বর্ধমান-কাটোয়া রেলপথের নিগণ রেলস্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বদিকে একটি গ্রাম। নাম ‘যবগ্রাম’। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার অন্তর্গত মঙ্গলকোট থানার ক্ষীরগ্রাম অঞ্চলাধীন এই গ্রাম। গ্রামটিতে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায় বাস করে। তবে গ্রামটি হিন্দুপ্রধান গ্রাম। গ্রামের উত্তর-পশ্চিম কোণে মুসলিম পাড়া। রেলস্টেশন থেকে চলন্ত সাপের মত আঁকাবাঁকা সড়কপথে গ্রামে আসতে হয়। গ্রামের মধ্যে মন্দির যেমন আছে, তেমন মসজিদও আছে।
মুর্শিদাবাদ জেলার কাশিমবাজারের জমিদার মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী মহাশয়ের শ্বশুরালয় এই গ্রাম। সড়কপথের ধারেই গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চবিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি মণীন্দ্রচন্দ্র মহাশয়ের সহধর্মিনী মহারানি কাশীশ্বরী দেবী নামাঙ্কিত। গ্রামে রায় দিঘি, তামিল পুকুর যেমন আছে, তেমনই মুসলিম পাড়ার পশ্চিম প্রান্তে হাস বাগান আর ঠাকুর বাগান নামে দুটি জলাশয়ও আছে। গ্রামের উত্তর প্রান্তে বামুন গ্রাম। এখান থেকে সতীপীঠ ক্ষীরগ্রাম দেড় কিলোমিটার উত্তর দিকে। মাঝে ধামাচি দিঘি দুটি গ্রামকে সংযুক্ত করেছে।
এই যবগ্রামেই জন্মেছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় কাকাবাবু, বাংলার বিশিষ্ট সাহিত্যিক আজিজুল হক মোল্লা; যিনি হাসান আজিজুল হক নামে সমধিক পরিচিত। কাকাবাবু মা-বাবার চতুর্থ সন্তান। কাকাবাবুর বাবা, অর্থাৎ আমার দাদু দোয়াবক্স মোল্লা ইংরেজ আমলে পঞ্চায়েত প্রধান ছিলেন। বাড়ির বৈঠকখানায় প্রতি রবিবার বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হত, যা বিচার সভা নামে পরিচিত ছিল। ওই সময়ে ঘোড়ায় অথবা ঘোড়ার গাড়ি চড়ে সাহেবরাও আসত। কাকাবাবুর বাবার উদ্যোগে নিগণ রেলস্টেশন থেকে পূর্বদিকে চন্দ্রপুর পর্যন্ত তৎকালীন কাঁচা রাস্তাটি নির্মিত হয়েছিল।
কাকাবাবুর পাড়ার সাথি মতিয়ার রহমান, মোস্তাফা, রউফ, এসানুল। ভিন্ন পাড়ার সাথি বলরাম মণ্ডল। এঁরাও কেউই আজ জীবিত নাই। অবশ্য তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে এখনও সুবলচন্দ্র পাল এবং দীপেন্দ্র ভট্টাচার্য্য জীবিত। সুবলচন্দ্র পাল বর্তমানে গ্রামেই বাস করেন আর অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক দীপেন্দ্রবাবু কাটোয়া শহরে বাস করেন। কাটোয়ায় বাস করেন রণজিৎ চট্টোপাধ্যায়, তাঁকে কাকাবাবুর প্রিয় শিষ্যদের একজন বলা যেতে পারে।
কাকাবাবু মহারানি কাশীশ্বরী দেবী উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ভাল ছাত্র যাকে বলে তাই ছিলেন। গ্রামে বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে বর্ধমান শহরে যান উচ্চশিক্ষার জন্য। কাকাবাবু খেলাধুলাও করতেন। তবে তখন প্রধানত ফুটবল আর হা-ডু-ডু খেলারই প্রচলন ছিল। পাড়ার সাথিদের সঙ্গে ধানের মরসুমে ধানের শিস কুড়োতে যেতেন। কাকাবাবু বলতেন কী চমৎকারভাবে তাঁর কোনও সাথি ডানহাতের তর্জনী এবং মধ্যমা ব্যবহার করে টপাটপ, চপাচপ শিস ধান কুড়োত। স্নাতক হওয়ার পর তিনি গ্রামের বিদ্যালয়ে বেশ কিছু দিন শিক্ষকতাও করেন। তখনও তিনি সাহিত্যচর্চা করেন নাই কিন্তু আত্মীয়দেরকে যখন চিঠি লিখতেন তখন বিশেষভাবে সাহিত্যিকের ভাষায় দীর্ঘ চিঠি লিখতেন। যেমন কবি নজরুল ইসলামের লেখা এই রকম অনেক চিঠি আছে।
