‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন’ বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে যাওয়া এই শব্দবন্ধ আমরা বারেবারে উচ্চারণ করি। যখনই কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় আসে, যখনই কোনও রোগের প্রকোপ বাড়ে, যখনই পরিবেশ ধ্বংসর কথা ওঠে, যখনই বিশ্ব উষ্ণায়নের কথা ওঠে। অনেককেই দেখি এই গ্রহের ভবিষ্যৎ নিয়ে, এই গ্রহের প্রতিটি প্রাণের ভবিষ্যৎ নিয়ে, সর্বোপরি মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। তাঁরা পৃথিবীর এই অসুখের কারণ হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড় করান তথাকথিত এই সভ্যতাকে।
নানান বিষয়ে বিকল্প রাস্তার কথা উঠে আসে। কীটনাশক রাসায়নিক সারের বদলে জৈব পদ্ধতিতে কৃষিকাজ, প্রাচীন শস্যবীজগুলোকে সংরক্ষণ ও ব্যবহার, জিএম চাষবাস না করা, উৎপাদনে কম দূষণের প্রযুক্তির ব্যবহার, কম দূষণের যানবাহনের ব্যবহার, প্লাস্টিকমুক্ত পৃথিবী, পাকা বড় বাঁধ তৈরি না করা, জনজাতি ও গ্রামীণ মানুষদের অভিজ্ঞতালবদ্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে জীবনকে একটু সরল করে তোলা, একটু বেশি কায়িক শ্রম করে জীবনযাপন, প্রাকৃতিক চিকিৎসা, লোকসংস্কৃতি রক্ষা, অরণ্য রক্ষা ইত্যাদি প্রভৃতি।
এভাবে চিন্তা যাঁরা করেন তাঁরা অবশ্যই আপমতলবি লোক নন। পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁরা খুবই চিন্তিত। তাই তাঁরা এই সমস্ত বিষয়গুলোকে নিয়ে ভাবেন, বিকল্প পথের সন্ধান দেন, সেই নিয়ে প্রচার করেন। আমি তাঁদের এই উদ্বেগকে অত্যন্ত সম্মান করি কিন্তু কিছু বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে গলা মেলাতে কেমন বাধো বাধো ঠেকে। কেন? সেইটাই একটু বলি।
প্রথমেই বলে নিই এই যে, তথাকথিত ‘সভ্যতা’ যাকে পৃথিবীর সমস্ত দুর্বিপাকের জন্যে দায়ী করতেই আমরা অভ্যস্ত সেই সভ্যতা কিন্তু আকাশ থেকে টুপ করে পড়েনি। কালক্রমে তার উন্নতি হয়েছে, কখনও ধীরে ধীরে, কখনও দ্রুত। সে দুম করে এসে কীটনাশক বা রাসায়নিক সার দিয়ে চাষ করতে নেমে পড়েনি। এই সভ্যতা অতীতে সমস্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই গেছে— পাঁচশো বছর পেছোলেই দেখব জৈব পদ্ধতিতে চাষ, দূষণহীন যানবাহন, প্লাস্টিকহীন পৃথিবী, কংক্রিটের বড় বাঁধ না-থাকা— এ সবই সভ্যতার মূলস্রোতে ছিল। যারা আজকের তথাকথিত সভ্যতার ধারক ও বাহক তাঁদের পূর্বপুরুষরাও গ্রামে বাস করেছেন, জনজাতিরা যেমন জীবনযাপন করেন বা ওইরকম জীবনযাপন করেছেন। সেই প্রাচীন পদ্ধতিতেই তাঁরা চিকিৎসা চালাতে বাধ্য ছিলেন তখন, লোকগীতি সৃষ্টি করেছেন, দেহতত্ত্ব নিয়ে গান বেঁধেছেন।
