‘হে ঠাকুর, করোনাকে আরও কয়দিন রেখে দাও গো।’
অদেখা এই ‘ঠাকুর’ নাম্নী শব্দমায়ার প্রতি কথাগুলো ছুড়ে দিয়ে, চটজলদি সব কাজ সারতে থাকে প্রতিমা। মেয়ের ঘরে নাতনি। প্রতিমার কাছেই থাকে। পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করল, বছর তিন সংসার করে এক মেয়ে ঘাড়ে করে ফিরে এল বাপের বাড়ি। মিটে গেল সব প্রেম। প্রতিমা কত করে বারণ করেছিল। শুনবে কেন? ওর কপালে আছে দুর্গতি।
আজ নাতনির স্কুলে মিড ডে মিলের সব জিনিস দেবে। আলু, চাল, সাবান, ছোলা, চিনি, ডাল। এই দিনটা মনটা বেশ খুশি থাকে। সকাল থেকে প্রাণ ঢেলে কাজ করতে থাকে। দু’হাতভরে এক পয়সাও না দিয়ে এত্ত জিনিস, মজাই আলাদা। নাতনি টিয়াকে নিয়ে রাখতে গিয়ে কত সময় যে বিরক্ত হয়েছে, কিন্তু মিড ডে মিলের জিনিস পাওয়ার এ আনন্দ সে কোথায় পেত যদি টিয়া তার কাছে না থাকত।
‘ও টিয়ে, কোথায় গেলি মা? এক কাপ চা বসা দেখি, রওনা দি তোর স্কুলে।’
টিয়া দৌড়ে রান্নাঘরে যায়। দিদা স্কুলে গেলে তার ভারি মজা লাগে। আন্টিদের কথা জানা যায়। আগের মিড ডে মিলে তো আন্টিরা খাতাও দিয়েছে।
দিদা বেরিয়ে গেলে ঘরটা সুন্দর করে গুছোতে থাকে টিয়া। দিদা কত কাজ করে। বড় খাটুনি দিদার। একটু ঘর গুছিয়ে রাখলে দিদা খুব শান্তি পায়। টিয়ার তো এক দিদাই আছে। মা মাঝে মাঝে আসে বটে। এলেই ঝগড়া। দিদা রেগে গিয়ে বলতে থাকে, ‘মেয়েটাকে আমার কাছে ফেলে রেখেছিস, খরচ লাগে সে কথা ভাববি। আমি কী করে চালাব?’
টিয়ার তখন খুব কষ্ট হয়। মা যে কেন তাকে নিজের কাছে নিয়ে যায় না। মা নাকি হাসপাতালে কাজ করে। দরজায় কেউ ধাক্কা দিচ্ছে। দিদা সব বন্ধ রাখতে বলেছে।
‘দরজা খোল টিয়া।’
বুকের ভিতর দলা পাকিয়ে কান্না এল। মায়ের কথাই যে মনে পড়ছিল। দরজাটা খুলে দিয়ে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল টিয়া। তার যে রোজ রাতে মায়ের বুকে মুখ রাখতে ইচ্ছে করে। ঝুমা মেয়েকে কাছে পেয়ে আকুল কান্নায় ভাঙে। সে মাকে টাকা দেয় না, কেবল জমাচ্ছে। সব জমিয়ে মাকে আর মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে যাবে।
‘কাঁদিস না রে মা, তোকে আমি নিজের কাছে নিয়ে যাব। আমি আর হাসপাতালের একটা দিদি একঘরে থাকি তো রে, কোথায় নেব তোকে?’
টিয়ার মনের অলিগলি বেয়ে একটা প্রশ্ন ঠিকরে বেরিয়ে এল, ‘আমার বাবা কোথায় মা, বলো না মা।’
কী উত্তর দেবে। না সত্যিটাই বলবে।
‘জানি না রে, তুই যখন ছোট, একদিন কোনও কিছু না বলে কোথায় যে চলে গেল। ও আসলে ভেবেছিল, আমার কাজের সব টাকাপয়সা আমি ওকে মাস গেলে দিয়ে দেব। যেই দেয়া বন্ধ করলাম, তখন থেকেই ঝামেলা শুরু। তারপর একদিন চলে গেল।’
খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করছে টিয়া। ওকে মায়ের দুঃখ ঘোচাতেই হবে।
***
‘কী রে, তোর তো ইভনিং ডিউটি। ও ঝুমা রেডি হলি না এখনও?’ একই জায়গায় কাজ করে ঝুমার সঙ্গে থাকে নমিতাদি, সেই তাড়া দেয়। ‘মনখারাপ করে গুমরে থাকিস না। কাজে বের হলেই দেখবি সব ভুলে যন্ত্রের মত চলছিস।’
ঝুমার আজ মনপাথারে ঠকে যাবার জ্বালা ধরেছে। রাজেন যে এমনটা করতে পারে ভাবতে পারেনি ঝুমা। মাকে ফেলে পালিয়েছিল। সরকারি হাসপাতালে একটা চাকরি তখন জুটেছে। রাজেন সে লোভে বিয়েটা করেছিল।
ইস্কুলের প্রিয়া আন্টির কথা সব সময় মনে হয়, কেবল বলতেন, ‘পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াও। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এলে মেয়েরা নিজের মত করে বাঁচতে পারবে। পুরুষের অত্যাচার থেকে বাঁচতে পারবে।’
