বড়পিসিকে আমরা পিসিমণি বলতাম। তাঁর ছেলেমেয়েদের ডাকা হত বড়দা, ছোটদা, বড়দি আর ছোটদি বলে। কিছুদিন আগে ছোটদা মারা গেছেন, বছর-পঞ্চাশেক বয়সে। আজ ছোটদি ছাড়া আর কেউই বেঁচে নেই। ছোটদির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। পুরনো দিনের অনেক গল্প বাইরে এল আর সেই গল্পের অনেকখানি জুড়ে ছোটদার কথা। ছোটদা, বাংলার একসময়ের নামী ফুটবল খেলোয়াড় অলোক মুখার্জি। জন্মেছেন গত শতকের ষাটের দশকে। তাঁদের শৈশব-বাল্য-কৈশোর কাল আজকের মত একবারেই ছিল না। ছোটদার প্রসঙ্গ, ছোটদার ছোটবেলার গল্পে তাঁর সখা গোপীনাথ থাকবে না, তাই কি হয়? সেই গোপীনাথ বা গোপীদার দুষ্টুমি ও মজার গল্প বলতেই ধারাবাহিক ‘ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ’।
পঞ্চম কিস্তি
বাড়ির আশপাশে আজকাল মুদিখানার দোকান আর তেমন দেখাই বা কোথায় যায়? মুদিখানা বুঝলে না? ‘গ্রসারি স্টোর’! কান পর্যন্ত টানা হাসি দেখেই বুঝতে পারছি এবার বুঝেছ! আজকাল তো সুপার মার্কেট বা অনলাইন থেকেই মুদিখানার জিনিস কেনার চল হয়েছে। ছোট জায়গায়, রাস্তার ধারে এক-আধটা দোকান থাকে বটে, তবে সেগুলো বেশিরভাগ ‘এমার্জেন্সি সার্ভিস’-এ কাজে আসে। অথবা যারা দোকানে খাতা করে, মানে সারা মাস জিনিস নিয়ে, মাসের শেষে একেবারে টাকা দেয়, তাদেরই কাজে আসে। ‘এমার্জেন্সি সার্ভিস’ মানে এই ধরো, এক্ষুনি চিনি বা চা পাতা চাই, অথচ সেটা ঘরে নেই। বাল্ক শপিংয়ের সময় আনতে ভুলে গেছি। তখন এই ছোট দোকানে চট করে গিয়ে, পট করে সেখান থেকে জিনিস নিয়ে আসার কথা বলছি। আগে কিন্তু এসব সুপার মার্কেট, অনলাইন স্টোর থেকে চাল, ডাল, তেল, নুন, চিনি আদি কেনার রেওয়াজ ছিল না। এইসব মুদিখানা থেকেই মাসকাবারির জিনিস কেনা হত। পাড়াতুতো দোকানগুলোর ভারি রমরমা বাজার ছিল। প্রথমদিকে, মোটা ব্রাউন পেপারের তৈরি ঠোঙায় জিনিস ভরে, সুতলি দড়ি দিয়ে তাকে বেঁধে দিত দোকানদার। অনেক পরে খবরের কাগজের তৈরি ঠোঙা এল। খুব মনে আছে, মা ওই প্যাকেটের গন্ধ শুঁকেই বুঝে নিত, কোন প্যাকেটে কী আছে। আর সেই হিসেবে প্যাকেট খুলত একেবারে সিস্টেমেটিক ওয়েতে।
‘এ. ভি. স্টোরস’ নাম ছিল দোকানটার। ছোট গেট থেকে একটু আগে, কিন্তু বড় গেট পর্যন্ত যেতে হবে না, ঠিক এমন জায়গায় ছিল এই দোকান। একেবারে জমজমাট মুদিখানার দোকান যাকে বলে! দোকানে ঢুকতেই, কাঁড়ি-কাঁড়ি বস্তায় চাল, গম, হরেক রকমের ডাল, শুকনো লঙ্কা, চিনি, নকুলদানা, বাতাসা, কাঠবাদাম ইত্যাদি সব রাখা আছে। আর ক্যাশ কাউন্টারের আগে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে কাঠ দিয়ে ঘেরা (কাউন্টার)। এই কাঠ ঘেরা কাউন্টারে বসতেন দোকানের মালিক, বিশ্বনাথবাবু। দোকানের কর্মচারী ছিল নিতাইদা আর মানিকদা। মাঝে-সাঝে বিশ্বনাথবাবুর ভাইও ওই কাউন্টারে এসে বসতেন। কাউন্টারের সামনে থরে থরে কাচের বোতলে সাজানো লজেন্স আর কাউন্টারের পেছনে দেওয়াল জুড়ে তাকগুলোতে কাজুবাদাম থেকে শুরু করে অন্য সব মশলাপাতি, সাবান, শ্যাম্পু, তেল আদি দুনিয়া ভর্তি জিনিস রাখা থাকত।
তখনকারের মধ্যবিত্ত ঘরের বাচ্চারা, আজকালকার মত এত ‘আতু তুতু’ করে বড় হত না। রোদে তেতে, মাঠে কাদা লাগিয়ে, শক্তপোক্ত হবার রীতি ছিল তখন।
এই করোনার কেরামতিতে মুদিখানাগুলো আবার মাথা তুলে দাঁড়াল! ‘এসেনসিয়ালস্’ কিনতে দলে দলে লোক মুদিখানার দ্বারস্থ হল। শপিং মল্ বন্ধ। অনলাইন সাপ্লাই বন্ধ। সবার ঘরের কাছে সুপার মার্কেট নেই। থাকলেও কুপন নাও, কুড়ি জনের বেশি এন্ট্রি নেই, এসবের হ্যাপা এড়াতে, একান্ত আপন মুদিখানা বেস্ট বলে মনে হল মানুষের। ঘরবন্দি মানুষগুলোর বিশ্ব দেখার সাধ মেটাল এই মুদিখানা! দূরে গিয়ে পুলিশের ডান্ডা খাবার থেকে, মুখে মাস্ক পরে, ঘরের কাছের মুদিখানা থেকে দরকারমত জিনিস আনা অনেক নিরাপদ। পাড়াতুতো মুদিখানাগুলোর নাম মুখস্থ হওয়া শুরু হয়ে যায়। হাজার হোক বিপদের বন্ধু বলে কথা!
