এক পুরাকীর্তি নিয়ে দুই বিখ্যাত মানুষের মিত্রতা একসময় বৈরিতার চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। শেষপর্যন্ত ক্ষমতার অপব্যবহার করে একজনের হস্তক্ষেপে অন্যজনের গলায় বসে ফাঁসির রজ্জু। এমন লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছিল আমাদেরই দেশে, ব্রিটিশ আমলে। ঘটনার চরিত্রদের একজন বাঙালি, অন্যজন ইংরেজ। একজন মহারাজা নন্দকুমার, অন্যজন লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস। লুটেরা ব্রিটিশের চক্রান্তে নন্দকুমারের ফাঁসি হলেও তাঁর অবদান ভোলেননি দেশবাসী। তাঁরই দৌলতে যে বেঁচে গিয়েছিল সেই অমূল্য পুরাকীর্তি ‘গুহ্যকালী’!
ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল তখন ওয়ারেন হেস্টিংস। কাশীতে একটি কুয়ো খোঁড়ার সময় হঠাৎই উঠে এসেছিল এক সর্পভূষণা দেবীমূর্তি। অতীতে কোনও হানাদারের হাত থেকে বাঁচাতে হয়তো এভাবেই মূর্তিটিকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। তো, মহারাজা চৈত সিংহ চেয়েছিলেন, মন্দির তৈরি করে দেবীমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু কাশীরাজের সাধে বাধ সাধেন হেস্টিংস। তিনি এই আশ্চর্য পুরাকীর্তিটিকে নিজের দেশে পাচারের মতলব করেন। মূর্তির ওপর হেস্টিংসের নজর পড়ায় কাশীরাজ চৈত সিং প্রমাদ গণলেন। উপায়ন্তর না দেখে শেষমেষ বিগ্রহটিকে গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে খবর রটিয়ে দিলেন, পুরাকীর্তিটি চুরি হয়ে গিয়েছে।
এদিকে, মহারাজ নন্দকুমার গোপনে নৌকোয় চাপিয়ে সেই মূর্তি নিয়ে চলে আসেন নিজের বাড়ি বীরভূমের ভদ্রপুরে। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার নলহাটি শহর থেকে কিছুটা দূরেই মহারাজা নন্দকুমারের ভিটে আকালীপুর। এখানেই ব্রাহ্মণী নদীর তীরে পুরোদমে চলছিল ‘গুহ্যকালী’ মন্দির তৈরির কাজ। ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের চক্রান্তে ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ আগস্ট কলকাতায় প্রকাশ্যে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ান মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসি হলে মাঝপথেই থেমে যায় মন্দির নির্মাণের কাজ। পরে নন্দকুমারের পুত্র গুরুদাস শোকাহত মনে অসম্পূর্ণ মন্দিরেই প্রতিষ্ঠা করেন কষ্টিপাথরে নির্মিত সর্পভূষণা গুহ্যকালীর বিগ্রহ। পুরাকীর্তিটি একটি বিরলদর্শন কালীমূর্তি। এমন কালীমূর্তি গোটা দেশে আর নেই।
