‘‘রাত্র যেমন আগামী দিবসকে নবীন করে, নিদ্রা যেমন আগামী জাগরণকে উজ্জ্বল করে, তেমনি অদ্যকার বর্ষাবসান যে গত জীবনের স্মৃতির বেদনাকে সন্ধ্যার ঝিল্লিঝঙ্কারসুপ্ত অন্ধকারের মতো হৃদয়ের মধ্যে ব্যাপ্ত করিয়া দিতেছে, তাহা যেন নববর্ষের প্রভাতের জন্য আমাদের আগামী বৎসরের আশামুকুলকে লালন করিয়া বিকশিত করিয়া তুলে। যাহা যায় তাহা যেন শূন্যতা রাখিয়া যায় না, তাহা যেন পূর্ণতার জন্য স্থান করিয়া যায়। যে বেদনা হৃদয়কে অধিকার করে তাহা যেন নব আনন্দকে জন্ম দিবার বেদনা হয়।’’— রবীন্দ্রনাথ। ‘বর্ষশেষ’, ‘ধর্ম’ গ্রন্থ থেকে।
নতুন বছরের আগমনীকে এরকম দৃষ্টিতেই দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। কাজী নজরুল ইসলামের একটি গানেও রয়েছে বাংলা নববর্ষের অনুরূপ গূঢ় বার্তা, ‘যে মালা নিলে না আমার ফাগুনে/ জ্বালাব তারে তব রূপের আগুনে/ মরণ দিয়া তব চরণ জড়াব হে/ মোর উদাসীন, যেও না ফেলে।’
ছয় ঋতুচক্রে বৈশাখ নির্ধারিত হয়েছে নববর্ষের আবির্ভাবরূপে। রুদ্র বৈশাখ তার তপ্ত চরণরেখা ফেলে চরাচরে, কালবৈশাখীর মত্ত ঝাপটা চরাচরকে করে তোলে ক্ষুব্ধ ও মাতাল, দারুণ দহনবেলা যেন ত্রাহি রবে হাহাকারে ভরিয়ে তোলে দিগন্ত; এই মহালগ্নই যেন নতুন বছরের আহ্বান জানিয়ে আমাদের বলে, এই আমি ঝরাপাতার আয়তন মাড়িয়ে এলাম তোমার দ্বারে, আমায় বরণ করো। আম্রমুকুলের গন্ধ-অতিক্রান্ত পৃথিবীতে আমি ফুটিয়েছি কত পুষ্প কত ফল, এসবের স্বাদে ও গন্ধে আনন্দিত আহ্লাদিত হয়ে ওঠো। বৎসরের আবর্জনা ধুয়েমুছে যাক, অশ্রুবাষ্পকে সুদূরে মিলাতে দাও। অগ্নিস্নানে ধরণী শুচি হোক, ‘পুরাতন বরষের সাথে/ পুরাতন অপরাধ যত’, তা হয়ে উঠুক ক্ষমার্হ।
নতুন বছর যেন প্রাণের উৎসব, নিজেকে নতুন করে নতুন উদ্যোগে জাগিয়ে তোলা। পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির মধ্যেই দেখা যায় নববর্ষ পালনের দেশীয় ঐতিহ্যজাত আবাহনী। ভারতবর্ষে, মিশরে, ইউরোপে, আমেরিকার দেশে দেশে।
নববর্ষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পৃথিবীর আহ্নিক গতি-বার্ষিক গতির হিসেব ও সালতামামি। প্রাচীন পৃথিবীতে জ্যোতির্বিদ্যার প্রাগ্রসরতা লক্ষ্য করি যে-সব দেশে, সেগুলির মধ্যে মিশর, মোসোপটেমিয়া এবং ভারত অন্যতম। টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নীল নদ আর সিন্ধু-গঙ্গার বাৎসরিক নদীচারিত্র্যের বৈশিষ্ট্য ও নিশ্ছিদ্র ছন্দ কৃষকের চাষবাসকে পরিচালনা করতে ভূমিকা রাখত। হ্যাঁ, চিনের হোয়াংহো নদীর বার্ষিক আবর্তনও কৃষিকাজে সহায়ক ভূমিকা রাখত। এই যে নৈসর্গিক নদীর ছন্দ, তার ফলেই কৃষি, তার জন্যেই সভ্যতা, জাতীয় পর্ব, ধর্মানুষ্ঠান। সংস্কৃতির