কাহলিল জিব্রান
ভাষান্তর: অনিন্দিতা মণ্ডল
১
এই বেলাভূমি ধরে অনন্তকাল হেঁটে চলেছি। বালি ও ফেনার মধ্যবর্তী পথ। ঢেউ এসে আমার পায়ের চিহ্ন মুছে দিয়ে যাচ্ছে, বাতাস এসে উড়িয়ে নিচ্ছে ফেনা। কিন্তু সাগর ও বেলাভূমি অপরিবর্তনীয়, শাশ্বত।
২
একবার কুয়াশা ভরে নিয়েছিলাম মুঠোয়। হাত খুলে দেখি, ওমা! কুয়াশা তো একটি কীট! মুঠো বন্ধ করে আবার খুললাম, এবার খোলা মুঠোয় একটা পাখি। আবারও মুঠো করা হাত খুললাম, দেখলাম বিষণ্ন এক মানুষ ঊর্ধ্বপানে চেয়ে। বন্ধ করলাম মুঠো, আর এবারে খোলা মুঠোয় কুয়াশা ছাড়া কিছু ছিল না। কিন্তু তার মধ্যে থেকে এক অপূর্ব মধুর সঙ্গীত শুনতে পেলাম।
৩
মাত্র গতকাল আমি নিজেকে খণ্ডিত মনে করেছিলাম। এই জীবনচক্রে যেন ছন্দহীন কেঁপে চলেছি। কিন্তু আজ জেনেছি যে, আমিই জীবনচক্র। আমার মধ্যেই ছন্দবদ্ধ সকল প্রাণের স্পন্দন।
৪
তারা যখন জেগে, তারা বলেছিল— তুমি আর যে বিশ্বে তোমার যাপন, তা আসলে অনাদি সাগরের অনন্ত বেলাভূমির এক কণা বালি। আমি স্বপ্নে তাদের বললাম— আমিই সেই অকূল সাগর এবং সমগ্র বিশ্ব আমারই বেলাভূমির বালুকণা।
৫
একবার মাত্র আমি মূক হয়ে গিয়েছিলাম, যেদিন একজন আমাকে প্রশ্ন করেছিল— তুমি কে?
৬
ঈশ্বরের প্রথম চিন্তা, দেবদূত। ঈশ্বরের প্রথম ধ্বনি, মানুষ।
৭
হাজার হাজার বছর আগে, অরণ্যের বাতাস ও সাগর যতদিন না আমাদের ‘বাক’ দিয়েছে, আমরা বেপথু তৃষ্ণার্ত ও দিশাহারা ছিলাম।
৮
স্ফিংস একবারই কথা বলেছিল। সে বলেছিল, একটি বালুকণাই প্রকৃত প্রস্তাবে মরুভূমি। আর মরুভূমি আসলে একটি বালুকণাই। এবার এসো আমরা নিঃশব্দ হই। আমি স্ফিংসের কথা শুনেছি কিন্তু বুঝিনি।
৯
একবার এক নারীকে দেখেছিলাম। তার মুখের দিকে চেয়ে তার সমস্ত ভাবী সন্তানদের দেখতে পেয়েছিলাম। আর একবার, এক নারী আমাকে দেখেছিল। সে আমার মুখের দিকে চেয়ে তার জন্মের পূর্বেই মৃত আমার সব পূর্বপুরুষকে দেখেছিল।
১০
আমি পূর্ণ হতে চাই। কিন্তু তার আগে আমি বুদ্ধিমান প্রাণীর বিচরণক্ষেত্র একটি গ্রহ হতে চাই। এইই কি মানুষের একমাত্র লক্ষ নয়?
১১
একটি বালুকণাকে ঘিরে বেদনার নির্মাণ হল মুক্তো। কোন সে আকাঙ্ক্ষা যা আমাদের দেহকে নির্মাণ করেছে? আর কোন কণাকে কেন্দ্র করেই বা এই দেহনির্মাণ?
