আয়নায় কালেভদ্রে মনোযোগ দিয়ে তাকানোর সময় মেলে ঝিনুকের।
দুদিন আগে কেনা ডেনিম ট্রাউজার আর ছোট ঝালর হাতার কালো টপটায় নিজেকে দেখতে বেশ লাগছে। গভীর ভি নেকলাইনের কারণে পিঠের অনেকটাই অনাবৃত, একটু পেছন ফিরে ফিতেটা ঠিকঠাক বাঁধা হয়েছে কিনা, দেখে নিল ও। এখনও সাইজ এইট টপ্, অবাক লাগে, আবার ভালও লাগে। শরীরটার তো যত্নই নেওয়া হয় না ঠিকমত, কালে কালে কম বেলা হয়নি অথচ তলপেটের চামড়ায় মাতৃত্বের প্রমাণ ওই সূক্ষ্ম শিরার মতো দাগগুলো ছাড়া আর তেমন কোনও বাহ্যিক পরিবর্তন আসেনি ঝিনুকের শরীরে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় নিজের লম্বা মূর্তিমান ছায়া, সূর্যের আলোতে চকচক করা গাঢ় বাদামি ত্বক আর কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা কুচকুচে কালো প্যাঁচানো সর্পিল চুল, এই পুরো শরীর, তার ভিতর-বাহির জুড়ে যে মন, তার সবকিছু এখন সে প্রতিদিন একটু করে ভালবাসে। কী অদ্ভুত ব্যাপারগুলো! আগে অসুন্দর, কালো ইত্যাদি ভাবত ও নিজেকে। কিন্তু ল্যাবে একবার এক পুঁচকে গ্রিক ছোকড়ার একটা কমপ্লিমেন্ট ঝিনুকের রূপ-সৌন্দর্য বিষয়ক চিন্তাভাবনার আগাপাশতলা নাড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে নিজেকে আর দেখতে খারাপ তো লাগেই না বরং আয়নায় তাকিয়ে অবাক লাগে, ভালবাসা জন্মায়।
সেই ছোকড়া, কাইরোস না কাইরাকোস কী যেন নাম ছিল তার, চিরায়ত ভূমধ্যসাগরীয় পুরুষের মত দেখতে না হলেও চোখদুটো তার ছিল এজিয়ান সমুদ্রের মত গাঢ় নীল। ঘুরপথে পথহারা কোনও কবিটবি নয়ত সে? জীবনের পথ মাড়াতে গিয়ে হয়ত একটু বিজ্ঞান গবেষণায় উঁকি দিতে এসেছে? ঝিনুককে সে বলে কিনা— তোমাকে দেখতে একদম এক্সোটিক দেবীর মতো, একথা বলার জন্য তিন দিন থেকে সুযোগ খুঁজছি, আই লাইক অল অ্যাবাউট ইউ, স্পেশ্যালি দোজ স্পাইরাল ব্ল্যাক হেয়ার… তোমাকে জাম্পস্যুট ফাটাফাটি মানায়, মনে হয় সব জাম্পস্যুট তোমাকে উদ্দেশ্য করেই বানানো।
হা হয়ে গেছে ঝিনুক, এই ছেলে বলে কী! কান ঝাঁঝাঁ করছিল, ঘন হয়ে এসেছিল নিশ্বাস। বুকের মৃদু ধড়ফড়ানি আর ঘন নিশ্বাস সামলে, লম্বা একটা চোরা শ্বাস টেনে মুখে শুধু মাপামাপা হাসি ফুটিয়ে ঝিনুক বলেছে— ওহ, অনেক ধন্যবাদ, তোমার এই প্রশংসা আমি মনে রাখব। ছোঁড়া ফ্লার্ট করল কি না এইসব অ্যানালাইসিসে যায়নি ঝিনুক, ভাল মন্তব্য ভাল মনে গ্রহণ করেছে, মনেও রেখেছে। তারপর থেকে যতবারই নিজেকে সুন্দর মনে হয়, ততবারই সেই গ্রিক ছেলেটাকে মনে মনে ধন্যবাদ দেয় ও। কখনও সখনও সোলেমান চাচার মুখে শোনা দু-একটা কলিও এলোমেলোভাবে মনে পড়ে ঝিনুকের— ভবের লাগি দোহাই দিয়া নিজও হইলাম পর, কার মুখেতে নিজের কথা শোনাইলে অন্তর, কোন দ্যাশেতে গেইলে বলো ভবে ধরা দ্যায়… যেই দ্যাশেতে গেইলে তুমি চিনিবে তোমায়…
