অনেক দিন ভেবেছি রামকে কেন আমার তেমন দেবতা-টেবতা মনে হয় না! আসলে, এটা হয়তো আমার বাংলায় জন্মানোর কুফল। ছোট থেকে এক ম্যা-ম্যা ডাকের প্রজাতির লিঙ্গ নির্বিশেষে বিশেষণ হল ওই রাম। সেটি ছাড়াও আরও কয়েকটি মনুষ্যেতর প্রজাতিও আছে এই রাম বিশেষণযুক্ত দলে। কী করে এতে আমার ভক্তিভাব জন্মাবে!
স্কুলে কিংবা বাড়িতে যখনই কিছু ভুল হল অমনি ওই রামবিশিষ্ট প্রাণীগুলি আমার ডাকনাম হয়ে যেত। কাহাঁতক ভাল লাগে। এমনই একদিন রামবাঁদরে ভূষিত হয়ে মনখারাপ করে সাদা ইরেসারের পেটের ঠিক মাঝখানে পেন্সিলের সিস দিয়ে প্রবল আক্রোশে ফুটো করার আপ্রাণ চেষ্টা করছি, তখনি ঠাম্মি বলল, যা তো খোকা ভাঁড়ার থেকে রামদাটা আন তো!
‘রামদা’! এ আবার নতুন কোন দাদা এল আবার। আমার বিহ্বল মূর্তি দেখে হয়তো ঠাম্মির হুঁশ এল। বলল, ওরে ও খোকা, যা না বাবা, কাটারির মত বড়সড় দা-টা নিয়ে আয় শিগ্গির। সাবধানে আনিস; নিজের পা-টা আবার থেঁতো করিসনি। আমি নিশ্চিত জানতাম ঠাম্মির জায়গায় অন্য যে কেউ হলে, এমন সব ক্ষেত্রে, আমার একাধিক রাম বিশেষণ জুটত!
কিন্তু ঠাম্মি আমাকে কখনও কোনও আপত্তিকর ডাকনামে ডাকেনি। আমি চিরকালই খোকা। অবশ্য অবাক হয়ে দেখতাম ঠাম্মির কাছে অবলীলায় আমার বাবাও খোকা, দাদাও খোকা আবার আমিও খোকা। ঠাম্মি যখন ‘খোকা খোকা’ বলে হিমালয় অক্টেভে হাঁক দিত, আমি কিছুতেই বুঝতাম না কার জন্য সেই হাঁকডাক! বেশিরভাগ সময়েই আমার ভাগ্যে জুটত, কী রে হাঁদারাম, শুনতে পাচ্ছিস না, ঠাম্মি ডাকছে! তখন থেকেই আমি জানি রামের অর্থ ‘খুব বড়’ কিছু কিংবা ‘অতিশয়’ এমন সব।
নিশ্চিত হলাম ওই অমর যেদিন ক্লাসে— ন’ উনিশং কত— লিখতে গিয়ে নামতা ভুলে খাতার পাশে রাফে গুণ করে ১৭১ বের করে মুছেও দিয়েছিল; কিন্তু অঙ্কের স্যার সোমনাথবাবু ঠিক ধরে ফেললেন; ব্যাটা, তুমি রামচালাক হয়েছ! বলে এমন ডাস্টার দিয়ে ঠকাঠক ঠকাঠক যে অমর সেদিনই মরে আর কী! আর জেনেছিলাম বেচারা চালাকি করলে হয়তো প্রাণে বাঁচত কিন্তু রামচালাকির খেলায় তার এমন মৃত্যুদণ্ড!
