ভাষা হচ্ছে এমন একটা পদ্ধতি যা ‘ধ্বনি এবং অর্থ’-র সঙ্গে সম্পর্কিত। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানীগণের অনেকে জীবদেহের তুলনা দিয়ে ভাষার অর্থসংশ্লেষের ব্যাখ্যা খোঁজেন। জীবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসংখ্য কোষসহযোগে গঠিত। কিন্তু দেহে ‘প্রাণের’ অস্তিত্ব না-থাকলে জীবকোষের কোনও কার্যকারিতাই থাকে না। ‘প্রাণ’ থাকলে কোষের, অসংখ্য কোষ দ্বারা গঠিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের তথা সমগ্র দেহেরই কার্যকারিতা থাকে। ‘অর্থ’-ও তেমনি রূপমূলের, শব্দাংশের এবং বাক্যের প্রাণ। অবশ্য নোয়াম চমস্কিই প্রথম অর্থকে ‘ভাষার প্রাণ’ বলে অভিহিত করেন। ভাষিক অর্থ সম্বন্ধে যে পঠন-পাঠন তাই Semantics (দানীউল, ২০১৩: ১৭৯-১৮১)। তবে Semantics শব্দটি ও এ-শব্দটির সঙ্গে জড়িত ধারণার জনক ফরাসি ভাষাতাত্ত্বিক মিশেল ব্রেয়াল। ১৮৯৭ অব্দে ফরাসিতে বেরোয় তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ বই, যা তিন বছর পর ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় ‘Semantics study in the Science of Meaning’ নামে। বাংলায় এ-বিদ্যার নাম হিসেবে ‘নিরুক্ত’, ‘শব্দার্থ’, ‘বাগর্থ’, ‘অর্থতত্ত্ব’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ড. জাহাঙ্গীর তারেক মনে করেন: ‘Semantics’ ব্যাপক অর্থে সংকেতবিদ্যা বোঝালেও ভাষার প্রসঙ্গে এই অর্থে হবে ‘শব্দার্থবিজ্ঞান’ (জাহাঙ্গীর, ১৯৯৮: ০৭)। আবার ড. হুমায়ুন আজাদ মনে করেন: ‘সিম্যানটিক্স’-এর বাংলা হওয়া উচিত ‘অর্থবিজ্ঞান’ (হুমায়ুন, ১৯৯৯: ১৫)। তবে এক্ষেত্রে অধ্যাপক মহাম্মদ দানীউল হক প্রস্তাবিত পারিভাষিক শব্দ বা নাম বাংলায় বহুল প্রচলিত ও অধিকতর উপযোগী বলে প্রতীয়মান হয়েছে আমাদের নিকট। তাঁর ভাষায়: বিভিন্ন দিক বিবেচনায় ‘বাগর্থবিজ্ঞান’ নামটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হয় (দানীউল, ২০১৩: ১৮১)। আর বাগর্থবিজ্ঞানের ভাষানির্ভর বিচারকে আমরা বাগর্থতত্ত্ব বলতে পারি।
সাধারণ লেখাপড়া-জানা লোক অভিধান এবং শব্দ, এ দুয়ের সম্পর্ক দেখে ধারণা করে: শব্দই অর্থের আশ্রয় এবং তার ফলে শব্দের অর্থ জুড়ে জুড়েই বাক্যের অর্থ তৈরি হয়। অবশ্য ভাষাবিজ্ঞান শৃঙ্খলায় ‘অর্থের’ পরিসীমা এখানেই শেষ নয়। কারণ কোনও শব্দের অর্থ তার অঙ্গে নিহিত নয় বা নিত্যসম্পর্কিত নয়, তা আরোপিত এবং কোনও এক ভাষাগোষ্ঠীতে দীর্ঘ ব্যবহারের দ্বারা গৃহীত। আধুনিক কালে ভাষাবিজ্ঞানী ফের্দিন্যাঁ দ্য সোস্যুর তাঁর ‘Course in General Linguistics’ (১৯১৬) বইয়ে এ বিষয়ে মূল সূত্রটি দিয়েছেন: ‘Linguistic sign is arbitrary’ (Saussure, ১৯৬৬: ৬৭)। সোস্যুর দ্যোতক (Signifier) ও দ্যোতিত (Signified)-কে দেখেছেন আকস্মিকভাবে একই বৃত্তে আবদ্ধরূপে; আর অগডেন ও রিচার্ডস তাঁদের ‘Meaning of Meaning’ (১৯২৩) বইয়ে এ-সম্পর্ককে দেখেছেন ত্রিভুজরূপে। তাঁদের মতে অর্থ (Meaning) শব্দনির্দেশিত বস্তু (Referent)-তে নেই, অর্থ আসলে একটি ধারণা (Concept) মাত্র। শব্দের ধ্বনিরূপ (Form) বা প্রতীক (Symbol) উচ্চারণমাত্রে বস্তু (Thing/ Referent)-র একটি ধারণাই শ্রোতার মনে জেগে ওঠে। বিষয়টি তাঁরা এইভাবে দেখিয়েছেন:
এ-চিত্রে উচ্চারিত শব্দ (Simbol) এবং বস্তু, ঘটনা, অনুভব ইত্যাদি (Referent) ভগ্ন রেখার সাহায্যে যুক্ত। এটা বোঝায় এদুটির সম্পর্ক পরোক্ষ; এরা ধারণার মধ্যস্থতায় সম্পর্কিত। অর্থ হল ওই ধারণা-র (Concept) বিন্দুটি। অর্থাৎ ভাব (Thought) বা নির্দেশন (Reference) বা ধারণা (Concept)-ই অর্থ (Meaning)।