রবিবারের দুপুর। রোদে জ্বলজ্বল করছে রিচমন্ড পার্ক। বাতাস খানিকটা উষ্ণ। আর সারাক্ষণ ঘুগরি পোকার একটানা কোরাস তো আছেই; দীর্ঘদিন পর মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে ঘুগরির দল যেন হামলে পড়েছে সঙ্গীর খোঁজে। থেকে থেকে ভেসে আসা লেমন ইউক্যালিপটাসের সতেজ ঘ্রাণটুকুই যা একটু শীতলতা জাগায় এই মৌসুমে। একটা ওক গাছের সুন্দর ছায়ায় ফাঁকা বেঞ্চ খুঁজে নিয়েছে ঝিনুক। গাড়িঘোড়ার শব্দ এড়ানোর জন্য কানে হেডফোন গুঁজে নিয়ে সেপিয়েন্স বইটাতে মন দিয়েছে। ভ্রু কুঁচকে একটা ছবির দিকে তাকিয়ে আছে ও, সাউথ আফ্রিকার একটা সমুদ্রসৈকতের একটা সাইনবোর্ড, যেখানে অ্যাপার্টাইড দশকগুলোতে নাকি…
এমন সময় ফোন আসল।
এইমুহূর্তে শুধু যে দুইজন মানুষের ফোন ধরবে ঝিনুক, তাদের একজন ফোন করেছে।
—হ্যাঁ… মা, কালকে কখন বাসায় ফিরলা? কালকে কল দিলাম নো আন্সার, সকালে দেখি মেসেজও সিন করোনাই, চিন্তা করতেছিলাম…
—হ্যাঁ রে মা, কালকে তো পনের ঘণ্টা লাগল ঢাকা থেকি লালমণিরহাট আসতে, তোর ওখানে তখন অনেক রাত এইজন্য আর মেসেজও দেই নাই। কত ঘটনা যে ঘটল, আমি তো সারা রাস্তা লা হাওলা ওয়ালা কুউয়াতা পড়তে পড়তে আসলাম।
—কেন! কী হইসে?
—আরে… শনির দশা শনির দশা, এমনিই কী আমি শনিবারে বের হইতে নিষেধ করি… শোন কী হইল, বাস তো সামনের ট্রাকের সাথে দুইবার ধাক্কা খাইতে খাইতে বাঁচল, আমি মনে করলাম এই গেলাম মনে হয় এই শেষ…
—বলো কী!
—হ্যাঁ, আরে শোন না, শেষে আরেকটা ঘটনা ঘটল, বিকট শব্দ, কী হইল কী হইল, আমাদের পাশের সারির সিটের পাশের জানলায় আসি লাগল বড় একটা ঢিল, কাচ ভাঙ্গি চুরমার…
—হায় হায় বলো কী?
—আর দ্যাখ আল্লাহর কী কাম, বাসে তার একটু আগে উঠছে দুইটা পুলিশ, মনে হয় ডিউটি শেষ করি বাড়ি যায়, ঢিল পড়ার সাথে সাথে ড্রাইভার বাস থামাইল, পুলিশ দুইটা হুড়মুড় করি বের হয়া গেল। শয়তানটাক ধরছে শেষ পর্যন্ত পুলিশগুলা। দুইটা রিকশাআলা আগে থেকি দেখিয়ায় শয়তানটাক আটকাইছিল, তো সাথে সাথে তো পুলিশগুলা গেল, পরে দেখি পুলিশগুলা ধরল শয়তানটাক, মানুষ তো এখন খুবে সজাগ এই বিকারগ্রস্তগুলাকে ধরার জন্য, চট্টগ্রামে একটা ছেলে মারা গেল না একবার… তারপর থেকি…
—ইশ, কী একটা অবস্থা…
—শোন ঘটনা, ওই সিটে বসছিল মাঝবয়সী একটা লোক আর তার মেয়ে, জানলার ধারে বসছিল মেয়েটা, ওই যে বড় হেডফোনগুলা থাকে না? মেয়েটার কানে ওইরকম একটা বড় হেডফোন ছিল, আর দ্যাখ, রাখে আল্লাহ মারে কে, ওই হেডফোনের উপর দিয়া গেছে, মেয়েটার মাথায় লাগে নাই, কাচ ভাঙ্গি পড়ছে গায়ের উপর, অল্প একটু করি হাত কাটছে মেয়েটার। বাসও থামছিল একদম একটা ডিস্পেন্সারির সামনে, ওখান থেকি দৌড়াদৌড়ি করিয়া আয়োডিন-টায়োডিন নিয়া আসল ওরা, মেয়েটার হাতটা ব্যান্ডেজ করি দিল ওরা।
—উফ। যাক, তাও ভাল। যাক… আচ্ছা, তারপর বলো, রফিক আঙ্কেলের সাথে দেখা হইছিল তোমাদের পরশুদিন?
