Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: লিচু চুরি

বড়পিসিকে আমরা পিসিমণি বলতাম। তাঁর ছেলেমেয়েদের ডাকা হত বড়দা, ছোটদা, বড়দি আর ছোটদি বলে। কিছুদিন আগে ছোটদা মারা গেছেন, বছর-পঞ্চাশেক বয়সে। আজ ছোটদি ছাড়া আর কেউই বেঁচে নেই। ছোটদির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। পুরনো দিনের অনেক গল্প বাইরে এল আর সেই গল্পের অনেকখানি জুড়ে ছোটদার কথা। ছোটদা, বাংলার একসময়ের নামী ফুটবল খেলোয়াড় অলোক মুখার্জি। জন্মেছেন গত শতকের ষাটের দশকে। তাঁদের শৈশব-বাল্য-কৈশোর কাল আজকের মত একবারেই ছিল না। ছোটদার প্রসঙ্গ, ছোটদার ছোটবেলার গল্পে তাঁর সখা গোপীনাথ থাকবে না, তাই কি হয়? সেই গোপীনাথ বা গোপীদার দুষ্টুমি ও মজার গল্প বলতেই ধারাবাহিক ‘ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ’।

প্রথম কিস্তি

গরমের ছুটি চলছে। গোপীনাথ সকাল-সকাল হাজির, ‘চল অলোক! মাঠে যাই!’ পিসিমণি বললেন, ‘এই রোদে, গরমে মাঠে যাবি কীরে? ঘরে বসেই কিছু খেল।’ জালের বারান্দায় বসে (জাল দিয়ে ঘেরা বারান্দা, জায়গাটাকে জালের বারান্দা বলা হত) গল্প-গুজব শুরু হল।
জালের বারান্দার ঠিক সামনের বাড়িটায় জানলা দিয়ে এক গোছা লিচু ঝুলছে। নজর গেল গোপীনাথের, ‘আরে গুরু! চলো, ঝেপে দিই!’ ছোটদা বলল, ‘ওটা সন্ধ্যাদির বাড়ি! ওদিকে নজর দিয়ো না। ধরলে, তোমায় কাইট্টা ফ্যালাইব!’ গোপীনাথ বলল, ‘বেশ তবে চ্যালেঞ্জ রইল। আজ সন্ধের মধ্যে ও লিচু পেটস্থ না করতে পারলে আমার নাম গোপীনাথ নয়।’ দুপুর বারোটা বাজতে চলেছে। গোপীনাথ বলল, ‘এখন উঠি। আবার তিনটে, সাড়ে-তিনটে নাগাদ আসব। তৈরি থেকো। ও লিচু আমায় টানছে।’
দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার জালের বারান্দায় বসা হল। এবার হোমওয়ার্ক নিয়ে। স্কুলগুলো ছুটিতেও স্বস্তি দেয় না! নাঃ, ও লিচু সত্যিই টানছে। জানলার উপর থেকে ঝোলানো আছে বড়-বড় লাল-লাল লিচু। এক লাফ মারলেই পুরো গোছাটা হাতে এসে পড়বে। গোপীনাথ কি সত্যিই লিচুর এটেম্পট নেবে? কে জানে?
বেলা তিনটে পনেরো নাগাদ গোপীনাথ হাজির। বেলা চারটের আগে বাইরে বেরনো বারণ ছিল ছেলেপুলেদের। গোপীনাথ বলল, ‘কাকিমা, গরমের ছুটির হোমওয়ার্ক একসঙ্গে করব আমরা।’ পিসিমণি তালা খুলে দিয়ে, তারপর গেলেন আধঘণ্টা গড়িয়ে নিতে। ভাতঘুম একটু দরকার হত তখনকার দিনে। পাড়া বেশ শান্ত। সাড়ে তিনটে বেজে গেছে। ও লিচু আর কাউকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। এদিকে চারটের আগে বাড়ি থেকে বেরনোর কোনও উপায় নেই। আবার ভয়, চারটের মধ্যে যদি সন্ধ্যাদি উঠে পড়ে? গোপীনাথ মুখ খুলল, ‘টার্গেট ফাইনাল! ও আজ কোনও মতেই ফসকাবে না!’
চারটে বাজতেই গোপীনাথ আর ছোটদা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল। গোপীনাথ বলল, ‘গুরু! লিচু আমি টানবই। তবে যদি ধরা পড়ি, তুমিও কিন্তু সাথি হয়ো।’ ছোটদা বলল, ‘ধরা পড়লে, বাবা পিঠের ছাল-চামড়া তুলবে। গোপীনাথ, ছেড়ে দে। লিচু টেনে আর কাজ নেই।’
