চৈত্র মাসের মাঝামাঝি। বেশ গরম-গরম ভাব এখন থেকেই। কী যে হবে গরমকালে, ভাবাই যায় না! ক’বছর হল দুই জায়ের দুই ছেলে মিলে গ্রামের বাড়িটাকে আবার করে খাড়া করিয়েছে। ওই বাড়িতে গিয়ে কালীপুজোর সময় দু’দিন থাকা হয়। বাকি সময় বাড়ি খালিই পড়ে থাকে। মাঝে-সাঝে সাফ-সাফাইয়ের জন্য লোক বলা আছে। এবার স্থির হল, টিনের চাল বদলে, বাড়িটার ছাদটা ঢালাই করা হোক। বড়জায়ের দুই মেয়ে, ছেলে নেই; মেয়েদের সব বিয়ে-থা হয়ে গেছে। বড় ভাসুরও গত হয়েছেন। তাই ও ঘরের প্রতি তার কোনও মোহমায়াও নেই। মেজ, সেজই ঘরটার ব্যাপারে উৎসাহী, কারণ তাঁদের পরিবার— ছেলেপুলে, নাতি-নাতনি, বউমারা সব কালীপুজোয় গ্রামে গিয়ে দু’দিন থাকে, আনন্দ করে। ছোটজা বাড়ির সব সুবিধা চায়, কিন্তু দায়দায়িত্ব নেয় না। তারা কালীপুজোয় ও বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করলেও, থাকে গেস্টহাউসে।
তো যেখান থেকে কথা শুরু হয়েছিল, সেখানে ফেরা যাক। মেজ, সেজর পরিবার ছাদ ঢালাই করার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু শহরের কাজকর্ম, অফিস ছেড়ে ওই অজগাঁয়ে ছাদ ঢালাই করাতে যাবে কে? থাকতে হবে ওখানে ক’দিন। কারই বা সময় আছে? কী চর্চাতে স্থির হল জানি না, তবে স্থির হল মেজ ও সেজজা যাবে ছাদ ঢালাই করাতে। দু’জনেই ষাটোর্ধ্ব। ওরা দুজনে আগেও এক-আধবার বছরের মাঝে গ্রামে গিয়েছে ধান কাটা-বেচার টাকা-পয়সা আনতে। ঘরও ওদের সামনেই হয়েছিল। আগের মাটির ঘরটা ঝড়ে পড়ে যাবার পর, ওদের আর ওদের ছেলেদের উৎসাহেই আবার গ্রামে ঘর হয়েছে। কালীপুজোর সময় গ্রামে গিয়ে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই হয়েছে। তাই বিষয়টা পাকা হল। মেজ আর সেজ দুজনে গেল গ্রামে। যাবার সময় নাতিপুতিদের ভাল হয়ে থাকার পরামর্শ দিয়ে, দিন দশেকের মত জিনিসপত্র, বিশেষত কাপড়জামা নিয়ে তারা রওনা হল।
গ্রামও সে হাতের কাছে নয়! যাবার সময় দুটো ট্রেন বদলে তারপর বাই রোডের লম্বা দূরত্ব। গ্রামটা এখন আবার ঝাড়খণ্ডের সীমায় পড়ে গিয়েছে। তাতে অবশ্য ওদের কিছু যায় আসে না। কারণ গ্রামে পৌঁছনোর রাস্তা সেই একই রকম আছে। কালীপুজোর সময়টা ছাড়া ওখানে শহর থেকে তেমন কেউ আসে না। গ্রামের লোক গ্রামেই থাকে। নতুন প্রজন্মের বেশিরভাগ লোক জীবিকার কারণে শহরে। ফলে গ্রামের দৈনন্দিন জীবনে বিশেষ কোনও আধুনিক পরিবর্তন আসেনি। তবে হ্যাঁ, গ্রামের পুরনো দেবীমন্দির নতুন করে মেরামত করা হয়েছে। মন্দির চত্বর ঘেঁষে গেস্টহাউস তৈরি হয়েছে। কালীপুজোর সময়ের জমকের কথা ভেবে কিছু কিছু রাস্তাঘাটও ঠিক করা হয়েছে। গ্রামে জরাজীর্ণ একশো আটটা শিব মন্দির আছে। সেগুলোর মেরামতি অবশ্য এখনও হয়নি। গ্রামে শালুকে ভরা পুকুর, বাঁশঝাড়, আতা গাছ, কচুরিপানা সবই আছে। আজকাল কারেন্টও এসেছে। তবে সে এসে থাকে কতক্ষণ, সেটা অন্য আলোচনার বিষয়!