—হ্যাঁ হইছে। রফিক তোদের কথাও জিগাস করল। রফিককে আর চেনায় যায় না, মাথাত একটা চুলও নাই। তোর বাপকে কয়, এইসব হোয়াটসঅ্যাপ-মেসেঞ্জার না থাকলে তো আপনাদেরকে আর খুঁজেই পাইতাম না, খয়ের ভাই।
—আচ্ছা…
—বহুদিনের অদেখা তো, কেমন একটা অস্বস্তি থাকেই, আমরা কিছু জিগাস-টিগাস করি নাই, ও নিজেই তোর বাপকে কইল— আপনার মতো কিসমত তো আমার না খয়ের ভাই, আমার বউ ভাগছে বহু আগে, তারপর আর ও রাস্তা মাড়াইনি।
—ও আচ্ছা, তা কতদিনের জন্য দেশে গেছে রফিক আঙ্কেল?
—সামনের সপ্তায় বলল ব্যাক করবে অ্যামেরিকায়। আটাইশ বছর পর আসছে দেশে, বাপরে বাপ…
—ও আচ্ছা। যাক, রফিক আঙ্কেলের সাথে তোমাদের দেখা হইল বহুদিন পর, ভালই হইছে।
—হ্যাঁ মা শোন, এই কারেন্ট গেল আবার, এখন ওয়াইফাই বন্ধ হবে।
বলতে বলতেই লাইনটা কেটে গেল হেনার মেসেঞ্জারের।
রফিকের প্রসঙ্গ আসল, তিস্তা পারের দোয়ানির দিনগুলোর কথা মনে পড়ল হেনার। মনে পড়াপড়ি বড় অদ্ভুত ব্যাপার, কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায় আমাদের মন…
ধূধূ বালুর চর। অনাবাদি জমিজমা। নদীতীরের প্রায় গাছগুলোই নির্ধন, শুকনো, ওখানকার মানুষগুলোর মতোই। তবু সেই বালুময় ভূখণ্ড আর আকাশের প্রতিধ্বনিতে, তিস্তাকে মনে হত প্রাণময় স্বপ্নের অভয়ারণ্য। বালি আর গরম বাতাসে অনুর্বর ক্ষমাহীন প্রকৃতির মাঝে তিস্তার শীতল জল যেন অশিক্ষিত মানুষগুলোর জীবনরেখা। সেই স্বচ্ছ নদীর জলে নুড়িপাথরের মতো ডুবে থাকে সেখানকার লোকের আশাভরসা।
সারাদিনের খাটাখাটনির পর বাদামচাষি, ব্যারেজের শ্রমিক আর নদী পার-করানি মাঝিরা জীর্ণ পথ ধরে পরিশ্রান্ত দেহ বয়ে ঘরে ফিরত। সন্ধে হতেই তপ্ত হাওয়ায় ভেসে চরাচরে আসত নিস্তব্ধতা। তারপর ঝড় থামার মতো সব নীরব হয়ে যেত। শুধু থাকত কিছু এলোমেলো শব্দ, ঘরে ফেরা পাখির গান। গেরস্থালির কাজকারবারের আওয়াজ আস্তে আস্তে থিতু হয়ে আসত। তারপর একসময় তারার আলো ঘুম হয়ে উঠত কোনও কোনও বাড়ির জানালা গলে। মাঝিদের ঘরে, চাষাদের ঘরে, তিস্তা ব্যারেজ কলোনির বাড়িগুলোতে মায়াবী বিশ্রাম হয়ে তখন বিশ্বপৃথিবী যেন এক কোকুনের ভেতর ঢুকে যেত। রাত বেশি না, তবু মখমল গভীর আকাশ আর ফিসফিস করা নক্ষত্রদের দিকে তাকিয়ে শেয়ালেরা ডেকে ডেকে উঠত।
২
তিস্তা ব্যারেজের সাব-ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার তখন খয়ের উদ্দিন। এগারো’শ টাকা মাহিনে, কিন্তু গভর্মেন্ট-এর সুযোগসুবিধা খুব ভাল। নদী পারাপারের জন্য স্পিডবোট, রান্নার লোক, বাজারের লোক কত কী, বাড়িভাড়া বিদ্যুতের বিল নামমাত্র। সেই প্রত্যন্ত এলাকায় ব্যারেজের ইঞ্জিনিয়ারদের আকৃষ্ট করতে ওইসব প্রণোদনা। গরমের সময় চামড়ায় হাতুড়ির মতো এসে লাগে সূর্যের তাপ। সারাদিন রোদে পুড়ে ধুলো মাখামাখি হয়ে, কাজ শেষে যখন রাত্রিবেলা সাইট থেকে ফেরে খয়ের উদ্দিন, তখন তাকে আর চেনা যায় না। আপাদমস্তক ধুলো ঢাকা ছয় ফুট শরীরটাকে ভৌতিক মনে হয়। আজও মনে হয় নয়টা-দশটা বাজবে।
