গীতা হল ধর্মগ্রন্থ। আর মহাভারত কাহিনি। বেশ জনপ্রিয় কাহিনি। ব্রাহ্মণ্য ধর্মর পাণ্ডারা যুগে যুগে মহাভারত-এর কাহিনির মধ্যে ধর্মমাহাত্ম্য গুঁজে দিয়েছেন। মূল কাহিনির সঙ্গে সেগুলোর তেমন কোনও সম্পর্ক নেই। সেগুলো না থাকলেও মহাভারত-এর গল্পর তেমন হেরফের হত না। গীতা-ও তেমনি এক গুঁজে দেওয়া ধর্মমাহাত্ম্য।
গীতা-র অর্জুন হঠাৎ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধর আগে বিবশ হলেন। তিনি যুদ্ধ চান না। কেন? যুদ্ধ হলে আত্মীয়স্বজন-বন্ধু বধ করতে হবে। সমাজ উৎসন্নে যাবে। আর নরহত্যার দায়ে তাঁর নরকবাস হবে— তা-ই। এইখানে অর্জুনের আর-এক নাম গুড়াকেশ। বাংলায় গীতা-র অন্যতম ভাষ্যকার শশীশেখর বসুর মতে, এখানে গুড়াকেশের অর্থ যিনি নিদ্রা ও আলস্যত্যাগ করেছেন যিনি। তা অর্জুন কীসের জন্যে ঘুম বিশ্রাম ত্যাগ করলেন। না, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আয়োজনের জন্যে। তবে কি তিনি জানতেন না যে যুদ্ধ কাদের সঙ্গে করতে হবে? অবশ্যই জানতেন। সারাজীবন যুদ্ধ আর হত্যা করে হঠাৎ নরকবাসের ভয়ও বেশ অমূলক। আসল কথা হল, সমাজের অবক্ষয় হবে ভেবে অর্জুন বিবশ হলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হলে বহু বহু ক্ষত্রিয়র মৃত্যু হবে আর ক্ষত্রিয়দের অভাবে তাঁদের কন্যা ও বিধবারা জৈবিক তাড়নাতেই অন্য বর্ণর মানুষদের সঙ্গে মিলিত হয়ে সন্তান উৎপাদন করবেন। সে সন্তান হবে বর্ণসংকর। আর বর্ণসংকরদের জন্ম মানেই সমাজের সর্বনাশ। ব্রাহ্মণ্যধর্মর ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী, বর্ণসংকর আসলে বর্ণাশ্রম বা জাতপাত থেকে বিচ্যুতি। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য এবং শূদ্র— ধর্মশাস্ত্রর মতে এই চার জাতের মধ্যে কোনওভাবেই বৈবাহিক সম্পর্ক করা যাবে না। শুধু নিজের জাতের মধ্যেই বিয়ে করতে হবে। নচেৎ বর্ণসংকরের জন্ম ও সমাজের অধঃপতন। ধর্মশাস্ত্র গীতা-তে অর্জুনের বর্ণসংকরদের জন্ম নিয়ে এই দুশ্চিন্তাকে দূর করতে শ্রীকৃষ্ণকে আঠেরো অধ্যায় ধরে ‘বেদবিরোধী’ জ্ঞান দিতে হয়।
এবার কাহিনি মহাভারত-এ অর্জুনের বংশর জাতবিচার করা যাক। বৈশম্পায়নীয় মহাভারত-এর মূল গল্প শুরু হয় সত্যবতীর জন্ম থেকে। উপরিচর (আকাশে আকাশে ঘুরত) নামে এক পুরু বংশীয় ক্ষত্রিয় বিয়ে করেন কোলাহল পর্বত ও শুক্তিমতি নদীর মেয়ে গিরিকাকে। একদিন স্নানের সময় উপরিচর-এর কাম জাগে ও বীর্যস্খলন হয়। সেই বীর্য যাতে বৃথা না যায় তাই উপরিচর এক বাজপাখির ঠোঁটে করে সেই বীর্য গিরিকার কাছে পাঠান। বীর্য নিয়ে যাওয়ার পথে সেই বাজপাখির সঙ্গে আর-একটি বাজপাখির লড়াই বাধে। বীর্য পড়ে যমুনাতে। সেই নদীতে অদ্রিকা নামে এক অপ্সরা তখন শাপগ্রস্ত হয়ে মাছের জীবন অতিবাহিত করছিলেন। সেই মাছটি ওই বীর্য খেয়ে ফেলে ও গর্ভবতী হয়, পরে এক ধীবরের জালে সেই মাছ ধরা পড়ে। পেট থেকে দুটি সন্তান পাওয়া যায়। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। ছেলের নাম হয় মৎস্য, মেয়ের নাম হয় সত্যবতী। ধীবরদের কাছেই তিনি বড় হন। তাঁর গায়ে ছিল মাছের তীব্র গন্ধ।
