জাতীয় নাট্যমঞ্চে বাংলার লোকনাট্যের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে— নানা সময়ে নানা জাতীয় স্তরের সমালোচকরা একথা প্রায় একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন। মালদা জেলার বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমান্তবর্তী মোথাবাড়ি, মানিকচক ও রতুয়া বিধানসভা কেন্দ্রের প্রান্তিক গ্রামগুলি একসময় লোকসংস্কৃতির বিচিত্র ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ ছিল। এখন সেখানে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে যায় হাওয়া। ইংরেজবাজার কেন্দ্রিক শহুরে নাট্যচর্চার প্রসার আর লোকঐতিহ্যের প্রতি ‘লোক’-্এর মনোযোগের অভাবে আজ হারিয়ে গিয়েছে লোকনাট্যের সমৃদ্ধ ঘরানা।

শহুরে প্রসেনিয়াম লাইট-সাউন্ড-অ্যাকশনের খবর রাখেন না ওঁরা— উল্টোটাও সমান সত্যি। দুর্বল শরীরে এখনও কেউ করেন গোরুর রাখোয়ালি, কেউ বা আবার মথুরাপুর হাটে মুদিখানার পসরা সাজিয়ে বসেন। অথচ তাঁদের নাটুয়া বা ডোমনি-গানে একসময় চমকে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গসহ রাজধানী দিল্লি। কলকাতার রবীন্দ্রসদন, হলদিয়ার রবীন্দ্রভবন থেকে শুরু করে দিল্লির ভারত রঙ্গ মহোৎসবে অভিনয় করে এসেছেন ওঁরা। বিশ্ব নাট্য দিবসে মালদার গুরুত্বপূর্ণ লোকনাট্য ডোমনি বা নাটুয়ার মতোই বিস্মৃতিই ঘিরে থাকল এই লোকনাট্যের দুই প্রবীণ শিল্পী অজিত ঘোষ ও সতীশ ঘোষকে।
৭৩ বছর বয়সেও ঢোল হাতে নাটুয়ার বোলে দর্শক-শ্রোতাকে মাতিয়ে রাখেন প্রবীণ লোকশিল্পী সতীশ ঘোষ। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, মথুরাপুর গোয়ালপাড়ার আদি বাসিন্দা সতীশ ঘোষই এই অবলুপ্তপ্রায় ধারার শেষ প্রতিনিধি।

লোকসংস্কৃতিবিদরা বলেন, মালদার মানিকচকের ফাগুয়া, নাটুয়া বা কর্মাধর্মা কার্যত অবলুপ্তপ্রায় লোক আঙ্গিক। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘আরণ্যক’-এ উল্লেখ আছে নাটুয়ার। সেখানে ৭৬ বছরের বৃদ্ধ নাটুয়া দশরথ ননীচোরা গোপালের ভূমিকায় অভিনয় করত পূর্ণিয়া আর ভাগলপুরের কাটনি মেলায়। বিহার-ঝাড়খণ্ড সীমান্তবর্তী মালদার মানিকচকের বাঁকিপুরে ৭৩ বছর বয়সি সতীশ ঘোষ এখনও মাতিয়ে দেন নাটুয়ার আসর। বয়সের ভারে এখন অবশ্য তিনি মথুরাপুর গোয়ালপাড়া নাটুয়া সংস্কৃতি মঞ্চ দলের মুখিয়ার ভূমিকায় থাকেন।
আচার্য বিনয়কুমার সরকার তাঁর ১৯১৭ সালে প্রকাশিত ‘ফোক এলিমেন্টস অফ হিন্দু কালচার’ নামের বহুখ্যাত গ্রন্থে ফাগুয়াকে আভীর বা গোয়ালাদের উৎসব হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। লোকসংস্কৃতিবিদরা বলেন, সাধারণভাবে ফাগুয়া নাট্যগীতি ঘোষ বা গোয়ালাদের বিবাহগীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। মানিকচক যেহেতু পূর্ণিয়া বা ভাগলপুর সীমান্ত সংলগ্ন, তাই সেখানে ফাগুয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লোকমাধ্যম। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বিবাহ করে গ্রাম পেরিয়ে যাওয়ার পথে সেই গ্রামের বাসিন্দাদের অনুরোধে নাটুয়া নাচ দেখানোর পর বরযাত্রীরা ফেরার পথ পেয়েছেন। আধুনিকতার আগ্রাসন এবং শিল্পীদের সরে যাওয়া এই লোকমাধ্যমকে প্রায় শেষ করে দিয়েছে।