নাজু, অ্যাই নাজু, শোন।
ঝিনুকের সাথে এতক্ষণ শুয়ে ছিল নাজু। আপার ডাকে উঠে এল।
হেনা জিজ্ঞেস করল— ঝিনুক ঘুমায়নাই এখনও?
—এই এখনই ঘুমাইল।
—শোন, তোর দুলাভাই আসতে মনে হয় আরও দেরি, চল আমরা খাওয়াদাওয়া করি।
—আচ্ছা চলো।
ক’দিনের টুকটাক ছুটিছাটায় নাজু চলে আসত তার হেন্পার বাসায়।
এ এমন এক এলাকা; গাছ, ঝোপঝাড় সব বাদামি রুপোলি ধুলো মাখামাখি। শুষ্ক ভূত্বক ছুঁয়ে উড়ে আসা বাতাসে চোখ জ্বালা করে ওঠে। বিস্তীর্ণ বেলেমাটিতে এখানে ওখানে বাদামের খেত, নীল পাপড়ি ছড়ানো সাদা তুলতুলে আকাশ আর তিস্তার বুকের নৌকাগুলোই যা একটু চোখ জুড়োয়। ঝিনুকের খুব মজা হত নাজু খালামণি আসলে, কত কী যে আনত খালামণি। খালামণি বেড়াতে আসলেই ওরা স্পিডবোটে করে ঘুরতে বের হত। সোলেমান চাচা বলত, ভাল্ করি ধরি বইসেন মাও, দেইম একখান টান। সোলেমান মুন্সী জাদুর মত শোঁ শোঁ করে স্পিডবোট ছোটাত। জল কেটে কেটে বোটের দুদিকে ঢেউ আছড়ে পড়ে। মনে হয় কোনও এক বুনো ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছুটছে ঝিনুক, ওর চুলে বাতাসের চাবুক, চারপাশের সবকিছু ঘোলাটে অস্পষ্ট হয়ে যায়, শক্ত করে সিট ধরে বসে থাকে ঝিনুক, মুখে এসে লাগে জলের ছিটা, বিশুদ্ধ উচ্ছ্বাসের তরঙ্গে ভেসে ভেসে সবকিছু সম্ভব মনে হওয়া এক শিহরণ ঝিনুকের বুকের ভিতরটা কাঁপিয়ে তোলে, জলের ওপর উড়ে যাওয়া ওই পাখিগুলোর মতো ঠাহর হয় নিজেকে।
ঝিনুকের মনে হত নাজু খালামণি যদি সবসময় থাকত ওদের সাথে…
এর আগেরবার নাজু খালামণি যখন আসল, সেবার ঝিনুককে যেমন খুশি তেমন সাজোয় সাজিয়ে দিয়েছিল। ঝিনুকের সে কী লজ্জা, ছেলেদের মতো করে সাজাল ওরা ওকে। গীতা মাসি কোত্থেকে আনল ছোট্ট একটা লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি। গীতা মাসি আর নাজু খালামণি মিলে একটা কাগজে লিখল— ‘আমি মুরগি বেচি রে আমার নাই কোনও ঠিকানা।’ লিখে ওর পিঠে আটকে দিল। সোলেমান চাচা কোত্থেকে কয়টা মুরগি যোগাড় করে আনল। ঝিনুকের সাথে সাথে সোলেমান মুন্সী মুরগি নিয়ে পুরো মাঠ ঘুরল। সবার সে কী হাসি, ঝিনুকের সে কী লজ্জা! ফার্স্ট প্রাইজ পেল ঝিনুক, একটা কসকো সাবান, সেই সাবান সে হাতছাড়া করে না। নাজু খালামণি ছুটিতে আসলে ঝিনুকের জীবনে এইসব অবাক ঘটনা ঘটে। ঘুমাতে যেতে ইচ্ছা করে না। কত গল্প যে করে