ছেলেবেলায় সহজ পাঠে সবে বাংলা বর্ণ চিনে প্রথম পাঠের ‘দীননাথ রাঁধে ভাত। গুরুদাস করে চাষ’ শেষ করে যেই দ্বিতীয় পাঠে জীবনের প্রথম পড়া গদ্যে ঢুকেছি অমনি, ‘রাম বনে ফুল পাড়ে। গায়ে তার লাল শাল। হাতে তার সাজি।… ফুল তুলে রাম বাড়ি চলে।’ এ তো আমার চেনা ছবি।
শীতের ছুটিতে মামার বাড়ি গেলে দেখতাম ঠিক অমন পোশাকেই ‘গল্পদাদু’ ভোরে বাগানে ফুল তুলতে আসতেন। ফুল তোলা হলে লাল শালের নিচে সাজিটি ধরে কত রকম সব গল্প বলতেন। সেই গল্পের লোভে আমরা ছোটরা শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়তে কোনওই আপত্তি করিনি কখনও। আর সেই গল্প, লাল শাল, সাজি, ফুলের সঙ্গে মিলেমিশে রামচন্দ্রও কখন যেন গল্পদাদুর মত বন্ধু হয়ে গেল।
বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের দশম পাঠে, ‘রাম, তুমি হাসিতেছ কেন। নবীন কেন বসিয়া আছে’ পড়ার পর থেকেই রাম আমার স্কুলের বেঞ্চে পাশে বসা ছেলেটি, যাকে ওই বইটির ষোড়শ পাঠে স্যার ধমকে বলতে পারেন, ‘দেখ রাম, কাল তুমি পড়িবার সময় বড় গোল করিয়াছিলে।’
এরপর বাংলা রিডিং পড়ায় সড়গড় হতেই হাতে এল যোগীন সরকারের ‘ছোটদের রামায়ণ’; সেই পাতলা চটি ছোটখাটো বইটির আশি পাতার মধ্যেই সাতকাণ্ড রামায়ণ। তারপরেই হাতে পেলাম উপেন্দ্রকিশোরের ‘ছেলেদের রামায়ণ’ আর এসব কৃশকায় বইগুলোই আমায় রামরাজাকে চেনাল। হাওড়ার ব্যাঁটরার ছেলে; তদ্দিনে পাবলিক লাইব্রেরির স্কুলে ক্লাস থ্রি। ব্রজর বাড়ি রামরাজাতলা। নির্ঘাত তার বাড়ি অযোধ্যার ধারেপাশে; এমন গর্বের বন্ধু পেয়ে আমার চেতনা ছাপ্পান্ন ইঞ্চি। তবে বৃত্তি পরীক্ষার গণ্ডি পেরোতেই উপহার পেলুম লীলা মজুমদারের ‘লঙ্কাদহন পালা’। উঃ, সে কী নাটক রে ভাই। সেই বইটিই আমায় শিখিয়েছে ‘ঠাট্টার সময়ে ইয়ার্কি’ করতে নেই। আর জানলাম সেই গুরুবাক্য, ‘রামায়ণে বাহাদুর রামচন্দ্র নয়/ কহ বাহু তুলে বদন খুলে/ হল্লুমানের জয়।।’ তাই বলি, কেন ইতিউতি সিঁদুরমাখা কমলা রঙের পেল্লাই হল্লুমান মূর্তি বসানো আছে! এরপর যখন দশ ক্লাসের বাংলা বইয়ে মধুসূদন দত্ত, ‘রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী, আমি কি ডরাই, সখি, … …?’ তখন রামচন্দ্র একেবারে পথে বসল। এইজন্যই বাংলার মোড়ে মোড়ে শনিমন্দির আছে, কিন্তু রামমন্দির কই!
আম বাঙালির ঠাকুরঘরে তাই কেষ্ট ঠাকুর, নারায়ণ কিংবা লক্ষ্মী, কালী, শিব সব আছে। রাম দেবতাটি কদাচ। সেই ইস্কুলবেলা থেকেই রাম আমার বনে ফুল পাড়া, পড়া না করা বন্ধুটিই রয়ে গেল। দেবতা তার আর হয়ে ওঠা হল না।
দারুন আ- রাম পেলাম এই বি- রাম হীন রম্য স্মৃতিচারণ পড়ে। তবে এর মধ্যে বাঙালির রাম ভক্তির একটি বিশেষ বস্তু, “বৃদ্ধ সন্যাসী ” সম্পর্কে কোন উল্লেখ নেই কেন? আর একটা প্রশ্ন আছে, “হে রাম” আর “হারাম” এর মধ্যে রাম এক সেই একই?
?