অগডেন ও রিচার্ডসের বইয়ের এক দশক পর বেরোয় ব্লুমফিল্ডের অত্যন্ত প্রভাবশালী বই ‘Language’ (১৯৩৩); এটিতে তিনি অর্থকে সমর্পণ করেন বিজ্ঞান ও মহাকালের হাতে। অর্থ সম্পর্কে তাঁর হতাশা ব্যাপক বদ্ধমূল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানের জগতে (হুমায়ুন, ১৯৯৯: ২১)। অবশ্য সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানীদের হাতে যে-সব ভাষিক ধারণার উৎপত্তি ঘটেছে, তার মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রূপমূল (Morpheme)। কিন্তু রূপমূল শব্দের সমস্যা সমাধান না করাতে ভাষাবিজ্ঞানীগণ শব্দের জন্য একটি নতুন পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করেন, তা হচ্ছে লেক্সিম। লেক্সিমকেই মেনে নিতে হয় অর্থের একক হিসেবে। লেক্সিমই অভিধানে অন্তর্ভুক্তি হিসেবে গৃহীত হয়। অস্বীকার করা যায় না ভাষার অর্থের একটি প্রধান উৎস হল ভাষায় অভিধানে (Lexicon) প্রাপ্ত শব্দাবলি, যা বহু আগে থেকেই ভাষায় ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। এর বেশিরভাগই ভাষাব্যবহারকারী ব্যাপক জনগোষ্ঠী সকলের আয়ত্তে, কিছু ‘আভিধানিক’ শব্দ; যা সাহিত্যের উচ্চবিদ্যাসংশ্লিষ্ট বই-পত্রে ব্যবহৃত তা সকলের জানা না থাকতেই পারে। এ-সব পারিভাষিক শব্দ (Technical Term) ছাড়া ভাষার অধিকাংশ শব্দেরই একাধিক অর্থ দাঁড়িয়ে যায়।
সংস্কৃত কাব্যতত্ত্বে শব্দের প্রাথমিক বা আভিধানিক অর্থকে বলে অভিধা আর দ্বিতীয় অর্থগুলিকে বলে লক্ষণা। লক্ষণা বা imposed meaning-এর ধর্মই হল উপলক্ষ্য অনুযায়ী মূল অর্থ বা অভিধাকে আড়াল করে নিজেকে সম্মুখে নিয়ে আসা (ফিরোজা, ২০১১: ৪০৭)। বাংলা ভাষার মত সিলেটের উপভাষায়ও অশ্লীল বা ঘনিষ্ঠ কথা-বার্তা, গালাগাল কিংবা আদরের ক্ষেত্রে শব্দের লাক্ষণিক অর্থকেই ব্যবহার করা হয়। যেমন:
এসব লক্ষণার্থ আসলে কোনও অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর অভ্যাসে আবেগে আরোপিত। হয়তো বাক্যে এসব প্রয়োগের ফলেই লেক্সিমগুলোর লক্ষণার্থের সৃষ্টি হয়েছে।
তবে সমরূপ শব্দের নানা অর্থ এভাবে লক্ষণার মত আরোপিত হতে পারে না। তার পেছনে আবেগের কোনও উৎস নেই। একই ধ্বনিগত শরীর হলেও প্রতি বহ্বর্থক (Ambiguous) লেক্সিম (Lexeme)-এর অভিধা বা মূল অর্থই পৃথক। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানীগণের (পবিত্র, ২০১৪: ৩১৩) মতে ভাষার শব্দের এই দ্ব্যর্থকতা বা বহ্বর্থকতার দুটি স্পষ্ট শ্রেণি:
এমন হতে পারে যে, শব্দগুলি ব্যুৎপত্তি সূত্রে এক, কিন্তু তাদের অর্থের রূপকজনিত সম্প্রসারণ বা রূপকায়ণ ঘটতে পারে; যেমনটা, সিলেটের উপভাষায় ‘বাতাস’ শব্দের বিশিষ্টার্থক প্রয়োগে:
ক. খিড়কি লাগা বা’রে বাতাস দের (জানালা বন্ধ কর বাইরে বাতাস দিচ্ছে)।
খ. দেশর বাতাস অংকু কার বায় (দেশের বাতাস [অবস্থা] এখন কার দিকে)?
গ. ইনো কিগুয়ে বে কুইয়া বাতাস ছাড়ছে (এখানে কে রে দুর্গন্ধযুক্ত বাতাস [গ্যাস] ছেড়েছে)?
ঘ. পুড়িগুর গাত উপরি বাতাস লাগছে (মেয়েটির গায়ে বাজে বাতাস [জ্বিনের আছর] লাগছে)।
ওপরের উদাহরণগুলোতে ক. বাক্যের ‘বাতাস’ শব্দের মূল অর্থের বিস্তারই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে অন্য বাক্যগুলোতে। ভাষাবিজ্ঞানে এর পরিভাষা অর্থান্তরণ (Polysemy)। অর্থান্তরণ-এর কারণ মূলত রূপক হিসেবে শব্দটির ব্যবহার। অন্যদিকে জা’ল-র অর্থ ‘নকল’, ‘দেবর বা ভাসুরের স্ত্রী’, ‘আগুন জ্বালানো’, এবং ‘মাছ ধরার ফাঁদবিশেষ বা নেট’; কিংবা ‘কর’ লেক্সিম-র অর্থ: ‘Do’, ‘Fuck’, ‘Back’, ‘Title’, ‘Hand’, ‘Tax’ ইত্যাদি। অর্থের এমন বহ্বর্থকতার কোনও ব্যাখ্যা না পাওয়াতে এদের পারিভাষিক নাম দেওয়া হয়েছে নানার্থন (Homonymy)। এই কারণেই সাধারণ অভিধানে শব্দগুলিকে ভুক্তিতে পর পর সাজানো হলেও সংখ্যাচিহ্ন দিয়ে সেগুলিকে আলাদা করা হয়। দেখানো হয়: শব্দগুলি ভিন্ন অর্থের এবং ভিন্ন চেহারার শব্দ থেকে ঐতিহাসিক ‘ধ্বনিগত’ বিবর্তনের ফলে শব্দগুলির ধ্বনি শরীর এক হয়ে গেছে, অথবা ভিন্ন ভাষার উৎস থেকে কোনও শব্দ একই ধ্বনিশরীর নিয়ে প্রবেশ করেছে। যেমন: জা’ল-র প্রথম অর্থ আরবি থেকে আসা, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অর্থ সংস্কৃত থেকে আসলেও ঐতিহাসিক ‘ধ্বনিগত’ বিবর্তনের উদাহরণ আর চতুর্থটি সংস্কৃত থেকে আগত। বাংলা ভাষার মত সিলেটের উপভাষায়ও বাক্যের প্রতিবেশই এগুলির অর্থকে সুনিশ্চিত করে।
