নিখাদ সাহিত্যকে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে পড়লে ব্যথা আছে। ‘উলটা বুঝলি রাম’ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। ‘মহাভারত’-এর ক্ষেত্রে যেটা হামেশাই হয়। ‘মহাভারত’ নাকি ধর্ম-অধর্মর দ্বন্দ্বকে ভিত্তি করে লেখা। ধর্মর জয় আর অধর্মর পরাজয়-ই মূল প্রতিপাদ্য। ‘মহাভারত’ নাকি আসলে ধার্মিক হওয়ার, ধর্মের পথে চলার শিক্ষা দেয়— এমন সব কথাবার্তা প্রায়ই শোনা যায়। আদৌ কি তাই?
‘মহাভারত’-এ ধর্মপক্ষর প্রতিনিধি যুধিষ্ঠির আর তাঁর ভাই-বন্ধুরা (সাহিত্যর নিরিখে দেখলে কৃষ্ণ ‘মহাভারত’-এ একেবারেই প্যাসিভ এক চরিত্র, অবশ্য ‘মহাভারত’-কে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসেবে পড়তে বসলে কৃষ্ণকে এমনকি ‘মহাভারত’-এর নায়ক ভাবতেও কোনও বাধা নেই)। আর অধর্মর প্রতিনিধি হলেন দুর্যোধন আর তাঁর ভাই-বন্ধুরা। কেউ ‘মহাভারত’-এর ধর্ম-অধর্মর তেত্রিশ কোটি ব্যাখ্যা দিতেই পারেন। মনে রাখতে হবে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধেই ‘মহাভারত’ শেষ হয় না, তার পরে আরও অনেকগুলো পর্ব থাকে। ‘মহাভারত’-এর যুগের ধর্ম মানে ভারতের সনাতন হিন্দু ধর্ম। সে-ধর্মর মূল কথা এই, ইহজীবন নেহাতই ফালতু ব্যাপার, পরলোকই আসল। ইহজীবন আসলে পরকালের পুঁজি যোগাড়ের জন্যে। এখন দেখা যাক ‘মহাভারত’-এর ধর্মর প্রতিনিধি আর অধর্মর প্রতিনিধিদের পরকালে কী গতি হল। কী শাস্তি আর কী পুরস্কার তাঁরা পেলেন। মানুষকে কেন ধর্মের পথে চলতে হবে তার হদিশ নিশ্চয়ই ‘মহাভারত’-এই আছে।
দুর্যোধন কিন্তু কুরুক্ষেত্র থেকে সরাসরি স্বর্গে গিয়েছিলেন। যুধিষ্ঠির আরও অনেকবছর ইহলোকে খাটান দিয়ে স্বর্গে গিয়ে কী দেখলেন?
“যুধিষ্ঠির স্বর্গে গিয়ে দেখলেন, দুর্যোধন সূর্যের ন্যায় প্রভান্বিত হয়ে দেবগণ ও সাধ্যগণের মধ্যে ব’সে আছেন। ধর্মরাজ ক্রুদ্ধ হয়ে উচ্চস্বরে বললেন, আমি দুর্যোধনের সঙ্গে বাস করব না; যে লোক পাঞ্চালীকে সভামধ্যে নিগৃহীত করেছিল, যার জন্যে আমরা মহাবনে বহু কষ্টভোগ করেছি এবং যুদ্ধে বহু সুহৎ ও বান্ধব বিনষ্ট করেছি, সেই লোভী অদূরদর্শী দুর্যোধনকে দেখতে চাই না, আমি আমার ভ্রাতাদের কাছে যাব। নারদ সহাস্যে বললেন, মহারাজ, এমন কথা ব’লো না, স্বর্গে বাস করলে বিরোধ থাকে না, স্বর্গবাসী সকলেই দুর্যোধনকে সম্মান করেন। ইনি ক্ষত্রধর্মানুসারে যুদ্ধে নিজ দেহ উৎসর্গ ক’রে বীরলোক লাভ করেছেন, মহাভয় উপস্থিত হ’লেও ইনি কখনও ভীত হন নি। তোমরা পূর্বে যে কষ্ট পেয়েছিলে তা এখন ভুলে যাও, বৈরভাব ত্যাগ ক’রে দুর্যোধনের সঙ্গে মিলিত হও।” (রাজশেখর বসুর অনুবাদ, পৃ. ৬৮৩)