কাঠামো গড়ে ওঠে কৃষিনির্ভর সভ্যতার হাত ধরে। নদীর জোয়ার-ভাটা তাকে উৎসুক ও উদগ্রীব করে তুলল পূর্ণিমা-অমাবস্যার রহস্যমোচনে। বর্ষার গুরুত্ব যেহেতু কৃষিকাজে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তাই আদিম মানুষ ঋতুপর্যায় সবিশেষ অনুধাবনে তৎপর হল। শুরু হল বর্ষপঞ্জি রচনা। প্রাথমিক উদ্দেশ্য কৃষিকাজকে সহায়ক করে তোলা। আর পরবর্তী উদ্দেশ্য জাতিবিশেষের ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে সংস্কৃতির যৌগে বাঁধা। সেই অভিপ্রায়ের সূত্র ধরেই নববর্ষের ধ্যান ও ধারণা মানুষের। এবং আদিতে তা ফসল ঘরে তোলার আনন্দ উৎসবকে শিরোধার্য করেই পরিকল্পিত হয়েছিল।
মনুষ্য সভ্যতার আদি থেকেই দেখা যায়, যাবতীয় উৎসব-অনুষ্ঠানের পেছনে ফসল ঘরে তোলার এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তারপর মানুষের বৈজ্ঞানিক চেতনাবৃদ্ধির ফলে অন্যান্য অনেক শাস্ত্রের মত জ্যোতির্বিদ্যা মানুষকে গ্রহনক্ষত্রের গতি ও কার্যক্রম জানতে শেখাল। পৃথিবীর আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতি সম্পর্কে অবহিতি ঋতুসমূহের আবর্তন-পুনরাবর্তনের ব্যাখ্যা দিল, আর এর ফলেই গ্রন্থিত হল পঞ্জিকা। উৎসব-অনুষ্ঠানের নির্ঘণ্ট এল এরই হাত ধরেই। এল নববর্ষের ধারণাও। দেখা যাচ্ছে, দেশে দেশে নববর্ষ পালন মূলত সৌরজগতের গ্রহনক্ষত্রের সংস্থান মেনেই পালিত হয়। এবং যুগপৎ এর সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করে কৃষিজ ফলন।
আমরা প্রাথমিকভাবে বাংলা নববর্ষ নিয়েই আলোচনা করব, যদিও এর পাশাপাশি ভারতবর্ষ ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে নববর্ষ পালনের তাৎপর্য, ধারাবাহিকতা বৈশিষ্ট্য-বৈচিত্র্য নিয়েও অনুসন্ধিৎসু হব।
বাংলা নববর্ষ
ভারতবর্ষে নববর্ষ পালনের বিচিত্র ইতিহাস রয়েছে। বাঙালির নববর্ষ পালনও বৈচিত্র্যময়। নববর্ষ এবং অন্যান্য উৎসবানুষ্ঠান আর সামাজিক-ধর্মীয় বিধিনিষেধ বিধৃত হয় যে পঞ্জিকায়, অঞ্চলভেদে তারই তো সংখ্যা প্রায় অনির্ণেয়। এদেশে কমবেশি চল্লিশ রকম পাঁজির ব্যবহার ও প্রচলন। এর মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক ও গার্হস্থ্য অনুষ্ঠানে পঞ্চাঙ্গ পঞ্জিকার শরণাপন্ন হয় হিন্দু বাঙালির বৃহদংশ। পঞ্চাঙ্গ অর্থাৎ বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণ। এই পঞ্চাঙ্গেরও রকমফের আছে, গুপ্ত প্রেস এক বলে তো বিশুদ্ধসিদ্ধান্ত অন্য, আবার জগজ্জ্যোতির সঙ্গে পি এম বাগচীর সর্বদা মিল হয় না। তবে এ-সব পঞ্জিকা পয়লা বৈশাখকেই নববর্ষরূপে মান্য করে। যদিও অতীতে বৈশাখ নয়, নববর্ষ হত অগ্রহায়ণে। কেন এবং কখন থেকে এই পরিবর্তন?
