
দেশীয় বাংলা গালাগালি
ভাল কাজ করলেও গালাগালি, আর মন্দ কাজ করলে তো কথাই নেই। অন্নপ্রাশনের ভাত পর্যন্ত উঠে যেতে পারে, এমনই দেশীয় বাংলা গালাগালির তেজ! শব্দ যে ব্রহ্ম,

ভাল কাজ করলেও গালাগালি, আর মন্দ কাজ করলে তো কথাই নেই। অন্নপ্রাশনের ভাত পর্যন্ত উঠে যেতে পারে, এমনই দেশীয় বাংলা গালাগালির তেজ! শব্দ যে ব্রহ্ম,

India’s First Bengali Daily Journal. বাংলায় শিশুদের খেলার মধ্যেও ছিল যুদ্ধের পরিবেশ তৈরির প্রচেষ্টা। ‘আগডুম বাগডুম’ খেলা— তারই একটি উদাহরণ। ‘আগডুম বাগডুম’ খেলায় শিশুরা গোল হয়ে বসে একে অন্যের হাঁটু ছুঁয়ে ছড়া কেটে এ খেলা খেলত, যে খেলা তাদের পরবর্তী জীবনে তৈরি করত যোদ্ধার জীবন। বিনয় ঘোষ তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ গ্রন্থে এই ছড়াকে জনসেনার যুদ্ধযাত্রার বিবরণ বলে উল্লেখ করেছেন। ধর্মমঙ্গল কাব্যে কানাড়ার বিয়েতে কালু ডোম ও তাঁর সঙ্গীরা এই সাজ সেজেছিলেন।

হরিচরণ এলেন শান্তিনিকেতনে, সময়টা ইংরেজি ১৯০২ সাল। শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রমে হলেন সংস্কৃত ভাষার অধ্যাপক। এখানে পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন, জগদানন্দ রায় প্রমুখের সঙ্গে হরিচরণকেও এক সারিতে ঠাঁই দিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনার সময় গুরুদেব হরিচরণকে একটি ভাল বাংলা শব্দকোষ লেখার কথা বলেন। রবীন্দ্রনাথের কথায় ইংরেজি ১৯০৫ সালে হরিচরণ শুরু করেন ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ সংকলনের দুরূহ কাজ। এরপর দীর্ঘ ৪০ বছরের চেষ্টায় ১৯৪৫ সালে শেষ হয় এই কাজ।

রজকিনী রামীর সঙ্গে ব্রাহ্মণসন্তান দ্বিজ চণ্ডীদাসের প্রেমকে মেনে নেয়নি সেকালের গোঁড়া হিন্দু সমাজের শিরোমণির দল। তাদের নির্দেশে চণ্ডীদাসকে মেরে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। অন্য একটি মতে, চণ্ডীদাস পালিয়ে গিয়েছিলেন সেসময়ের বৈষ্ণবধর্মের অন্যতম পীঠস্থান বীরভূমের ইলামবাজারের দিকে। তারপর আর কিছু জানা যায় না। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ বলে রাঢ়-বীরভূমের নানুরের মাটিতে মানবিকতাবাদের জন্ম দিয়েছিলেন যে কবি, তাঁর মৃত্যুরহস্য আজও অন্ধকারেই ঢাকা।

ভারতে বিলাসী মোগল সম্রাট শাহজাহানের রসুইখানায় মোরব্বার উৎপত্তি বলে কথিত আছে। আগ্রা ছিল সম্রাট শাহজাহানের রাজধানী। সম্ভবত সেই কারণেই আগ্রা সহ উত্তর ভারতে মোরব্বা জনপ্রিয় হয়। মোরব্বাকে উত্তর ভারতে বলে ‘পেঠা’। উত্তর ভারতে জনপ্রিয় মিষ্টিটি দেখতে সাধারণত আয়তাকার হয়। এখানে কেশর পেঠা, অঙ্গুরি পেঠা প্রভৃতি উৎকৃষ্ট মোরব্বাও পাওয়া যায়। আনাজ বা মরসুমি ফলের মূল উপাদানটি অক্ষুন্ন রেখে স্বাদ ও গন্ধে ভিন্নতা আনতে অনেক সময় এতে নারকেল বা কেওড়ার নির্যাসও ব্যবহৃত হয়। আগ্রা শহরে প্রবল লোকপ্রিয়তার কারণে এটিকে সচরাচর ‘আগ্রার পেঠা’ বলা হয়।