সুতরাং বলা যায় প্রতিটি ভাষার অভিধানে তালিকাবদ্ধ ষবীরপধষ সবধহরহম-এর যথেষ্ট বৈচিত্র্য থাকে। বাক্যে ব্যবহৃত না হলে অভিধানে লেক্সিমগুলোর মৃত অর্থই পড়ে থাকে। এমনকি এগুলি বাক্যে অন্যান্য লগ্নক ও পদের সঙ্গে সম্বন্ধে তাদের অর্থ নানাভাবে বিশেষিত করে। বাংলা ভাষার মত সিলেটের উপভাষাতেও: ‘গু’ (টা), ‘গুইন’ (গুলো) প্রভৃতি লগ্নক; ‘আর’, ‘ও’ প্রভৃতি যোজক; এবং ‘আরু’ (তাই), ‘টাইন’ (নিকট) প্রভৃতি অনুসর্গ, প্রকাশ করে ব্যাকরণিক অর্থ (Grammatical meaning)। শাব্দিক অর্থ (Lexical meaning) আর ব্যাকরণিক অর্থ মিলেই হয় পদের অর্থ (পবিত্র, ২০১৪: ৩১৭)। আবার কখনও অসমাপিকা ক্রিয়াপদ ও সমাপিকা ক্রিয়াপদ মিলে যৌগিক ক্রিয়াপদ গঠন কালে; যেমন: ‘খাই লা’ (খেয়ে নে), ‘আইজা’র গি’ (এসে যাচ্ছে গিয়ে) ইত্যাদির শেষ ক্রিয়াটির নিজস্ব অর্থ আর এসব প্রয়োগে বজায় থাকে না, ‘সম্পন্নতা’, ‘আসন্নতা’ ইত্যাদি ব্যাকরণগত অর্থ দাঁড়িয়ে প্রমিত বাংলা ভাষার মত সিলেটের উপভাষাতেও ব্যাকরণায়ন (Grammaticalization) ঘটে।
অন্যদিকে অভিধানে লেক্সিমগুলোর যে-অর্থ, তাকে বিভিন্ন লক্ষণে বা অণু-লক্ষণে ভাগ করার একটি পদ্ধতি সংবর্তনী-সঞ্জননী ব্যাকরণের আলোকে উদ্ভাবিত হয়েছে: তার নাম অর্থাণু-বিশ্লেষণ। তাতে ধরা হয়েছে যে একটি লেক্সিম একাধিক অর্থাণুর সংযোগে গঠিত হয়। যেমন: সিলেটের উপভাষার ‘পুয়া’ (বালক/ছেলে) ও ‘পুড়ি’ (বালিকা/মেয়ে) লেক্সিমদুটির অর্থাণুতে বিশ্লেষণ (স্থূলত) এভাবে হতে পারে:
এই অণুবিশ্লেষণ বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগের ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ হলেও চমস্কির মতে, মানুষের মস্তিষ্কস্থিত ব্যাকরণে লেক্সিমগুলির অর্থসংগঠনে (Semantic structure) এই অণু-উপাদানগুলি কার্যকর থাকে। এই অর্থাণু-সংগঠনের সঙ্গে অন্য লেক্সিমের অর্থাণু-সংগঠনের বা অর্থ-মানচিত্রের সংগতি-অসংগতিরও নানা নিয়ম তৈরি থাকে, যার ফলে কোন শব্দ আর কোন শব্দের সহগামী হবে বা হবে না অন্বয়ের ব্যাকরণে তাও নির্ধারিত থাকে (ফিরোজা, ২০১১: ৪১১)। যেমন: সিলেটের উপভাষায়:
তাইন এবলা দেশো আইবা তান পুয়াগুরে বিয়া করাইতা আর পুড়িগুরে বিয়া দিতা। (তিনি এখন দেশে আসবেন তাঁর ছেলেটিরে বিয়ে করাতে আর মেয়েটিকে বিয়ে দিতে)।
এখানে ‘পুয়া’-র সঙ্গে ‘বিয়া করাইতা’ এবং ‘পুড়ি’-র সঙ্গে ‘বিয়া দিতা’ সহগামী হবে, বিপরীত অন্বয় অসম্ভব। এভাবে সংগতির নিয়ম মেনে সমস্ত বাক্যটি একটি অর্থপূর্ণ উক্তি হয়ে ওঠে। আবার যদি বলা হয়:
তাইন এবলা দেশো আইবা তান পুয়া আর পুড়ির বিয়ার লাগি/ বিয়াল্লাগি। (তিনি এখন দেশে আসবেন তাঁর ছেলে আর মেয়ের বিয়ের জন্য)।
তখন ‘পুয়া’ ও ‘পুড়ি’ উভয়ের সঙ্গেই ‘বিয়ার লাগি/ বিয়াল্লাগি’ নির্বাচন করা যায়। কিন্তু এ বাক্যে ‘বিয়া করাইতা’ বা ‘বিয়া দিতা’ সম্ভাব্য বিকল্প হলেও ব্যবহৃত হয় না, পরিহার করা হয়। এভাবে সম্ভাব্য নানা বিকল্পের মধ্য থেকে একটিকে নির্বাচনের এই প্রক্রিয়াই বৈকল্পিক নির্বাচন বা pradigmatic choice। এটা মূলত অর্থের অনুরোধে বাছাই। অধুনা ভাষাবিজ্ঞানীগণের ধারণা: একটি শব্দের বৈকল্পিক নির্বাচনে বাইরের সম্পর্কের চেয়ে শব্দের নিজস্ব অর্থাণুর সংগঠনই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে (পবিত্র, ২০১৪: ৩১১)। কারণ অর্থাণু-বিশ্লেষণ করে দেখা হল শব্দকে ভিতর দিক থেকে দেখা। অবশ্য এ ছাড়াও লেক্সিমের আরও নানা লক্ষণ থাকে: ধ্বনিগত, অন্বয়গত ইত্যাদি। সব কিছু মিলিয়েই বাক্যে বিশেষ প্রতিবেশে তার প্রয়োগ বিহিত বা অবিহিত বলে বিবেচিত হয়।