পুরনো বাংলা ছড়াতে দেখি অগ্রহায়ণে বর্ষ শুরুর সমর্থন, ‘অঘ্রানেতে বছর শুরু নবান্ন হয় মিঠে।/ পৌষেতে আউলি বাউলি ঘরে ঘরে পিঠে।’ বর্ষ শেষ হত কার্তিক মাসে। এজন্য বাংলার মেয়েদের কার্তিকে পিত্রালয়ে না যাওয়ার বিধান ছিল,— ‘কার্তিক মাস বছরের শেষ, না যেও পিতার দেশ।’
আবার বৈদিক আমলে সম্বৎসরের গোড়ায় রয়েছে মধুমাস, অর্থাৎ বসন্তকাল। সে-যুগে মাসগুলির নাম ছিল মধু, মাধব (বসন্ত), শুক্র, শুচি (গ্রীষ্ম), নভঃ, নভস্য (বর্ষা), ইষ, উর্জ (শরৎ), সহঃ, সহস্য (হেমন্ত), তপঃ, তপস্য (শীত)। ষড়ঋতু বৈদিক যুগ থেকেই লক্ষ্যযোগ্য ছিল ভারতবর্ষে। প্রাচীন ভারতে যে শকাব্দ, সেখানেও পয়লা চৈত্র থেকে নববর্ষের সূচনা। আমরা পরে দেখব, ভারতের বহুস্থানে আজও পহেলা চৈত্রকেই নববর্ষরূপে গণ্য করা হয়।
বরাহমিহিরের ‘সূর্য সিদ্ধান্ত’, আর্যভট্টের ‘আর্ধরাত্রিকা’, ব্রহ্মগুপ্তের ‘খণ্ডখান্দক’ হাজার বছরেরও পূর্বে পৃথিবীর বার্ষিক গতি প্রায় নির্ভুল নির্ধারণ করে দেখিয়েছে। অন্যদিকে, খ্রিস্টীয় একাদশ শতকে ওমর খৈয়ামের মত গণিতজ্ঞ (হ্যাঁ, ইনিই আবার রুবাইয়াৎ-রচয়িতা) বার্ষিক গতির আরও অনুপুঙ্খ নির্ঘণ্ট বার করেন, যা পরবর্তীকালে কোপার্নিকাসের গণনার সঙ্গে মিলে যায়।
মেঘনাথ সাহা চৈত্র ও বৈশাখ মানের দুই নববর্ষের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বরাহমিহির ও আর্যভট্টের গণনা ছিল প্রায় নির্ভুল, কিন্তু কিঞ্চিৎ ত্রুটিযুক্ত। বছরে ৩৬৫.০১৬৫৬ দিন করে এগিয়ে আছে হিসেব। তাই ১৪০০ বছরে ২৩.২ দিনে এগিয়ে এসে পয়লা বৈশাখ ২২-এ মার্চ আরম্ভ না হয়ে ১৩ বা ১৪-ই এপ্রিল শুরু হচ্ছে। ড. সাহা তাঁর নবশকাব্দের তারিখ তাই পুনরায় পয়লা চৈত্র থেকে শুরু করেছেন।
কিন্তু পয়লা বৈশাখ নববর্ষ হল কেমন করে? কবে থেকেই বা? আমরা এখন সে-প্রসঙ্গেই যাব।
পয়লা বৈশাখ থেকে নববর্ষ গণনার সূচনা আকবরের। ৯৬৩ হিজরি সনে সম্রাট আকবর দিল্লির মসনদে বসেন। বাংলাদেশ তখন মুঘলদের অধীনে। হিজরি সন হচ্ছে চান্দ্র বৎসর, ৩৫৪ দিনের। এতে করে খাজনা আদায় বিড়ম্বিত হয়, কেন-না হিজরি সনে ঋতুর বৈষম্য ঘটে যায়। তাই নির্দিষ্ট দিনে খাজনা আদায়ে অসুবিধে হয়। হিজরি সন অনুসরণ করলে নির্দিষ্ট মৌসুমে নির্দিষ্ট দিন নির্ধারণ অসম্ভব। সম্রাটের দরবারে কোনও কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তির পরামর্শে আকবর একটি নতুন সনের প্রবর্তনে আগ্রহী হন। সম্রাটের কাছেও তা যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল, বিশেষ করে খাজনা আদায়ের দিক থেকে বিচার করে।