১২
আমি যেন একটি ঢিলের মত নিক্ষিপ্ত হলাম। ঈশ্বর আমাকে এক আশ্চর্য সরোবরে নিক্ষেপ করলেন। আমি প্রচুর তরঙ্গ তুললাম। তারপর দীঘির অতলে পৌঁছে আমি স্থির হয়ে গেলাম।
১৩
আমাকে নৈঃশব্দ্য দাও, আমি রাত্রিকে জয় করব।
১৪
যখন আমার দেহ ও আত্মা পরস্পরকে ভালবাসবে, তাদের মিলন হবে, তখন আমার পুনর্জন্ম হবে।
১৫
আমি একজনকে জানতাম যাঁর শ্রবণশক্তি প্রখর ছিল, কিন্তু তিনি বোবা। যুদ্ধে তাঁর জিভ কাটা পড়েছিল। এখন আমি জানি কী সেই যুদ্ধ, যাতে এই নিস্তব্ধতা আসে। আমি খুশি যে তিনি মৃত। পৃথিবী আমাদের দুজনের থাকবার মত যথেষ্ট বড় নয়।
১৬
অনেক আগে আমি মিশরের ধুলায় পড়ে ছিলাম। কত শত ঋতু আমার শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে। তারপর সূর্য আমাকে জন্ম দিল। আমি উঠে দাঁড়ালাম আর নীলনদের তীরে চলতে শুরু করলাম। আমি দিনের বেলা গান গাইতাম আর রাতে স্বপ্ন দেখতাম। আমি যাতে আবার মিশরের ধুলায় মিশিয়ে যাই, তাই এখন সূর্য তার হাজার পা নিয়ে আমার ওপর চলে।
দাঁড়াও, এই ধন্দ ও যাদুটিকে জানি। যে সূর্য আমায় প্রাণ দিয়েছে, তা আমায় ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারে না। এখনও আমি সিধে দাঁড়িয়ে আছি। এখনও নীলের তীর ধরে হেঁটে যাব গভীর প্রত্যয়ে।
১৭
স্মৃতিচারণ এক প্রকার সাক্ষাৎ।
১৮
বিস্মরণ স্বাধীনতা।
১৯
আমরা অনন্ত সূর্যের চলাচল থেকে কালনির্ণয় করি। ওরা ওদের পকেটে রাখা ছোট্ট যন্ত্রটি থেকে কাল মাপে। তাহলে কী করে আমরা একই স্থানে পরস্পরের দেখা পেতে পারি?
২০
যে ছায়াপথের বাতায়ন থেকে নীচে তাকায় তার কাছে পৃথিবী আর সূর্যের মধ্যে তো কোনও দূরত্বই নেই!
২১
মানুষ হল একটি আলোর নদী যা সীমা থেকে অসীমে ছুটে চলেছে।
>>> ক্রমশ >>>
চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
***
লেখক পরিচিতি
কাহলিল জিব্রান (Kahlil Gibran) একজন লেবানিজ-আমেরিকান কবি, শিল্পী ও দার্শনিক। ১৮৮৩ সালে লেবাননে জন্ম। বাল্য কেটেছে জন্মভূমিতে। আমেরিকার বোস্টনে আসেন কৈশোরে। আবার লেবাননে শিক্ষালাভ করতে যান। তাঁর দর্শনে মধ্যপ্রাচ্যের সুফী ভাবধারার স্পষ্ট ছাপ। সুফী মরমিয়াদের মতই তাঁর দর্শনে বালির ধারা যেন প্রাণের ধারা। প্রাচ্য দর্শনের মধ্যে ইসলামের একেশ্বরবাদের সঙ্গে ঔপনিষদিক দর্শনের প্রভাবও দেখতে পাওয়া যায়। তিনি আরবি ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই লিখেছেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘দ্য প্রফেট’ প্রকাশ হয় ১৯২৩ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রকাশিত এই লেখাটির মধ্যে প্রচলিত পাশ্চাত্য দর্শনের বিপ্রতীপ একটি কণ্ঠস্বর শোনা গিয়েছিল। প্রফেটের সমগোত্রীয় লেখা ‘স্যান্ড অ্যান্ড ফোম’। দর্শনকাব্য বলা চলে। পুস্তকের অলংকরণ তাঁর নিজের করা। এটি ১৯২৬ সালে প্রকাশিত।
আরও পড়ুন…
সব কটিই সুন্দর। তবে সব থেকে বেশী নাড়া দিয়ে গেছে ১৮, ১৯ আর ২০। খুব সুন্দর অনুবাদ। লেখিকাকে অনেক ধন্যবাদ কহলিল জিব্রানের স্যান্ড এন্ড ফোমকে তুলে ধরার জন্য এত সুন্দর করে।
চমৎকার অনুবাদ। সাবলীল।
খুব সুন্দর অনুবাদ। পড়ে মনে হলো আপনারই লেখা যেন।