বেশ হাসিখুশিতেই জীবন কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে কাকাবাবুর বাবা পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) চলে যাবেন ঠিক করলেন। অনেক টানাপোড়েনের পর অবশেষে ভারত ছেড়ে চলে যাওয়াটাই স্থির হয়ে গেল। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কোনও এক বীরেনবাবুর সঙ্গে সম্পত্তি বিনিময় করে কাকাবাবু সহ সমগ্র পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে চলে গেলেন। সেখানে প্রথমে সেখানকার ফুলতলায় বসবাস করতে শুরু করেন। কাকাবাবু পরে খুলনা কলেজের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। আর তখন থেকে খুলনা শহরে বসবাস করতে আরম্ভ করলেন। এরপর নিয়মিত লেখালেখি শুরু করলেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকল। ক্রমে হয়ে উঠলেন খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক।
আমাদের দেশে যেমন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেমন, কাকাবাবুও তেমন তাঁর লেখার মধ্যে গ্রামীণ মানুষের মুখের কথা প্রয়োগ করেছেন। তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে মানুষের অন্তরে তিনি বেঁচে থাকবেন। তাঁর লেখা একটা কাহিনিতে দেখা যায়, একটা গ্রামের বাড়ির দরমা থেকে মুরগি ধরে নিয়ে একটা শেয়াল চলে যাচ্ছে। বাড়ির লোকজন জেগে উঠে শেয়ালটার উদ্দেশে দৌড়চ্ছে। কিন্তু শেয়ালটার দেখা মিলল না। তখন একজন বলছে, ‘হালার শেয়ালডা কোন দিকি গেল ক’ দিনি?’
তাঁর ‘পাতালে হাসপাতালে’, ‘আগুনপাখি’, ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ ইত্যাদি কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ পড়েছি। ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসে যে মানুষীর বয়ান আমরা পাই, সে তো তাঁর মা। কাকাবাবুর মা এবং ভাইয়েরা এই মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে চাননি। তাঁরা ভারত থেকে চলে যাবার সময়কার পরিবারিক ঘটনাপ্রবাহ ও তাঁর মায়ের হাহাকার ওই নারীচরিত্রের ভেতর দিয়ে প্রকাশ করেছেন।
কাকাবাবু বাংলাদেশের নাগরিক হলেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাংলা অ্যাকাডেমি, বোলপুরের শান্তিনিকেতন এবং কাটোয়ার রবীন্দ্রসদন লাইব্রেরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে কোনও সভাসমিতিতে আমন্ত্রণ পেলেই তিনি চলে আসতেন কলকাতায়। আর কলকাতায় এলেই যেমন তিনি শান্তিনিকেতন ও কাটোয়ায় আসতেন, তেমনই ঝটিকা সফরে নিজ গ্রামে চলে আসতেন। গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার আগে বিশেষ বিশেষ স্থান ও ব্যক্তিরা কে কেমন আছে বা আছেন, কী অবস্থায় আছেন তা দেখে যেতেন।
রেলস্টেশন থেকে গ্রামে আসার সেই আঁকাবাঁকা রাস্তার ধারে চাঁড়ালগড় এবং সেই অশ্বত্থ গাছ আজও দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামে প্রবেশ করার মুখে ঝিঝির পুকুর সেই রকমই আছে। গ্রামের রাস্তাঘাট এখন পাকা হয়ে গেছে। নিজ বাসভূমি অন্যের হাতে পড়ে কী অবস্থা হয়েছে, যেখানে বৈঠকখানা ছিল তার চিহ্নমাত্র নেই। অন্য কেউ সেখানে বসতবাড়ি নির্মাণ করেছে। গ্রামের প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয় আজও পাশাপাশিই রয়েছে। আজও হাস বাগান একই রকম। আর ঠাকুর বাগানের উত্তর পাড়ের শেওড়া গাছে কাকাবাবু ঝাল-ঝপটি খেলতেন সাথিদের সঙ্গে, তাও অক্ষত আছে। যতবার আসতেন গ্রামের পরিচিত ব্যক্তি ও সহপাঠী যাঁরা ছিলেন তাঁদের সঙ্গে দেখা করতেন। তারপর যেতেন ধামাচি দিঘি দর্শনে। কত কালের দিঘি সেইভাবেই আছে। মনে হচ্ছে তাদের বয়স বাড়ে নাই, শুধু কাকাবাবুর বয়সই বেড়ে গেছে।
আবার বৈশাখী সংক্রান্তিতে ক্ষীরগ্রামে যোগাদ্যা মেলা বসবে। হাজারও মানুষ সেখানে ফি-বছর ভিড় জমাবেন। গ্রামে গ্রামে হাট বসবে, শহরে শহরে বাজার। ভারত-বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের জীবনযাত্রায় ব্যস্ত থাকবে। সবই আছে, সবই থাকবে, দুঃখের বিষয়, কাকাবাবু আর আমাদের মধ্যে আসবেন না।