নদীর ধার ঘেঁষে রাতারাতি বসে গেছে বেশ কয়েকশত দোকান। খাবারদাবার থেকে আরম্ভ করে লোহা এবং কাঠের জিনিসপত্র, মণিহারি জিনিস, গয়নার দোকান মিলিয়ে চেনা ঘাটগুলি একদিনের জন্য আস্ত একটা মেলার চেহারা নিয়েছে। মানিকচকের রাজমহল ঘাট পঞ্চানন্দপুর পাগলাঘাট, নাজিরপুর ঘাট বা সাদুল্লাপুর ঘাটে শতাব্দীপ্রাচীন গঙ্গালাহানি মেলায় মেতে ওঠেন স্থানীয় এবং বাইরে থেকে আসা লক্ষাধিক মানুষ। মেলা ছাড়াও হয়েছে রীতি মেনে গঙ্গাপূজা। বসেছে বাউল গানের আসর। মাঘী পূর্ণিমার গঙ্গা স্নানযাত্রাকে কেন্দ্র করে প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন এই মেলা আধুনিকতার দাপট এড়িয়েও বজায় রাখতে পেরেছে তার লোকঐতিহ্য।
কেন এমন অদ্ভুত নাম এই প্রাচীন মেলার? উত্তর দিতে গিয়ে খোট্টা ভাষা গবেষক ড. পতিতপাবন চৌধুরী বলেন, ‘‘মানিকচক, রতুয়া এবং মোথাবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্রের লক্ষাধিক মানুষের কথ্য খোট্টা ভাষার প্রভাবেই এমন নাম। খোট্টা মৈথিলিতে হিন্দি স্নানযাত্রা বা ‘নাহানি’ পরিবর্তিত হয়ে ‘লাহানি’ হয়েছে। তাই এই মেলাকে এককথায় গঙ্গাস্নানের মেলা বলা যেতেই পারে।’’

মাঘী পূর্ণিমার গঙ্গাস্নানের সঙ্গে পাপমোচনের এক সামাজিক ও ধর্মীয় তাৎপর্য আছে। রয়েছে বাড়ির অন্তঃপুরের মহিলাদের বছরের একটা দিনের জন্য ঘরের বাইরে বেরিয়ে গঙ্গাস্নানের পর নদীর ধারে খোলামেলা চড়ুইভাতি বা কেনাকাটি করার স্বাধীন আনন্দের স্বাদ পাওয়া। অনেকে গঙ্গাস্নান করার পর ডাব, কলা আর ফুল দিয়ে নিষ্ঠাভরে গঙ্গামাইয়ার পূজা করেন।
মানিকচকের লালবাথানি গ্রামের ষাটোর্ধ্ব প্রবীণা ঝর্না রায় এই মেলায় প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আগে গ্রাম থেকে ফুল, মালা আর রঙিন ফিতে দিয়ে সুন্দর করে সাজানো গোরুর গাড়ি ভাড়া করে সমস্ত মেয়ে-বউরা নদীর ধারে আসত। বাড়ি থেকে রান্না করে আনা লুচি, ছোট আলুর তরা (কথ্য খোট্টা মৈথিলিতে অর্থ তরকারি), বাঁধাকপির ঘন্ট, বুনিয়া (কথ্য খোট্টা মৈথিলিতে অর্থ বোঁদে) আর নানা খাবারদাবার নিয়ে গঙ্গাস্নান করার পর পূজা করে সবাই মিলে বসে খাওয়া হত। অনেকে নদীর ধারে খিচুড়ি রান্না করত। আশপাশের দোকান আর মেলা থেকে মিষ্টি কিনে নেওয়া হত। বছরেরই একটা দিনের জন্য সকলেই সমান। এমনও হয়েছে যে গোরুর গাড়ি ভাড়া করেছে, তার পরিবার আর যে গাড়োয়ান, তার পরিবার একইসঙ্গে গঙ্গালাহানির মেলায় গেছে।’

এই মেলার সঙ্গে মিশে থাকে হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের কিছু প্রাচীন সংস্কার। লোকসংস্কৃতিবিদদের একাংশের মতে, এই বিশেষ মেলা এই দুই প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। কেননা, গৌড়বঙ্গে এই দুই ধর্মের শাসকরাই একসময় রাজত্ব করেছেন। মানিকচক, মোথাবাড়ি ও রতুয়া অঞ্চলে বসবাসকারী মৈথিল জনসংস্কৃতির লোকাচারও মিশে রয়েছে এই একদিনের উৎসবের মধ্যে। ত্রিপিটক-এ আছে, এই মাঘী পূর্ণিমার দিনে ভক্তদের উদ্দেশে অন্তিম উপদেশ দান করেছিলেন ভগবান বুদ্ধ। আবার প্রচলিত হিন্দু সংস্কারে, এই মাঘী পূর্ণিমার দিন গঙ্গাস্নান করলে রোগশোক থেকে মুক্তি, জরামুক্তি এবং পাপমুক্তি ঘটে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইছামতী’ উপন্যাসেও ইছামতী নদীর তীরে গ্রামের সমস্ত মেয়ে-বউদের গোরুর গাড়িতে করে গিয়ে গঙ্গাস্নানের মেলায় যাওয়ার উচ্ছ্বাস এবং নদীর তীরে বনভোজনের স্মৃতি বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে রয়েছে।
বাঙ্গিটোলা গ্রামে বসবাসকারী নতুন প্রজন্মের তরুণী সর্বাণী ঝা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে মায়ের সঙ্গে গঙ্গালাহানি মেলায় গিয়ে গঙ্গাস্নান করেছি। এখন নতুনদের মধ্যে এসবের প্রচলন কমে গেছে বটে তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে এতে মানসিক শান্তি পাই। হাজার হাজার মানুষ টোটো ভাড়া করে পাশের গ্রামগুলো থেকে, এমনকি গাড়ি ভাড়া করে শহর থেকেও এই দিনটায় পাগলাঘাটে আসেন।’

তবুও মানুষ মুক্তি চায়। অনেক না বলা যন্ত্রণা, চেপে রাখা চোখের জল, গোপন পাপ থেকে মুক্তি। রতুয়ার বাহারালের সেই পঞ্চাশোর্ধ্ব যেমন। অন্ধকারে বুঝতে না পেরে শেয়াল ভেবে মাছমারা কোঁচের ঘায়ে মেরে ফেলেছিলেন আট বছরের ভাইকে— তখন তার বয়স বারো। থানা-পুলিশ-জেল আর অনুতাপের আগুনে নিজেকে পুড়িয়ে ছাই করে যখন বেরিয়ে এলেন, তারপর থেকে একটা বছরও বাদ দেননি গঙ্গালাহানির মেলায় আসতে। একা আসেন— একা একাই দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন জলে। গঙ্গামাইয়ার ঠান্ডাজল বুক ছাড়িয়ে গলা অবধি উঠে আসে, কিন্তু জ্বালা কমে কই? তার শরীরের ওপর দিয়েই চুপচাপ বয়ে যান পতিতোদ্ধারিণী জাহ্নবী— তিনি তো সবার মা; ‘খুনি’-রও।