বর্ণসংকরের মাত্রাটা একবার ভাবুন। ক্ষত্রিয়র বীর্য, ধারণ করছে অপ্সরা, যে কিনা আবার মাছ। মানে, বর্ণসংকর শুধু মানুষে সীমাবদ্ধ নয় অপ্সরা আর মাছের মিশ্রণ সেখানে।
যাঁরা অলৌকিক এই গালগল্প মানতে চান না, তাঁরা বোঝেন সত্যবতী আসলে ধীবরদের মেয়ে। ধীবর মানে শূদ্র। জাতে কৈবর্ত। কৈবর্ত আবার কোনও বিশুদ্ধ জাত নয়। বর্ণসংকর। নিষাদ পিতা ও আয়োগবি মাতার সন্তান। নৌকর্ম, মাছ ধরাই এঁদের জীবিকা। বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুযায়ী এঁরা অসৎ শূদ্র মানে জল-অচল শূদ্র। পশ্চিমবঙ্গে এখন কৈবর্তদের দুটি ভাগ জালিয়া (জেলে) ও হালিয়া (চাষি বা কৃষক)। তার মধ্যে জালিয়ারা তপশিলি সম্প্রদায়ভুক্ত।
এখন জল-অচল শূদ্রর মেয়ে সত্যবতীর সঙ্গে ব্রাহ্মণ পরাশর ঋষির প্রেম হল। আর কুমারী অবস্থায় সত্যবতী এক সন্তানের জন্ম দিলেন। তাঁর নাম কৃষ্ণ। দ্বীপে জন্মেছিলেন বলে পরিচয় হলো কৃষ্ণদ্বৈপায়ন। তিনি বর্ণসংকর। তিনিই মহাভারত নামক মহাকাব্যর আদি রচয়িতা। আর বেদকে চারভাগে ভাগ করেছিলেন বলে তাঁর নাম বেদব্যাস। ব্রাহ্মণ্যধর্ম পালন ইত্যাদিতে তিনি এত জ্ঞান লাভ করেন যে, অমর বা চিরঞ্জীবী হয়ে যান। ভারতে সাধারণত সাত চিরঞ্জীবীর কথা আসে, ব্যাস, কৃপ, বলী, অশ্বত্থামা, পরশুরাম (ইনি আবার এক অবতারও। কিন্তু এঁর বাবা জমদগ্নি ছিলেন ব্রাহ্মণ, মা রেণুকা ক্ষত্রিয়। অর্থাৎ ইনি বর্ণসংকর। মানে ব্রাহ্মণ্য ধর্মর অবতারও বর্ণসংকর), বিভীষণ ও হনুমান। বেদব্যাস শুধু মহাভারত-এর রচয়িতাই নন, এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রও বটে।
পরবর্তীতে সত্যবতীর বিয়ে হল কুরু বংশীয় শান্তনুর সঙ্গে। শান্তনুর বংশবৃত্তান্ত ঘাঁটলে জানা যাবে, তাঁর পূর্বপুরুষদের কারুর স্ত্রী শূদ্রা, কারুর বা দেবী। মানে এঁরাও বর্ণসংকর। শান্তনু ও সত্যবতীর দুই ছেলে চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। চিত্রাঙ্গদ অকালে মরলেন। বিচিত্রবীর্য দুই স্ত্রীয়ের গর্ভেই সন্তান উৎপাদন করতে পারলেন না। ওদিকে ওঁদের সৎদাদা ভীষ্ম ভীষণ প্রতিজ্ঞা করে বসে আছেন বিয়ে তিনি করবেন না। কুরুবংশ লোপ পাওয়ার দশা। তখন সত্যবতী তাঁর পুত্র ব্যাসদেবকে ডেকে পাঠালেন। ব্যাসের ঔরসে বিচিত্রবীর্যর দুই স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নিলেন যুধিষ্ঠির ও পাণ্ডু, আর এক শূদ্রের গর্ভে জন্ম নিলেন বিদুর। পাণ্ডু হলেন অর্জুনের পিতা। তাহলে গীতা-য় বর্ণসংকর নিয়ে চিন্তিত অর্জুনের বংশর জাতবিচার করতে বসলে কী বেরোবে? ব্রাহ্মণ (পরাশর), ক্ষত্রিয় (কাশীরাজের দুই কন্যা বিচিত্রবীর্যের স্ত্রী ছিলেন), অসৎ শূদ্র (সত্যবতী)— সব মিলিয়ে জগাখিচুড়ি। আক্ষরিক অর্থে জাতের ঠিক নেই। তা ছাড়া অর্জুনের বায়োলজিকাল ফাদার ইন্দ্র। সেখানেও মানুষে দেবতাতে মিলন। বর্ণসংকর।
