Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

মহানদীর তীরে, সম্বলপুরে

পুরী ঘুরতে গিয়ে সম্বলপুরী শাড়ি কেনেন অনেকেই, তবে সম্বলপুরে বেড়াতে যান তাদের মধ্যে খুব কম সংখ‍্যক মানুষ। কিন্তু ওড়িশার ‘হ্যান্ডলুম সিটি’ বলে প্রসিদ্ধ এই শহরটি বিশ্ববিখ্যাত সম্বলপুরী ইকত শাড়ির জন্য যেমন প্রসিদ্ধ, তেমনই মহানদীর তীরে অবস্থিত একটি অল্পপরিচিত হলেও স্বল্পছুটি কাটানোর এক অনন্য ভ্রমণস্থান হবার যোগ্যতা রাখে। হিরাকুঁদ ড‍্যাম, ডেব্রিগড় ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি, খালাসুনি ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি, সমালেশ্বরী, ঘণ্টেশ্বরী, হুমা, বুদ্ধরাজা মন্দির, গুদগুদা জলপ্রপাত, ডিয়ার পার্ক, ঊষাকোটি ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি, প্রধানপাত ওয়াটার ফলস— সব মিলিয়ে সম্বলপুর ভ্রমণপিপাসুদের নিরাশ করে না।

সম্বলপুর নামটি প্রাপ্ত দেবী সমালেই-এর নামানুসারে, যিনি এই অঞ্চলের শাসক দেবতা হিসাবে বিবেচিত। এছাড়া সম্বলপুর শহর যে অঞ্চলে অবস্থিত, সে অঞ্চলটি প্রাচীন কালে হীরাখণ্ড নামেও প্রসিদ্ধ ছিল। আদিকাল থেকে ইতিহাসে এটি ‘সংবলাকা’ নামেও পরিচিত। ক্লডিয়াস টলেমি জায়গাটিকে ‘সম্বলক’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে গুপ্ত সম্রাট ‘দক্ষিণ কোশালা’ অঞ্চলটি জয় করেছিলেন যা বর্তমান সম্বলপুর, বিলাশপুর এবং রায়পুরের সমন্বয়ে গঠিত ছিল। এরপর পাণ্ডুভমশি রাজা বালার্জুন শিবাগুপ্ত অঞ্চলটি জয় করেন। তারপরে সোমভমশি রাজা জনজায়া-প্রথম মহাভাবগুপ্ত আধুনিক অবিভক্ত সম্বলপুর ও বোলঙ্গীর জেলা নিয়ে গঠিত কোসালার পূর্ব অংশ একীভূত করে উপকূলীয় আধুনিক ওড়িশার ভৌম-কারা রাজবংশের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। উদ্যোতকেশারীর পরে, সোমভমশি রাজ্য ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে। এরপর অল্প সময়ের জন্য এই এলাকাটি তেলুগু রাজাদের অধীনে চলে আসে। দক্ষিণ কোসালার সর্বশেষ তেলুগু রাজা ছিলেন সোমেশ্বর তৃতীয়, যিনি ১১১৯ খ্রিস্টাব্দের দিকে কালাচুরি রাজা জজল্লদেব-১ দ্বারা পরাজিত হন।

এই কালাচুরিদের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই উত্তালার (বর্তমান উপকূলীয় ওড়িশা) গঙ্গা রাজবংশের দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত। অনঙ্গবিমা দেবা-তৃতীয় (১২১১-১২৩৮ সি.ই.)-র রাজত্বকালে শেষ পর্যন্ত কালাচুরিস বা কলচুরিরা সম্বলপুর ও সনেপুর অঞ্চলটি গঙ্গার কাছে হেরে যান। গঙ্গা রাজ সম্বলপুর অঞ্চলে আরও ২ শতাব্দী ধরে রাজত্ব করেছিল। তবে তারা উত্তর থেকে বঙ্গ সুলতানি এবং দক্ষিণের বিজয়নগর এবং বাহমানি সাম্রাজ্যের আগ্রাসনের মুখোমুখি হয়েছিল। এই অবিরাম সংগ্রামগুলি সম্বলপুরে গঙ্গার ক্ষমতাকে দুর্বল করেছিল। শেষ পর্যন্ত রামাই দেব, উত্তর ভারতের চৌহান রাজপুত সমগ্র পশ্চিম ওড়িশায় চৌহান শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সম্বলপুরও তাঁর অধীনে ছিল।