যুধিষ্ঠির চটে গেছেন দেখে ইন্দ্র একটু মেকআপ করার চেষ্টা করেছিলেন, তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলেন, “সকল মানুষেরই পাপপুণ্য থাকে; যার পাপের ভাগ অধিক এবং পুণ্য অল্প সে প্রথমে স্বর্গ ভোগ ক’রে পরে নরকে যায়; যার পুণ্য অধিক ও পাপ অল্প সে প্রথমে নরক ও পরে স্বর্গ ভোগ করে।” (রাজশেখর বসুর অনুবাদ, পৃ. ৬৮৩-৬৮৪)
কিন্তু এর কিছু পরেই হাটে হাঁড়ি ভেঙে যায়। ‘মহাভারত’ তো আসলে গল্পর ভেতরে গল্প। বৈশম্পায়ন গল্পটি বলছিলেন। কুরু-পাণ্ডবদের গল্প শেষ করে ‘মহাভারত’ আবার কাঠামো গল্পে ফেরে। সেখানে… “জনমেজয় প্রশ্ন করলেন, দ্বিজোত্তম, আপনি যাঁদের কথা বললেন তাঁরা কত কাল স্বর্গবাস করেছিলেন? কর্মফলভোগ শেষ হ’লে তাঁরা কোন্ গতি পেয়েছিলেন? বৈশম্পায়ন বললেন, অগাধবুদ্ধি সর্বজ্ঞ ব্যাসদেবের নিকট আমি যেমন শুনেছি তাই বলছি। — ভীষ্ম বসুগণে, দ্রোণ বৃহস্পতির শরীরে, কৃতবর্মা মরুদ্ গণে, প্রদ্যুম্ন সনতকুমারে, ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী কুবেরলোকে, পাণ্ডু, কুন্তী ও মাদ্রী ইন্দ্রলোকে, এবং বিরাট দ্রুপদ ভূরিশ্রবা উগ্রসেন কংস অক্রূর বসুদেব শাম্ব প্রভৃতি বিশ্বদেবগণে প্রবেশ করেছেন। চন্দ্রপুত্র বর্চা অভিমন্যু রূপে জন্মেছিলেন, তিনি চন্দ্রলোকে গেছেন। কর্ণ সূর্যের, শকুনি দ্বাপরের, এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন পাবকের শরীরে গেছেন। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা রাক্ষসের অংশে জন্মেছিলেন, তাঁরা অস্ত্রাঘাতে পূত হয়ে স্বর্গলাভ করেছেন। বিদুর ও যুধিষ্ঠির ধর্মে লীন হয়েছেন। …কর্মফলভোগ শেষ হ’লে এঁদের অনেকে সংসারে প্রত্যাবর্তন করবেন।” (রাজশেখর বসুর অনুবাদ, পৃ. ৬৮৫)
মানে শুধু দুর্যোধন নন, কংস, কর্ণ এবং শকুনিও স্বর্গে আছেন। দুঃশাসনও আছেন আর বিকর্ণও আছেন। বাকি সাতানব্বই ভাইও আছেন। অধার্মিকরাও দিব্যি স্বর্গসুখ ভোগ করছেন। এবং কতদিন ভোগ করেছেন তা স্বয়ং ‘অগাধবুদ্ধি সর্বজ্ঞ’ ব্যাসদেবেরও জানা নেই।
তবে ‘মহাভারত’ কী শিক্ষা দিল? অধার্মিকদেরও স্বর্গসুখ ভোগ করিয়ে দিল যে। ইহজীবনের ঝামেলা দুর্যোধনকে যুধিষ্ঠিরের চেয়ে অনেক কম ভোগ করতে হল। যুদ্ধের পরও যুধিষ্ঠির কেবল কেঁদেই গেলেন। তারপরে অত কষ্ট করে হিমালয় অভিযান করে স্বর্গে গেলেন, গিয়ে দেখলেন দুর্যোধন ‘প্রভান্বিত’ হয়ে বসে আছেন।