কবি জয়দেবের জন্ম ১১৭০ খ্রিস্টাব্দে বীরভূমের কেন্দুলিতে। এবং ১২৪৫ খ্রিস্টাব্দে সেখানেই তিনি দেহ রাখেন। এই জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক আছে। ওড়িশাবাসীর একাংশের দাবি, তিনি জন্মেছিলেন উৎকলে। এই দাবি অনেকাংশে মনগড়া এবং তার সপক্ষে খুব শক্তপোক্ত কোনও তথ্যপ্রমাণ নেই। তা সত্ত্বেও জয়দেবকে ওড়িয়া প্রমাণে তৎপর তাঁরা। শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬ খ্রি.–১৫৩৩ খ্রি.) পরবর্তী মাধব পট্টনায়কের আগে কোনও সূত্রেই জয়দেবকে উৎকলবাসী বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়নি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই মাধব পট্টনায়ক শ্রীচৈতন্যদেবকেও ওড়িয়া প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিলেন।

জন্ম থেকেই গ্রামবাংলার শিশুদের কাঁথার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক। মোলায়েম কাপড়ে তৈরি হওয়ায় সদ্যোজাতকে কাঁথায় একপ্রকার মুড়িয়ে রাখা হয়। বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের শরীরের ওমের মত কাঁথা যেন জড়িয়ে থাকে শৈশবের গায়ে। কাঁথা গায়ে এক বাঙালি বিশ্বজয় করেছেন। তিনি ‘গীত গোবিন্দম্’ রচয়িতা কবি জয়দেব। ভারতের বেশিরভাগ আধুনিক ভাষা এবং বহু ইউরোপীয় ভাষায় অনূদিত তাঁর ‘গীত গোবিন্দম্’ কাব্য পড়ে আপ্লুত হয়েছিলেন জার্মান মহাকবি গ্যোটেও। কাঁথা-প্রীতির জন্য কবি জয়দেবকে ডাকা হত ‘কন্থারী’ নামে।

গ্রামের গৃহস্থ বাড়িতে আলাদা ঢেঁকিশাল বা ঢেঁকিঘর থাকত। ঢেঁকির বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন নাম আছে, যেমন ঢেঁকির সামনের অংশের নাম ‘মুষল’, মুষলের মুখে লাগানো লোহার বেড়ির নাম ‘শামা’, আর মাটিতে যেখানে শস্য রাখা হয়, সেই গর্তের নামটি হলো ‘গড়’। ধান ভানেন যে মহিলা, তার নাম ‘ভানারি’। ঢেঁকির পিছনে চাপ দিলেই ঢেঁকি ওঠা-নামা করে, একে বলে ‘পাড় দেওয়া’। ঢেঁকির কর্মপদ্ধতির সঙ্গে রতিক্রিয়ার মিল খুঁজে পেয়েছে বাঙালি। তাই ঢেঁকিকে নিয়ে চালু গ্রামীণ প্রবাদ: ‘বৌয়ের সঙ্গে গোঁসা করো,/রেতের বেলা গড়ে পড়ো।’

হেস্টিংস অন্যায়ভাবে নন্দকুমারকে ফাঁসিতে ঝোলাতে সমর্থ হলেও আশ্চর্য পুরাকীর্তিটিকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে পারেননি। শত চেষ্টাতেও হেস্টিংস তার নাগাল পাননি। লোকচক্ষুর অন্তরালে দেবীজ্ঞানে প্রতিষ্ঠা পেয়ে সেই পুরাকীর্তি রয়ে গিয়েছে নন্দকুমারের ভিটেতেই। আসলে, প্রবলকেও কখনও কখনও হেরে যেতে হয় দুর্বল প্রতিপক্ষর কাছে। যেমনটা হেরেছেন ওয়ারেন হেস্টিংস। আর হেরেও যেন জিতে গিয়েছেন নন্দকুমার। আকালীপুরের কালীকে লোকে বলে, নন্দকুমারের কালী।

পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কলকাতায় আসার পথে বালক ঈশ্বরচন্দ্র পথের পাশের মাইল-ফলক (Milestone) দেখে দেখে ইংরেজি বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। আধুনিক কালের মাইলস্টোন আসলে মাইল বা দূরত্ব নির্দেশক স্তম্ভ বা প্রস্তর। কিন্তু তারও আগে যখন রাস্তার ধারে কোনও দূরত্ব-নির্দেশক স্তম্ভ বা পাথর ছিল না, তখন পথ চেনাতেন ‘পাথর বুড়ি’। স্তূপের আদলে আদিকালের মাইল-ফলক ‘পাথর বুড়ির থান’ এখনও পথিককে পথ চেনায়।

