের দেখা পেতে পারি?

২০

যে ছায়াপথের বাতায়ন থেকে নীচে তাকায় তার কাছে পৃথিবী আর সূর্যের মধ্যে তো কোনও দূরত্বই নেই!

২১

মানুষ হল একটি আলোর নদী যা সীমা থেকে অসীমে ছুটে চলেছে।

>>> ক্রমশ >>>
চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়

***

লেখক পরিচিতি

কাহলিল জিব্রান (Kahlil Gibran) একজন লেবানিজ-আমেরিকান কবি, শিল্পী ও দার্শনিক। ১৮৮৩ সালে লেবাননে জন্ম। বাল্য কেটেছে জন্মভূমিতে। আমেরিকার বোস্টনে আসেন কৈশোরে। আবার লেবাননে শিক্ষালাভ করতে যান। তাঁর দর্শনে মধ্যপ্রাচ্যের সুফী ভাবধারার স্পষ্ট ছাপ। সুফী মরমিয়াদের মতই তাঁর দর্শনে বালির ধারা যেন প্রাণের ধারা। প্রাচ্য দর্শনের মধ্যে ইসলামের একেশ্বরবাদের সঙ্গে ঔপনিষদিক দর্শনের প্রভাবও দেখতে পাওয়া যায়। তিনি আরবি ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই লিখেছেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘দ্য প্রফেট’ প্রকাশ হয় ১৯২৩ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রকাশিত এই লেখাটির মধ্যে প্রচলিত পাশ্চাত্য দর্শনের বিপ্রতীপ একটি কণ্ঠস্বর শোনা গিয়েছিল। প্রফেটের সমগোত্রীয় লেখা ‘স্যান্ড অ্যান্ড ফোম’। দর্শনকাব্য বলা চলে। পুস্তকের অলংকরণ তাঁর নিজের করা। এটি ১৯২৬ সালে প্রকাশিত।

আরও পড়ুন…

বালি ও ফেনা: দ্বিতীয় কিস্তি

বালি ও ফেনা: তৃতীয় কিস্তি

বালি ও ফেনা: চতুর্থ কিস্তি

বালি ও ফেনা: পঞ্চম কিস্তি

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
মোহাম্মদ কাজী মামুন
মোহাম্মদ কাজী মামুন
2 years ago

সব কটিই সুন্দর। তবে সব থেকে বেশী নাড়া দিয়ে গেছে ১৮, ১৯ আর ২০। খুব সুন্দর অনুবাদ। লেখিকাকে অনেক ধন্যবাদ কহলিল জিব্রানের স্যান্ড এন্ড ফোমকে তুলে ধরার জন্য এত সুন্দর করে।

Rajdip Bhattacherjee
Rajdip Bhattacherjee
2 years ago

চমৎকার অনুবাদ। সাবলীল।

পৃথা চট্টোপাধ্যায়
পৃথা চট্টোপাধ্যায়
2 years ago

খুব সুন্দর অনুবাদ। পড়ে মনে হলো আপনারই লেখা যেন।

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

যত মত তত পথ

বহুদিক দিয়েই একজন স্বতন্ত্র মননের ধর্মীয় সাধক। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ধারণাতীত, আর তা কেবল তাঁর স্বদেশ বা এই উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিনের পর দিন তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ভাব-আন্দোলন, তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের নিয়ে নিয়ত চর্চা ও গবেষণা হয়ে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী দুশোর ওপর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যাবলি প্রমাণ করে (প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে), আজকের এই অশান্ত বিশ্বে তাঁরা মানুষের কতখানি আশ্রয়।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »