Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: ঘুগনি সেল

বড়পিসিকে আমরা পিসিমণি বলতাম। তাঁর ছেলেমেয়েদের ডাকা হত বড়দা, ছোটদা, বড়দি আর ছোটদি বলে। কিছুদিন আগে ছোটদা মারা গেছেন, বছর-পঞ্চাশেক বয়সে। আজ ছোটদি ছাড়া আর কেউই বেঁচে নেই। ছোটদির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। পুরনো দিনের অনেক গল্প বাইরে এল আর সেই গল্পের অনেকখানি জুড়ে ছোটদার কথা। ছোটদা, বাংলার একসময়ের নামী ফুটবল খেলোয়াড় অলোক মুখার্জি। জন্মেছেন গত শতকের ষাটের দশকে। তাঁদের শৈশব-বাল্য-কৈশোর কাল আজকের মত একবারেই ছিল না। ছোটদার প্রসঙ্গ, ছোটদার ছোটবেলার গল্পে তাঁর সখা গোপীনাথ থাকবে না, তাই কি হয়? সেই গোপীনাথ বা গোপীদার দুষ্টুমি ও মজার গল্প বলতেই ধারাবাহিক ‘ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ’।

তৃতীয় কিস্তি

গোপীনাথকে যত জানছি ততই হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরছে। সেবার যখন গুবলুর পৈতেতে কলকাতা গেলাম, তখনও হঠাৎ করেই গোপীনাথ প্রসঙ্গ এসে পড়ল। ছোটবেলা, কত হুটোপাটি করা, এসব কথা উঠতেই ঠিক মনের সরু গলি দিয়ে গোপীনাথের আবির্ভাব হল। ছোটদি বলল, যদি ছোটদা বেঁচে থাকত, তবে ভাল করে গোপীনাথের গল্প শুনতে পেতিস। ছোটদার চলে যাওয়ার কথা ভাবলেই মন ভরে আসে। কিন্তু ওই বিষয়টাকে জোর করে ঠেলে সরিয়ে দিলাম। আমরা বললাম, আরে তুমি যা জানো তাই বলো না!
সেবার দুর্গাপুজোয় সন্তুদা ঘুগনির দোকান দিয়েছে আমতলা মাঠে। পূজামণ্ডপের ঠিক সামনের রাস্তার ধারে, যেখানে ফুচকাওয়ালা, বেলুনওয়ালা, আরও সব টুকিটাকি দোকান লেগেছে, সেখানে। হজমিওয়ালার পাশের দোকানটা, সন্তুদার ঘুগনির দোকান। দোকান কী আর বলব? ওই টেম্পোরারি স্টল আর কী। ষষ্ঠীর দিন বিক্রি কমই হবে, এমনটা আন্দাজ ছিল। তবু ঘুগনি ভরা ডেকচি নিয়ে, সন্তুদা, বিকেল সাড়ে পাঁচটায় দোকানে এসে বসল। ছেলেছোকরাদেরই ভিড় আজ হবে। বাড়ির বড়দের ষষ্ঠীর দিনে ঠাকুর দেখতে বেরনো আর কোথায় হয়? পুজোর সময় বাড়িতে কত কাজ থাকে! সপ্তমী, অষ্টমীতে বড়রা সব ঠাকুর দেখতে বেরোত।
গোপীনাথ তার দলবল নিয়ে বিকেল চারটে থেকে প্যান্ডেলের সামনে আড্ডা জমিয়েছে। গোপীনাথ বলল, ‘ভাই, অনেকক্ষণ একই জায়গায় আমরা বসে আছি। কোমর, পা, সব ধরে গেল! চলো, মাঠে ঢোকার মেন এন্ট্রিটার দখল নিইগে। মাঠে ঢোকার মুখে ওই যে লোহার বড় গেটটা, তার ওপরে গিয়ে বসি সব। ওখানে বসলে, কারা আসছে, যাচ্ছে, তারও হিসাব রাখা যাবে আর পুজোর কী লেটেস্ট ফ্যাশন মার্কেটে খাচ্ছে, তারও আইডিয়া নেওয়া হবে।’
যা বলা, তাই কাজ! একঝটকায় উঠে দাঁড়াল গোপীনাথ। তারপর বলল, ‘‘চলো, গেটের দিকে। ‘চরৈবেতি’!’’
রানা বলল, ‘কী বেতি?’
গোপীনাথ টক করে বলল, ‘আহ ইডিয়েট একটা! আস্ত আহাম্মক! সংস্কৃত হচ্ছে গিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ। সেটারও কিস্যু জানিস না! শেখারও কোনও ইচ্ছে নেই। খালি ফোড়নকাটা স্বভাব!’
বাকিরা আর কথা না বাড়িয়ে গোপীনাথের সঙ্গে গেটের ওপর গিয়ে বসল। গোপীনাথ বলল, ‘‘জ্ঞান বিতরণ করলে আরও বাড়ে। আর তাছাড়া, মা আজ বলছিল, পুজোগণ্ডার দিনে কিছু না কিছু দান করা উচিত। তাই আমি বরং এইবেলা আমার দানকার্যটা সেরে ফেলি। শোন সবাই। আর রানা, তুই একটু বেশি মন দিয়ে শোন। ‘চরৈবেতি’ মানে হল এগিয়ে চলো।’’
একথা-সেকথা চলছে। সবাই এমনিতেই পুজো বলে খুব খুশি, আরও খুশি যে পুজোর চার দিন বইপত্রে হাত দেওয়ার কথা কেউ বলবে না। গোপীনাথের নজর গেল, ‘আরে বাহ! সন্তুদা ঘুগনির দোকান দিয়েছে!’ তারপর একলাফে গেট থেকে নেমে বন্ধুদের বলল, ‘দাঁড়া একটু খবর নিয়ে আসি। তদারকিটার দরকার আছে।’
চট করে সন্তুদার দোকানে পৌঁছে গোপীনাথ বলল, ‘তা ডেকচিতে কী এনেছ সন্তুদা?’ এরপর সন্তুদার উত্তরের অপেক্ষা না করেই, ডেকচির ঢাকনা সরিয়ে, তাতে নিজেই উঁকি মারল আর বলল, ‘বাহ! ঘুগনি! বেশ সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে তো! মনে হচ্ছে, বৌদি খাসা রেঁধেছে! তা, কত করে প্লেট রেখেছ সন্তুদা?’
সন্তুদা বলল, ‘এক টাকা আর দুটাকা।’
‘আচ্ছা’, বিজ্ঞের মত বলল গোপীনাথ, ‘তুমি হলে গিয়ে পাড়ার লোক। তোমার হেল্পার লাগলে বোলো, আমি আছি।’ উড়ন চাকতির মত চলে গেল গোপীনাথ।
ষষ্ঠীর সন্ধে গড়িয়ে গেল। তেমন লোক আজ আসেনি। তাই বিক্রিবাটাও তেমন হয়নি। ‘কাল সপ্তমী। কাল বিক্রি ভাল হবে’, ভাবছিল সন্তুদা। পরের দিন একটু বিকেল-বিকেলে দোকান লাগাল। মণ্ডপে লোক আসছে। কেউ কেউ ঘুগনি কিনছে। সব যেন চলছে ধীরে-ধীরে, নিজের তালে। সন্তুদাকে একবার দোকান ছেড়ে বাড়ি যেতে হবে। কিছু জরুরি তলব। পাশের বাড়ির ছেলে এসে খবর দিয়ে গেছে। ‘কী যে করি’, ভাবছে। হঠাৎ দেখল, গোপীনাথ তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। মনে পড়ল, গোপীনাথের কালকের বলে যাওয়া কথা। সে ডাক দিল, ‘এই গোপী, একটু শোন এদিকে। কথা আছে।’ চটজলদি এল গোপীনাথ। ‘আমার দোকানটা এক মিনিট দেখবি? একবার বাড়ি যেতে হবে আমাকে। এখনই চলে আসব। দেখবি?’
গোপী সদা রাজি। সে বীরপুরুষের মত এগিয়ে এল। ‘সন্তুদা, তুমি নিশ্চিন্তে বাড়ি যাও। গোপীনাথ সব সামলে দেবে।’
দোকান ক্যাপচার করতে তার এক মিনিটও লাগল না। আগেই বলেছি, এ দোকান মানে পুজোর সময় লাগানো টেম্পোরারি স্টল। হরে-গড়ে একটা ছোট কাঠের টেবিল, যাতে ঘুগনির ডেকচি রাখা আছে। একটা বসার জন্য ছোট বেঞ্চ। নিচে রাখা, ছোট একটা জলের ড্রাম। মোড়ানো শালপাতার ঠোঙা, চামচ, কিছু পুরনো খবরের কাগজ আর একটা জলের জাগ।
ডেকচির ঢাকনা খুলে গোপীনাথ বেশ গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল। তারপর বন্ধুদের উদ্দেশ করে জোরালো একটা সিটি মারার চেষ্টা করল। নাঃ, তাতে বিশেষ কাজ হল না! এই সিটিটাই একটা জিনিস, যা গোপীনাথ এখনও হান্ড্রেড পার্সেন্ট আয়ত্ত করতে পারেনি। তাই সে, একে একে বন্ধুদের নাম ধরে হাঁক মারতে শুরু করল। ছোটদা, রাজা, রানা, পার্থ, গৌতম, পল্টু সবাই সন্তুদার দোকানে পৌঁছে গেল। এবার গোপী গলা খাঁকরে নিয়ে বলতে শুরু করল, ‘আট আনা, আট আনা… হোলসেল আট আনা… বন্ধুদের জন্য আট আনা… যে এইবেলা আসবে, সেই বন্ধু… হোলসেল আট আনা।’
‘এই গোপী, কী বলছিস এগুলো তুই? সন্তুদার দোকানে করছিসই বা কী?’, জিজ্ঞেস করল পল্টু। গোপীনাথ আবার বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে বলল, ‘গোপীর দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে কারওর সন্দেহ নেই। মাল গোপীনাথের হাতে ছেড়ে দিয়েছে গুরু! আগে তোমরা খেয়ে দেখো। তবেই বুঝব মাল সেল হবে, কী হবে না। সেই বুঝে লেবার দেব।’
আট আনার ঘুগনি শুনে গোপীনাথের দলবদলের ছেলেরা তো কিনলই; আশপাশের কচিকাঁচারাও ভিড় জমাল। এক টাকা, দুটাকার কমে কেউই ঘুগনি দিচ্ছে না আজকাল। কোনও পাড়ার স্টলে আট আনার ঘুগনি নেই। কচিকাঁচাদের মুখে এমনও ফিসফিসানি শোনা গেল যে, কেউ কেউ একটু আগেই, এই স্টল থেকেই দুটাকার ঘুগনি কিনে নিয়ে গেছিল। কেউ আবার বলল, তখন দোকানদারটা অন্য ছিল! একজন আবার ষষ্ঠীর দিনেই বাকি পাড়ার পুজো সব ঘুরে এসেছিল। সে বলল পিয়ার্স রোড, বয়েজ স্পোর্টিং কোথাওই আট আনার ঘুগনি নেই। তাই এই সুযোগটা হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। আট আনায় দুর্লভ ঘুগনিকে সুলভ করতে সবাই তৎপর হল। মোটকথা ঘুগনি বিকোতে শুরু করল।
সন্তুদা আসছে। দোকান পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে ঘুগনি প্রায় সব শেষ। এক ডেকচি ঘুগনি হাওয়া। সন্তুদা হতবাক। গোপী বলল, ‘বৌদি এমন খাসা ঘুগনি বানিয়েছিল যে, সব ধুলোর মতো বিকে গেল। আচ্ছা সন্তুদা, এবার ছাড়ো দেখি, আমার কমিশন।’ সন্তুদা ক্যাশবাক্সে উঁকি মারল। মাথায় হাত তার! ‘গোপী, তুই এ কী করলি? তুই লস খাইয়ে দিলি?’ তারপর বলল, ‘আমারই দুর্বুদ্ধি যে আমি তোকে দোকান দেখতে বলে গেছিলাম! তোকে মাল বেচতে কে বলেছিল? শুধু একটু খেয়াল রাখিস বলে, গেলাম। ভারি লস খাইয়ে দিলি।’ আর চিন্তিত মুখে লোকেদের জন্য রাখা বেঞ্চটাতে বসে পড়ল সন্তুদা। গোপীনাথ বলল, ‘তুমি চিন্তা কোরো না সন্তুদা। কাল দোকান থেকে আমি মটর আনব। তোমরা খালি বানাও। তুমি কাল দেখে নিয়ো।’