গোপীনাথ একথায় একটুও রাজি হল না। ছোটদাকে বলল, ‘লিচু টানার পর, পগার পার দেওয়ার দু’চারটে অপশন রাস্তা দেখাও। আর তুমি তার একটিতে গিয়ে দাঁড়াও। আমি কাজ সেরে আসছি।’ ছোটদা বাড়ির পেছনের অবাঙালি বস্তির রাস্তা আর তার পাশ দিয়ে বাড়ির ছাদে যাওয়ার রাস্তা বলে দিল। আর নিজে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল।
গোপীনাথ সন্ধ্যাদিদের জানলার পাশে গিয়ে প্রথমে দেখে নিল কেউ আছে কিনা। সব শুনশান দেখে গোপীনাথ টপ করে জানলায় চড়ে, মারল এক হ্যাঁচকা টান। সট করে লিচু গোছাসুদ্ধ গোপীনাথের হাতে! ‘এই কে রে?’ আওয়াজ এল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু গোপীনাথ কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে, ডালপালা সমেত লিচু নিয়ে দিল এক ছুট। সে যে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল, কারও সাত পুরুষের খোঁজার ক্ষমতা ছিল না! তাই সন্ধ্যাদিকে ‘আমার লিসু (লিচু) লইয়া গেল’ আর তার সঙ্গে ক’টা খিস্তি-খেউড় করে নিজের মনেই গজগজ করতে হল। ওদিকে ছোটদা আর গোপীনাথ, অবাঙালি বস্তির দিকের রাস্তা দিয়ে বাড়ির ছাদে উঠে, এক পাশে বসে লিচু সাবড়াল। আমার মায়ের মুখে শুনেছি, ওই লিচুর গোছা থেকে, একটা লিচু, গোপীনাথ আমার মাকেও (ওরা মামিমা বলত) দিয়েছিল। সব লিচু পেটস্থ করে, পেছন দিকের রাস্তা দিয়েই মাঠে খেলতে চলে গিয়েছিল ওরা। সন্ধ্যাদি, সন্দিগ্ধ কাউকে আশপাশে না দেখে, লিচুর জন্য স্বতঃস্ফূর্ত শোক জারি রেখেছিল। গোপীনাথ অভিযানে সফল হয়ে মনের আনন্দে ছিল।
আসল গল্পটার কিন্তু এখানেই শেষ নয়। উপসংহার পড়লেই বুঝবে গোপীনাথ কেন আজ গল্পের নায়ক হয়ে উঠেছে!
পরের দিন বিকেলবেলা, গোপীনাথ মাঠে খেলতে যাবার জন্য ছোটদাকে রোজকার মত ডাকতে এল। সন্ধ্যাদি তখন বাড়ির দাওয়ায় বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। গোপীনাথ হঠাৎ করে, তার অচেনা-অজানা সন্ধ্যাদিকে বলে বসল, ‘লিচুগুলো বড় মিষ্টি ছিল, তাই না দিদি?’ সন্ধ্যাদি তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। ‘তুমি কী কইরা জানল্যা? তুমি সুরি (চুরি) করসিলা কাল?’ গোপীনাথ একটুও ঘাবড়াল না। একদম গোবেচারা হয়ে বলল, ‘কী চুরি? আরে দিদি, সেদিন আপনি যে দোকান থেকে লিচু কিনলেন, আমিও যে আপনার পাশে দাঁড়িয়ে ওই ফলের দোকান থেকেই লিচু কিনে নিয়ে গেলাম।’ সন্ধ্যাদির তপ্ত মাথা পট করে ঠান্ডা হল। ‘ওঃ! তাই বলো! আর বোলো না ভাই! কাল কোন হতচ্ছাড়া আমার জানলাতে সইরা (চড়ে) লিসু চুরি কইরা লইয়া গেল! কী বলব সোরের (চোরের) দল সব! সবে দুইট্যা আমরা খাইসিলাম! বাকি সব সোরে নিল ভাই!’
গোপীনাথ সন্ধ্যাদির লিচু-শোকে সমব্যথী হয়ে, ছোটদাকে নিয়ে মাঠের পথে পা বাড়াল। ছোটদার কালো চেহারা কিছুক্ষণের জন্য ভয়ে সাদা হয়ে থাকবে! তবে গোপীনাথ থাকতে রং বদলানোর আর সুযোগ হয়ে ওঠেনি। ছোটদাও বলতে বাধ্য হয়েছিল, ‘জয়বাবা গোপীনাথ!’