রাজা অজিত সিং চৌহানের রাজত্বকালে (১৬৯৫–১৭৬৬) সম্বলপুর আলাদা গুরুত্ব পায়। রাজা অজিত সিং বৈদিক মত অনুসারে সম্বলপুরকে একটি ধর্মীয় স্থান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। অজিত সিং বুঝতে পেরেছিলেন যে, সম্বলপুর প্রাচীনকালে শক্তিপীঠ হিসাবে বিখ্যাত ছিল, এখানে শিব এবং শক্তির পূজা করা হয়েছিল। দেওয়ান দক্ষিণা রায় রাজাকে অষ্টসংভূ মন্দিরগুলিতে উদারভাবে অবদান রাখার পরামর্শ দেন। সম্বলপুর এলাকায় হুমা মন্দির ‘অষ্টসংভূ’ দেবদেবীদের মধ্যে প্রধান দেবতা বিমলেশ্বরের বাসস্থান। পরে অজিত সিং আরও সাতটি মন্দির স্বয়ংশম্ভুর জন্য তৈরি করেছিলেন। (অম্বাভোদার কেদারনাথ, দেওগাঁর বিশ্বনাথ, গাইসামার বালুনকেশ্বর, মনেশ্বরের মান্ধাতা, সর্ণার স্বপ্নেশ্বর, সোরান্ডার বিশ্বেশ্বর এবং নীলজির নীলকণ্ঠেশ্বর)।

সম্বলপুরের ইতিহাস সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা তো পাওয়া গেল। এবার বেড়ানোর জায়গাগুলোর একটু বিশদে অবতারণা। সম্বলপুরে দেখার জায়গা অনেক। তারমধ্যে সবচেয়ে প্রথমে আসে হিরাকুঁদ বাঁধের কথা। ভারতের স্বাধীনতার পরে শুরু হওয়া প্রথম বহুমুখী নদী উপত্যকা প্রকল্পগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। সম্বলপুর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে। বাঁধের পিছনে প্রসারিত রয়েছে একটি হ্রদ, হিরাকুঁদ জলাধার, যা প্রায় ৫৫ কিমি দীর্ঘ। ১৯৩৬-এ ওড়িশা রাজ্য গঠিত হওয়ার সময় বিধ্বংসী বন্যার আগেই স্যার এম বিশ্বেসরাইয়া প্রস্তাব দেন একটি বিস্তারিত তদন্তের জন্য, যা মহানদী বদ্বীপ অঞ্চলে বন্যা সমস্যার মোকাবিলা করবে। ১৯৪৫ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় জলপথ, সেচ ও ন্যাভিগেশন কমিশন কাজটি গ্রহণ করে।

হিরাকুঁদ বাঁধ।

এই বাঁধটি ১৯৫৭ সালে সম্পন্ন হওয়ার পর বহু মন্দির জলের নিচে চলে যায়। গ্রীষ্মকালে, বাঁধের জল কমে যাওয়ায় কাঠামোগুলি দৃশ্যমান হয়। অনেক বছর পরে, এই মন্দিরগুলি ঐতিহাসিকদের মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং এই মন্দিরগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বুঝতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এত বছর ধরে জলের নিচে থাকার ফলে অনেক মন্দির ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। যাইহোক, কিছু অবশেষ অপরিবর্তিত আছে। পদ্মাপুর গ্রামের পদ্মসেনী মন্দির বলে যেটি কথিত আছে, সেটির মন্দিরগাত্র থেকে দুটি শিলালিপি (শিলা লিখন) পাওয়ার পরে এই হারিয়ে যাওয়া মন্দির সম্বন্ধে ঐতিহাসিকরা আগ্রহী হয়েছেন। জলাধার এলাকার অভ্যন্তরে অবস্থিত মন্দিরগুলি তদানীন্তন পদ্মপুরের একটি অংশ ছিল। ২০০টিরও বেশি মন্দিরের মধ্যে ১৫০টি মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে বা সম্পূর্ণরূপে জলে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছে আর বাকি ৫০টি মন্দির গ্রীষ্মকালে দৃশ্যমান হয়। হারানো মন্দিরগুলি স্কুবা ডাইভিং উৎসাহীদের জন্য অন্বেষণের চমৎকার এক সুযোগ। সাধারণভাবে মে জুন মাসে নদীতে নৌকাযোগে পরিভ্রমণের সময় দর্শকদের কাছে মন্দিরগুলি দৃশ্যমান হয়।