খালামণি! কয়দিন বাদেই খালামণি রাজশাহী চলে যাবে আবার, সবাইকে বড় হয়ে কেন এত পড়তে হয়, ঝিনুক কখনও অত পড়াশুনা করবে না, বড় হয়ে সে সোলেমান চাচার মতো হবে, শোঁ শোঁ করে স্পিডবোট নিয়ে ছুটে যাবে, লোকজনকে নদী পার করে দেবে। নাজু খালামণির অনেক লিপস্টিক, খালামণি বলেছে, লক্ষ্মী মেয়ের মত ঠিক সময়ে ঘুমাতে গেলে যাবার সময় ওকে এবার গোলাপী লিপস্টিকটা দিয়ে যাবে। ঘুমের মধ্যেও ঝিনুক চিন্তায় পড়ে যায়, বড় হয়ে ও নাজু খালামনির মতো হবে নাকি সোলেমান চাচার মত হবে, ঠিক বুঝে ওঠে না…
৩
খেতে খেতে কথা হচ্ছিল নাজু আর হেনার। নাজু অমনোযোগী হয়ে আছে। এবার তার রফিক ভাইয়ের সাথে দেখা হয়নি এখনও।
লম্বা হ্যান্ডসাম গঠন, মাথা ভর্তি চুল, উঁচু কপাল, চোখা নাক, রোদে পুড়ে যাওয়া বাদামি বরণ রফিকের পুরো অস্তিত্ব নাজুকে চুম্বকের মতো টানত। রফিকের কণ্ঠে আর হাসির শব্দে… নাজুর পৃথিবীটা যেন থমকে যেত। আশেপাশে রফিকের উপস্থিতিতে, তিস্তা-চরের সূর্য-চুম্বিত বালির মতোই নাজুর চোখ চকচক করে উঠত। কখনও গুমরে উঠত অনন্তকালের মতো মনে হওয়া কোনও কোনও অপেক্ষার প্রহর; সে কোথায়, এখন সে কোথায়, সেও কি তার কথা ভাবে… কখনও তিস্তার পাড় ধরে, কখনও অলস স্রোতে পা ভিজিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, গীতাদি আর ঝিনুককে নিয়ে মাঝে মাঝে ব্যারেজের ওয়ার্কশপের দিকে চলে যেত নাজু। ওয়ার্কশপের কাছাকাছি পৌঁছে লাহে লাহে হাঁটা, যদি একটু দেখা যায়, চুপিচুপি দূর থেকে তাকে যদি একবার দেখা যায়। দেখতে পেতও, ওই যে রফিক ভাই, ওইই যে ক্যাটারপিলার এক্সক্যাভেটরটা চালাচ্ছে, ওটাই রফিক ভাই। চরের অনুর্বর শুকনো বালিতে বৃদ্ধ-মুখের মতো দেখতে আজগুবি যে পাথরগুলো ইতিউতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকত, তারই কোনওটার ওপর বসতে বসতে নাজু বলত— গীতাদি, আসো এখানটায় বসি। মুচুর মুচুর হাসি হেসে গীতাদি বলত— তা তো বসবই তা তো বসবই…
তিস্তার স্বচ্ছ জল জ্বলজ্বল করে, দূরে ভাসে বিন্দু বিন্দু নৌকা। নাজু, গীতাদি, ঝিনুক মিলে বসে বসে সেইসব বিন্দুর মিলিয়ে যাওয়া দেখত। একেকজনের মনে একেক ভাবনার গ্রাস। ঝিনুকের ভাবনা হত নৌকাগুলোকে নিয়ে, আগে সেগুলোকে জাহাজ ভাবত ও, এখন জানে ওসবের নাম নৌকা, কিন্তু জানে না ওরা কোথায় যায়, কে যায়, ওই যে কতক বাদামি রঙের পাখি ওড়ে জলের ওপর আর পরক্ষণেই ডুব দেয় ওদেরই বা কী নাম, আর পিকনিক করে বাড়ি ফেরার পথে আকাশের ওই উঁচুতে কাল রাতে দূর থেকে দূরের যে চাঁদটা ওদের সাথে সাথে আসছিল, সেটা আজ গেল কোথায়…, চাঁদ কেন সাথে সাথে আসে, কার কাছে জিজ্ঞেস করে ঝিনুক সে কথা!
