Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

বালি ও ফেনা: দ্বিতীয় কিস্তি

কাহলিল জিব্রান

ভাষান্তর: অনিন্দিতা মণ্ডল

২২

ইথার তরঙ্গে ভাসমান আত্মাগুলি কি মানুষী যন্ত্রণাকে হিংসে করে না?

২৩

পবিত্র নগরে যাওয়ার সময় আমি সহযাত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এইটিই নিশ্চয় পবিত্র নগরে যাওয়ার পথ? সে বলল— আমাকে অনুসরণ করো, একটি দিন ও রাতের মধ্যেই তুমি সেখানে পৌঁছে যাবে। আমি তাকে অনুসরণ করলাম। অনেক দিন ও রাত হেঁটে চলেও পবিত্র নগরে পৌঁছতে পারলাম না। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, আমাকে ভুল পথে চালিত করেছে বলে সে আমার ওপরে ভীষণ রেগে গেল।

২৪

হে ঈশ্বর, আমাকে সিংহের শিকারে পরিণত করো, আর খরগোসকে আমার শিকারে।

২৫

রাত্রিকে অতিক্রম না করে ভোরে পৌঁছনো যায় না।

২৬

ঘর বলল— আমাকে ছেড়ে যেয়ো না। এখানেই তোমার অতীত। পথ বলল— আমাকে অনুসরণ করো, আমি তোমার ভবিষ্যৎ। আমি ঘর ও পথকে বললাম, আমার কোনও অতীত নেই, ভবিষ্যৎও নেই। যদি ঘরে থেকে যাই তবে তার মধ্যে একটা যাত্রা থাকবে। আর যদি পথে নামি তবে তার মধ্যে একটা বসত থাকবে। শুধু ভালবাসা ও মৃত্যুতেই সব রূপান্তর।

২৭

যখন দেখি, পালকের বিছানায় শুয়ে যারা স্বপ্ন দেখে তাদের স্বপ্নের চেয়ে মাটিতে যারা শুয়ে থাকে তাদের স্বপ্ন কম সুন্দর নয়, তখন জীবনের বিচারের প্রতি আমার আস্থা দৃঢ় হয়।

২৮

আশ্চর্য! কিছু আনন্দ আমার বেদনার অংশ!

২৯

সাতবার আমি নিজের প্রতি বিরক্ত হয়েছি। প্রথমবার, যখন দেখেছি উচ্চতাকে ছুঁতে সে ভয় পেয়েছে। দ্বিতীয়বার, যখন সে পঙ্গুর সামনে খুঁড়িয়েছে। তৃতীয়বার, সে যখন সহজ ও কঠিনের মধ্যে সহজকে বেছেছে। চতুর্থবার, যখন সে একটি অন্যায় করে ভেবেছে, আহা, অন্যরাও তো করে। পঞ্চমবার সে যখন তার সহনক্ষমতাকে শক্তি বলেছে, দুর্বলতাকে স্বীকার করেনি। ষষ্ঠবার, যখন সে একটি কুৎসিত মুখকে ঘৃণা করেছে, আর জানতেও পারেনি এই মুখ আসলে তারই একটি মুখোশ। সপ্তমবার, একটি স্তাবক যখন বন্দনাগীত গাইছিল সে সেটিকে পুণ্য বলে উচ্চারণ করেছে।

৩০

পরমসত্য কী আমি জানি না। কিন্তু আমার অজ্ঞানতা সম্পর্কে আমি অবহিত। তাতেই আমার সম্মান ও প্রাপ্তি।

৩১

মানুষের কল্পনা ও অর্জনের মধ্যে একটি অবকাশ আছে। আকাঙ্ক্ষাই সেই অবকাশকে পার হতে পারে।

৩২

ওই দরজার ওপাশে স্বর্গ আছে। ঠিক পাশের ঘরেই। কিন্তু আমি চাবিটা হারিয়ে ফেলেছি। বা, হয়তো, চাবিটা ভুলেই গিয়েছি।