বাঁধের একপ্রান্তে গান্ধি মিনার আর এক প্রান্তে জওহর মিনার। এই মিনারের ওপর থেকে পারিপার্শ্বিক দৃশ্যাবলি অসাধারণ। গান্ধি মিনারের ওপরের অংশটি ঘূর্ণায়মান। জওহর মিনারের খুব কাছেই রয়েছে সুসজ্জিত জওহরলাল নেহরু পার্ক। শীতকালে এই জায়গাটা পিকনিকের জন্য বিখ্যাত। তবে হিরাকুঁদ বাঁধের ওপর দিয়ে যেতে গেলে পারমিশন নিতে হয়। তবে একবার পারমিশন পেয়ে গেলে এক দারুণ অভিজ্ঞতা হয়। দু’দিকে বিস্তীর্ণ জলরাশির ঠিক মাঝখানে উপস্থিতির অনন্য উপলব্ধি হয়।

সম্বলপুর শহরের স্থানমাহাত্ম্য মা সমালেশ্বরীর মন্দিরকে কেন্দ্র করে। অনেকটা জায়গা জুড়ে মায়ের মন্দির। একদম সামনে থেকে বিগ্রহ দর্শন করা যায়। সম্বলপুর শহরের মধ্যেই রয়েছে তিনটে পাহাড়ি টিলা। একটির ওপর অবস্থিত বুড়হারাজা শিব মন্দির। হেঁটে ওঠার পথ রোমাঞ্চকর জঙ্গলে ঘেরা। আর এক পাহাড়ের টিলায় আছে ডিয়ার’স পার্ক। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে এই পার্ক। হরিণ ছাড়াও আরও অনেক ধরনের জন্তুজানোয়ার আছে। আর তৃতীয় পাহাড়ের টিলার ওপরে আছে ওটিডিসি-র পান্থনিবাস।

সমালেশ্বরীর মন্দির।

সম্বলপুর শহরের কাছেই আছে হুমা মন্দির আর চিপলিমায় মা ঘণ্টেশ্বরীর মন্দির। হুমা মন্দিরে ভগবান শিবের অধিষ্ঠান। এই মন্দিরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল মন্দিরটি হেলানো। মন্দিরটি মহানদীর তীরে অবস্থিত। মন্দিরে পূজোর পরে মন্দিরের ঘাট থেকে নৌকোয় চড়ে মহানদীর বক্ষে পরিভ্রমণ করা যায়। মন্দির সংলগ্ন ঘাটে প্রাচীন মহাশোল মাছ আছে। খাবার দিলে একদম সামনে চলে আসে। কেউ এই মাছ ধরেন না। এবার আসি চিপলিমায় মা ঘণ্টেশ্বরী মন্দিরের কথায়। সম্বলপুর থেকে ৩০ কিমি দূরে এই মন্দির‌ও মহানদীর তীরে। অসংখ্য ঘণ্টার মাঝে দেবতার অধিষ্ঠান। কেউ মানত করলে এই মন্দিরে ঘণ্টা বেঁধে দেন। এই মন্দিরের প্রবেশপথ খুবই রোমাঞ্চকর। নীচে মহানদীর জল আর ওপরে খুবই সরু লোহার ব্রিজের ওপর দিয়ে যেতে হয়। আর জলের স্রোত বেশ বেশি।