এখানে বলে রাখি, সন্তুদা আসলে পাঞ্জাবি, মানে পাঞ্জাবের লোক। ওদের পুরো পরিবার এখানেই থাকে অনেক বছর ধরে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত, বড় পরিবার। পুজোর সময় ওরা কোনও না কোনও জিনিসের ছোট একটা স্টল লাগাত। তাই এবারে ঘুগনির স্টল। গোপীনাথের কথা শুনে সন্তুদা শুধু বলল, ‘জ্যাদা বার খাওয়াস না গোপী।’
মণ্ডপের ভিড় হালকা হয়ে আসছে। সময় অলসতা করে কি? হয়তো না। একমাত্র সময়ই এমন একটা কনসেপ্ট, যে ডিসিপ্লিন ভাঙার কোনও কারণই খুঁজে পায় না। সারাক্ষণ সেই এক ক্রিস্প রুটিনে চলে। আর এই সময় সিদ্ধান্ত অনুসারেই সপ্তমীর পর অষ্টমী এল। সকালে অঞ্জলি, দুপুরের ভোগ পেরিয়ে-গড়িয়ে সন্ধে আসতে দেরি হল না। গোপীনাথ সপ্তমীর রাতে বলেছিল, ‘আজ লস খাওয়ালাম, কাল লাভ করাব।’ সন্তুদা দোকানে রেডি। আজ লোকের ভিড় বেশি হবে। কাজেই বিক্রির সম্ভাবনা বেশি। ওদিকে গোপীনাথ তার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল। নজর তার দোকানের দিকে। সন্তুদার স্টল লাগানো পুরো হতেই গোপীনাথ বন্ধুদের বলল, ‘গুরু তোমরা আড্ডা মারো, আমি একটু সন্তুদার সেল করাই। দরকার হলে ডাকব। তৈরি থেকো।’ ছোটদারা ভাবছে, কী যে করে গোপীনাথ! তবে ভুললে চলবে না, কাল সস্তায় ঘুগনি গোপীনাথের দৌলতেই জুটেছে। গোপীনাথ আড্ডায় না থাকলে, আড্ডাটা তেমন জমে না। তবু আড্ডা তো আর বন্ধ হয় না! তাই আড্ডা চলছে। সত্যি বলতে কী, সবারই নজর পড়ে আছে গোপীনাথের দিকে।
অষ্টমীর রাত। বেশ ভিড় জমা শুরু হয়েছে প্যান্ডেলে। লোকেদের আনাগোনা বাড়তেই থাকছে। হঠাৎ দেখা গেল, গোপীনাথ লোকেদের প্রায় ধরে ধরে সন্তুদার স্টলে আনতে শুরু করেছে। দোকানের সামনে রাখা পাতলা বেঞ্চে বড়-বুড়ো লোকেদের বসাচ্ছে। কিছু ভাবা, বোঝার আগেই তাদের হাতে পটাপট ঘুগনির প্লেট দিচ্ছে, আর বলছে, ‘অতিথি হল গিয়ে নারায়ণ। আমি পাখা করছি, আপনারা খান।’ খবরের কাগজ ভাঁজ করে, তা দিয়ে গোপীনাথের পাখা করার সে কী বহর! গোপীনাথের বন্ধুরাই দূর থেকে দেখে হাসি সামলাতে পারছে না, বাকিদের অবস্থা ভেবে দেখো! লোকেদের মনোরঞ্জনও ভালই হচ্ছিল। শেষে এমন হল যে ভিড় সামলাতে এবার সন্তুদা হিমশিম খাচ্ছে। গোপী সন্তুদাকে বলল, ‘ভেবো না। ইমার্জেন্সি সার্ভিস স্ট্যান্ডবাই রেখেছি। গোপী কাঁচা কাজ করে না।’ এমনটা বলে, গোপীনাথ তার বন্ধুদের ডাক দিল, ‘ওরে জনাপাঁচেক এদিকে আয় দেখি।’ গোপীনাথের দলবল জনাপাঁচেক, চারেক হিসেব করতে গেল না। তারা যেন এই ডাকটার জন্য অনন্তকাল থেকে অপেক্ষা করছিল। হুড়মুড় করে তারা সন্তুদার স্টলের কাছে পৌঁছে গেল। গোপী বন্ধুদের বলল, ‘সব বাঁদরের দল! কবে আর ডিসিপ্লিন শিখবি? মেলা কাজ বাড়াস না। শুধু জনাপাঁচেক এদিকে আয় দেখি। এনাদের পাখা কর।’ আদেশ হওয়ামাত্রই অতি উৎসাহী পাঁচজন আগে এগিয়ে গিয়ে, যারা ঘুগনি খাচ্ছেন তাদের খবরের কাগজ দিয়ে পাখা করা শুরু করল। গোপী মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে বাকিদের উদ্দেশে বলল, ‘এরা হাঁপিয়ে গেলে, নেক্সট জনাচারেক আসবি।’ গোপীনাথের দল সব কাজে লেগে গেছে। কেউ পাখা করছে, কেউ হাত ধুতে জল দিচ্ছে, কেউ ‘আসুন আসুন’ বলে লোকেদের ডেকে ডেকে দোকানে আনছে। গোপীনাথ এগিয়ে গেল সন্তুদার দিকে। সন্তুদা খুব খুশি। খুব উৎসাহের সঙ্গে সন্তুদা বলল, ‘গোপী আর একটু পরেই সব ঘুগনি শেষ হয়ে যাবে।’ গোপী ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তুমি থামো তো। জল ঢালো। মালটাকে বাড়াও। আমি চট করে বৌদির কাছে গিয়ে ফুটিয়ে আনছি।’ গোপীকে রোখা দায়। সে সন্তুদার উত্তরের অপেক্ষা না করেই, সন্তুদার বাড়ি থেকে একটা মিডিয়াম সাইজের কড়াই নিয়ে এল। কিছুটা ঘুগনি সেই কড়াইতে ট্রান্সফার করেই, আসল ডেকচি নিয়ে সন্তুদার বাড়ির দিকে ধাঁ! হনুমানের সঞ্জীবনী আনার জন্য পর্বত কাঁধে নেবার দৃশ্য চোখে ভেসে উঠল। এদিকে কড়াইয়ের ঘুগনি শেষ হতে চলেছে। সন্তুদা এনাউন্স করতেই যাবে যে, ‘ঘুগনি শেষ’, ঠিক তখনই ‘এসে গেছি, এসে গেছি, রাস্তা দাও’, বলতে বলতে গোপীনাথ ড্রামাটিক এন্ট্রি নিল। আবার পুরোদমে ঘুগনি বিক্রি চলতে লাগল। ডেকচির তলানি কুরে কুরে ঘুগনি না বেচা পর্যন্ত গোপীনাথ ক্ষান্ত হল না!
রাত প্রায় সাড়ে ন’টা। ঘুগনি শেষ। আজ খুব সেল হয়েছে। পকেট ভারি! সন্তুদা বলল, ‘তোর সঙ্গে আর কারবার করব না গোপী, মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিলি। শেষে জল ঢেলে, ঘুগনি আমারই বাড়ি থেকে ফুটিয়ে আনলি!’ হাজির জবাব গোপীনাথ বলল, ‘রাখো তো তোমার মান সম্মান! বলেছিলাম না, পুষিয়ে দেব। দেখলে তো? একেই বলে বিজনেস!’ সন্তুদা, বেশ কিছু টাকা পকেট থেকে বের করে বলল, ‘নে গোপী, তোর কমিশন।’ গোপীনাথ বলল, ‘সে তো কালই নিয়েছি। গোপীকা সব অ্যাডভান্স! বন্ধুদের আট আনায় তোমার ঘুগনি খাইয়েছি।’ সন্তুদা অনেক জোর করা সত্ত্বেও গোপীনাথ একটা টাকাও নিল না। সন্তুদা গোপীর কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘বেশ তবে দশমীর দিন আমার বাড়িতে তোদের সবার ঘুগনি পার্টি।’ গোপীনাথ একগাল হেসে বলল, ‘জি হুজুর! তবে তার আগে, কাল, নবমীর সেলটারও আমি দায়িত্ব নিলাম।’ এটা বলেই, পরক্ষণে গোপীনাথ বন্ধুদের হাঁক দিতে দিতে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। আর সন্তুদা ঘুগনির খালি ডেকচিতে হাত রেখে একটুকু তাকিয়ে রইল গোপীনাথের চলে যাবার রাস্তার দিকে।
মণ্ডপ খালি। আমতলা মাঠ প্রায় খালি। রাস্তাও খালি। শুধু সন্তুদার মন খুশিতে ভরে আছে। সন্তুদা দোকান গুছিয়ে পা বাড়াল নিজের বাড়ির দিকে। রাতের বেলার ঝিম ধরানো আম গাছ শরতের আকাশের কাছে সমস্ত খবর পৌঁছে দিচ্ছে।

