বড়পিসিকে আমরা পিসিমণি বলতাম। তাঁর ছেলেমেয়েদের ডাকা হত বড়দা, ছোটদা, বড়দি আর ছোটদি বলে। কিছুদিন আগে ছোটদা মারা গেছেন, বছর-পঞ্চাশেক বয়সে। আজ ছোটদি ছাড়া আর কেউই বেঁচে নেই। ছোটদির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। পুরনো দিনের অনেক গল্প বাইরে এল আর সেই গল্পের অনেকখানি জুড়ে ছোটদার কথা। ছোটদা, বাংলার একসময়ের নামী ফুটবল খেলোয়াড় অলোক মুখার্জি। জন্মেছেন গত শতকের ষাটের দশকে। তাঁদের শৈশব-বাল্য-কৈশোর কাল আজকের মত একবারেই ছিল না। ছোটদার প্রসঙ্গ, ছোটদার ছোটবেলার গল্পে তাঁর সখা গোপীনাথ থাকবে না, তাই কি হয়? সেই গোপীনাথ বা গোপীদার দুষ্টুমি ও মজার গল্প বলতেই ধারাবাহিক ‘ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ’।
দ্বিতীয় কিস্তি
গোপীদাকে ছোটবেলায় অনেকবার দেখেছি। বড়দি, ছোটদিরা (আমার পিসতুতো দাদা-দিদিদের এই নামে ডাকতাম সব) বলত, এই গোপীদার মত দুষ্টুমি ছোটবেলায় আর কেউ করেছে কিনা সন্দেহ! ‘আলোদা কী খবর? সব ভাল তো?’ চলতে-চলতে, বলতে-বলতেই এগিয়ে যেত গোপীদা।
একদিন ছোটদাকে ধরে বসলাম, ‘আচ্ছা ছোটদা, এই তোমাদের বন্ধু গোপীদা কি ছোটবেলায় সত্যিই খুব দুষ্টু ছিল?’ ছোটদার চোখদুটো চকচক করে উঠল। মুখে হাসি। ওই রাশভারী, নামী ফুটবল খেলোয়াড়, অলোক মুখার্জির এত হালকা মেজাজ দেখার সৌভাগ্য এর আগে খুব একটা হয়নি। ছোটদাকে আমরা ঘরেও কমই দেখতাম। বেশিরভাগ সময়ই সে কোথাও না কোথাও খেলার জন্য বাইরে যেত। তাকে আমরা একটু সমঝেই চলতাম। আমাদের প্রশ্নের উত্তরে ছোটদা বলল, ‘আরে বাবা, গোপীনাথ! সে কি আর যে সে রকমের দুষ্টুমি করত? তার দুষ্টুমির ধরণই ছিল আলাদা। একটা নমুনা শোনাই, শোন।’
সরস্বতী পুজো আসছে। আমরা তখন বেশ ছোট। চাঁদা তুলে, সেই পয়সায় প্যান্ডেল বানিয়ে পুজো করার মুরোদ আমাদের ছিল না। ঘরে, ঘরে সরস্বতী পুজোর ধুম তখন। হঠাৎ এক বিকেলে গোপীনাথ এসে বলল, ‘চলো গুরু, সরস্বতী পুজোর চাঁদা তুলিগে।’
সবাই বলে উঠল, ‘আরে, বাড়িতে তো পুজো হচ্ছেই। আমরা চাঁদা তুলে কী করব?’
গোপীনাথ বলল, ‘পিকনিক গুরু পিকনিক— এই ধর পার্টি হবে!’
‘হ্যাঁ রে গোপী, লোকে যদি জিজ্ঞেস করে কোথাকার পুজো? কী পুজোর ব্যবস্থা? তখন কী বলব আমরা?’
গোপীনাথ বলল, ‘সে সব তোমরা আমার ওপর ছেড়ে দাও। এখন একটা কৌটো যোগাড় করো, যাতে চাঁদার পয়সাগুলো ভরে রাখতে পারি। আর শোনো, কাল থেকেই কাজ শুরু। পিকনিক হবে সরস্বতী পুজোর আগের দিন রাত্রে।’
আমরা হতবাক। লোকে পয়সা দেবে কী না দেবে, তার কোনও ঠিক নেই; আগে থেকেই একেবারে পিকনিকের দিনক্ষণ পাকা করে ফেলল!
গোপীনাথ বলল, ‘ভাইসব, সবার একসঙ্গে চাঁদা তুলতে যাবার দরকার নেই। আমি তো আছিই। তোমরা দু-চারজন সঙ্গে থাকলেই হবে। কাল বাকিরা আশপাশে ঘাপটি মেরে টেকনিক শিখে নেবে, যাতে দিন চারেক পরে আরও বেশি গ্রুপ চাঁদা তুলতে যেতে পারে। পুজোর মাত্র পনেরো দিন বাকি। পুজোর চার-পাঁচ দিন বাকি থাকতেই যতদূর পর্যন্ত পারা যায়, এরিয়া কভার করে ফেলতে হবে, বুঝে গেছ তো?’