হুমা মন্দির।

ক্যাটল আইল্যান্ড সম্বলপুরের আরও একটি আকর্ষণ। হিরাকুঁদ জলাধারের প্রান্তিক সীমার পয়েন্টগুলির একটিতে এটি অবস্থিত, একটি প্রাকৃতিক আশ্চর্য। মানুষের কোনও চিহ্ন ছাড়াই, সম্পূর্ণ দ্বীপটি বন্য গবাদিপশু দ্বারা অধিকৃত। এটি সম্বলপুর থেকে ৯০ কিমি দূরে, যা বেলপাহাড়-বানরপালি পরিসরের কুমারবন্ধ গ্রামের কাছে অবস্থিত। এটি হিরাকুদ বাঁধ থেকে লঞ্চ (নৌকা) করে পৌঁছানো যায়, নদীপথে এর দূরত্ব প্রায় ১০ কিমি। দ্বীপটি প্রকৃতপক্ষে একটি নিমজ্জিত পাহাড়ের অঙ্গিশ, এবং বাঁধ নির্মাণের আগে এটি একটি উন্নত গ্রাম ছিল। পুনর্বাসনের সময় গ্রামবাসীরা তাদের কিছু গোরু ফেলে এসেছিলেন; যখন বাঁধ নির্মাণ শেষ হয়, গবাদিপশুরা পাহাড়-পর্বতের উপর বসতি স্থাপন করে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভিযোজিত হয়ে বন্য প্রকৃতির হয়ে ওঠে। মানবজাতির কাছ থেকে দূরে থাকায়, গবাদিপশুগুলি এখন অত্যন্ত দ্রুতগামী এবং সহজে ধরা যায় না। ঘন বনের মধ্যে পর্বতটিলায় বাস করার ফলে, তাদের আকৃতি সাধারণ গৃহপালিত গবাদিপশুর চেয়ে বড়, প্রায় সবার গায়ের রং সাদা। এই প্রাণীগুলি বন্যপশুর জীবনে ফিরে যাওয়ায় পশুর বংশের একটি বিপরীত চিত্র প্রদান করে।

এরপর বলা যাক ডেব্রিগড় বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যর কথা। শীতকালে প্রচুর প্রজাতির পরিযায়ী পাখি এই প্রাকৃতিক সংরক্ষণাগারে আসে। প্রকৃতিপ্রেমীদের তাদের পরিদর্শন করার সুযোগ আছে। প্রায় ২০-২৫টি প্রজাতির পাখি এই সংরক্ষিত অভয়ারণ্যের জলাধারে দেখা যায় এবং তাদের মধ্যে প্রচলিত সাধারণ পোচারড, রেড-ক্রেস্টেড পোচারড, গ্রেট ক্রেস্টেদ গ্রেব উল্লেখযোগ্য।

ডেব্রিগড় অভয়ারণ্য।

এরপর অসাধারণ সৌন্দর্যমণ্ডিত ঘন জঙ্গলের মধ‍্যে দিয়ে মুগ্ধ হয়ে প্রাকৃতিক শোভা দেখতে দেখতে সম্বলপুর থেকে কোলাবিরা রোড ধরে সাতানব্ব‌ই কিলোমিটার গেলেই দেখতে পাওয়া যায় অপরূপা গুদগুদা ওয়াটার ফলস। তিনটি ধাপে নেমে আসা বিপুল জলরাশির শোভা দেখতে বহু মানুষ এখানে আসেন। ওড়িশা সরকার এখানে গাড়ি পার্কিং, বসা ও পিকনিক করার সমস্ত সুযোগ-সুবিধার বন্দোবস্ত রেখেছে। ঝর্নার সুশীতল জলে এখানে অনেকে স্নান করেন। এখান থেকে মাউন্টেন ট্রেকের‌ও সুবিধা আছে।

গুদগুদা জলপ্রপাত।

সম্বলপুর থেকে ৯১ কিলোমিটার দূরে ওড়িশার দেওগড় জেলায় অবস্থিত আরও একটি সুন্দর জলপ্রপাত আছে যার নাম প্রধানপাত জলপ্রপাত। এটিও সম্বলপুর থেকে সড়কপথে খুব সহজেই যাওয়া যায়। ঊষাকোঠির দূরত্ব সম্বলপুর শহর থেকে মোটামুটি পঁয়ত্রিশ কিলোমিটারের কাছাকাছি। ঊষাকোঠি নাম বদলে এখন এটি বাদরামা অভয়ারণ্য নামেই পরিচিত। বাঘ, লেপার্ড, ভালুক, হরিণ ইত্যাদির বিপুল সমাবেশ আছে এখানে। তবে এই অভয়ারণ্যের মূল খ্যাতি হাতির জন্য। এখানে জঙ্গল সাফারির ব‍্যবস্থাও আছে।

এবার আসি এই শহরের একটি বিখ‍্যাত উৎসব বা কার্নিভালের কথায়। সিতালিস্তি কার্নিভাল বা শীতলষষ্ঠী উৎসব। এটি উত্কল ব্রাহ্মণদের একটি প্রধান উৎসব। জ্যেষ্ঠাশুক্লা ষষ্ঠীতে দেবাদিদেব শিব এবং দেবী পার্বতীর বিবাহ অনুষ্ঠান উদযাপিত হয় শীতলষষ্ঠী কার্নিভালের আকারে। সম্বলপুরের রাজা পুরী জেলার সাসানা গ্রাম থেকে উত্কল শ্রোত্রিয়া বৈদিক ব্রাহ্মণদের সম্বলপুরে নিয়ে আসার পরে এই উৎসবটি সম্বলপুরে শুরু হয়েছিল। প্রায় ৪০০ বছর আগে এই উৎসবের সূচনা হয়। এই উৎসবের মূল লক্ষ্যটি হচ্ছে বৃষ্টির ঈশ্বরকে সূর্যের জ্বলন্ত উত্তাপ থেকে মুক্তি দিতে বলা।