আসলে কাহিনি তুলে ধরে সমাজের ছবিকে। আর ধর্মশাস্ত্রগুলো তুলে ধরে আদর্শর ছবিকে। মহাভারত কাহিনি। সেই সময়ের সমাজ এই বর্ণসংকর ব্যবস্থা বা বর্ণাশ্রমকে খুব বেশি পাত্তা দিত বলে মনে হয় না। বেদব্যাস, পরশুরাম তার প্রমাণ। মহাভারত ঘাঁটলে এইরকম অজস্র উদাহরণ পাওয়া যাবে। বিদুর আজীবন বেশ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। এমনকি পঞ্চপাণ্ডব যখন বাণপ্রস্থে যাচ্ছে তখন পরীক্ষিৎ নেহাত ছেলেমানুষ। যুধিষ্ঠির রাজ্য দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান ধৃতরাষ্ট্র ও এক বৈশ্যার সন্তান যুযুৎসুকে।
মহাভারত-এর সমাজ বুঝেছিল বিভিন্ন জনগোষ্ঠী থাকলে বর্ণসংকর ব্যবস্থাকে আটকানো যাবে না। ফলে সে নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু ভারতের মানুষদের পেছনদিকে এগিয়ে চলার এক অদ্ভুত উৎসাহ। পরবর্তীতে তাঁরা মনু ইত্যাদি ধর্মশাস্ত্রকারগণ যে আদর্শ জাতপাতভিত্তিক সমাজ তৈরির কথা বলে গেছেন, সেই দিকে পা বাড়ালেন এবং এখনও হাঁটছেন। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। ভারতীয়রা সকলেই এখন বর্ণসংকর। বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য বা শূদ্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। নামের পরে পদবি ছাড়া জাত আর কোত্থাও নেই। চারবর্ণ ছাড়াও ভারতীয়দের রক্তে মিশে আছে ম্লেচ্ছ আর যবনদের রক্তও। বুখারা সমরখন্দ পারস্য পর্তুগাল ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের রক্তও যে ভারতীয়দের মধ্যে মিশে নেই, এমন কথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবেন না। অথচ জাতপাত নিয়ে এখানে প্রতিদিন কী নিষ্ঠুরতা। একটি দলিত মেয়ের ধর্ষণ হলে সে নীচুজাত অর্থাৎ ধর্ষণের যোগ্য বলে অভিহিত করা হয়। শরীরের সব বর্ণর মিশ্রিত রক্ত নিয়েও ব্রাহ্মণ পদবির জোরে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করেন। কিন্তু সত্যিটা অন্যরকম। আক্ষরিক অর্থেই ভারতীয়দেরও এখন জাতের ঠিক নেই।
khub delicately apnar lekhay ekta point apni focus korechen . varotiyo bolte apni kebolmatro hindu der bapare alochona kore hoyto etai bojhalen je varote bosobaskari onno dhormer lokera varotiyo non . varotiyo bolte hindu der mark kore , evabe onno dhormer lokeder indirectly o-varotiyo bolar ortho ki ?