সবাই মাথা নাড়লাম।
গোপীনাথ বলল, ‘আজ চলি। কাল থেকে মিশন শুরু। কৌটো আনতে ভুলো না। প্রথমে একটা কৌটো, পরে চাঁদা তোলার গ্রুপ ক’টা হচ্ছে দেখে, কৌটোর সংখ্যা বাড়বে।’
আমরা বেশ উৎসাহিত হয়েই বাড়ির দিকে রওনা দেবার জন্য উদ্যত, এমন সময় পার্থ বলল, ‘হ্যাঁ রে গোপী, লোকে যদি চাঁদা দিয়ে আমাদের কাছ থেকে বিল চায়, তখন আমরা কী করব? কী বলব?’
গোপীনাথ দমবার পাত্র নয়। জবাব দিল, ‘বেশি পড়াশোনা করলে এই অতি জ্ঞান দেবার স্বভাবটা দাপিয়ে আসে। শোন পার্থ, আমরা হলাম কচি-কাঁচা পুজো পার্টি। তাই বিল-ফিল আমাদের নেই। আর সেই জন্যেই তো কৌটো সিস্টেমে চাঁদা তুলছি। আর দ্যাখ, চাঁদা চাওয়ার স্টাইল সব আমার কাছ থেকে শিখে নিবি। বিলের কথা কেউ ভুলেও আর জিজ্ঞেস করবে না। বুঝেছিস? এবার যা। ব্রেনে বেশি চাপ নিস না।’
আমরা সবাই বাড়ির পথে পা বাড়ালাম। ‘কৌটো একটা চেয়ে নেব মায়ের কাছে। বাবা যেন জানতে না পারে। জানলেই সব প্ল্যানের ষষ্ঠী কীর্তি হয়ে যাবে।’ এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ি এলাম। এই যাঃ! বাবা বাড়ি এসে গেছেন। এখন আর কৌটো চাওয়া যাবে না। কাল চেয়ে নেব, ভেবে হাত পা ধুয়ে, পড়তে বসতে হল। এই পড়াশোনাটা যে কে সৃষ্টি করেছে কে জানে? সারাক্ষণ মাঠে ফুটবলের পেছনে ছুটছি, এমনটা ভাবতেই আমার বেশি ভাল লাগত।
পরের দিন যথারীতি স্কুল থেকে ফিরে, মায়ের কাছে একটা কৌটো চাইলাম। আমাদের বাড়িতে যে কোনও কিছু স্যাংশন করাতে গেলেই হাজার প্রশ্নের সামনা-সামনি হতে হত। ফাইনালি কৌটো ম্যানেজ হল, এদিক-ওদিক বুজরুকি দিয়ে আর ভুজুম-ভাজুম বলে। কৌটো নিয়ে রাজার চালে মাঠে পৌঁছলাম। আর কে কে কৌটো আনবে কে জানে?
আমরা হাজির। গোপীনাথের পাত্তা নেই। হরেগড়ে তিনটি কৌটো এসেছে। ‘চলো ভাইসব, আমি এসে গেছি’, গোপীনাথ এল হন্তদন্ত হয়ে। চাঁদা তোলা কোথা থেকে শুরু হবে, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হল। গোপীনাথ বলল, ‘তিনটে কৌটো যখন এসেই গেছে, আপাতত গ্রুপও তিনটে করা যাক।’
আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ রে গোপী, তুই একসঙ্গে তিনটে গ্রুপে যাবি কী করে? আর ওই যে কী টেকনিক শেখাবি বলেছিলি, সেটা হবে কী করে?’