কিংবদন্তি অনুসারে, পার্বতীর সঙ্গে বিয়ের আগে শিব তাকে পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন, জানতে চেয়েছিলেন যে, তিনি তাঁকে কত গভীরভাবে ভালবাসেন। তিনি নিজেকে বাতু ব্রাহ্মণ (স্বল্প উঁচু ব্রাহ্মণ) হিসাবে অবতীর্ণ করেছিলেন এবং পার্বতীকে বলেছিলেন, আমি জানি যে মহেশ্বরকে (শিব) আপনি বিয়ে করতে চান। ওহ! পার্বতী, আপনি যুবতী এবং সুন্দরী, কেন আপনি শ্মশানে বসবাসকারী এমন কোনও দেবতাকে বিয়ে করতে বেছে নিচ্ছেন, যিনি গাছের বাকল এবং সাপকে অলঙ্কার হিসাবে পরিধান করেন। অর্ধনগ্ন সহচর‌ আবৃত হয়ে থাকেন, দেখতে কুৎসিত, কেউ তাঁর ‘কুলা’ এবং ‘গোত্র’ নিশ্চিতভাবে জানেন না এবং আপনি কীভাবে এমন কোনও যাযাবরকে নিয়ে খুশি হতে পারেন। বাতুর ব্রাহ্মণের‌ এই পরামর্শ শুনে পার্বতী রেগে গিয়ে বলেন, ওরে মূর্খ ব্রাহ্মণ, এত শাস্ত্র পড়ার পরেও আপনি শিব সম্পর্কে অজ্ঞ রয়েছেন, আপনি কত বোকা? সে বয়স্ক বা যুবা, কদর্য বা সুদর্শন আমি জানি না, কারণ আমি তাঁর সৌন্দর্য দেখে তাঁকে বিয়ে করছি না, সে সম্পর্কে আমি মাথাও ঘামাই না, তাঁর জ্ঞানের জন্য আমি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। আমি তাঁকে ছাড়া আর কাউকেই স্বামী হিসেবে গ্রহণ করব না। তখন তাঁর সমস্ত পরীক্ষায় সন্তুষ্ট হয়ে শিব তাঁর ঐশ্বরিক আত্মায় হাজির হন। এবং জ্যেষ্ঠের শুক্লপক্ষ পঞ্চমীতে তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই পবিত্র শীতলষষ্ঠী অনুষ্ঠানে একটি মনোনীত পরিবার পার্বতীর পিতা এবং মাতা হিসাবে কাজ করে এবং শিবের সঙ্গে বিবাহের জন্য পার্বতীর হাত প্রদান করে। শিব যেহেতু ‘স্বয়ম্ভূ’ তাই কেউ তাঁর পিতা ও মাতার ভূমিকায় অভিনয় করেন না।

শিব তাঁর মন্দির থেকে অন্যান্য দেবদেবীদের সঙ্গে তাঁর বিবাহ শোভাযাত্রা শুরু করেন। হনুমান এবং নৃসিংহ শোভাযাত্রাকে কনের বাসায় নিয়ে যান। দেবতাদের পরিবার বরযাত্রীদের স্বাগত জানান। মিছিলে দেবদেবীদের মূর্তিগুলি একটি সুন্দরভাবে সজ্জিত পালকিতে রাখা হয়, পার্বতীর বাবা এবং মা এবং অন্যান্য আত্মীয়রা ‘কন্যাদান’ সম্পাদন করেন এবং বিবাহ নিবিড়ভাবে করা হয়। পরের দিন শোভাযাত্রা শিবমন্দিরে ফিরে আসে পার্বতীর সঙ্গে। এই কার্নিভাল দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তো বটেই, বিদেশ থেকেও বহু পর্যটক আসেন। বিভিন্ন লোকনৃত্য, (বাঘানাচা, দাশকাঠিয়া, ধুড়ুকি, ঘুমুরা, ঝুমার) লোকসঙ্গীত (খানজানি, কেন্দারা, ধুমপা) পরিবেশন, পটচিত্র প্রদর্শন এই কার্নিভালের মূল আকর্ষণ।