চিত্র : গুগল

ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: লিচু চুরি

ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: চাঁদা আদায়

ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: লে হালুয়া

ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: মুদিখানার প্রত্যাবর্তন

ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: আচার অভিযান

ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: পরীক্ষার খাতা

ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: পথের চাঁদা

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »
শুভদীপ রায়চৌধুরী

শুভদীপ রায়চৌধুরীর দুটি কবিতা

অন্ধকারের তুমি,/ নরম পুঁইমাচার নিচে সবজেটে বহুরূপী/ তোমাকে আলোর কণার ভেতর গড়িয়ে যেতে দেখব বলে/ আমি এই পাগলের পৃথিবী ছেড়েছি/ টিলাপায়ে বাস করি/ নাম, সমুদ্রসম্ভব।/ পাতার ইমারত আছে, আছে/ কিছু দৈনন্দিন কাজ/ মাছ ধরার নাম করে/ বালসাভেলায় অনেকদূর যাওয়া/ যতদূর ভেসে গেলে ঢেউয়ের চুম্বন থেকে/ ছোবলটুকু আলাদা করাই যায় না

Read More »
নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | দ্বিতীয় পর্ব

সকালে চিড়ে নারকেল-কোরা আর গুড় খেয়ে আমি সাইকেলে চেপে ছুটিয়ে দিলাম— আট মাইল রাস্তা ঠেঙিয়ে যখন পৌঁছালাম— তখন গণগণে রোদ্দুর তেষ্টায় গলা কাঠ। ঘন্টাখানেক গাড়ি চালিয়ে একটা বাড়ি দেখে সাইকেল থেকে নেমে পড়লাম যদি একটু জল খাওয়া যায়। বাড়ির বারান্দায় একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি বসেছিলেন— তার কাছে উদ্দিষ্ট ঠিকানার কথা প্রশ্ন করতেই তিনি উঠে এসে আমার হাত ধরে আমাকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে একটা পাটি পেতে বসতে দিলেন। আমি আবার জল চাইলে বললেন, “দাদাঠাকুর ব্যস্ত হবেন না— ঠিক জায়গায় এসে পড়েছেন।”

Read More »