আমাদের যৌবনে, অর্থাৎ বিশ শতকের ছয়ের দশকের শেষ ও গোটা সাতের দশক জুড়ে সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটক যেন ছিলেন ‘দুই ভ্রাতৃসূর্যলোক’। মৃণাল সেন, তপন সিংহ বা হঠাৎ চমকে দেওয়া রাজেন তরফদার-হরিসাধন দাশগুপ্তরা হয়তো ছিলেন, কিন্তু ফিল্মি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ওই রায় আর ঘটক। তাঁদের ছবি কবে মুক্তি পাবে, তাই নিয়ে বছরভর আগ্রহ, কৌতূহল, প্রতীক্ষা ও উৎকণ্ঠা। এঁদের ছবি বছরের পর বছর চাখানায়, রকে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে-কফিহাউসে আলোচনার ঝড় তুলত।
এহেন সময়ে ঋত্বিক ঘটকের তখন পর্যন্ত নির্মিত ছবির পূর্বাপর (Retrospective) দেখানোর আয়োজন করল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম ক্লাব। সে-উপলক্ষ্যে স্বয়ং আমন্ত্রিত হলেন ঋত্বিক। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ফিল্ম ক্লাবের সদস্য হওয়ার সুবাদে ঋত্বিকের সব ছবি দেখা আর পরিচালককেও, এ ছিল এক অসামান্য অভিজ্ঞতা।
প্রথম দিন তিনি এলেন, বক্তৃতা দিলেন, এবং আমাদের সকলের মন জয় করে নিলেন মুহূর্তে। তাঁর ছবি তৈরির নেপথ্যের কাহিনি শোনালেন, যে ভাষণে স্বাধীনতা ও দেশভাগ নিয়ে তাঁর বেদনার্ত উচ্চারণ আপ্লুত করল শ্রোতাদের। বক্তৃতার এক পর্বে তিনি গান্ধী সম্পর্কে তুমুল বিতর্কিত একটি উক্তি করেছিলেন। পরদিন সংবাদপত্রে তা প্রকাশিত হলে সংসদে পর্যন্ত আলোড়ন ওঠে তা নিয়ে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে ডেকে পাঠান। উক্তি প্রত্যাহার করতে বলেন। ঋত্বিক রাজি হননি। সেই থেকে ঋত্বিক আমাদের কাছে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ বা ‘সুবর্ণরেখা’ ছবির পরিচালক হিসেবে নন, তার অনেক অধিক। যিনি নজরুলের মতোই বলতে পারতেন, ‘আমি আপনারে ছাড়া করিনে কাহারে কুর্নিশ’।
ঋত্বিককে প্রথম দেখা থেকে তাঁর সঙ্গে আলাপ হতে লেগেছিল তিন বছর। ১৯৭২-৭৩ সেটা। আমরা বারোজন মিলে ‘সন্ধান সমবায় সমিতি’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা খুলি। আমি ছিলাম সেখানকার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। আমরা প্রথমেই ঋত্বিক ঘটকের প্রবন্ধের বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিই। সদস্যদের মধ্যে দুজন ছিলেন ঋত্বিকের স্নেহভাজন। পার্থ সেন ও প্রবীর সেন। পার্থদা বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব সতু সেনের ছেলে। প্রবীরদা সতু সেনের আপন ভাগ্নে। সতু সেন ঋত্বিকের বন্ধুস্থানীয় ছিলেন।