মানে আমি বলতে চাইছি যে বিকল্প জীবনপদ্ধতির পক্ষে সওয়াল উঠছে সেই পদ্ধতিতে তো আমাদের পূর্বপুরুষরা বাস করেছেন। তবে কেন সেগুলো ছাড়তে হল? জীবনের প্রয়োজনে। তাঁরা আরও এগোতে চাইলেন। নিশ্চয়ই জৈবচাষ সকলের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য যোগাতে পারছিল না তাই অজৈব নানান পথের খোঁজ করতে হয়েছিল। ওই যে কী একটা কথা আছে না ‘নেসেসিটি ইস দ মাদার অব ইনভেনশন’ না কি।
আমি মনে করি, সভ্যতাকে টিঁকে থাকতে গেলে দুটো ব্যাপারের সঙ্গে কখনওই আপস করা যাবে না। এক হচ্ছে মানুষের কায়িক শ্রম কমিয়ে যন্ত্রনির্ভর হয়ে উৎপাদন বাড়ানো, দুই হচ্ছে গতি। এই দুটো থেকে পিছিয়ে আসার কোনও জায়গা নেই। এক পা এগিয়ে দু-পা পেছনো কোনও ব্যক্তির বা কোনও সামাজিক অথবা রাজনৈতিক সংগঠনের স্ট্রাটেজি হতে পারে। কিন্তু সভ্যতায় সে-সুযোগ নেই। উপরের বিকল্পগুলো খেয়াল করুন— জৈব চাষ, দূষণহীন যানবাহন, প্লাস্টিকহীন পৃথিবী, ছোট বাঁধ, জনজাতি-জ্ঞান-ভিত্তিক জীবনযাত্রা, চিকিৎসা, সংস্কৃতি— এগুলো কিন্তু কোনওটাই নতুন বিকল্প নয়। একেবারেই এক দুই বা কয়েক ধাপ পিছিয়ে যাওয়ার কথা বলা। পুরাতনীর চর্চা কেউ করতেই পারেন, সেটা শখ মেটানোর জন্যে ভাল। কিন্তু দরকারের জায়গায় পিছিয়ে আসার কোনও জায়গা নেই।
এই বিকল্পগুলো যাঁরা হাজির করেন তাঁরা উদাহরণ হিসেবে উন্নত নানান দেশের নানান ঘটনার কথা তোলেন। প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ আর আর্থিক সম্পদসম্পন্ন অল্প জন্যসংখ্যার দেশের উদাহরণ কি এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে খাপ খাবে? চারদিকে লক্ষ লক্ষ একর জমিতে রাসায়নিক কীটনাশক কিংবা সার দিয়ে চাষ কয়েক দশক ধরে হচ্ছে আর তার মাঝখানে দশ একর জমিতে জৈব চাষ করে ফসল ফলিয়ে কিছুই প্রমাণ হয় না। মাটি পরিবেশ ইতিমধ্যেই অজৈব চাষ বেশ খানিকটা বদলে ফেলেছে। আপনার যত সদিচ্ছাই থাকুক জনসংখ্যা বাড়বে, মানুষের নাগরিক চাহিদা বাড়বেই। কৃষিজমি কমবেই, সে-জমি অকৃষি জমিতে রূপান্তরিত হবেই। মানে সেখানে চাষবাস হবে না। তবে কম জমিতে বেশি ফলনের পথ আপনাকে ভেবে বার করতেই হবে। মনে রাখতে হবে ছ’শো কোটি মানুষকে খাওয়াতে হবে। জানি না জিএম ফুডের বিকল্প কী? অবশ্যই জিএম ফুডের বাণিজ্যর সমর্থন করছি না। কিন্তু বিকল্প কী? শুধুই পিছিয়ে যাওয়া।