মানিকচক স্ট্যান্ড সংলগ্ন ছোট্ট মুদিখানার দোকানেই দিন কেটে যায় ষাটোর্ধ্ব অজিত ঘোষের। প্রায় তিন দশক ধরে ডোমনি-গানের সঙ্গে যুক্ত এই বর্ষীয়ান লোকশিল্পীর নাট্যগুরু ছিলেন মানিকচকের কিংবদন্তি বাম জননেতা ও বিধায়ক সুবোধ চৌধুরী। সুবোধ চৌধুরীকে বাংলা সাহিত্যে অমর করে রেখেছেন রবীন্দ্র পুরস্কার জয়ী ঔপন্যাসিক অভিজিৎ সেন। ২০০৬-এ প্রকাশিত তাঁর স্বল্প আলোচিত উপন্যাস ‘নিম্নগতির নদী’-র নায়ক তিনিই। এখনও মানিকচকের প্রচুর মানুষের কাছে তিনি গল্পকথার ‘এমলে সাব’। বাম সরকারের পরিবহণ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী থাকার সময় ১৯৯৫-৯৬ সালে মূলত সুবোধবাবুর উদ্যোগে যাত্রা শুরু করে পশ্চিমবঙ্গ লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গব্যাপী ছড়িয়ে থাকা লোকসংস্কৃতির মাধ্যমগুলিকে একছাতার তলায় নেওয়ার ব্যাপারে যাঁরা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। মনে রাখতে হবে, এখান থেকেই প্রকাশিত লোকসংস্কৃতি গ্রন্থমালা সিরিজে ডোমনি বিষয়ক বইটির লেখক সুবোধ চৌধুরী স্বয়ং। সীমান্ত বাংলার লোকসংস্কৃতির পরবর্তী প্রজন্মের গবেষক ড. দেবশ্রী পালিত বা ড. দীপাঞ্জনা শর্মা একবাক্যে স্বীকার করেন— এই ছোট্ট বইটি এখনও অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমান্ত অঞ্চলের কথ্য দ্বারভঙ্গিয়া খোট্টা, চাঁই খোট্টা বা শেরশাবাদিয়া খোট্টায় রচিত এই ডোমনির কোনও লিখিত স্ক্রিপ্ট থাকে না। আসরের প্রয়োজনে সাধারণভাবে বন্দনাগান দিয়ে আরম্ভ করে দর্শকের চাহিদা অনুসারে বিভিন্ন রকম বিষয়কেন্দ্রিক ভাবনা সেখানে নাট্যগীতির মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়। এই অঞ্চলের ডোমনি নিয়ে বেশ কিছু ডিজিটাল ডকুমেন্ট তৈরি করেছিলেন গবেষক সৌমেন্দু রায় এবং অর্ঘ্য চট্টোপাধ্যায়। সেখানে দেখা গিয়েছিল— এই ২০২৩-এও ডোমনিতে নারীর ভূমিকায় অভিনয় করেন পুরুষরা। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের আলকাপকে কেন্দ্র করে লিখিত অসামান্য উপন্যাস ‘মায়া মৃদঙ্গ’-র সেই ছোকরা-ছুকরিদের মতো এখানেও কোথাও যেন জীবন আর অভিনয় মিলেমিশে এক হয়ে যায়।

১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর অযোধ্যায় গিয়েছিল ভারতীয় গণনাট্য সংঘের একটি শাখা। সুবোধবাবুর হাতেগড়া ডোমনি দল মানিকচক লৌকিক সৃজনীর সঙ্গে অজিত ঘোষও সঙ্গী ছিলেন সেই ঐতিহাসিক যাত্রার। অযোধ্যায় সম্প্রীতির প্রচারে ডোমনি-গান বেঁধে পরিবেশন করেছিলেন তাঁরা। পঁচানব্বইয়ে সিকিমে লোকসংস্কৃতি উৎসব থেকে হলদিয়া লোকসংস্কৃতি উৎসব— রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে এই লোকমাধ্যমকে তুলে ধরার অন্যতম কুশীলব আজ অনেকটা সরে এসেছেন প্রিয় এই শিল্প থেকে। তবে জীবনের জমা-খরচ মেলাতে মেলাতে দোকানের জমা-খরচ মেলানোটাও কখন মিশে গেছে রক্তে, তার খবর রাখে না কেউ। এই বিশেষ দিনগুলোতে শহরের নাট্যজগতের কেউ কোনও দিনও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, একথা অতি বড় স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না তিনি। বরং ডোমনি বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবে— এই বিশ্বাসটুকুই সম্বল রেখেই তিনি আজও পাল্লায় বাটখারা চাপান।
বিভূতিভূষণ এবং বনফুলের লেখাতে আছে পূর্ণিয়া এবং ভাগলপুরের বিখ্যাত নাটুয়া গায়ক ধাতুরিয়ার কথা। মার্চ মাসে সরষে কাটার পর পূর্ণিয়া, ভাগলপুর এবং মালদার কিছু কিছু অংশে যে কাটনি মেলা বসত, সেই অঞ্চলগুলিতে ঘুরে ঘুরে নাটুয়া পরিবেশন করে বেড়াত ধাতুরিয়া। মূলত শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলাকে অবলম্বন করে কিশোরী রাধিকার মান-অভিমান অসম্ভব সুরেলা গলায় পরিবেশন এই বালক শিল্পীকে কিংবদন্তির মর্যাদা দিয়েছিল। ‘আরণ্যক’ উপন্যাসেও একাধিকবার এসেছে এই বালক লোকশিল্পীর কথা।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে অধ্যাপক সিলেবাস মেপে পড়ান জয় গোস্বামীর ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’। ছাত্রছাত্রীরা এই কবিতার নোট বানায় ‘বেণীমাধব বেণীমাধব’ নামে। বেণীমাধব শব্দের অর্থ যে ঝুঁটিবাঁধা শিশু-কৃষ্ণ; সেই ব্যঞ্জনা লোপামুদ্রার শাণিত গলায় কোথায় যেন হারিয়ে যায়। আসলে, সময়ই হয়তো ছুটি দিয়ে দেয় অসময়কে— শুরু হয় অন্য এক সময়। বহু যুগের ওপার হতে অজিত ঘোষ বা সতীশ ঘোষের স্মৃতিতে ভর করে ভেসে আসে বেণীমাধবের ভূমিকায় অভিনয়রত ধাতুরিয়ার সুরেলা কণ্ঠ। আন্তর্জাতিক নাট্য দিবসের প্রসেনিয়াম যে ‘মেঠো সুর’-কে (উল্লেখ্য, সুবোধ চৌধুরী সম্পাদিত পত্রিকার নাম ‘মেঠোসুর’) কোনওদিন ঢেকে দিতে পারেনি, পারবেও না, আকাশজুড়ে বাজতে থাকবে— ‘রাজা লিজিয়ে সেলাম ম্যায় পরদেশিয়া…’।