আসলে ‘মহাভারত’-এর রচয়িতারা কোনও শিক্ষাই দিতে চাননি। যুগে যুগে প্রজন্ম পর প্রজন্মর কবিরা ‘মহাভারত’-এর কলেবর বৃদ্ধি করেছেন। কবিদের দায় পড়েছিল ধর্ম নিয়ে কাঁচা জ্ঞান দেওয়ার। আসলে ‘মহাভারত’-এর জনপ্রিয় হওয়ার পরে ‘গীতা’, ‘শান্তিপর্ব’, ‘অনুশাসনপর্ব’ ইত্যাদির মাধ্যমে ধর্মের পাণ্ডারা নিজেদের কথা ঢুকিয়েছেন আর গল্পর গতিকে ব্যাহত করেছেন। নইলে ভীষ্মর মারা যেতে দুটো পর্ব লাগার কোনও কারণ নেই।
‘মহাভারত’-এর নাম ‘যুধিষ্ঠিরায়ণ’ হলেও তেমন ক্ষতি ছিল না। ‘মহাভারত’-এর রচয়িতারা একজন ধার্মিক মহান চরিত্রকে কেন্দ্রে রেখে সমাজে চলতে থাকা দুনিয়ার অধর্মকে তুলে ধরেছেন। ধার্মিক নায়ক না পেয়েছেন সুখ, না শান্তি। এই বৈপরীত্যই ‘মহাভারত’-এর অমর হয়ে ওঠার একটা অন্যতম কারণ।
‘মহাভারত’-এর ধর্মপক্ষের মানুষদের কাণ্ডকারখানা দেখুন। ‘গীতা’-র দিকে চোখ দিলে দেখব যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মীয়বন্ধুদের দেখে অর্জুন বোমকে গেলেন, তিনি বললেন, “কৃষ্ণ, এইসকল যুদ্ধেচ্ছু স্বজনগণকে সমুপস্থিত দেখিয়া আমার অঙ্গসমূহ অবসন্ন হইতেছে, মুখ শুকাইয়া যাইতেছে, শরীর কাঁপিতেছে ও রোমহর্ষ হইতেছে, হাত হইতে গাণ্ডীব খসিয়া পড়িতেছ, গাত্রদাহ হইতেছে, এক স্থানে স্থির হইতে পারিতেছি না, এবং মন চঞ্চল হইয়াছে।” (গিরীন্দ্রশেখর বসুর অনুবাদ, পৃ. ২৫)
ডাক্তার বনবিহারী মুখোপাধ্যায় (যাঁকে কেন্দ্র করে বনফুল ‘অগ্নীশ্বর’ উপন্যাস লিখেছিলেন এবং একটি জনপ্রিয় বাংলা সিনেমা হয়েছিল) একটি চমৎকার ছোট গীতাভাষ্য লিখেছিলেন। সেখানে তিনি অর্জুনের এইসব শারীরিক উপসর্গকে একেবারেই ম্যালেরিয়ার সিম্পটম বলে উল্লেখ করেছেন। ডাক্তার বনবিহারী মুখোপাধ্যায়ের গীতাভাষ্যটি হালে বই আকারে ছাপা হয়েছে। আগ্রহীরা অবশ্যই পড়বেন।
এখন ম্যালেরিয়াই হোক আর চিত্তবিকার, অর্জুনের যুদ্ধে অনাসক্তির কারণগুলিকে গিরীন্দ্রশেখর বসু তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন, ব্যক্তিগত, সামাজিক আর অলৌকিক। সামাজিক আপত্তি হচ্ছে, এত ক্ষত্রিয় পুরুষ যুদ্ধে মারা গেলে মহিলারা অসবর্ণে স্বামী গ্রহণ করবেন ও সন্তান উৎপাদন করবেন। এতে বর্ণশঙ্করের দোষ ঘটবে তাতে ধর্মর হানি হবে।
কিন্তু অর্জুন কি জানতেন না, ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডু ও বিদুরের পিতা আসলে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস স্বয়ং? যিনি আবার ব্রাহ্মণ ও ধীবরকন্যার সন্তান। কুন্তী ও মাদ্রীর কোনও সন্তানের পিতাই পাণ্ডু নন, কোনও ক্ষত্রিয়ও নন। তবে তো অর্জুনের বংশেই তো বর্ণ ঘেঁটে চন্দ্রবিন্দু হয়ে গেছে। ধর্ম কোথায়?