বাইরের দিক থেকে একটি শব্দকে অন্য শব্দের সম্পর্কে মিলিয়ে দেখার প্রাচীন প্রথা পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক ভাষাতেই আছে। অর্থাণু-বিশ্লেষণের উলটো দিক থেকে দেখার এ উপায় হচ্ছে শব্দের অধিশব্দ, উপশব্দ, বিপরীতার্থক শব্দ আর প্রতিশব্দের পরিচয়গুলি দেখা। অধিশব্দ ও উপশব্দ পরিভাষাদুটি নতুন হলেও এবিষয়ক ধারণাটি বেশ পুরনো। এদুটি পরিভাষাকে একত্রে অন্তর্ভুক্ততা (Hyponymy) বলা হয়। Synonymy ও Antonymy-র সাদৃশ্যে Hyponymy পরিভাষাটি গঠিত। একে অনেক সময় Inclusion বলা হয়। এটি অর্থের অত্যন্ত মৌলিক পদগত সম্পর্ক, যা অনুসারে ভাষার শব্দসম্ভার সংগঠিত হয়; ব্যাপারটি খুব ব্যাপক। যেমন: সিলেটের উপভাষায়: গেন্ডা (গাঁদা), শেফাইলকা (শিউলি), গুলাফ ( গোলাপ), চ’ম্পা (চাঁপা) ইত্যাদি নাম ফুল শব্দের অন্তর্ভুক্ত। অন্তর্ভুক্ততা নির্দেশ করে বিশেষ এক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হওয়া। যে-ধারণার মধ্যে একাধিক ধারণা অর্ন্তভুক্ত হয়, তাকে বলা হয় ঊর্ধ্বধারণাবাচক শব্দ (Superordinate term) বা অধিশব্দ (Hypernym); যেমন: ‘ফুল’। আর তার অন্তর্ভুক্ত শব্দ বা সেই শ্রেণির সদস্য ধারণা ও শব্দকে বলা হয় অন্তর্ভুক্ত শব্দ বা উপশব্দ (Hyponym); যেমন: উল্লিখিত বিভিন্ন ফুলের নামগুলো ফুল শব্দের অন্তর্ভুক্ত শব্দ বা উপশব্দ। কাজেই অধিশব্দতা এবং উপশব্দতা; এ দুটি শব্দে শব্দে দুটি সম্পর্কের সূচক। অবশ্য সিলেটের উপভাষার শব্দে প্রচুর অন্তর্ভুক্ত শব্দ বা উপশব্দ বিদ্যমান থাকলেও সব সময় সবগুলোর ঊর্ধ্বধারণাবাচক শব্দ বা অধিশব্দ পাওয়া যায় না বা ব্যবহৃত হয় না সচরাচর।
আরেক ভাবে শব্দের অর্থকে আংশিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় এ বলে যে, এর দ্বারা কী বোঝায় না বা এটা আসলে কী নয়। এরকম বিচারে যে-সব শব্দ একে অন্যটির ঋণাত্মক বা উলটো অর্থ বোঝায় সেগুলোকে বলা হয় বিপরীতার্থক শব্দ। দীর্ঘকাল ধরেই অর্থ-বৈপরীত্য বা বিপরীতার্থকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থগত সম্পর্ক বলে গণ্য। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানীগণের দৃষ্টিতে বিপরীতার্থক শব্দগুলোতে অন্য সকল আর্থবৈশিষ্ট্য অভিন্ন থেকে শুধুমাত্র একটি বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হয়ে থাকে (দানীউল, ২০১৩: ১৯৫)। সিলেটের উপভাষায় ‘ডেকা’ (ষাঁড়) ও ‘দামা’ (বলদ/ দামড়া) বিপরীতার্থক শব্দদুটির মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ সম্পর্ক এভাবে দেখানো যায়:
অর্থগত দিক থেকে বা আর্থবৈশিষ্ট্যে দুই শব্দের শেষেরটিই কেবল বিপরীতার্থক, তা ছাড়া আর সব দিকেই শব্দ দুটি কাছাকাছি।
অন্যান্য ভাষার মত সিলেটের উপভাষায়ও বিপরীতার্থক শব্দের রকম অনেক। পরিপূরক জোড় আছে, যেমন: জি’ত্তা-মরা (জীবিত-মৃত), বেটা-বেটি (পুরুষ-নারী), ডিগা-পাকনা (কাঁচা-পাকা) ইত্যাদি। এগুলি এভাবে পরিপূরক: যে ‘জি’ত্তা’ নয় = (তাই) ‘মরা’ এবং ‘মরা’ নয় = (তাই) ‘জিত্তা’। আবার মাত্রিক জোড় আছে, যেমন: লাম্বা-বাট্টি (লম্বা-বেঁটে), বড়-হুরু (বড়-ছোট), রুশে-আস্তে (দ্রুত-ধীরে), গাট্টা-চিকনা (প্রশস্ত-সংকীর্ণ), বুড়া-জোয়ান (বৃদ্ধ-তরুণ) ইত্যাদি। এসব বিশেষণ শব্দ; আর এগুলোর নানা রকম মাত্রা রয়েছে। তাই কেউ হতে পারে ‘থুড়া হুরু’ (সামান্য ছোট) বা ‘জব্বর হুরু’ (বেশি ছোট) ইত্যাদি। স্যাপির বলেছেন এসব শব্দ ব্যাখ্যা করা সম্ভব তারতম্য ধারণার সাহায্যে। মাত্রিক-বিপরীতার্থক শব্দের একটা চরিত্র হল একটা চিহ্নিত হবে এবং অন্যটি হবে অচিহ্নিত। উপরের উদাহরণের ‘লাম্বা’, ‘বড়’, ‘রুশে’, ‘গাট্টা’ ও ‘বুড়া’ জোড়গুলোর অচিহ্নিত সদস্য। অচিহ্নিত শব্দটিই সাধারণত প্রধান ধারণা প্রকাশ করে থাকে, আর চিহ্নিত শব্দটি প্রকাশ করে তার বিপরীত ধারণা। সিলেটের উপভাষায় বাংলা ভাষার মতই সাধারণত অচিহ্নিত শব্দই ব্যবহৃত হয়; যেমন:
পুড়িগু কতখান লাম্বা (মেয়েটি কতটুকু লম্বা)?
: হাড়ে তিন আ’ত্ লাম্বা (সাড়ে তিন হাত লম্বা)।
তবে ঠাট্টা করে বা কৌতুক করে চিহ্নিত শব্দ ব্যবহারের প্রচলনও সিলেটে প্রচুর; যেমন:
কইন্যা বাট্টি নি বে (কনে বেঁটে নাকি রে)?