ঋত্বিক অতি সহজেই রাজি হলেন। এ-সময় তাঁর লেখা সংগ্রহ করতে তাঁর বাসায় আমাকে একাধিকবার যেতে হয়েছিল। তবে ওরকম আগ্নেয় ব্যক্তিত্বের কাছে নিতান্তই অপ্রতিভ থাকতাম। এসময় তিনি সদ্য দুটি ছবি তোলা শেষ করেছেন। কলকাতায় বসে ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’, আর বাংলাদেশে গিয়ে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। ছবিদুটি করাকালীন তাঁকে দুটি কঠিন রোগের সঙ্গেও লড়তে হয়েছিল,— টি বি আর মানসিক ব্যাধি। শরীর জীর্ণ, দেখে কষ্ট হত।
সত্যজিতের ‘সীমাবদ্ধ’ রিলিজ করেছে তখন। মুখ ফুটে বেরিয়ে এল আমার, ‘সীমাবদ্ধ দেখেছেন?’ খানিকটা ব্যঙ্গাত্মক হাসি উপহার দিয়ে বললেন উনি, ‘বাংলা ছবি ইদানীং বড় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।’ যা বুঝবার বুঝে নিলাম।
ওইরকম দুর্বল ও রোগগ্রস্ত শরীর, অথচ দেখতাম তাঁকে, সদ্য যক্ষ্মা থেকে রেহাই পাওয়া মানুষটি অনবরত বিড়ির পর বিড়ি খেয়ে চলেছেন। সঙ্গে আরও এক মারাত্মক বিষ,— দিশি মদ। যেন তিনি পুষ্পের হাসি হাসবার জন্য জাহান্নামের আগুনে বসাতেই পরিতোষ বোধ করেন।
একদিন লেখা আনতে গিয়ে জানতে চাইলাম, আগামী ছবির কী পরিকল্পনা তাঁর। বললেন, বিষ্ণুপ্রিয়া নামে একটি মেয়ে সম্প্রতি ধর্ষিতা হয়েছে। ধর্ষণের পরে মেয়েটিকে মেরে ফেলা হয়। ঘটনাচক্রে ওই বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্ম চৈতন্যজায়া বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্মস্থানে, নবদ্বীপের মালঞ্চপাড়ায়। এই ঘটনা নিয়ে ছবি করবেন ভাবছেন। প্রযোজকের অপেক্ষায় আছেন।
যথসময়ে ঋত্বিকের বই বের করলাম আমরা। ‘চলচ্চিত্র, আমি ও অন্যান্য’। বইয়ের শিরোনাম তাঁর-ই দেওয়া। আমাদের আগ্রহাতিশয্যে বইটির প্রচ্ছদ-ও এঁকে দিলেন তিনি। ঋত্বিকের প্রথমতম বইয়ের প্রকাশক আমরা, এটা ঐতিহাসিক ঘটনা।
আমাদের প্রকাশনার দ্বিতীয় বইটিও তাঁকে নিয়ে করব ঠিক হল। তাঁর লেখা নয়, তাঁর বিস্তৃত সাক্ষাৎকার নিয়ে বই। নিঃসন্দেহে অভিনব পরিকল্পনা। টানা তিন দিন ধরে এজন্য সাক্ষাৎকার নিলাম তাঁর। ম্যারাথন কথোপকথন। সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে জানলাম, তিনি ওস্তাদ আলাউদ্দীন খান-এর কাছে সেতার শিখেছিলেন। জানলাম, ‘সুবর্ণরেখা’-র প্রিমিয়ারে তিনি আমন্ত্রণ জানান সত্যজিৎ রায়কে, কিন্তু অকিঞ্চিৎকর অজুহাত দেখিয়ে সত্যজিৎ যাননি। এরকম আরও বহু অজানা তথ্যে ভরা ছিল সেই অবিনশ্বর সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি।
এই তিন দিন তাঁর অতি কাছাকাছি আসা আমার জীবনের চিরস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন আরও দুজন,— পার্থদা ও প্রবীরদা। দক্ষিণ কলকাতার এক জীর্ণ বাড়িতে থাকতেন তিনি, শরৎ চ্যাটার্জি (ব্যানার্জি নয়) রোডে। মলিন বিছানা, একটি নিতান্ত সাধারণ চৌকি, সেখানেই বসতে হত আমাদের। তাঁর তুচ্ছ বেশবাস, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আর সকাল থেকেই অনবরত মদ্যপান। বিড়ির গন্ধে সমস্ত ঘরটি দান্তের Inferno যেন।