আবার শহুরে নদীবিজ্ঞানী নানান তথ্য ও তত্ত্ব দিয়ে প্রমাণ করতেই পারেন বড় কংক্রিটের বাঁধ কোনও কাজের কাজই করে না, বরং বছর বছর বন্যা হতে দিলে সেটা পরিবেশের পক্ষে ভাল। কিন্তু একটা ভরা কোটালে যাঁদের ঘর ভেসে যায় তাঁরা অবশ্যই প্রতিবছর ভাসতে পছন্দ করবেন না। নদী বিশেষজ্ঞর কাছে যেটা চমৎকার বিকল্প সেইটাই একদল মানুষের পক্ষে চরম বাৎসরিক বিপর্যয়। অনেকে আবার সুন্দরবনের ব-দ্বীপগুলোতে মানুষের বসবাসেরই বিপক্ষে। মানুষ কোথায় না বাস করে? একই কথা পাহাড়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্লাস্টিকের থেকে বেশি উপযোগী ও বেশি ব্যাবসায়িক মূল্যর কিছু আবিষ্কার না করতে পারলে এই মুহূর্তে প্লাস্টিককে সরানো সম্ভব নয়। সভ্যতায় ব্যান করে কিছু করা যায় না। উপযোগী নতুন বিকল্প দিতে হয়। সেইটাই সভ্যতার চ্যালেঞ্জ আর জীবনীশক্তিও বটে। এই চ্যালেঞ্জ না নিতে পারলে সভ্যতা বাঁচতে পারবে না। মেট্রোরেল দূষণমুক্ত যান কিন্তু তাকে চালাতে বিদ্যুৎ লাগে, সে বিদ্যুৎ পেতে হলে ফসিল ফুয়েল পোড়াতে হবে অথবা নদীতে বাঁধ দিতে হবে। তার মানে কিন্তু আমি একবারও বলছি না যে নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস হোক কিংবা যার যা ইচ্ছে তাই করুক। অভয়ারণ্য, সমুদ্রে কত গভীরতায় কীরকম মাছধরার জাল ব্যবহার করা হবে সেসব নিয়ে আইনকানুনও আছে এই তথাকথিত সভ্যতায়।
আসলে একটা ধাপ এগোলে কিছু কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ হবেই। গত একশো বছরে যেহেতু উন্নতির হার সর্বোচ্চ কো-ক্যাটারাল ড্যামেজও অনেক বেশি করে চোখে পড়ছে। একে আরও বাড়িয়েছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা। সর্বোচ্চ মুনাফার তাড়নায় এই ড্যামেজ কন্ট্রোলের ওপর জোরটা কম পড়ছে। কাজটা আসলে সেখানেই। একধাপ পিছিয়ে যাওয়ায় নয়। মানুষের ওপরে দূষণের প্রভাব নিয়ে আপনি এক লক্ষ একটা সমীক্ষা ও গবেষণার তথ্য পেশ করতেই পারেন। কিন্তু মানুষের গড় আয়ু যে ক্রমশ বাড়ছে সেটাও অস্বীকার করার জায়গা নেই।
পরিবেশের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবকে যতই গালমন্দ করা হোক না কেন আসল সমস্যা কিন্তু অতি উৎপাদন। একটা দেশে একদিনে পাঁচশো সাবান লাগলে তৈরি হচ্ছে একদিনে পাঁচ হাজার। তাই চাপটা বেশি পড়ছে পরিবেশের ওপর। সেটাই দূষণের সমস্যার প্রধান কারণ। প্রচুর মেধা অনেক অপ্রয়োজনীয় লাভজনক পণ্যের গবেষণায় ব্যাপ্ত তাই বোধহয় যেগুলো মূল সমস্যা সেগুলোর নতুন বিকল্প পেতে অনেক দেরি হচ্ছে। সমস্যা এইখানেই, সমাধান তাই আরও এগিয়েই পেতে হবে। যাতে যতটুকু দরকার ততটুকুর উৎপাদনই হয় কিংবা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে অর্থ ও মেধার যোগানে যেন ঘাটতি না থাকে। শুধুই পিছিয়ে যাওয়ার কথা ভাবলে কিন্তু মুশকিল। ইন্টারনেট যদি কাজের জিনিস হয়, সেগুলো যদি সবার ব্যবহারে কাজে লাগে, তবে গ্রামগঞ্জের