: তিন আ’ত তাকি আরকটুক বাট্টি আ’ইব (তিন হাত থেকে আরেকটু বেঁটে হবে)।
আর-এক রকমের ‘বিপরীত’ধর্মী জোড়শব্দ আছে যেগুলোকে বলা হয় সম্পর্কিত বিপরীত; যেমন: ‘কওয়া-হুনা’ (বলা-শোনা), ‘জামাই-বউ’ (স্বামী-স্ত্রী), ‘বাপ-বেটা’ (পিতা-পুত্র), পুবে-পইছ’মে (পূর্বে-পশ্চিমে) ইত্যাদি। এগুলোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখ্য বিষয় হল: অর্থের সংগতি ও প্রতিসাম্য। আমি যদি কারও ‘পুবে’ থাকি, তিনি থাকবেন আমার ‘পইছ’মে’। কেউ আমার ‘বাপ’ হলে আমি হব তাঁর ‘বেটা’ (অবশ্য ‘বেটি’ও হতে পারি)।
বিপরীতার্থকতা ভাষায় খুব স্বাভাবিক, যদিও সব বিপরীতার্থকতা একই ধরনের নয়। প্রমিত বাংলা ভাষার মত সিলেটের উপভাষায়ও বিপরীতার্থক শব্দ তৈরির একাধিক উপায় আছে। ভিন্ন ভিন্ন শব্দে বিপরীতার্থক শব্দ তৈরি হয়; যেমন: আগে-করে (সামনে-পিছে), আ’লিয়া-চা’লাক (আলসে-চটপটে) ইত্যাদি। নঞ-চিহ্ন যোগে: কাম-আকাম (কাজ-অকাজ), বিয়াইত্তা-আবিতা (বিবাহিতা-অবিবাহিতা), মাত্রা-নিমাত্রা (সবাক-নির্বাক), শরমিন্দা-বেশরম (লাজুক-নিলাজ) ইত্যাদি। ভিন্নার্থক লগ্নক বা প্রত্যয়ের সাহায্যে: চা’লাইল-চা’লাওরা (চালিত-চালক), শাসক-শাসিত ইত্যাদি। এছাড়া প্রমিত বাংলায় ব্যবহৃত: উপসর্গ যোগে: মান-অপমান, গমন-আগমন; বিপরীতার্থক উপসর্গ যোগে: আদান-প্রদান, সুলভ-দুর্লভ, উন্নতি-অবনতি ইত্যাদি বিপরীতার্থক শব্দ সিলেটের উপভাষায় অবিকল অথবা সামান্য পরিবর্তিত উচ্চারণে ব্যবহৃত হতে শোনা যায়।
সিলেটের উপভাষায় যে কেবল বিপরীতার্থক শব্দই থাকে তা-ই নয়, এর উলটো রকম সমার্থক শব্দের উদাহরণও প্রচুর। ‘সম বা অভিন্ন বা একই অর্থ’বিশিষ্ট ভিন্ন ধ্বনির সমার্থক শব্দগুলোকে প্রচলিত বাংলা ব্যাকরণে বলা হয়ে থাকে প্রতিশব্দ (দানীউল, ২০১৩: ১৯৪)। যে-কোনও ভাষার অভিধানেই প্রত্যেক লেক্সিম (Lexeme)-এর সঙ্গে অনেকগুলো প্রতিশব্দ দেয়া থাকে। যদিও আগে থেকেই শব্দগুলোর অর্থ জানা না থাকলে পাঠকের বিশেষ উপকার হয় না। সমার্থকতা ধারণাটিকে কঠোর ও শিথিল দু’ভাবে প্রয়োগ করা গেলেও আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে কঠোরভাবে প্রয়োগ করাই রীতি। উলম্যান বলেছেন, ‘সার্বিক সহনামিকতা (সমার্থকতা) একটি অতি বিরল ঘটনা, এ এমন-এক বিলাসিতা যার দায় বহন করা ভাষার পক্ষে কঠিন’ (Ullman, ১৯৯৩: ১১৫)। সাধারণত Roget’s Thesaurus বা যথাশব্দ-এর মত বইতে সমার্থকতার ধারণাকে শিথিলভাবে প্রয়োগ করা হয়। যেমন, এখানে দেখানো হয়: বই, কেতাব, গ্রন্থ, পুস্তক, পুঁথি, বহি, শাস্ত্র, পুস্তিকা ইত্যাদি প্রমিত বাংলা ভাষায় সমার্থক শব্দ বা পুস্তক-র প্রতিশব্দ (হাবিবুর, ২০১১: ২১৯)। এবার সিলেটের উপভাষায় উদাহরণ দিয়ে এগুলোকে বিচার করা যেতে পারে:
ক. মর বাপে বই পড়ইন (আমার বাবা বই পড়েন)।
খ. মক্তবর হুজু’রে কেতাব না নিলে মারইন (মক্তবের হুজুর কেতাব না নিয়ে গেলে মারেন)।
গ. মন্দিরঅ পাঠক আইছইন শাস্ত্র পাঠ আরম্ব অ’ইব (মন্দিরে পাঠক এসেছেন শাস্ত্র পাঠ শুরু হবে)।
ঘ. আগর আমলোর পুথি পড়ডা অংকু নাই (আগের আমলের পুঁথি পড়ুয়া এখন নেই)।
ঙ. তান ভাই খুব নামি পুস্তক ব্যবসায়ি (তাঁর ভাই খুব নামি পুস্তক ব্যবসায়ী)।
ওপরের ক. ও ঙ. উদাহরণে ‘বই’ ও ‘পুস্তক’ সমার্থক, এমনকি ক. উদাহরণে বই-র সবগুলো প্রতিশব্দই ব্যবহার করা যাবে। কিন্ত খ. ও গ. উদাহরণে এরা মোটেই প্রতিশব্দ নয়। ঙ. উদাহরণটি সাধারণত শিক্ষিত জনগণ ব্যবহার করেন, এটিও গ. ও ঘ. উদাহরণের প্রতিশব্দ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। এভাবে শব্দগুলো বিশেষ বিশেষ প্রতিবেশে সমার্থক বা প্রতিশব্দ; বিশেষ বিশেষ প্রতিবেশে অসমার্থক। আবার ঙ. উদাহরণে ‘পুস্তক ব্যবসায়ী’-এ পুস্তকের বদলে ‘বই’, ‘গ্রন্থ’, ‘কিতাব’ ইত্যাদি ব্যবহার করা গেলেও, ‘পুঁথি’, ‘বহি’, ‘শাস্ত্র’, ‘পুস্তিকা’ ইত্যাদি বিকল্পন বা বিনিময় সম্ভব নয়। এর কারণ এ ভাষার শৈলীগত (Stylistic) চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য। শৈলীগত কারণে সিলেটের উপভাষায় উদ্ভূত প্রতিশব্দ: মরিযাওয়া (মারাযাওয়া), সগ্গেযাওয়া, যমরবাড়ি যাওয়া, হোয়ানাল যাওয়া, কব্বরঅযাওয়া, চ’উকমুজা’, একইবারে যাওয়া ইত্যাদি। তেমনই আছে প্রতিশব্দের বা শব্দের সামাজিক (Social) অর্থ। প্রমিত বাংলা ভাষার মত সিলেটের উপভাষাতেও অনেক শব্দ বা প্রতিশব্দ বিনিময়যোগ্য নয় বা সমার্থক নয় সব সময়; যেমন:
ক. মেয়েলোকরা অমনেদি বউকা (মেয়েলোকরা এদিকে বসুন)।
খ. মা-ভইনহক্কল অমনেদি বউক্কা (মা-বোনেরা এদিকে বসুন)।