মূল গল্পে আসা যাক। ঘর ঢালাইয়ের টাকা-পয়সা নিয়ে মেজ-সেজ দু’জনে গ্রামে পৌঁছল প্রায় সন্ধেয়। বাঁচোয়া একটাই, ও গ্রামেই সেজোর বাপের বাড়ি। বাড়িতে আজ আর বাপ, মা কেউই নেই। সব গত হয়েছেন। তবে সেজর শহরে থাকা, আদরের ভাই বাড়িটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ওদের মা মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ও বাড়িতে একাই থাকতেন। তাই সেজর ভাই, কাঁচাবাড়িটাকে পাকা করে, তাতে জল, কল, টিভি, লাইট সবই বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল। ওদের মা মারা যাবার পর থেকে বাড়িটা খালিই পড়ে আছে। ওই কালীপুজোর সময়ই ভাই আসে। সেজোর ভাই বলে দিয়েছিল, রাতে ওই বাড়িতেই থাকতে। তাই সেজ আর মেজ সেই বাড়িতে গিয়ে উঠল। মোবাইল ফোন এখানে বেকার। একদমই নেটওয়ার্ক নেই এখানে। মেজ, সেজ চান-টান করে, ভাতে-ভাত ফুটিয়ে নিল। সেজোর ভাইই, চাল, ডাল, আলু সব বাড়ির কেয়ারটেকার মানিককে আগে থেকে এনে রাখতে বলেছিল। আজ রাত পেরোলেই, কাল থেকে নিজেদের ভিটের ছাদ ঢালাইয়ে লাগতে হবে। মিস্ত্রিদের সব খবর করতে হবে। কত কাজ বাকি। এইসব আলোচনা করতে করতে ওরা ঘুমিয়ে পড়ল।
পরের দিন সকাল সকাল তৈরি হয়ে, দু’জনে নিজেদের বাড়ি গেল। এই বাড়ি থেকে ওই বাড়ি, এমনিতে দশ মিনিটের পথ। তবে দুই বুড়ির হেঁটে ওখানে পৌঁছতে একটু বেশি সময় লাগল। হাঁটা ছাড়া কোনও গত্যন্তরও নেই এই গ্রামে। বাড়িতে পৌঁছে কন্ট্রাক্টরকে বাড়ি দেখাল ওরা। ছাদ ঢালাইতে কত কী সময় যাবে, খরচাপাতি ইত্যাদির আরও একপ্রস্থ আলোচনা হল। ঠিক হল, পরের দিন থেকে কাজ শুরু হবে। দিনটা কেমন করে কেটে গেল ব্যস্ততায়, মেজ-সেজ টেরই পেল না। ওরা ঠিক করল, ‘কাল থেকে যখন ঢালাইয়ের কাজ শুরু হবে, আমরা বরং কষ্ট করে হলেও এ বাড়িতেই থাকব। একসঙ্গে তো আর সব ঘরের ছাদ ঢালাই হবে না! এখানে থাকলে কাজ ঠিক করে দেখা যাবে। নইলে ও মিস্ত্রিরা সব ফাঁকি দেয়। আর রোজ রোজ আমাদেরও এবাড়ি-ওবাড়ি করতে হবে না।’ এই আলোচনা করতে করতে ওরা সন্ধেবেলা সেজর বাপের বাড়ি পৌঁছল।