ছেলেমেয়েরা কিন্তু বাইক চড়বে বা মোবাইলে গেম খেলবে। এখন তো কোথাও পরীক্ষা করার উপায় নেই যে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে মোবাইল আবিষ্কার হলে শিশু-কিশোররা পাবজি না খেলে মাঠে ফুটবল খেলতে যেত। যদি গ্রামে একটা উন্নত হাসপাতাল বা স্কুল তৈরি করতে হয় তবে বিদ্যুৎ ইত্যাদি লাগবেই। আর সেগুলো গ্রামে এলে মানুষ টিভি দেখবেই। তাদের মধ্যে নাগরিক জীবনের স্পৃহা তৈরি হবে। সেইটিই স্বাভাবিক, বরং না হলেই আশ্চর্য। একটা নতুন প্রযুক্তি সব দিক থেকেই প্রভাব বিস্তার করবে। তার খানিকটা নেব খানিকটা ফেলে দেব— এইরকম হয় না। ২০২১-এর বাচ্চাদের মোবাইল নিয়েই ভোলাতে হবে। এক নতুন ধরনের জীবনযাত্রায় ঢুকলে এক নতুন সংস্কৃতিও আসবে। শহর ও গ্রামের জীবনযাত্রা ধরনটা যত একরকমের হবে সংস্কৃতিও তত একরকম হতে বাধ্য। জনজাতিদের মধ্যেও তাই হবে। জনজাতি ছেলেপুলেরা বই পড়বে, কম্পিউটার চালাবে, সারা বিশ্বের খবর রাখবে আর অবসরে মাদল বাজিয়ে গান গাইবে— এমন ভাবলে একটু সমস্যাই হবে, কেউ কেউ হয়তো করবে কিন্তু বেশিরভাগই করবে না। এগুলো হবেই— এ নিয়ে গেল গেল রব তোলার কিছু নেই। একটাকার শাম্পু আর গুঁড়ো সাবানের পাউচ নিয়ে একসময় খুব রব তোলা হয়েছিল। কী ক্ষতি হয়েছে জানি না তবে ছারপোকা আর উকুনের উপদ্রব যে কমেছে তা অস্বীকার করা যায় না।
সবশেষে একটা কথা বলি, বহু ধ্বংসাত্মক ব্যাপার থাকলেও আজকের এই সভ্যতাই মানুষের সবচেয়ে বড় অবদান। যারা এই সভ্যতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না তারা আসলে কয়েক ধাপ নিচে আছেন। এই সভ্যতা সেই ধাপগুলো পেরিয়ে এসেছে, তাদেরও পেরিয়ে আসাটাই কাম্য। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর আধুনিক চিকিৎসা শিক্ষা পাওয়ার স্বাধীনতা এক জিনিস নয়। ওরা ওদের মত আছে, থাকতে দেওয়া, ওদেরটাই তো প্রকৃত সভ্যতা জাতীয় আলফাল কথা না বলাই ভাল। সভ্যতা যে যে সুবিধে দিয়েছে তা প্রত্যেক মানুষের জন্যে বরাদ্দ করতে হবে। এই হল মোদ্দা কথা। ঘরে এসি চালিয়ে স্কচে চুমুক দিতে দিতে ল্যাপটপে এয়ারলাইন্সের টিকিট বুক করার পরে ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ নামক ফেসবুক গ্রুপে বীরভূমে কয়লাখনি হলে তসরের পোকার কী হবে, কিংবা কীভাবে বিলিতি দারু আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছে সে নিয়ে জ্ঞানবর্ষণ খুবই স্বার্থপরের মত কাজ বলেই মনে হয়। সবশেষে বলি, পুরাতনী কৃষি, যানবাহন, গানবাজনা, সংস্কৃতির চর্চা কেউ করতে পারেন কিন্তু সকলের কাছ থেকে তার সমর্থন আশা না-করাই ভাল। দুটো বিষয়ের তফাত ভাল করে বুঝতে হবে শখ আর দরকার।