কুন্তীর কুমারী মাতা হওয়া ধর্মসম্মত? একজন নারীকে পাঁচ ভাইয়ের বিবাহ কি ধর্মের নিদান? জুয়া খেলতে বসে বউকে বাজি রাখাকে কি ধর্ম স্বীকৃতি দেয়? ধর্ম কোথায়? ‘মহাভারত’ তো অধর্মময়! এমনকি ‘মহাভারত’-এ যেসব অন্য গল্প ঢুকেছে সেগুলোতেও, সে কচ দেবযানী, যযাতী, নল দময়ন্তী, দুষ্মন্ত শকুন্তলা, সবেতেই অধর্মেরই জয়জয়কার। আসলে কবিরা সমাজের ছবি এঁকেছেন। ‘মহাভারত’-এর সমাজ মোটেই ধর্মশাস্ত্রে বর্ণিত আদর্শ সমাজ নয়। রাজশেখর বসু তাঁর অনুবাদের ভূমিকায় কিছু আভাস দিয়েছেন, যেমন তখন ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়রা প্রচুর মাংস (গোমাংস সমেত) খেতেন ও সুরাপান করতেন, অস্পৃশ্যতা কম ছিল, ধর্মশাস্ত্রে বাল্যবিবাহের বিধান থাকলেও যুবতীবিবাহই বেশি হত, সহমরণ থাকলেও বিধবারা দিব্যি সংসার করতেন, মেয়েদের কিছু মর্যাদা ছিল তবে জুয়ায় পণও রাখা হত, পালাপার্বণে বেশ্যাদের নাচের প্রথা ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিশ্ব চিরায়ত সাহিত্যর একটি পরিচিত ও সফল থিম হল মহান ও বড় মাপের মানুষের ভাগ্যবিপর্যয়। রাম হোক বা যুধিষ্ঠির, কিং লিয়র কিংবা ইডিপাস। এঁরা কেউই খুব খারাপ মানুষ ছিলেন না, কিন্তু ভুগেছেন খুব। এই থিম আসলে জনপ্রিয় হয়। সাধারণ পাঠক/শ্রোতার একটা সমানুভূতি কাজ করে কেন্দ্রীয় চরিত্রর প্রতি। আমিও জীবনে ভুগছি আবার এইসব বড় মাপের লোকেরাও ভুগছে— এইরকম একটা ভাব তাঁদের গল্পটা পড়তে বা শুনতে আকর্ষণ করে। যুধিষ্ঠিরকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে, তাঁর আজীবনের ভোগান্তি তুলে ধরে ‘মহাভারত’-ও আসলে সেই থিমের পথ ধরেই হেঁটেছে। কোনও জ্ঞানবাজির প্রশ্নই নেই।
‘মহাভারত’-কে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে দেখলে সমস্যা অনেক। এক তো সাহিত্যরস আস্বাদনে বাধা পড়ে। তারপর ধরুন, কবে কোন হনুমান কোন বিধর্মীর উপাসনাগৃহ দেখিয়ে বলে উঠবে, এইখানেই যুধিষ্ঠির বসে ধর্মের প্রশ্নর উত্তর দিয়েছিলেন, অতএব ভাঙো, করো দাঙ্গা।
আর এক দল তো অন্য ধর্মের ‘ধর্মগ্রন্থ’ ছোঁবেনই না। খিলাফতের ঐতিহ্যই নিজেদের ঐতিহ্য বলে মনে করবেন।
অথচ ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের গর্ব করার মতো ঐতিহ্য হল ‘মহাভারত’। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি হিসেবে উপমহাদেশের প্রতিটি মানুষেরই ‘মহাভারত’ পড়া উচিত।
সূত্র:
গিরীন্দ্রশেখর বসু। ‘ভগবদগীতা’। ১৩৫৫ বঙ্গাব্দ।
রাজশেখর বসু। ‘মহাভারত’ সারানুবাদ। এম সি সরকার, ১৪১৮ বঙ্গাব্দ।