গ. বেটিন অমনেদি বও (বেটিরা এদিকে বসো)।
ঘ. মায়েরা অমনেদি বইন (মায়েরা এদিকে বসুন)।
ওপরের উদাহরণে প্রতিটি বাক্যে নারী-র প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত শব্দগুলো একই জৈবিক অস্তিত্ব বোঝালেও; এগুলি বাক্যে একটির বদলে আরেকটি সকলের কাছে স্বচ্ছন্দে ব্যবহৃত হতে পারে না। উদাহরণগুলো থেকে একজন ভাষাভাষী অনায়াসে অনুমান করতে পারে বাক্যগুলোর বক্তা যেমন একই বয়সের বা সমাজের একই স্তরের নয়, উদ্দিষ্ট নারীরাও সমাজের সমস্তরের নয়। এমনকি সিলেটের হিন্দু সমাজ-সংস্কৃতিতে এখনও: পূজা-পার্বণাদিতে প্রথমে ‘দেফ্তার ভুগ লাগানি’ (দেবতার ভোগ লাগানো) হয়, তার পরে ‘বাব্নে সেবা করইন’ (ব্রাহ্মণে সেবা করেন), ‘পাচোর ভুজ লাগে’ (পাঁচ জনের [সমাজের] ভোজন শুরু হয়) এবং সব শেষে ‘ভক্তবৃন্দ প্রসাদ পায়’। এখানেও খাওয়া (to eat)-র প্রতিশব্দ সামাজিক স্তরের সঙ্গে সুনিয়ন্ত্রিত। সুতরাং অর্থের সামাজিক মাত্রাও (Social meaning) আমাদের ভাষার বা উপভাষার পার্শ্বিক নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করে।
সিলেটের উপভাষায় কোনও শব্দের একটি লোক-বিশ্বাস-নির্ভর অর্থও গড়ে ওঠে; যা ধর্মীয় সংস্কার বা কুসংস্কারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর ফলে কিছু শব্দ মূল রূপে অনেক সময় অনুচ্চার্য হয় কিংবা অল্পবিস্তর পরিবর্তিত হয়ে উচ্চারিত হয়। যেমন: শাহজালাল-শাহপরানের মাজার-র বদলে শুধু ‘মাজার’ কিংবা ‘মামু-ভাইগনার মাজার’, হিন্দু ধর্মের দেবী মনসা-র বদলে ‘বিষহরি’ কিংবা ‘কানি বেটি’ ইত্যাদি। সামাজিক-পারিবারিক সম্পর্কের কোনও গুরুজনের নাম নিষিদ্ধ শব্দাবলি (Taboo words) বিবেচনায় নারী ভাষায় নামের পরিবর্তে ‘ওমুকর বাপ’, ‘ওমুকর জেঠা’, ‘ওমুকর দাদা বা দাদি’ ইত্যাদি বিবরণমূলক শব্দবন্ধ ব্যবহৃত হয়। আবার একই নামের অন্য শব্দের ক্ষেত্রেও নারী ভাষায় বিকল্প শব্দ ব্যবহৃত হয় বা সংকেত বদল ঘটে। যেমন: শাশুড়ির নাম রসুন বেগম কিংবা ভাসুরের নাম রুশন আলী হওয়াতে রসুন বদলে উচ্চারিত হয় ‘ধলা পিয়াইজ’; শ্বশুরের নাম রবীন্দ্র হওয়াতে রবিবারের বদলে ‘সুরুজবার’। এর কারণ স্বামী অথবা বয়স্ক স্বজনের নাম উচ্চারণে অনেক এলাকায় ‘ট্যাবু’ রয়েছে (রাজীব, ১৯৯৩: ১২৪)। সিলেট অঞ্চলে পুরুষদের মধ্যেও ট্যাবু রয়েছে; যেমন: স্ত্রীকে ‘ওমুকর মা’, ‘এই’, ‘হুনছনি’ ইত্যাদি। তবে দুর্ভাষণের কারণে পুরুষরাও সিলেটের উপভাষায় বিকল্প শব্দ ব্যবহার করে বা সংকেত বদল ঘটায়। যেমন: পিতা-মাতাকে ‘বুড়াবেটা-বুড়িবেটি’ শব্দ ব্যবহার করতে দেখা যায়। অবশ্য এগুলি নিছক পারিবারিক অভিধানের শব্দ; এই প্রক্রিয়া উপভাষার বৃহৎ অভিধান বা ব্যাকরণকে তেমন ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে না। তবে নামের সঙ্গে কোনও ভীতিজনক বা দুর্ভাগ্যের অনুষঙ্গ থাকলে বিকল্প নামকরণের দৃষ্টান্ত সিলেটের সংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামীণ সমাজে আজও বিদ্যমান। সাপের ভয়ের কারণে রাতের বেলা সাপ বোঝাতে তাই ‘কেদচু’, ‘লত’, ‘লতা’ ইত্যাদি শব্দ এবং অলৌকিক বিশ্বাসজাত ভূত-প্রেত-জ্বিন বোঝাতে ‘বাতাস’, ‘বায়’, ‘বয়ার’, ‘আছদর’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়। অবশ্য ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার প্রসার আর নাগরিক সমাজের বিস্তারে এই প্রবণতা প্রতিনিয়ত বিলুপ্ত হচ্ছে।
যে-কোনও ভাষা বা উপভাষায় শব্দের অর্থপরিবর্তন মূলত একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া, অর্থাৎ ঘটতে সময় লাগে। শব্দের অর্থপরিবর্তনের কারণগুলি বাগর্থবিজ্ঞানে বিবেচনা করা হয়। এগুলোর অন্যতম প্রক্রিয়া সুভাষণ। অকল্যাণমূলক, নিন্দিত বা কুৎসিত অর্থকে কল্যাণবাচকরূপে বা ভদ্রভাবে প্রকাশ করার জন্য এই উৎপাদক কাজ করে (দানীউল, ২০১৩: ২০৭)। সিলেটের উপভাষায় উৎপাদকটি ক্রিয়াশীল; এখানে মল-মূত্র ত্যাগ করতে যাওয়ার সময় বলা হয়: ‘গা ধওয়াত যাইরাম’ (গা ধৌত করতে যাচ্ছি), ‘পইচদমর টাট্টিত যারাম’ (পশ্চিমের বেড়াদেওয়া জায়গায় যাচ্ছি) বা ‘বাদরে যারাম’ (বাইরে যাচ্ছি) ইত্যাদি। আধুনিক শহুরে সমাজে অবশ্য প্রমিত বাংলার মত ইংরেজি শব্দ ‘লেট্রিন’, বাথরুম’, ‘টয়েলেট’ কিংবা আরও আধুনিক শিক্ষিত হলে ‘ওয়াশরুম’ ব্যবহার করতে শোনা যায়। কেউ অশ্লীল ভাষায় গালাগাল শুরু করলে অভিভাবক বা মান্য ব্যক্তি বলেন, ‘অইছে, তর পদ্মপুরাণ পাঠ বন্দ কর’ (হয়েছে, তর পদ্মপুরাণ পাঠ বন্ধ কর)। এখানে ‘গলাগালি’র সুভাষণ ‘পদ্মপুরাণ পাঠ’। নাপিতের বাড়িকে ‘নাইপতর বাড়ি’ বা ‘শিল বাড়ি’ বলা হলেও নাপিত-এর সুভাষণ রূপে ‘চন্দ্রবৈদ্য’ বা ‘নরসুন্দর’, এবং বাবুর্চি-কে ‘পাকসি’ বা ‘ঠাকুর’ নামে ডাকার প্রচলন সিলেটের সমাজে এখনও বর্তমান।