তখনকার দিনে তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলেরা থলি হাতে ফাইফরমাশ বেশ কিনে আনতে পারত দোকান থেকে। তাদের হিসাব বা বিচক্ষণতা নিয়ে সন্দেহের জায়গা ছিল না। হ্যাঁ, এক-আধটা ছেলে-ছোকরা একবার দোকানে গেলে বাড়ি ফিরতে আবহমানকাল সময় লাগাত বটে, তবে জিনিস বাড়িতে নিয়েই আসত। আর সময় লাগবে নাই বা কেন বলো? রাস্তার ধারে, ওটা হাঁড়িচাচা না চিল? একটা শালিক দেখলে, দ্বিতীয়টাকে না খুঁজে বার করা পর্যন্ত মনের খিটপিটুনি, ঘেঁটু ফুলের জঙ্গলে উড়তে থাকা কালো ভোমরার পিছু নেওয়া, আর তারপরে যদি একটি বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, তাহলে তো কথাই নেই! কাজের কি আর শেষ আছে?
গোপীনাথ বলতো, ‘কথায় কথা বাড়ে’, সেকেলে প্রবচন! আজকাল হল, ‘কাজে কাজ বাড়ে’! একদিন গোপীনাথ সেইরকমই অলিগলি ঘুরে, ঘরের দুটো-ক’টা জিনিস আনতে এ. ভি. স্টোর্স পৌঁছল। পৌঁছেই দোকানের এক কর্মচারীকে উদ্দেশ করে বলল, ‘কী নিতাইদা কেমন বিক্রিবাটা হচ্ছে?’ এমনটা বলতে বলতে, সে বেশ একমুঠো নকুলদানা, দোকানে রাখা বস্তা থেকে নিয়ে মুখে পুরে দিল। তারপর খেতে খেতেই বলল, ‘চলো দেখি, জিনিসগুলো ঝটপট দাও।’ দোকানের কর্মচারী নিতাইদা বলল, ‘আগে তুমি নকুলদানা খাও। তারপর সোজা মুখে জিনিসের লিস্টি বলো।’ গোপীনাথের চোখ ততক্ষণ দোকানের বাকি বস্তা তদন্ত করছে। নকুলদানা শেষ করে, সে আট-দশটা বাদাম তুলে নিল। হাতের চেটোয় বাদাম (মুংফলি) রেখে সে বলতে লাগল, ‘বাহ! বাদামগুলো খুব ভাল। একেবারে পালিশ করা। তবে একদম সলিড দিয়েছে কিনা, তা চেখে দেখতে হবে।’ বলা শেষ করেই, সে ওই বাদামগুলো নিজের মুখে পাচার করে দিল। দোকানের দ্বিতীয় কর্মচারী মানিক বলল, ‘এই এমন করো না। বাবু দেখবে।’ গোপীনাথ বাদাম চিবোতে চিবোতে জবাব দিল, ‘তোমার বাবুকে কাবু করে দেব! এই নাও ফর্দ শোনো।’ গোপী জিনিসের লিস্ট পড়ছে আর পাশে রাখা বস্তা থেকে বাঁ হাতে বাতাসা পকেটে পুরছে। মানিকদা এবার গোপীকে চোখের ইশারা করল। গোপী বলল, ‘মানিকদা, তুমি বাবুকে একটু গার্ড করে দাঁড়াও না।’ গোপীর ততক্ষণে লিস্ট পড়া শেষ হয়েছে। সে মানিকদার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আরে মানিকদা, আমরা তোমার ভাইয়ের মত! তোমাদের দয়াতেই তো বেঁচে-বর্তে আছি। আরে জিজ্ঞেস করে দেখো, তোমাদের বাবুও ছোটবেলায় এমনই করত।’ নিতাইদা জিনিস ভরছে প্যাকেটে। মানিকদা বিরক্তিভরে গোপীনাথের হাত নিজের কাঁধ থেকে সরাল। গোপীনাথের এক্সপ্রেশন বদলাল। সে গম্ভীরভাবে বলল, ‘আমার বাড়ির পাশ দিয়েই তুমি বাজার যাবে কিন্তু! সেটা মনে রেখো!’