১৭৪২ খ্রিস্টাব্দ। মারাঠা বর্গির আক্রমণে অস্থির বাংলা। এদিকে ফকিরের ছদ্মবেশে আমিনার খোঁজে একসময় হেতমপুরে দেখা গেল মুঘল সেনাপতি হোসেন খাঁ-কে। হোসেন খাঁ হাত মেলায় বর্গিদের সঙ্গে। ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে বর্গিবাহিনী একদিন রাতে হঠাৎ আক্রমণ করল হেতমপুর গড়। দু’পক্ষের তুমুল যুদ্ধে নিহত হলেন হাফেজ। বীরাঙ্গনা শেরিনা ঘোড়ায় চেপে যুদ্ধ চালালেন। শেষমেশ প্রণয়প্রার্থী হোসেনকে সামনে দেখে একমাত্র শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে গড়ের ছাদ থেকে লাফ দিলেন নিচে দিঘিতে।

মৌর্যযুগের পণ্ডিত কৌটিল্য তাঁর ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে পায়রার সাহায্যে ডাক বা চিঠি পাঠানোর কথা উল্লেখ করেছেন। এর সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ অব্দ। সম্রাট অশোক পর্যন্ত এই পায়রা-ডাকের ব্যবস্থাই বহাল ছিল। খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে ভারতে এসেছিলেন মরক্কোর পর্যটক ইবন বতুতা। দিল্লির সম্রাট তখন মহম্মদ বিন তুঘলক। সে সময় অশ্বারোহী ও পদাতিক— ভারতে দু’ধরনের ডাকব্যবস্থা চালু ছিল বলে ইবন বতুতা লিখেছেন।

নবান্ন। এটি কেবল একটি ঋতুভিত্তিক পার্বণ নয়; এটি সেই বৈদিক পূর্ব কাল থেকে ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় (যা প্রাচীন পুথি ও পাল আমলের লোক-আচারে চিত্রিত) এই সুবিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের ‘অন্নময় ব্রহ্মের’ প্রতি নিবেদিত এক গভীর নান্দনিক অর্ঘ্য, যেখানে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে শস্যের অধিষ্ঠাত্রী লোকদেবতার আহ্বানও লুকিয়ে থাকে। নবান্ন হল জীবন ও প্রকৃতির এক বিশাল মহাকাব্য, যা মানুষ, তার ধৈর্য, শ্রম এবং প্রকৃতির উদারতাকে এক মঞ্চে তুলে ধরে মানব-অস্তিত্বের শ্রম-মহিমা ঘোষণা করে।

বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম অবদান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Literature) বিষয়টির প্রবর্তন। সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়-মানে এ বিষয়ে পড়ানোর সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তিনি যে বেশ কয়েকজন সার্থক আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরি করেছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বহু ধ্রুপদী রচনা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা অনুবাদসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অনুবাদকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব।

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

তালিবান। জঙ্গিগোষ্ঠী বলেই দুনিয়াজোড়া ডাক। আফগানিস্তানের ঊষর মরুভূমি, সশস্ত্র যোদ্ধা চলেছে হননের উদ্দেশ্যে। মানে, স্বাধীন হতে… দিনান্তে তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। ২০১২ সালে লন্ডনের প্রকাশনা C. Hurst & Co Publishers Ltd প্রথম সংকলন প্রকাশ করে ‘Poetry of the Taliban’। সেই সম্ভার থেকে নির্বাচিত তিনটি কবিতার অনুবাদ।

দূর পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে/ বসে আছে একটুকরো মেঘ। বৈরাগী প্রজাপতি।/ সন্ন্যাস-মৌনতা ভেঙে যে পাহাড় একদিন/ অশ্রাব্য-মুখর হবে, ছল-কোলাহলে ভেসে যাবে তার/ ভার্জিন-ফুলগোছা, হয়তো বা কোনও খরস্রোতা/ শুকিয়ে শুকিয়ে হবে কাঠ,/ অনভিপ্রেত প্রত্যয়-অসদ্গতি!

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।