এবং এর-ই মাঝে প্রজ্ঞা, যাবতীয় শিল্পের তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ, রাজনীতি ধর্ম অর্থনীতি নিয়ে নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গী, নির্দ্বিধ মন্তব্য। ‘যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে/ উচ্ছ্বসিয়া উঠে’, ঠিক তাই। মহাভারতীয় সেই সাক্ষাৎকারে তিনি কেন ছবিতে এলেন, চলচ্চিত্রে তাঁর পূর্বসূরিদের অবদান, তাঁর আত্মদর্শন নিয়ে কত কথা-ই না বলেছিলেন! পাশে বসা ছিলেন ঋত্বিকের এক ভাই, নাবিক হয়ে একদা সারা বিশ্ব চষে বেড়িয়েছেন।
এক পর্যায়ে ঋত্বিকজায়া সুরমাদেবী দুজনের জন্য গেলাসে করে দুধ নিয়ে এলেন। দুই ভাই পরম ব্যঙ্গে ফিরিয়ে দিলেন তা।
বিধি বাম ছিল আমাদের প্রতি। সেই সাক্ষাৎকারটি বই হয়ে বেরোতে পারল না শেষপর্যন্ত। সাক্ষাৎকার দেবার কয়েক মাস বাদেই ঋত্বিক প্রয়াত হন। ওঁর পরিবার থেকে বইটি ছাপার জন্য মোটা টাকা দাবি করা হয়। তা দেবার সাধ্য আমাদের ছিল না। পরে ‘চিত্রবীক্ষণ’ ও অন্যান্য চলচ্চিত্র-বিষয়ক পত্রিকায় বিচ্ছিন্নভাবে সাক্ষাৎকারটি বেরিয়েছিল। আরও পরে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সাক্ষাৎ ঋত্বিক’ গ্রন্থে এর বহুলাংশ ছাপা হয়।
আজ ঋত্বিকের বই তাঁর চলচ্চিত্রের মত-ই জনপ্রিয়। ‘চলচ্চিত্র, আমি ও অন্যান্য’ বর্ধিতাকারে নামী প্রকাশনা থেকে বেরিয়েছে (ওদের প্রচ্ছদে ঋত্বিক বর্জিত!)। তাঁর গল্পগ্রন্থের-ও প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর লেখা বারোটি নাটক নিয়ে বেরিয়েছে নাট্যসমগ্র। আমরা এখন ধূসর স্মৃতি!
ভালো লাগল
ঋত্বিক ঘটক বাংলাদেশের মানুষ। তাকে জানি ‘তিতাস একটি নদী’ থেকেই। এও জানা ছিল, তিনি নজরুলের মতই ক্ষ্যাপাটে ছিলেন। কিন্তু জানা ছিল না, ইন্দিরা গান্ধির অনুরোধ প্রত্যাখানের কাহিনি, জানা ছিল না তাকে নিয়ে বই করার কাহিনি, জানা ছিল না সত্যজিৎয়ের ছবিকে নিয়ে তার অর্থপূর্ণ মন্তব্যের কথা। এমনকি, তিনি যে গল্প লিখেছেন, তাও তো অজানাই ছিল। আর সব থেকে অবাক করা ব্যাপার, যে মলয়দার সাথে আমি কথা বলেছি, তিনি দিনের পর দিন এই মনীষিকে দেখেছেন, সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। আচ্ছা, ঋত্বিকের বইগুলো পাওয়া যায়? … মলয়দা, অনেকবারই ভেবেছি ঋত্বিকের ছবিগুলো দেখে ফেলব। এখন মনে হচ্ছে, আর দেরী করা উচিৎ হবে না। আসলে আমরা একটা সীমার মধ্যে বাস করি বলেই হয়ত দেরী হয়ে গেছে আমাদের মাটির সম্পদকে আরো চিনে নিতে!…লেখাটার জন্য কোন প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।