কী ভীষণ শান্ত এখানে চারদিক। সন্ধে সাতটা বাজলেই মনে হয় গভীর রাত! ঝিঁঝিঁ ডাক দিয়ে শুরু হয়, শেয়াল ডাক দিয়ে রাত বাড়তে থাকে! এত বছর শহরে থাকার অভ্যাস, ঘুমও ওখানে দেরিতে আসে। এই অজগাঁয়ে কালীপুজোর দু’রাতই থাকা যায়! তার আগে-পিছে নয়। ‘অথচ এই গ্রামেই তো জন্মেছি, বড় হয়েছি। বিয়ের পর না হয় শহরে থাকতে গেছিলাম’, ভাবল সেজ। মেজর মনেও একই কথা চলছে। সে এই গাঁয়ের থেকে একটু দূরের এক গ্রামের মেয়ে। তার ভাইরা সব আজও ওই গাঁয়েরই বাসিন্দা। গ্রামেই বড় হওয়া। অথচ আজ এই গ্রামে এসে থাকার কথা ভাবলেও বুক শিউরে উঠছে। একথা-সেকথায় তারা ঘুমিয়ে পড়ল।
পরের দিন সকালে, যথারীতি ওই আগের দিনের মত, চান, জলখাবার সেরে ও বাড়িতে যাওয়ার জন্য তৈরি হল। আজ ওরা ভেবেছে, জামাকাপড়ের বাক্স নিয়েই ও বাড়িতে যাবে, আজ থেকে ওখানেই থাকবে। মেজ-সেজ বাক্স গুছিয়ে নিচ্ছে। হঠাৎ কী মনে হল, জামাকাপড় ভাঁজ করা থামিয়ে সেজ বলল, ‘মেজদি আমরা এখনই বাক্স নিয়ে যাব না ও বাড়ি। আগে দেখি, ছাদ ঢালাই ওরা কীভাবে শুরু করে। পরে না হয় বাক্স নিয়ে যাওয়া যাবে। আমরা যদি নাও আসি, মানিককে দিয়ে আনিয়ে নেব।’ তাই ঠিক হল। রাস্তার সারি সারি শিবমন্দির, কালী-দুর্গা তৈরির চাতাল পেরিয়ে, ওরা নিজেদের বাড়িতে পৌঁছল। মিস্ত্রিরা আসছে, আরও দু’টি পৌঁছবে। একজন কুয়ো পারের আতাগাছের নিচে বসে বিড়ি খাচ্ছে। উঠোনের বাঁশঝাড়টা বেশ জাঁকিয়ে আছে। আগে ছোট দেওর এসে বাঁশ কাটিয়ে, বেচে, সব পয়সা নিয়ে উধাও হয়ে যেত। এখন তার বয়স হয়েছে, সে আর এমুখো হয় না। তবে বয়সই একমাত্র কারণ নয়। এমনটাও শোনা গেছিল যে, সে একবার এই গাঁয়ে এসে হারু বাগদির মেয়েকে নাকি বিয়েও করেছিল। এমন কাণ্ড সে কী করে করেছিল বা তার সত্যি-মিথ্যে যাচাই করার ইচ্ছে সেজ বা মেজর কখনও হয়নি।
মিস্ত্রিরা সব এসে গেছে। কন্ট্রাক্টরও এল। সে মিস্ত্রিদের কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে। দুই বুড়ি, (যদিও ওরা নিজেদের বুড়ি বলে মনে করে না! আর অন্য কেউ ওদের বুড়ি বললে বেশ রাগই করে!) দাওয়াতে এসে বসল। মিস্ত্রিরা কাঁচামাল সাজাচ্ছে। বালি, সিমেন্ট, জল মেশানো শুরু হয়ে গেছে। ঘরের ভেতর কিছু ঠুকঠাকও চলছে। মেজ-সেজ একগাল হাসল, ‘যাক বাবা! কাজ শুরু হয়ে গেছে।’ সব মিটিয়ে দিন ছয়েকের মধ্যেই শহরের বাড়িতে! নিজেরা নিজেদের বুদ্ধি, সাহস আর শক্তিতে যারপরনাই খুশি, সেটা ওদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
মিস্ত্রিগুলো কি ফাঁকিবাজ? সব বাড়ির মালিকদের এমনটাই মনে হয়। ‘ফাঁকিবাজই মনে হয়’, বলল মেজ। সেজ বলল, ‘মনে হয় নয়, তাইই। নইলে বলো, সারাদিনে এইটুকু কাজ হল? খালি দিনমজুরি বাড়ানোর ধান্দা! যত দিন বাড়বে, তত দেহারি! হিসেবে এরা সব পাকা। আজ খালি ফাটা-ফুটো মেরামতির নাটক করেছে মনে হচ্ছে।’ এইসব আলোচনা করতে করতে মেজ-সেজ ও পাড়ায় সেজর বাপের বাড়ির দরজার কাছে সবে পৌঁছেছে কী দেখল, মানিক হন্তদন্ত হয়ে আসছে। সে বলল, ‘কাকিমা, সব বন্ধ হয়ে গেল গো! লকডাউন। ওই যে করোনা, না কি যেন এসেছে, কোথাও যাওয়া-আসা বন্ধ। আজ রাত বারোটার পর থেকে লাগু হবে।’
মেজ-সেজ তো মানিকের কথার কিছুই বুঝছে না। ‘করোনা, না কি বললি? সেটা কে? কেনই বা সে সব বন্ধ করাচ্ছে? দেশে কি কোন আইনকানুন নেই?’ বলল সেজ। মেজ তাতে জুড়ে দিল, ‘এই যে এত সৈন্য, মন্ত্রী, পুলিশ— এরা সব ওটাকে আটকাচ্ছে না কেন?’ মানিক বলল, ‘ওরা বলছে, এইরকম সব বন্ধ করলেই নাকি করোনাকে আটকানো যাবে।’ তারপর বলল, ‘কন্ট্রাক্টর ফোন করেছিল। খবর দিয়েছে, কাল থেকে কাজ আর করা যাবে না। মিস্ত্রিরা সব এখনই নিজেদের গাঁয়ের দিকে রওনা হয়ে যাচ্ছে। এইবেলা না বেরোলে ওরাও এখানে আটকে যাবে।’
মেজ-সেজ সত্যিই ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। কী হল? কেনই বা সব বন্ধ হচ্ছে? আটকে যাবে মানে কী? নানা এদিক, ওদিককার প্রশ্ন ঘুরছে মাথায়। মানিক বলল, ‘আমি যাই। আরও খবর করতে হবে অনেককে।’ ‘এই মানকে…’ বলার আগেই মানিক ধাঁ! মেজ-সেজ দরজা খুলে ঘরে ঢুকল। হাত-মুখ ধুয়ে বসল ওরা। টিভি আছে ঘরে, তবে কানেকশন প্রবলেম। ‘আজ একবার নেড়েচেড়ে দেখব যদি কাজ হয়! আসলে দেখাই হয়নি ঠিক করে, ঘরটাতে কী আস্ত আছে, আর কী নেই’, বলল সেজ, ‘এই ঘরেই তো জন্মেছি, বড় হয়েছি। তবু এই ঘর আর নিজের বলে মনে হয় না।’
মেয়েদের ওই হয়। যখন যেখানে, তখন সেটাকে আপন করে নিতে শিখতে হয়। আর শেষে হয়তো কিছুই নিজের হয় না! বাপের ঘর; বিয়ের পর বোঝে ওটা নিজের ঘর নয়। শ্বশুর ঘর; তার মালিক শ্বশুরমশাই। ফ্ল্যাট কিনে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে শিফ্ট করলে ওটা বরের ঘর আর ছেলেপুলের বিয়ে হয়ে গেলে ওটার মালিকানা অলিখিতভাবেই ছেলপুলেদের হাতে হস্তান্তরিত হয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই হয়। এমনকি যে মহিলারা বাড়ি কেনার ফান্ডে পুরো কন্ট্রিবিউশনও দিয়ে থাকেন, মালিকানার অস্তিত্ব-তত্ত্বে কিন্তু তারাও প্রায়শ গৌণই থেকে যান!