হোটেল শীলা টাওয়ার, হোটেল উপহার প‍্যালেস, দ্য গ্র‍্যান্ড শিভা, হোটেল লিন জা, দ্য ম‍্যান্ডারিন, হোটেল প্রমোদ, হোটেল নটরাজ অনেক আগে থেকে বুক করে ফেলতে হয় বহু জনসমাগমে চাহিদা বৃদ্ধির জন্যে। এবছর ৬ জুন সম্বলপুরে শীতলষষ্ঠী সাড়ম্বরে পালিত হতে চলেছে। কেউ আগ্রহী হলে তাই আর দেরি না করে এই অভিনব উৎসবের সাক্ষী হতে বেরিয়ে পড়তে হবে।

১২৮৭১/হাওড়া-টিটিলাগড় ইস্পাত এক্সপ্রেস, ১২৮৭১K/হাওড়া কাঁটাবাঞ্জী ইস্পাত এক্সপ্রেস, কামাখ্যা-মুম্বাই লোকমান্য তিলক টাৰ্মিনাস কৰ্মভূমি এক্সপ্রেস, গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস, হাওড়া-সাঁইনগর শিরডি সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস, সাঁতরাগাছি-পুণে হামসফর এক্সপ্রেস। এইসব ট্রেনগুলো হাওড়া থেকে সম্বলপুর আবার সম্বলপুর থেকে হাওড়ায় চলাচল করে।

সম্বলপুর ভ্রমণে দর্শনীয় স্থান প্রত‍্যক্ষ করা, তার ইতিহাসকে জানা, কার্নিভালে অংশগ্রহণ করার পরে একটু অসম্পূর্ণতা থেকে যায় যদি এখানকার বিখ‍্যাত মিষ্টি সরসতিয়া-র স্বাদ আস্বাদন না করা যায়। গুঞ্জির গাছের ছাল তুলে তার থেকে বেরনো আঠাকে দু-তিনদিন জলে ভিজিয়ে রেখে তারপর ছেকে নিয়ে অরুয়া চালের গুঁড়ো ও চিনি দিয়ে ফেটিয়ে তার মধ্যে মিঠাই কারিগররা হাত ডুবিয়ে নিয়ে গরম তেলের মধ্যে সেই গোলাকে ভেজে তৈরি করেন এই পিঠে। তাই এই অভিনব মিষ্টিটির প্রচুর চাহিদা থাকলেও গুঞ্জির গাছের অপ্রতুলতার কারণে এই মিষ্টির সরবরাহ কমে আসছে।

বিখ‍্যাত মিষ্টি সরসতিয়া।

যাঁরা লোকজ শিল্পের অনুরাগী, সম্বলপুর তাঁদের কাছে খনিস্বরূপ। সম্বলপুরের আর্ট গ‍্যালারিটি নিজস্বতায় উজ্জ্বল আর মহানদীর তীরে ঘণ্টেশ্বরী মন্দিরের কাছে অবস্থিত সম্বলপুরের কারডোলা গ্রামটিতে গেলে দেখতে পাওয়া যায় পশ্চিম ওড়িশার শিল্পীদের সুতোর কাজে, শাড়িতে, কাঠের ওপর সব মনোমুগ্ধকর মোটিফ, প‍্যাটার্ন, ম‍্যুরাল নকশা। এই গ্রামের অনেক বাড়ির দেওয়ালেও লক্ষ করা যায় নানান শৈল্পিক নকশা। ওড়িশার ললিতকলা একাডেমি পুরীর কাছে অবস্থিত রঘুরাজপুরের সঙ্গে তাই এই গ্রামটিকেও শিল্পগ্রাম হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে। নভেম্বর মাসে এখানে চারদিনের ম‍্যুরাল পেইন্টিং ক‍্যাম্প হয়, যেখানে প্রচুর শিল্পী ও বয়নশিল্পী একত্রিত হন।