আর গীতাদির দৃষ্টিও দিগন্তে স্থির, তার মনই বা কোথায় হারাত কোন জগতে, কে তার খবর রাখে…
আর ওই যে ওইদিকটা, যে দিকের আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি, ব্যারেজের সেই কন্সট্রাকশন সাইটের ওদিকটা থেকে সময়ে সময়ে ধুলো আর ঝাঁক ঝাঁক মৌমাছির গুঞ্জনের মতো ওয়েলডিংয়ের শব্দ ভেসে আসত। ওসবের মাঝেও নাজুর মাথার ভেতর, প্রজাপতির ডানার মতো ঝিকমিক করে সারাক্ষণ গুনগুন গুনগুন চলত— তোমারে লেগেছে এত যে ভাল চাঁদ বুঝি তা জানে…
—তোর রফিক ভাই আর আসবেও না, খেতে খেতে প্রসঙ্গটা তুলল হেনা। তারপর যতটুকু বলা যায় ব্যাপারটা ততটুকুই জানাল নাজুকে।
সব শুনে নাজুর ফর্সা টসটসে মুখটা লাল হয়ে গিয়েছিল।
—কেন হেন্পা তুমি বলতে গেলে, ছি ছি ছি ছি…
—আহ, সমস্যাটা কোথায়? আমাদেরও তো বুঝতে হবে রফিকের চিন্তাভাবনা।
—এখন হল তো? অপমানের একশেষ, ছি ছি ছি…
হেনা আর খয়ের উদ্দিন মিলে রফিকের কাছে নাজুর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিল। রফিক সরাসরি বলেছে— খয়ের ভাই, আপনি তো জানেন, আমি অ্যামেরিকা যাব, যাবই যাব, সেজন্য আমি এমন কোনও ফ্যামিলিতে বিয়ে করতে চাই যে ফ্যামিলি আমাকে সেটা এন্স্যুওর করবে, ইত্যাদি। এই যুক্তিই চলত, হেনা কি বুঝত না? তার পরের কথাটা রফিক না বললেও পারত। আশ্চর্য! রফিক বলে কিনা— ভাবি, আর তাছাড়া নাজুর নাক বোঁচা, বোঁচা নাকের মেয়ে আমার ভাল লাগে না। শুনে হেনার অন্তরের অন্তস্তল কেঁপে ওঠে। এই কথাটা হেনা বলতে পারেনি নাজুকে।
সেদিন রাতে খয়ের উদ্দিন মসকরা করে বলেছিলেন, নাজু বাদ দে, যায় আসে না, আমরা সিংহের মতো সাহসী, কুকুরের মতো লয়্যাল, গাধার মতো পরিশ্রমী আর বিড়ালের মতো আদুরে একটা ছেলে নিয়ে আসব দেখিস। সেন্সিটিভ ইস্যু নিয়ে মসকরা ভাল লাগে না দুলাভাই— বলে নাজুও হেসেছিল। সেই হাসি আড়াল করে রেখেছিল ওর বুকের গহীনে ছড়িয়ে পড়া হুহু একটা দীর্ঘশ্বাস। তবে জীবনের একপাক্ষিক প্রথম প্রেম প্রত্যাখ্যানের ক্ষত অবশ্য কোনও মানসিক মেলোড্রামা ছাড়াই নাজু কাটিয়ে উঠেছিল।
তার প্রায় মাস সাতেক পর কানা ঘটকের দেয়া ঠিকানা আর দিন-তারিখ মতো খয়ের উদ্দিন আর হেনা মিলে জয়পুরহাটে গেল নাজুর জন্য ছেলে দেখতে। ছেলে সুগার মিলের ইঞ্জিনিয়ার। কানা ঘটকের কাছে নাজুর ছবি দেখে ছেলে নাকি বড়ই আগ্রহী। হেনারা কথাটথা বলে দেখতে গেল।
আচার-ব্যবহারে ছেলেটাকে বেশ লেগেছিল হেনার। গায়ের রং অন্তত ফর্সা না, ছেলে ফর্সা হওয়া যাবে না, নাজুর প্রথম শর্ত।
—সেদিক থেকে এই ছেলেটা দশে সাড়ে আট পাবে, আমার চেয়ে এক নম্বর কম, কী বলো?