ঝুমার মনে বড় আশা, একদিন টিয়া অনেক বড় হবে। আর ক’টা ক্লাস পাশ করতে পারলেই কন্যাশ্রী প্রকল্পের টাকা পাবে। স্কুল থেকে এখন কত কিছু দেয়। বই, ব্যাগ, সাইকেল। পড়াশোনা করতে এখন আর চিন্তা নেই। যে ভুল সে করেছে, মেয়েটার যেন তা না হয়।
***
স্কুল খুলে যাচ্ছে। শোনামাত্রই প্রতিমার মেজাজ খারাপ। আর তো মিড ডে মিলের অত জিনিস পাওয়া যাবে না। তবে হ্যাঁ, টিয়ার দুপুরে ভরপেট খাওয়াটা হয়ে যাবে। ঝুমাকে কত আদরে মানুষ করছিল। মেয়ে হাসপাতালে ধরাকরা করে চাকরি যোগাড় করল, টিউশন করত, পয়সাও জমেছিল বেশ। সব নিয়ে ওই রাজেনের সঙ্গে চলে গেল। কত কেঁদেছে প্রতিমা। টাকার লোভ যখন ঝুমা মেটাতে পারেনি, তখনি রাজেন বেপাত্তা।
প্রতিমা তো স্বপ্ন দেখত, চাকরির ফাঁকে আরও পড়াশোনা করবে ঝুমা। সে ক্লাস টেন অবধি পড়েছে। মেয়েটা অন্তত অনেক পড়াশোনা করুক।
***
রাজেনের মেজাজ চট করে তুঙ্গে উঠে গেল। ‘শাল্লা, মাগির তেজ দ্যাখো। টাকাটা দিল না। উল্টে বলছে তোর বউ-মেয়ের কাছে ফিরে যা।’ মাসে মাসে মদের টাকা যোগান সে করতে পারবে না। লতিকার কাছে এসেছিল, বোকাসোকা মেয়েটা বুঝি সারাজীবন রাজেনের হুমকিতে চলবে। মেয়েগুলো সব বড্ড ট্যারা হয়ে যাচ্ছে। কল্যাণী ঘোষপাড়ায় লতিকার ঘুগনির দোকান রমরমিয়ে চলে। টাকা সরিয়ে ফেললেও টের পায়নি এতকাল। কিন্তু এখন সে খুব হিসাব বুঝেছে। না লতিকার চোখ খুলে গেছে। অন্য কোথাও ঘাঁটি গাড়তে হবে।
রাজেন মেয়েমানুষের এত তেজ সহ্য করতে পারে না। করবেও না। তবে কি পাত্তা লাগাবে ঝুমার কাছে। সেই বাচ্চাটা এখন নাকি স্কুলে পড়ে। খোঁজ নিয়েছে রাজেন। পড়াশোনায় ভাল হয়েছে। ঝুমার কাছে ফিরলে লুফে নেবে। গা-গতর আছে খাটিয়ে নেবে ঝুমাকে।
***
শরীরটা ক’দিন বেচাল করছে মায়ের। তবে কি দিন শেষ হয়ে এল? টিয়াকে তো বড় করে তুলতে হবে। শয়তান বাবাটা তো পালিয়েছে। ঝুমা মাকে দেখতে এসে ফিরছিল। একটু রাত হয়ে গেছে। পা চালায় দ্রুত।
পিছন থেকে কে যেন ডাকে, ‘ঝুমরি।’ বুকের ভিতর ছ্যাঁৎ করে ওঠে, এ নামে তো একজনই ডাকত। তবে কী! ঘাড় ঘোরাতেই সে মানুষ। কত চোখের জল ফেলেছে, অপেক্ষায় দিন গুনেছে, কিন্তু আজ দেখামাত্রই কী অবিশ্বাসের বাতাস ছেয়ে ফেলল ঝুমার মনপাথার। ভিতর থেকে কে যেন বলল, ‘সাবধান ঝুমা আর বোকামি করিস না।’
‘বিশ্বাস করো ঝুমরি, তোমাকে আর মেয়েকে নিয়ে যাব আমার কাছে, স্কুলে ভর্তি করে দেব।’
স্কুলে ভর্তি করলে এখন সব পেয়েছির দেশ। কে না জানে। আর ভুল নয়।
সপাটে ফিরে দাঁড়ায়, চোখে আগুন। অনেক বছর আগে যে আগুন জ্বলেনি। আজ সে দাউ দাউ করে দীপ্তমান। শব্দরা ছুটল খরবেগে,
‘খবরদার, একদম চলে যাও। আমার মেয়ে আমি একা মানুষ করতে পারব। আর কখনও যদি আসো, আমি পুলিশে ধরিয়ে দেব। আমার সব টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়েছিলে। চলে যাও।’ চিৎকার শুনে লোকজন ছুটে আসে। রাজেন দেরি করে না। সরে পড়ে।
মনের মধ্যে খচখচ করতে থাকে। মেয়েটার মন যদি বাবার জন্য উচাটন হয়। ঝুমা কী ভুল করল? মেয়ে যদি কোনওদিন বাবার কাছে যেতে চায়।
মায়ের শরীরটা ঠিক নয়। তাই ঝুমা পরদিন আবার আসে। মেয়েকে কাছে টানে, ‘দিদার কিছু হলে ভয় পাস না আমি আছি তো।’
টিয়া চোখ বড় করে তাকায় মায়ের দিকে। মা আর দিদাকেই তো চেনে কেবল। প্রতিমা চুপ করে তাকিয়েছিল টিয়ার দিকে। না জানি কী বলবে মেয়েটা। তার বুকের ভিতর শঙ্কা।
‘আমি ভয় পাই না। আমার তো মা আছে। আর কাউকে চাই না।’
প্রখর উষ্ণ দিনে কোথা থেকে উড়ে এল মিষ্টি স্বস্তি বাতাস। কী যেন মনে পড়ে টিয়ার— ‘দিদা আছে আমার আর আছে মিড ডে মিল।’ বলেই আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে।
প্রতিমা আর ঝুমার দুচোখে আত্মবিশ্বাসের ফল্গুধারা।