মুদিখানার দোকান থেকে জিনিসপত্র কিনে গোপী দোকান থেকে বেরোতে বেরোতে পকেটে রাখা বাতাসার দুটো মুখে পুরল। কড়র-মরর করে বাতাসা ভাঙছে। দোকানের দরজার কাছে এসে সে থামল। তারপর নিতাইদাকে বলল, ‘এবারের বাতাসাগুলো তেমন কড়া পাকের আনতে পারোনি।’ এটা বলে সে বাড়ির পথে রওনা দিল। নিতাইদা মুচকি হেসে মাথা নাড়ল।
এই করোনার আতঙ্কে সব যখন সন্ত্রস্ত, তখন মুদিখানা থেকে জিনিস আনার পরের স্টেপগুলোও বেশ ক্রিটিক্যাল আর টাইম টেকিং হয়েছে! আমাদের বাড়ির উদাহরণই দিই। মুদিখানার জিনিস এলে, সেগুলোকে দরজার পাশে রাখা হচ্ছে নেক্সট দিন পর্যন্ত। কারও তাতে হাত লাগানো বারণ। বাজার থেকে আনা বাকি জিনিস, যেমন সবজি-টবজি ধোয়া হচ্ছে নুন জল দিয়ে। তা শুকিয়ে, প্যাক করে তবেই ফ্রিজে তাদের প্রবেশাধিকার দেওয়া হচ্ছে! প্রাণ বেরোনোর যোগাড়! আমি যে কী পরিমাণে তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছি সে আর কী বলব? ক’দিন আগেও এমনটা ছিল না। মুদিখানার জিনিস এলে, তাকে কত তাড়াতাড়ি যথাস্থানে রাখা যায় সেদিকেই লক্ষ্য থাকত। এখন মুদিখানা থেকে আনা জিনিসগুলো যেন ঘরে এসেই বলছে, ‘ওঃ গিভ মি এ ব্রেক!’ সবজিগুলো বলছে, ‘লেটস গেট ফ্রেশ ফার্স্ট’।
গোপীনাথ মুদিখানার জিনিস নিয়ে বাড়ি এল। গোপীর মা প্যাকেট খুলছেন। সব যথাস্থানে রেখে নিশ্চিন্ত হওয়া আর কী! চিনির প্যাকেট খুলতেই গোপীর মায়ের সন্দেহ হল। ‘হ্যাঁরে গোপী, চিনি কম লাগছে।’ ওঘর থেকে গোপীর সরল আওয়াজ এল, ‘ঠোঙা ফুটো আছে নাকি মা?’ মা বললেন, ‘না, ঠোঙা ফুটো হয়নি। তবে পরিমাণ কম দেখছি। তুই নিশ্চয়ই খেতে খেতে এসেছিস!’ গোপী রান্নাঘরে মায়ের কাছে এসে বলল, ‘দেখছিলাম ছোট দানা চিনি, না মোটা দানা চিনি। একরত্তি খেয়েছি মা।’ মা হাতের কাছে রাখা বেলনা উঁচিয়ে বললেন, ‘আজ তোর একদিন, কী আমার একদিন।’ গোপী বিপদ বুঝে সটান দরজার কাছে গিয়ে, ‘মা, তোমার জিনিস এনে দিয়েছি। এই আমি চললাম। ঢুকছি কখন তাই দেখো’, বলতে বলতে হাওয়াই চপ্পলে পা গলাল। মা তেড়ে এলেন, ‘তবে রে…’, গোপী ততক্ষণে হাওয়া! ঘুরতে ঘুরতে গোপী ছোটদার কাছে এসে কিছুক্ষণ গল্প করল। গল্পের মাঝে একবার বলল, ‘মা আজ বেলনা নিয়ে দাঁড়িয়েছে।’ ছোটদা জিজ্ঞেস করল, ‘কী করবি তাহলে? বাড়ি যাবি না?’ গোপী বলল, ‘ধুস্! বাড়ি গিয়ে, মায়ের কাছেই বসে পড়ব, যেন আমি কিছুই করিনি!’
চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: লিচু চুরি
ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: চাঁদা আদায়
ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: ঘুগনি সেল
ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: লে হালুয়া
ইনস্টলমেন্টে গোপীনাথ: আচার অভিযান