সুভাষণ-এর বিপরীত প্রক্রিয়া বা উলটো উৎপাদক দুর্ভাষণ। এর সাধারণ ক্ষেত্র হল ভাষিক হিংস্রতা বা গালাগাল। অধিকাংশ গালাগাল এক ধরনের রূপক প্রয়োগ ছাড়া আর কিছু নয়। তবে সিলেটের উপভাষায় গালাগাল ছাড়াও ঘনিষ্ঠ আলাপন, আড্ডা, আদর এমনকি সাধারণ আলোচনায়ও দুর্ভাষণ (Dysphemism) ব্যবহৃত হয় হরদম। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় বন্ধুদের ইয়ার, দুস্ত, ভাই ইত্যাদি সম্বোধনের চেয়ে অনেক বেশি ব্যবহৃত হয় ‘শালা’, ‘হালা’, ‘হালারহালা’ ইত্যাদি সম্বোধন। কৌতুক সম্পর্কের আত্মীয়রা মশকরা করে ছোটদের ‘গুন্ডা’, ‘ডাকাইত’, ‘বাছুদর’ এবং তরুণদের ‘ডেকা’, ‘ডেকি’, ‘পাঠা’, ‘পাঠি’ ইত্যাদি সম্বোধন করেন প্রায়শই। বর্তমান গবেষকের দিদিমা (দুলু রায়) তাকে ‘গুন্ডা’ বলেই সম্বোধন করতেন। এ ছাড়াও সাধারণ কথাবার্তায় সিলেটে: ‘দুর বেটা চেট (পু-যৌনাঙ্গ) মর কতা হুন’, ‘হরগি জাদ বেটি হেটি (স্ত্রী-যৌনাঙ্গ) আমার’ ইত্যাদি বাক্যাংশের ব্যবহার দেখে আমাদের মনে হয় আড্ডাবাজ স্বভাবের অধিকাংশ বাঙালির মত সিলেটের উপভাষাতেও সুভাষণের চেয়ে দুর্ভাষণই বেশি; অন্তত মৌখিক ভাষায়। অবশ্য সিলেটে পঠিত মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরাণ পুঁথিগুলোতে বেশ অশ্লীল গালির নিদর্শন মেলে। অনেক সময় দূষণীয় শব্দকে ছদ্মবেশ পরিয়েও ভাষায় ব্যবহার করা হয়; তখন একে বলা হয় বক্রোক্তি। ফলে অনেকের কাছে অখাদ্য বলে মুরগি বদলে হয় ‘রামপাখি’ আর কচ্ছপ বদলে হয় ‘জলখাসি’। আবার ব্যঙ্গোক্তি ব্যবহারে শব্দ তার বিপরীতার্থক অর্থ বোঝায়; যেমন: মিথ্যাবাদীকে ‘ধর্মপুত্র’, দুষ্ট নারীকে ‘সতীনারী’, জেলখানাকে ‘মামারবাড়ি’, ‘হউরবাড়ি’ বা ‘লালঘর’ বলা হয়।
এ ছাড়াও নামবিস্তার বা বঢ়ড়হুসু আর-এক ধরনের রূপক ব্যবহার। সিলেটে কোনও ব্যক্তির আচরণ-বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে তাকে ‘নবাব’, ‘বাপর বেটা সাদ্দাম’, ‘হিটলার’, ‘মিরজাফর’, ‘ঘরর শত্রু বিভীষণ’ ইত্যদি শব্দে সম্বোধিত হতে দেখা যায়। বর্তমান গবেষক উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় তার মামা তাকে বলতেন, ‘পড়া-লেখা বাদ দিয়া তাইন কবিতা লেখঅরা, রবীন্দ্রনাথ অ’ইছদইন’। এ ধরনের প্রয়োগে তুলনার লক্ষ্যটি গোপন থাকে না। স্থানের নামকরণের মধ্যে অনেক সময় ঐতিহাসিক অনুষঙ্গ বা স্মৃতি কাজ করে। ‘বিষ্ণুপুর’, ‘লংলা’, ‘জয়ন্তীয়া’, ‘শমসেরনগর’, ‘মৌলভীবাজার’, ‘বিষ্ণুপদ’, ‘পাড়ার দেবাল’; এ সব নামই কোনও না কোনও ব্যক্তি বা ঘটনার অনুষঙ্গ থেকে আগত। সাদৃশ্য (Analogy) দ্বারা শব্দার্থ পরিবর্তনের বহু দৃষ্টান্ত রূপক প্রভৃতি আলংকারিক কারণের দৃষ্টান্তে দেখা যায় (দ্বিজেন্দ্রনাথ, ১৯৭৫: ২২৮)। প্রমিত বাংলা ভাষার এ বৈশিষ্ট্য সিলেটের উপভাষায়ও ব্যাপক। সাদৃশ্যের কারণে এখানে ‘আত্তি’ (হাতি) ও ‘ঘুড়া’ (ঘোড়া) শব্দদুটি যথাক্রমে বড় ও খুব অর্থে ব্যবহার হয়; যেমন: আদত্তি পাড় শাড়ি (বড়/চওড়া পাড় শাড়ি), ঘুড়া নিম (খুব তেতো নিম)। রাজদমেস্তইর (রাজমিস্ত্রি) ও রামছদাগল (বড় জাতের ছাগল) শব্দেও বড় অর্থে ‘রাজ’ ও ‘রাম’-র প্রয়োগ সাদৃশ্যের উদাহরণ। অনেক সময় শব্দের স্বভাব সংযোগ থেকে এমন ধারণা হয়ে যায় যে, তার সংযোগ শব্দ বাদ দিয়ে অর্থাৎ অঙ্গচ্ছেদ (Trunction) ঘটিয়েও অর্থ ব্যক্ত হয়। ভাষা ব্যবহারকারীর মানসিক সহযোগ (Assocation) থেকে এটি সম্ভব হয়। যেমন: ‘খুদ’ শব্দটি ক্ষুদ্রশস্য শব্দের অঙ্গচ্ছেদ। আবার অনেক সময় অঙ্গচ্ছেদ বিপরীতার্থক শব্দ ব্যবহার করেও মূল অর্থ প্রকাশ করে ; যেমন: ‘বিরতি’ বিরতিহীন অর্থে ব্যবহৃত হয়।