৩৩

তুমি অন্ধ, আর আমি মূক ও বধির। অতএব এসো আমরা হাত ধরি ও পরস্পরকে অনুভব করি।

৩৪

মানুষের অর্জনে কোনও মহত্ত্ব নেই। আছে তার অর্জনের আকাঙ্খায়।

৩৫

আমরা কেউ যেন কালি, কেউ বা কাগজ। আমাদের মধ্যে কালির কালো না থাকলে আমরা বোবা হয়ে যেতাম। আবার আমাদের মধ্যে সাদা না থাকলে আমরা অন্ধ হয়ে যেতাম।

৩৬

আমাকে শ্রুতি দাও আমি তোমাকে কণ্ঠস্বর দেব।

৩৭

আমাদের মন যেন শোষক, আর হৃদয় যেন স্রোত। এটা স্বাভাবিক যে আমরা স্রোতের মত ছুটে চলার চেয়ে শুষে নিতে পছন্দ করি।

৩৮

যখন তোমার আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও তুমি আশীর্বাদের নামটি জানো না, কিংবা দুঃখের কারণ যখন অজানা, ঠিক তখনই আসলে তুমি তোমার মহৎ সত্ত্বার দিকে ধাবিত হচ্ছ। প্রকৃত অর্থে যা কিছু বর্ধিত হচ্ছে, সেসবের সঙ্গে তুমিও বর্ধিত হচ্ছ।

৩৯

একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ছুটে যাওয়া যদি কারও নেশা হয় তবে তার ক্ষীণতম প্রকাশও উৎকৃষ্ট সুরার মতো।

৪০

তুমি মাতাল হবার জন্য সুরা পান করো। আমি অন্য মদে মাতাল না হতে চেয়ে সুরা পান করি।

৪১

শূন্য পাত্রকে আমি গ্রহণ করি। কিন্তু যখন তা অর্ধেক ভরা থাকে, তাকে আমি ঘৃণা করি।

৪২

একটি মানুষ যতটা বাহ্যত প্রকাশিত তা থেকে তাকে সম্পূর্ণ জানা যায় না। বরং, যা সে প্রকাশে অক্ষম তা থেকেই তাকে সঠিক জানা যায়। তাই, যদি তুমি তাকে চিনে থাকো, তবে সে যা বলে তা না শুনে, সে যা বলতে পারে না তাই শোনো।

>>> ক্রমশ >>>
চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়

***

লেখক পরিচিতি

কাহলিল জিব্রান (Kahlil Gibran) একজন লেবানিজ-আমেরিকান কবি, শিল্পী ও দার্শনিক। ১৮৮৩ সালে লেবাননে জন্ম। বাল্য কেটেছে জন্মভূমিতে। আমেরিকার বোস্টনে আসেন কৈশোরে। আবার লেবাননে শিক্ষালাভ করতে যান। তাঁর দর্শনে মধ্যপ্রাচ্যের সুফী ভাবধারার স্পষ্ট ছাপ। সুফী মরমিয়াদের মতই তাঁর দর্শনে বালির ধারা যেন প্রাণের ধারা। প্রাচ্য দর্শনের মধ্যে ইসলামের একেশ্বরবাদের সঙ্গে ঔপনিষদিক দর্শনের প্রভাবও দেখতে পাওয়া যায়। তিনি আরবি ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই লিখেছেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘দ্য প্রফেট’ প্রকাশ হয় ১৯২৩ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রকাশিত এই লেখাটির মধ্যে প্রচলিত পাশ্চাত্য দর্শনের বিপ্রতীপ একটি কণ্ঠস্বর শোনা গিয়েছিল। প্রফেটের সমগোত্রীয় লেখা ‘স্যান্ড অ্যান্ড ফোম’। দর্শনকাব্য বলা চলে। পুস্তকের অলংকরণ তাঁর নিজের করা। এটি ১৯২৬ সালে প্রকাশিত।

আরও পড়ুন…

বালি ও ফেনা প্রথম কিস্তি

বালি ও ফেনা: তৃতীয় কিস্তি

বালি ও ফেনা: চতুর্থ কিস্তি

বালি ও ফেনা: পঞ্চম কিস্তি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 × five =

Recent Posts

শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আমার স্মৃতিতে ঋত্বিককুমার ঘটক