বাইরে বেরিয়ে আকর্ণবিস্তৃত হাসি হেসে স্ত্রীর সাথে মসকরা করলেন খয়ের উদ্দিন।
কথা হয়েছে পুজোর ছুটিতেই দেখাদেখি হবে, পাত্রপাত্রী কথাবার্তায় বনিবনা হলে দিন-তারিখ পাকাপাকি হবে, বলা যায় না কবুল পড়ানোও হতে পারে, শুভকাজে দেরি করা ঠিক না।
কত কী মনে পড়ে যায় হেনার…
কিন্তু যার কথা ঘুরে উল্টে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে, তার নাম ছিল সাজু।
৪
সাজু নামের বিশ-বাইশ বছরের একটা ছেলে ঢাউস ব্যাগটা দিতে বাড়ি খুঁজে খুঁজে এসেছে। ছোট্ট একটা তালা ঝুলছে ব্যাগের জিপার থেকে। ব্যাগের গায়ে কাগজের একটা লেবেল টেপ দিয়ে আটকানো, তাতে নামঠিকানা নাজুর হাতে লেখা।
সারাক্ষণ রান্নাঘরে চা জ্বাল হচ্ছে। খোর্কি বেচারি বড় কেটলিটাতে সকাল-বিকাল চা জ্বাল দিচ্ছে। হেনা গিয়ে সাজুর জন্য চা-বিস্কিট নিয়ে এল।
—ভাই, তুমি দুপুরে খেয়ে যাবে কিন্তু।
সাজু প্রায় অনুনয়ের সুরে বলল, না আপা না, আমি আর বসব না। হেনা অবশ্য বেশি জোরজবরদস্তি করতেও চাচ্ছে না। ছেলেটা চলে যেতে চাইলে যাক, তবে আম্মার সাথে ছেলেটাকে একবার দেখা করাতে পারলে ভাল হত কি? অবশ্য আম্মার অবস্থা এখনও উঠে বসার মতো না, গত কয়দিন ধরে আম্মাকে দানাপানি খাওয়ানো যায়নি। খোর্কি তিনবেলা রান্না করে চলেছে, একেকজন একেক সময় রান্নাঘরে আসছে, খুলিবাড়ির চৌকিতে বসছে, যার যখন পেটে টান পড়ছে সে তখন পেটে দম দিচ্ছে। বিয়ের আনজাম করা বাড়ি ছিল, বাড়ি ভর্তি লোক। মাগুলো ছোট বাচ্চাদের দুবেলা তুলে খাইয়ে ছেড়ে দিচ্ছে, আর ওদেরই কেউ কেউ বাচ্চাগুলোকে সামলে রাখছে। সবাই মিলেও মধ্যে মধ্যে সামান্য পানি-শরবত বাদে আম্মাকে আর কিছুই খাওয়াতে পারছে না।
সাজু একটা বিস্কিট নিয়ে চায়ে ডুবাল।
সাজু ছেলেটা কে, সে এখানে কী করছে, এইসব একটু বলা আবশ্যক। কারমাইকেল কলেজের জনাকতক ছাত্র মিলে নাজু সহ সব আহত বাসযাত্রীদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, সাজু ছিল তাদেরই একজন। মারাত্মক ফ্রন্টাল-স্কাল ইনজুরি নিয়েও নাজু নাকি বেশ ভালভাবেই কথা বলে যাচ্ছিল, অন্তত রিকশায়। হাসপাতালে পৌঁছার পর পরই নাজুর অবস্থা খারাপ হয়। ওটি-তে ঢোকানোর সময় নাজু নাকি সাজুকে বলেছে:
—ভাই তোমার নামটা তো জানলাম না।
নাম শুনে নাজু নাকি বলেছে:
—দ্যাখো দেখি আমাদের নামের কী মিল, নাজুর ভাই সাজু।