মেজ তো মোবাইল ফোনটাকে দূরে ঠেলে দিল। ‘একদম বেকার এখানে! এই মানকেটা কী যে বলে গেল! মিস্ত্রিরা আর কাজে আসবে না, মানে তো ঢালাইয়ের কাজ বন্ধ! আর ঢালাই হবে না তো আমরা এখানে থেকে কী করব? ওই দেখো আবার কারেন্ট গেল! দাঁড়াও লন্ঠনটা জ্বালি’, বলল সেজ। হঠাৎ মেজর কী হল, ঝট করে উঠে দাঁড়াল সে। তার হাত মাথায় পৌঁছে গেছে। ‘ওরে সেজ, মানকে যে বলল সব বন্ধ! মিস্ত্রিরা নিজেদের ঘর চলে গেছে! মানে হল গিয়ে, গাড়িঘোড়া, ট্রেন, সব বন্ধ! তাহলে আমরা এই গাঁ থেকে বেরোব কী করে?’ সেজরও মাথায় হাত গেল। ‘ধুর ছাই! কারেন্টটা এলে টিভিটাকে একটু ঝাঁকাব’, ভাবল সেজ।
আশপাশে বেশি ঘরও নেই। যারা আজকাল পাশের দু-একটা ঘরে থাকে, তাদের ওরা বিশেষ চেনে না। পুরনো লোকজন, হয় মারা গেছেন, আর নয় তো শহরে ছেলেপুলেদের কাছে থাকেন। বেশ ক’টা ঘর বন্ধই পড়ে থাকে, এই ঘরটার মতই। আর লোক থাকলেই বা কী হত? যাদের কোথাও যাবার নেই, তারা গাঁ-ঘরে এসব লকডাউন নিয়ে মাথা ঘামাবে কেন? সত্যি বলতে কী, লকডাউন ব্যাপারটা মেজ-সেজ সেভাবে পুরো বুঝতে পারছিল না। ‘জন্মে শুনিনি বাপু, বিনা কারণে সব বন্ধ!’ বলল সেজ। মেজ বলল, ‘আমরা বাংলার লোক। বাংলা বনধ শুনেছি। খুব জোর হলে একদিনের জন্য ভারত বনধ। কিন্তু এ আবার কী?’
কারেন্ট এল। সেজ একমুহূর্ত দেরি না করে উঠল টিভিকে ঝাঁকানি দিতে। উঃ কাজ হল! মা যখন বেঁচেছিল তখন রোজ চলত বাংলা সিরিয়াল। এখন কেউ থাকে না, তাই এমনিই পড়ে আছে। ডিডি ন্যাশনাল হল গিয়ে বিপদের বন্ধু! কিন্তু এ খবর যে সব হিন্দিতে বলছে! ঝাড়খণ্ডের সীমানা। এই একটা চ্যানেলই ঝিরঝির করে চলছে এখানে। হিন্দি ওরা বোঝে, তবে খুব সড়গড় নয়। আর এমন একটা আপৎকালীন সময়ে মাতৃভাষায় খবর শোনাটা খুব দরকার, এ বিষয়ে দুজনেই একমত। খবর শুনে ওরা যা বুঝল, ‘করোনা’ নামের এক অনামুখো ভাইরাস এসেছে। ঘরবন্দি হয়ে থাকতে বলছে সরকার। গাড়িঘোড়া সব বন্ধ থাকবে। মোটের ওপর এই জায়গা থেকে ওদের বেরোনোর এখন কোনও রাস্তা নেই। ঘর ঢালাইয়ের স্বপ্ন তো দূরঅস্ত!
সেজর টকটকে ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেল। চোখে জল। ‘কী হবে মেজদি?’ মেজ সাহস জুটিয়ে বলল, ‘দাঁড়া, কাল একটু লোকজনদের কাছ থেকে ব্যাপারটার খোঁজখবর নেব গিয়ে।’ ওরা দুজনেই বিধবা। দিনে ভাত খেলে, রাতে ভাত খায় না! ভাত একবারই খাবার নিয়ম আছে নাকি! হাজারো নিয়ম ওরা মেনে চলে। মেজ বছর তিরিশেক আগে বিধবা হয়েছিল। কত অল্প বয়স তখন তার। সেজর স্বামী বছর ছয়েক আগে মারা গেছেন। সে রাতে মুড়ি আর শসা খেয়ে ওরা ঘুমোতে গেল। পরের দিন এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, বাড়ি ফেরার রাস্তা এখন বন্ধ। সরকার যখন বলবে, তখন সব খুলবে। করোনার আরও কত কথা শোনা গেল। করোনার কত কথা কথকতা হয়ে দাঁড়াল।