গোপী বলল, ‘গোপীনাথ আছে গুরু! কোনও চিন্তা কোরো না। সব ঠিক প্ল্যান করে হবে মাইরি! শিখিয়ে-পড়িয়ে তবেই সাগরেদদের ফিল্ডে নামাব।’
তারপর যা ঠিক হল, তা হল এই যে, আমাদের নিজেদের এলাকাতে একদল যাবে কৌটো নিয়ে। সরস্বতী পুজোর যেমন চাঁদা সবাই চায়, তেমনই চাইবে। আর এক দল, একটু দূরে যাবে, চাঁদা চাইবে। গোপীনাথ বলল, ‘লোককে কনভিন্স করাটাই আসল আর্ট। তাই ঝুলোঝুলি করে হলেও চাঁদা আনতেই হবে।’ আর শেষ গ্রুপ যাবে সব থেকে দূরে। পর্টিকুলারলি সেই সব এরিয়ায়, যে এরিয়ার লোকেদের আমাদের এরিয়ার পুজোর চাঁদা দেবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। এই শেষ গ্রুপে যোগদান করতে কেউ রাজি হল না। মার খাবার শখ কারও ছিল না! গোপী আমার দিকে তাকাল। আমিও অন্য দিকে তাকালাম। গোপী বলল, ‘গুরু, আসল চ্যালেঞ্জ হল এই লাস্ট গ্রুপের কাছে। আর আমি নিজে এই গ্রুপের সঙ্গে যাব।’
গোপীনাথের মধ্যে এমন একটা ব্যাপার ছিল যে, বিপদে পড়ার আশঙ্কা থাকলেও ওর সঙ্গে থাকাকালীন ঘটিত নানা রকম ঘটনার থ্রিলটাকে এড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করত না। প্রখর বুদ্ধি গোপীনাথ, সব সিচুয়েশনকে কীভাবে যে সামলে নিত তা এক দেখবার মত বিষয় ছিল। তা যা হোক, ঠিক হল, তৃতীয় গ্রুপে গোপীনাথের সঙ্গে এক-এক দিন, অন্য দুটো গ্রুপ থেকেও এক-একজন যাবে।
চাঁদা তোলা শুরু হল। বেশ চাঁদা উঠতে শুরু করল। কোনওদিন বেশি, কোনওদিন কম। একদিন, আমার পালা এল গোপীনাথের সঙ্গে যাবার। সেদিন আবার গোপীনাথ বড় গেটের পার, জি টি রোডের কাছে এক এলাকাকে বেছেছে।
বললাম, ‘গোপী এখানে কী করব আমরা? এখানকার লোকেরা বেশিরভাগ অবাঙালি আর কোথায় পুজো আমাদের? এরা কেন চাঁদা দেবে?’
গোপীনাথ বলল, ‘গুরু, চুপচাপ আমার সঙ্গে চলো। তারপর দেখা যাবে।’ এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুরছি। টুকটাক, কমবেশি চাঁদা জুটছে। গোপীনাথ বলল, ‘এসব চাঁদা বোনাস গুরু, বোনাস!’ আর বলতে-বলতে কড়া নাড়ল একটা বাড়ির দরজায়। দরজা খুলল। গোপীনাথ নিজস্ব পদ্ধতিতে চাঁদা চাইল। কিন্তু এ ভবী তাতে ভোলবার ছিল না! গোপীনাথকে জেরা করা শুরু করল, ‘কাঁহাসে আয়ে হো? চান্দা কিঁউ?’ ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্ন আসছে আর গোপীনাথ নির্ভীকভাবে সব প্রশ্নের মোকাবিলা করছে। আমার তো কালঘাম ছুটতে শুরু করেছে। আমার দিকে একবার তাকিয়ে, গোপীনাথের দিকে শেষ মোক্ষম প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন সামনের লোকটি। ‘ইয়ে পূজা হো কাঁহা রাহা হ্যায়?’
গোপীনাথ ফট করে বলে উঠল, ‘আপকে পিছে।’
আমি তো থ। লোকটা আর কিছু না বলে, চাঁদা দিয়ে আমাদের বিদায় করল। আমার তো যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। বললাম, ‘কীরে গোপী, যদি জায়গার নাম-টাম সব জিজ্ঞেস করত, তাহলে?’
গোপী বলল, ‘গোপী হ্যায় গুরু, চিন্তা কোরো না। ঠিক জবাব দিয়ে দিতাম।’
কী আর বলব, তারপর ওই এলাকায়, সে রাতে যতগুলো ঘর থেকে চাঁদা উঠল, সব জায়গাতেই, কোথায় পুজো জিজ্ঞেস করলেই আমরা ওই একই জবাব দিয়েছিলাম, ‘আপ কে পিছে!’ আর যতদূর মনে পড়ে ওই বোনাস চাঁদার দৌলতে, সরস্বতী পুজোর আগের রাতে পিকনিকটা বেশ জমজমিয়ে হয়েছিল!
এক-আধবার ছুটকো প্রশ্ন উঠেছিল বটে, যে, ‘পুজোর নামে তোলা চাঁদার সবটাই খেয়ে মেরে দেব?’ তবে গোপীনাথ এ সমস্যারও সমাধান বলে দিয়েছিল! ‘ঠাকুরের নাম নাও, পেটে ভরো। আর কাল, অঞ্জলি দেবার সময় মনে মনে দুটো প্রণাম বেশি ঠুকে দিয়ো। মা সরস্বতী হলেন গিয়ে অন্তর্যামী, সব নিজেই বুঝে নেবেন।’
এরপর গোপীদার বাকি কথা শোনার জন্য ধীরে ধীরে আরও ঔৎসুক্য বাড়তে লাগল। গোপীদার গল্পকথার দৌলতে, ছোটদার সঙ্গে গল্প করার রাস্তাটা সেদিন খুলে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে আবিষ্কার করতে শুরু করেছিলাম, ছোটদার মত সাদাসিধে আর মজার মানুষ দুনিয়াতে খুব কমই হয়।
গ্রাফিক্স : মুনির হোসেন
ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: লিচু চুরি
ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: ঘুগনি সেল
ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: লে হালুয়া
ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: মুদিখানার প্রত্যাবর্তন
ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: আচার অভিযান