এদিকে ভারতীয় বর্ষগণনার অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, বছর হল সৌরপদ্ধতির, কিন্তু মাসগুলি চান্দ্র। আকবর চেয়েছিলেন মাসগুলোকেও সৌরপদ্ধতিতে নিয়ে আসতে। এখানেও উল্লেখযোগ্য, চান্দ্রমাসকে সৌরবৎসরের সঙ্গে সংযুক্ত করতে ভারতের জ্যোতির্বিদরা মলমাসের নিদান রেখেছিলেন। তাতে বছরের হিসেব শেষ পর্যন্ত ৩৬৫ দিনেই দাঁড়ায়। কিন্তু আকবরের আদেশে বিজাপুরের সুলতানের প্রাক্তন সভাসদ আমীর উল্লাহ্ শিরাজী নতুন ‘ইলাহী সাল’-এর বাংলা মাসগুলো পারস্য দেশীয় মাসের অনুকরণে সৌরমাসে পরিণত করলেন। আকবর-প্রবর্তিত নতুন বাংলা সনকে আদিতে ‘ইলাহি সাল’ বলা হত, তাঁর প্রবর্তিত ‘দীন-ই ইলাহী’ ধর্মের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে। একে নামান্তরে বলা হয় ‘ফসলি সাল’, যার সূচনা ৯৬৩ হিজরি। অর্থাৎ বাংলা সনকে ইসলামি সনের সঙ্গে এক করে দেওয়া হল। সম্রাটের সিংহাসন আরোহণের এক মাস পরের তারিখ থেকে অর্থাৎ ১১-ই এপ্রিল ১৫৫৬ থেকে বাংলা নববর্ষের সূচনা। খ্রিস্টাব্দের সঙ্গে তাহলে বাংলা সনের সম্পর্কটা দাঁড়াল কীরকম? খ্রিস্টীয় সন থেকে বাংলা সন ৫৯৩ বছর ৩ মাস ১১ দিন কম। আজ পর্যন্ত তা বহাল আছে। কিন্তু ৯৬৩ হিজরি বাংলা ৯৬৩ সন হলেও আজকের হিসেবটা অন্যরকম। এ বছর বাংলা ১৪৩০, কিন্তু হিজরি ১৪৪৪। কেন এমন পার্থক্য? কারণ হিজরি বছর চান্দ্রমাস অনুযায়ী হয় বলে ৩৫৪ দিনে বছর হয়, ইসলামী বছর তাই এই প্রায় ৪৬৮ বছরে দুটি ক্যালেন্ডারে ঘটে গিয়েছে ১৬ বছরের পার্থক্য! আকবরের কল্যাণে আমরা একদিকে পহেলা বৈশাখে নববর্ষ পেলাম, অন্য দিকে পেলাম ইংরেজি গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সাযুজ্য।
আকবর-প্রবর্তিত বাংলা সন যে দ্রুত জনপ্রিয় এবং গ্রহণীয় হয়ে উঠেছিল তার প্রমাণ মধ্যযুগের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যপ্রণেতা কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘অভয়ামঙ্গল’ কাব্যেই পাওয়া যায়। ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে শেষ হয়েছে এ কাব্য। কাব্যে ফুল্লরার বারোমাস্যা শুরু হয়েছে বৈশাখের বিড়ম্বিত জীবন দিয়ে— “ভ্যারেণ্ডার খাম ওই আছে মধ্য ঘরে।/ প্রথম বৈশাখ মাসে নিত্য ভাঙ্গে ঝড়ে।।/ বৈশাখে অনলসম বসন্তের খরা।/ তরুতল নাহি মোর করিতে পসরা।।/ পা পোড়ায় খরতর রবির কিরণ।/ শিরে দিতে নাহি আঁটে খুঞার বসন।।/ বৈশাখ হৈল বিষ গো, বৈশাখ হৈল বিষ।/ মাংস নাহি খায়— সৰ্ব্বলোক নিরামিষ।।’
>>> ক্রমশ >>>
চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
পড়ুন, দ্বিতীয় পর্ব
পড়ুন, তৃতীয় পর্ব
পড়ুন, চতুর্থ পর্ব
Good knowledge
তথ্যময় ও স্বাদু রচনা…লেখককে অভিনন্দন