বেশ ক’দিন কেটে গেছে। মানিক ছুটতে ছুটতে আসছে। ‘কাকি, দাদাবাবু ফোনে আছে। কথা কয়ে নাও।’ দাদাবাবু মানে, সেজর ভাই। সে আজ অনেক কষ্টে মানিকের লাইন পেয়েছে। ‘ওরে সতীশ…’ বলে সেজ হাঁকুড়ে কেঁদে উঠল। সতীশ তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। সে বলল, ‘দিদি আগে কথা শোনো। যেকোনো সময় লাইন কেটে যেতে পারে।’ তারপর সে সমস্ত স্থিতির বর্ণনা দিল। সে আরও বলল, ‘ঘরে আছিস। কিছু চিন্তা করিস না। খাওয়া-দাওয়ার জিনিসপত্র মানিক এনে দেবে। এছাড়া কোনও উপায়ও তো নেই।’ সেজ বলতে গেল, ‘মানিকের নম্বরটা ছেলেদের দিস’, কিন্তু লাইন কেটে গেল।
চাঁদনি রাত। দুই বুড়ি বসে আছে আজ উঠোনে। হাতপাখা করছে। গরম খুব। একটু বৈশাখী ঝড়ের আভাস পেতেই, সেই যে কারেন্ট গেল, আসার নামটি নেই! বাইরের বন-বাদাড়ে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। দূরে কোথাও শেয়ালের ডাকও শোনা যাচ্ছে। বেশ ক’দিন কেটে গেছে, লকডাউন চলছে। এখনও কতদিন আরও বাকি! দিনভর শুয়ে-বসে থাকতে ওরা ভয় পায়। যদিও কোনও কাজ নেই, ভয়, রাতে যদি ঘুম না আসে! তবু রাতে ঘুম সহজে আসতে চায় না। বয়স হলে কি মানুষের ঘুম কমে যায়, ভাবে ওরা। ঘরের গল্প, ছেলেপুলে, নাতি-নাতনিদের গল্প যেন ফুরিয়ে এসেছে ওদের।
অথচ, এই ক’দিন আগেই ওদের দুজনেরই মনে হত, এত ভরভরন্ত ঘর সংসার, এখানকার গল্প কখনও ফুরোবার নয়! এমনও মনে হত, ‘আমাদের বয়স হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের বিনা আজও আমাদের সংসারের পাতাটি হেলে না!’ সেজ বলল, ‘মেজদি, এই যে আমি এখানে আটকে গেলাম, আমাদের বউমারা তো সব ঘর-সংসার ঠিকই চালিয়ে নিচ্ছে তাই না?’ মেজ বলল, ‘আমার ছেলে, বউও ঘর ঠিকই চালাচ্ছে নিশ্চয়ই। আমি থাকলে বাজার যাওয়া থেকে, কুটনো কাটা, নাতি খাওয়ানো সব আমাকেই করতে হয়।’ সেজ আবার বলল, ‘আচ্ছা মেজদি, যদি তোমার সেজ দেওর বেঁচে থাকত, তাহলে কী করত? এমনই নিশ্চিন্তে থাকত সে ওখানে?’ মেজ বলল, ‘কী জানি ভাই! পরিস্থিতিই এমন, এই ভেবে মনকে ঠান্ডা কর! মেজবাবু তো সেই কবেই চলে গিয়েছে। ছেলে তখন দশ বছরের। তারপর কীভাবে কী চলেছে সবই তোরা জানিস।’
দুটো জোনাকি আমগাছটার কাছে এসে টিপটিপ করছে। সেজর নজর গেল সেদিকে। ‘মেজদি দেখো, ওই সেজবাবু আর মেজবাবু আলো হয়ে এসেছে আমাদের দেখতে।’ মেজ তাকাল ওইদিকে। সেজর কাছঘেঁষে বসল একটু। তারপর বলল, ‘সত্যিই তো! ওরা আমাদের বলছে, আমরা আটকে পড়িনি। বন্ধ হয়ে নেই আমরা। আমরা দুজনে বোধহয় প্রথমবার স্বাধীন হয়েছি।’ মেজর কাঁধে মাথা রাখল সেজ, ‘মেজদি, এই প্রথমবার আমার মনে হচ্ছে, আমি সত্যিই ভাল আছি।’ মেজ বলল, ‘আমিও।’
ভালো লাগলো, লেখক কে ধন্যবাদ
অসংখ্য ধন্যবাদ। এমন প্রশংসা অনেক আনন্দ আর উৎসাহ জোগালো। চেষ্টা করব, যেন আগেও এমন ভালো লাগা আদায় করে নিতে পারি। সঙ্গে থাকবেন।