চিত্র : গুগল

ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: চাঁদা আদায়

ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: ঘুগনি সেল

ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: লে হালুয়া

ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: মুদিখানার প্রত্যাবর্তন

ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: আচার অভিযান

ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: পরীক্ষার খাতা

ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: পথের চাঁদা

5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গাপুজো: অতীত দিনের স্মৃতি

মহালয়া দিয়ে হত পুজোর প্রকৃত সূচনা। শরতের ভোররাতে আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত এই অনুষ্ঠানটির শ্রোতা অন্তহীন, এবং এখনও তা সমান জনপ্রিয়। বাংলাদেশেও অনুষ্ঠানটির শ্রোতা অগণিত। আমাদের শৈশবে বাড়ি বাড়ি রেডিও ছিল না, টিভি তো আসেইনি। বাড়ির পাশে মাঠে মাইক থাকত, আর প্রায় তিনশো গজ দূরের এক বাড়িতে মাউথপিস রাখা থাকত। সেখান থেকে ভেসে আসত মহালয়ার গান, ভাষ্য।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গাপূজা, মূর্তিপূজা: দেশে দেশে

আসলে বাঙালি নিরন্তর এক অনুসন্ধানী, ব্যতিক্রমী, অভিনব-চিন্তক, ক্রমবিকাশপ্রিয় ও অন্তিমে রহস্যময় জাতি। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান মুসলমান আস্তিক নাস্তিকে মিলিত এই জাতি সঙ্ঘারাম আর মিনার, ধ্বজা ও ওংকার, জগমোহন-মিরহাব-স্তূপ-ভস্মাচ্ছাদিত এক জাতি, নিজ মুদ্রাদোষে নয়, মু্দ্রাগুণে আলাদা।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শারদোৎসব: বাংলাদেশে

দুর্গাপুজো কেবল ভক্তের জন্য-ই নয়, ভাল লাগাদের জন্যও। যে ভাল লাগা থেকে ভাই গিরীশচন্দ্র সেন কোরানশরীফ বাংলায় অনুবাদ করেন, অদ্বৈত আচার্য যবন হরিদাসের উচ্ছিষ্ট নিজহাতে পরিষ্কার করেন, স্বামী বিবেকানন্দ মুসলিম-তনয়াকে কুমারীপুজো করেন! দুর্গা বাঙালির কাছে, ধর্মনির্বিশেষে আগ্রহের, যেহেতু এই দেবী পরিবারসহ আসেন, আর সঙ্গে নিয়ে আসেন কাশফুল আর শিউলি। তাই তো সনাতন রামপ্রসাদ, খ্রিস্টান মাইকেল, ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ এবং মুসলমান কাজী নজরুল দুর্গাকে নিয়ে কলম না ধরে পারেননি!

Read More »
কাজী তানভীর হোসেন

ধানমন্ডিতে পলাশী, ৫-ই আগস্ট ২০২৪

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে কয়েকদিন ধরে যা ঘটেছিল, তা শুরু থেকেই গণআন্দোলনের চরিত্র হারিয়ে একটা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে পরিণত হয়েছিল। আজ আমরা কার্যক্রম দেখেই চিনে যাই ঘটনাটি কারা ঘটাচ্ছে। আগুন আর অস্ত্র নিয়ে রাজনীতি করার স্বভাব রয়েছে বিএনপি-জামাত ও রোহিঙ্গাদের। তারা যুক্তিবুদ্ধির তোয়াক্কা করে না।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য: কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

আমরা বিধানচন্দ্র রায়ের মতো মুখ্যমন্ত্রী পেয়েছিলাম, যাঁকে খুব সঙ্গত কারণেই ‘পশ্চিমবঙ্গের রূপকার’ বলা হয়। পেয়েছি প্রফুল্লচন্দ্র সেন ও অজয় মুখোপাধ্যায়ের মতো স্বার্থত্যাগী মুখ্যমন্ত্রী। এবং জ্যোতি বসুর মতো সম্ভ্রান্ত, বিজ্ঞ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রখর কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদ। কিন্তু তাঁদের সকলের চেয়ে অধিক ছিলেন বুদ্ধদেব। কেননা তাঁর মতো সংস্কৃতিমনা, দেশবিদেশের শিল্প সাহিত্য চলচ্চিত্র নাটক সম্পর্কে সর্বদা অবহিত, এককথায় এক আধুনিক বিশ্বনাগরিক মানুষ পাইনি। এখানেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অনন্যতা।

Read More »