মনোমুগ্ধকর মোটিফ।

ওড়িশার জাতীয় পর্যটন, ভাষা শিল্প, সাহিত‍্য বিভাগ কারডোলা গ্রামে একটি ওয়াল গ‍্যালারি নির্মাণ করেছেন, যা পর্যটকদের কাছে অবশ্যই এক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তাই বলা যায়, সবুজ বনভূমি, বর্ণিল বন্যজীবন, উঁচুনীচু পাহাড়, জলপ্রপাত সমৃদ্ধ উপজাতির জীবন ও সংস্কৃতি, লোকসঙ্গীত ও নৃত্য এবং বিভিন্ন ধরনের স্মৃতিস্তম্ভে সজ্জিত সম্বলপুর পশ্চিম ওড়িশার জাদুকরী প্রবেশদ্বার হিসাবে নিজেকে গৌরবের সঙ্গেই প্রকাশিত রেখেছে পর্যটনের দুনিয়ায়।

চিত্র: লেখক
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

কাজী তানভীর হোসেন

ধানমন্ডিতে পলাশী, ৫-ই আগস্ট ২০২৪

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে কয়েকদিন ধরে যা ঘটেছিল, তা শুরু থেকেই গণআন্দোলনের চরিত্র হারিয়ে একটা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে পরিণত হয়েছিল। আজ আমরা কার্যক্রম দেখেই চিনে যাই ঘটনাটি কারা ঘটাচ্ছে। আগুন আর অস্ত্র নিয়ে রাজনীতি করার স্বভাব রয়েছে বিএনপি-জামাত ও রোহিঙ্গাদের। তারা যুক্তিবুদ্ধির তোয়াক্কা করে না।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য: কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

আমরা বিধানচন্দ্র রায়ের মতো মুখ্যমন্ত্রী পেয়েছিলাম, যাঁকে খুব সঙ্গত কারণেই ‘পশ্চিমবঙ্গের রূপকার’ বলা হয়। পেয়েছি প্রফুল্লচন্দ্র সেন ও অজয় মুখোপাধ্যায়ের মতো স্বার্থত্যাগী মুখ্যমন্ত্রী। এবং জ্যোতি বসুর মতো সম্ভ্রান্ত, বিজ্ঞ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রখর কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদ। কিন্তু তাঁদের সকলের চেয়ে অধিক ছিলেন বুদ্ধদেব। কেননা তাঁর মতো সংস্কৃতিমনা, দেশবিদেশের শিল্প সাহিত্য চলচ্চিত্র নাটক সম্পর্কে সর্বদা অবহিত, এককথায় এক আধুনিক বিশ্বনাগরিক মানুষ পাইনি। এখানেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অনন্যতা।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর দুটি কবিতা

তারার আলো লাগে না ভাল, বিজলীবাতি ঘরে/ জ্বালাই তাই অন্তহীন, একলা দিন কাটে/ চেতনা সব হয় নীরব, বেদনা ঝরে পড়ে/ যজ্ঞবেদী সাজানো থাকে, জ্বলে না তাতে ধূপ/ রাখে না পদচিহ্ন কেউ ঘরের চৌকাঠে/ শরীরে ভয়, নারীরা নয় এখন অপরূপ/ তারারা সব নিঝুম ঘুমে, চাঁদের নেই দেখা/ অর্ধমৃত, কাটাই শীত ও গ্রীষ্ম একা একা

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বিশ্বকর্মার ব্রতকথা

বিশ্বকর্মা পুজোতেও কেউ কেউ বিশ্বকর্মার ব্রত পালন করে থাকেন। এমনিতে বিশ্বকর্মা যেহেতু স্থাপত্য ও কারিগরির দেবতা, তাই কলকারখানাতেই এই দেবতার পুজো হয়ে থাকে। সেখানে ব্রতকথার স্থান নেই। আবার কোন অলৌকিক কারণে এবং কবে থেকে যে এদিন ঘুড়িখেলার চল হয়েছে জানা নেই। তবে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন শহর ও গ্রামের আকাশ ছেয়ে যায় নানা রঙের ও নানা আকৃতির ঘুড়িতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উত্তমকুমার কখনও বাংলাদেশে পা রাখেননি!

ভাবতে অবাক লাগে, ‘৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ উত্তমকুমারকে অভিনয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি। টালিগঞ্জের কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করেছিলেন সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে। অন্যদিকে ববিতা, অলিভিয়া ও আরও কেউ কেউ টলিউডের ছবিতে কাজ করেছেন। ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার ও পরে গৌতম ঘোষ ছবি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশে এসে, কিন্তু উত্তমকুমারকে আহ্বান করার অবকাশ হয়নি এখানকার ছবি-করিয়েদের।

Read More »