দুটো‌ জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম তাঁর।‌ এক, তিনি কথা বলার সময় আত্মমগ্ন‌ থাকতেন। কারও দিকে‌ তাকিয়ে‌ কথা বলতেন না। তাকাতেন‌ হয় সুদূরে, আর নয়তো‌ চোখ বুজে‌ কথা বলতেন। আর দ্বিতীয় যা, তা হল‌ ঋত্বিকের চোখ। এত উজ্জ্বল আর‌ মরমী, এক-ই সঙ্গে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত আর লুব্ধক নক্ষত্রের মতো দীপ্ত, তা আর কারও মধ্যে দেখিনি। সত্যজিৎ-মৃণালের মধ্যেও না, যদিও ঘটনাচক্রে ওই দু’জনের সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছিল অনেক বেশি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঋত্বিক ঘটক ও বাংলাদেশ

ঋত্বিক ঘটকের জীবনের প্রথম বাইশ বছর (১৯২৫-১৯৪৭) কেটেছে মূলত পূর্ব-বাংলায়, যা এখনকার বাংলাদেশ। তাঁর জন্ম ঢাকার ২,ঋষিকেশ দাস রোডের ঝুলন বাড়িতে। ১৯৪৭, অর্থাৎ দেশভাগ ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত তিনি মূলত পূর্ব-বাংলায় কাটান। আমরা দেখব, পূর্ব-বাংলা যেমন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, সে-দেশ, সে-ভূমির প্রভাব তদনুরূপ ঋত্বিকেরও পড়েছিল তাঁর চলচ্চিত্রে।

Read More »
মণিকর্ণিকা রায়

অনুগল্প: অর্জন

অসহায় বৃদ্ধের খাওয়া হয়ে গেলে মাঝেমাঝে গল্পও করত ওঁর সাথে। আদিত্য লক্ষ্য করেছিল এই ব্যাপারটা যেন তার মনে একটা বদল আনছে— যেন রোজ তার শরীর-মন জুড়ে সঞ্চালিত হচ্ছে এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি। যেন সে সত্যিই মানুষ হয়ে উঠছে।

Read More »
মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনানন্দ দাশের সময়চেতনা: পুরাণ, প্রকৃতি ও আধুনিক নিঃসঙ্গতার নন্দনতত্ত্ব

পৌরাণিক, মনস্তাত্ত্বিক ও প্রকৃতিগত সময়চেতনা তাঁকে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে এক স্থায়ী ও ব্যতিক্রমী মহাকবির আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর শিল্পকর্ম আমাদের শেখায়— দ্রুত ধাবমান জীবনের বাইরে দাঁড়িয়ে ধীরে চলতে, নীরবতার গভীরে কান পাততে এবং প্রতিটি ক্ষণিকের মাঝে অনন্তের ইশারাকে খুঁজে পেতে। তাঁর সাহিত্য ভবিষ্যতের প্রতিটি সংবেদনশীল পাঠকের জন্য আধুনিকতার এক অমূল্য পাঠ হয়ে থাকবে, যা মানুষের জীবনকে শিল্প ও প্রকৃতির একাত্মতায় আবিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং প্রমাণ করে দেয়— কাব্যই চূড়ান্ত আশ্রয়, যখন সমস্ত পথ ফুরিয়ে যায়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

জীবনানন্দ: প্রয়াণদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

হেমন্তকাল ও জীবনানন্দ অভিন্ন, ওতপ্রোত ও পরস্পর পরিপূরক। তাঁর কবিতায় বারবার নানা অনুষঙ্গে, বিভঙ্গে ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে হেমন্তের বসতি যেন। ‘হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু/ শিশিরের জল’, ‘ধানক্ষেতে, মাঠে,/ জমিছে ধোঁয়াটে/ ধারালো কুয়াশা’! কুয়াশা আর শিশির, এই দুই অচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হেমন্তের, চিনিয়ে দেন তিনি। ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল’, হেমন্তকে বাহন করে এই যে প্রকৃতির অপরূপতা মেলে ধরা, তা অন্য কোন বাঙালি কবির আছে?

Read More »