ভাষা বা উপভাষার সাধারণ পরিবর্তনেরই অঙ্গ তার শব্দার্থের পরিবর্তন। কালক্রমে ভাষার বহুলসংখ্যক শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হয়। সর্বজনলক্ষিত এ ঘটনা বা পরিবর্তনকে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়। শব্দের অর্থ যদি রূপকের অর্থ অতিশয়োক্তির প্রভাবে বস্তুনিরপেক্ষ হয়ে পড়ে তা হলে অর্থপ্রসার ঘটে। কালক্রমে শব্দের অর্থের ব্যাপ্তি লাভ বা অর্থের প্রসারের দৃষ্টান্ত হল: ‘গাঙ্গ’ যার পূর্ববর্তী অর্থ ছিল গঙ্গা নদী, এখন সিলেটের উপভাষায় যে-কোনও নদীই গাঙ্গ বা গাঙ। ব্যাপক তাৎপর্যশীল কোনও শব্দ যখন পরিবর্তিত হয়ে একটি বিষয়ের তাৎপর্য বহন করে তখন অর্থের সংকোচন ঘটে। শব্দের অর্থের সীমানা ছোট হয়ে আসা বা অর্থ-সংকোচনের দৃষ্টান্ত হল: ‘নজ’র’, পূর্বে এর অর্থ ছিল দৃষ্টি, এখন কুদৃষ্টি। আর প্রসারিত বা সংকুচিত অর্থের মূলের সঙ্গে তার যোগ প্রায় ছিন্ন হয়ে মূল অর্থের সঙ্গে যোগটিও অস্পষ্ট হলে অর্থের সংক্রম ঘটে। যেমন: ‘মা’জন’ (মহাজন=মহৎ যে জন) শব্দের পূর্বের অর্থ মহৎজন, বর্তমান অর্থ ব্যবসায়ী। অর্থ পরিবর্তনের এই তিনটি শ্রেণিকেই আবার অর্থের উন্নতি এবং অর্থের অবনতি; এই দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা সম্ভব। অবশ্য অধুনা বাঙালি ভাষাবিজ্ঞানীগণ একে যথার্থ ভাষাতাত্ত্বিক বিভাজন বলে মনে করেন না (পবিত্র, ২০১৪: ৩১৬)। কারণ, উন্নত-অবনত-র ধারণা আপেক্ষিক; যেমন: প্রমিত বাংলা ভাষায় ‘শুঙ্গা’ শব্দের অর্থ ঘ্রাণ নেয়া বা শোঁকা আর সিলেটের উপভাষায়: ‘হুংগা’ শব্দের অর্থ নাক দিয়ে আদর বদলে স্থূলভাবে আদর অর্থে ব্যবহৃত হয়। এতে সংকীর্ণ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি-প্রণোদিত মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের রুচিতে অবনমিত অর্থের দৃষ্টান্ত হলেও, সিলেটের পল্লি অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর কাছে এটি নিছক সাধারণ বর্ণনাত্মক শব্দ।
এভাবে আলোচনায় দেখা যায়, কোনও ভাষার সকল শব্দই অভিধানে পাওয়া যায় না। বিভিন্ন প্রসঙ্গে শব্দ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়, এবং ভাষাতে তার বিচিত্র দ্যোতনা দান করে। অভিধানের পক্ষে শব্দের সম্ভাব্য সমস্ত অর্থ উদ্ধার সম্ভব হয় না (দানীউল, ২০১৩: ২০৮)। তাই আমরা সিলেটের উপভাষায় ব্যবহৃত শব্দের অর্থ উদ্ঘাটনে বাগর্থবিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে ফল পেতে পারি। তবে এক্ষেত্রে প্রধান প্রতিকূলতা বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান এবিদ্যার পরিভাষা ব্যবহারে অস্থিরতা। উলম্যান বলেছেন, ‘পরিভাষা ব্যবহারে সর্বাধিক সতর্কতার সঙ্গে সঙ্গতিরক্ষার প্রয়োজনীয়তা শব্দার্থবিজ্ঞানের (বাগর্থবিজ্ঞান) মতো আর কোনো বিজ্ঞানে এত বেশি নয়। … এই বিজ্ঞানের নামটি পর্যন্ত বিতর্কের বস্তু’ (Ullman, ১৯৯৩: ০৪)। বৈজ্ঞানিক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ঘটছে প্রতিনিয়ত এবিদ্যার বিভিন্ন সূত্রের। ফলে আমরা নিজেদের মত করে পরিভাষা ব্যবহার করে বাগর্থের নানা সূত্রের প্রাথমিক আলোচনায় লক্ষ্য করেছি; ভিন্ন ভিন্ন ভাষা বা উপভাষার শব্দের অর্থ নির্দেশের জন্যে ওই ভাষার স্বভাব অনুসারে পরিভাষা ও সূত্রের কাঠামো পরিবর্তন অপরিহার্য। সিলেটের উপভাষার বাগর্থতত্ত্বে আমরা একাধারে: অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, চিনা-তিব্বতি ও আর্য প্রভাবের প্রমাণ পাই যথাক্রমে ‘ড়াড়ি’, ‘টাট্টি’, ‘হুংগা’ ও ‘বিরতি’ ইত্যাদি লেক্সিম প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। তবে অস্বীকার করা যায় না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রমিত বাংলা ভাষার সঙ্গে সিলেটের উপভাষার শব্দের ধ্বনিগত পরিবর্তন ছাড়া মৌলিক অর্থগত পরিবর্তন অতি অল্প।
নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি:
১. জাহাঙ্গীর তারেক, শব্দার্থবিজ্ঞানের ভূমিকা, ঢাকা: বাংলা একাডেমি, জানুয়ারি ১৯৯৮।
২. দানীউল হক, মহাম্মদ, ভাষাবিজ্ঞানের কথা, ঢাকা: মওলা ব্রাদার্স, ২০১৩, (প্র.প্র.২০০২)।
৩. দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু, বাংলা ভাষার আধুনিক তত্ত্ব ও ইতিকথা (প্রথমাংশ), কলকাতা : পুথিপত্র, ১৯৭৫ ।
৪. পবিত্র সরকার, সম্পা. ‘বাগর্থতত্ত্ব’, প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ, ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ২০১৪।
৫. ফিরোজা ইয়াসমিন, ‘বাগর্থতত্ত্ব’, প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ (১মখণ্ড)। ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ২০১১।
৬. হাবিবুর রহমান, মুহাম্মদ, যথাশব্দ, ঢাকা: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০১১ (প্র.প্র.১৯৭৪)।
৭. হুমায়ুন আজাদ, অর্থবিজ্ঞান, ঢাকা : আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৯।
৮. Ullman, Stephen.শব্দার্থবিজ্ঞানের মূলসূত্র, অনু. জাহাঙ্গীর তারেক, ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৯৩।