সেই ঘটনার সাতদিন পর সাজু ছেলেটা এখন বসে আছে নাজুদের গ্রামের বাড়িতে; বাস কোম্পানির অফিস থেকে নাজুর ব্যাগটা যোগার করে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দিতে এসেছে। ঝিনুক ধারণা করেছে এই ব্যাগে অসম্ভব সুন্দর কিছু জিনিস আছে। সম্ভবত খালামণির মালা দুল চুড়ি মেকআপ বক্স সব আছে, এরকম একটা সম্ভাবনায় সে ভীষণ পুলকিত। নাজু খালামণির অনেক লিপস্টিক ছিল, সব কি এই ব্যাগে আছে? বলা যাচ্ছে না, ব্যাগ না খোলা পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না। ঝিনুক খুব উদ্গ্রীব হয়ে আছে, কখন ব্যাগটা খোলা হবে সেই অপেক্ষায়…
—আপা আমি তাহলে বের হই, বলে, সাজু উঠে দাঁড়াল।
হেনা ছেলেটাকে এগিয়ে দিতে খুলিবাড়ি পর্যন্ত সাথে আসল, বড় রাস্তায় ওঠার পথে বাঁশঝাড় পার হয়ে কবরস্থানের কাছে এসে একটু থামল, একটা নতুন কবরের দিকে মুখ উঁচিয়ে দেখাল— ওই যে ওইটা নাজুর কবর। সাজু ছেলেটা হাঁটিহাঁটি পায়ে সেদিকে সামান্য এগিয়ে গিয়ে বিড়বিড় করে আওড়াল— আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহ্লাল কুবুর…
ওদের সাড়াশব্দে বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে একটা লোমশ বেজি বেরিয়ে দ্রুত পুকুরের দিকটায় সটকে পড়ল।
ভাল থেকো ভাই, আমরা তোমার কাছে ঋণী।
হেনা সেদিন সাজু নামক সেই ছেলেটাকে বিদায় দিয়ে খুলিবাড়ির পশ্চিমের ঘরটাতে ফিরে এসে নাজুর ব্যাগটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে ছিল কিছুক্ষণ। এদিকে ঝিনুক অস্থির হয়ে আছে ব্যাগটা কখন খোলা হবে, বড়দের ব্যাপারস্যাপার তার মাথায়ই ঢোকে না…
পরিশিষ্ট
সাজু তো সেদিন চলে গেল। কিন্তু মজার ব্যাপার, এই সাজু আর এই হেনার আরও একবার দেখা হয়েছিল। সেটা বত্রিশ বছর পরের ব্যাপার; ততদিনে সাজু পুরোদস্তুর মাঝবয়সী একটা লোক, মেয়েকে নিয়ে সে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরছিল। একই বাসেই হেনাও ছিল পাশাপাশি সিটে বসা, কিন্তু এই দুই পক্ষ কেউ কাউকে চিনতে পারেনি, চেনার কথাও না। জীবনের এইসব এলোমেলো যোগাযোগ মানুষের যাত্রাপথের মহাকাব্যে ভুলে যাওয়া পঙ্ক্তির মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, কেউ তা জানতেও পারে না।
খুব ই চমৎকার। আরও পড়ার ইচ্ছাটা বাড়িয়ে দিয়েই গল্প টা শেষ হয়ে গেলো
অনেক ধন্যবাদ। পড়ার ও মন্তব্যের সময়ের জন্য কৃতজ্ঞতা। ভাল থাকবেন।