কেন এই কালীমূর্তি বিরলদর্শন? সাধারণভাবে আমরা দেবী কালীর পায়ের তলায় শিবকে শুয়ে থাকতে দেখি, কিন্তু আকালীপুরের দেবী গুহ্যকালীর পদতলে ‘শব’ বা ‘শিব’ নেই। সাধারণত আমরা কালীদেবীর পায়ের তলায় ‘শিব’-কেই দেখতে অভ্যস্ত হলেও এর অন্য ব্যাখ্যাও আছে। এ প্রসঙ্গে সাধক রামপ্রসাদ জানাচ্ছেন, ‘শিব’ নয়, মায়ের পদতলে পড়ে থাকেন ‘শব’ এবং এই ‘শব’ পড়ে থাকেন ‘শিব’ হবার আশায়। মা কালী করেছেন অসুর নিধন। তাই কালী শিবারূঢ়া নন, তিনি শবারূঢ়া। তাই মায়ের পায়ের তলায় ‘শিব’ নয়, পড়ে আছে ‘শব’ অর্থাৎ নিহত দৈত্যের দেহ বা মৃতদেহ। সাধক-কবি রামপ্রসাদ বলছেন, ‘শিব নয় মায়ের পদতলে।/ ওটা মিথ্যা লোকে বলে।।/ দৈত্য বেটা ভূমে পড়ে।/ মা দাঁড়াবে তাহার উপরে।।/ মায়ের পাদস্পর্শে দানবদেহ।/ শিবরূপ হয় রণস্থলে।।’
অধ্যাত্ম মতে, আকালীপুরের গুহ্যকালী সৃষ্টি ও প্রলয়ের পরবর্তী রূপ হিসেবে বস্ত্র পরিহিতা, দ্বিভুজা, সর্পবেদিমূলে যোগাসনা। তিনি বিনাশ করছেন না এবং তাই তাঁর হাতে খড়্গ অস্ত্র নেই, তার বদলে তাঁর দু’হাতে রয়েছে সর্পবলয়। দেবী ঘন মেঘের মত কৃষ্ণবর্ণা, পরণে রক্তবস্ত্র, লোল জিহ্বা, প্রসারিত ভয়ংকর দন্ত, কোটর মধ্যগত চক্ষু, গলায় সর্পহার, কপালে অর্ধচন্দ্র, মাথায় আকাশগামিনী জটা, হাসি মুখ, বৃহৎ উদর, কানে শব-কুণ্ডল, ডান হাতে বরমুদ্রা, বাম হাতে অভয়প্রদায়িনী অট্টহাসা মহাভয়ংকরী দেবী গুহ্যকালী সাধকের অভিষ্ট ফল প্রদানকারিণী, শিবমোহিনী। অন্যদিকে, মায়ের অষ্টকোণাকৃতি মন্দির সাধককে দিচ্ছে যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি— এই অষ্টাঙ্গিক যোগের নির্দেশ।
মহাভারতের কাহিনি ধরলে, মগধরাজ জরাসন্ধ পাতালে মন্দির তৈরি করে গুহ্যকালীর আরাধনা করতেন। ইতিহাস বলছে, গত প্রায় আড়াইশো বছর আগে রানি অহল্যাবাঈ মূর্তিটি দিয়েছিলেন কাশীরাজ চৈত সিংকে। কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের পুনর্নির্মাণ রানি অহল্যাবাঈয়ের অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কাজের অন্যতম বলে মানা হয়। কিন্তু লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস দুর্লভ মূর্তিটি ইংল্যান্ডে নিয়ে গিয়ে সেখানকার যাদুঘরে রাখার পরিকল্পনা করেন। মাঝখান থেকে তা হস্তগত করেন মহারাজা নন্দকুমার। বিষয়টি জানাজানি হতেই মহারাজা নন্দকুমার হেস্টিংসের চিরশত্রুতে পরিণত হন, যার জেরে অন্য অজুহাতে নন্দকুমারকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। বেনারসের শেষ স্বাধীন রাজা চৈত সিংয়ের সঙ্গেও একসময় যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তবে সে কাহিনি ভিন্ন।
জনশ্রুতি এই, মহারাজা নন্দকুমার নাকি স্বপ্নে দেবীর আদেশ পান যে, তাঁকেই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাই কাশীরাজের সহায়তায় মহারাজা নন্দকুমার কাশীর গঙ্গা থেকে মাতৃবিগ্রহ তুলে নৌকো করে দ্বারকা নদী এবং দ্বারকা থেকে ব্রাহ্মণী নদীপথে আসেন আকালীপুরে। নন্দকুমারের ভিটে ভদ্রপুরের কাছে নৌকোর গতি নিয়ন্ত্রণে না আসায়, নৌকো এসে থামে সোজা আকালীপুরে। এখানেই নির্জনে দেবীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। ব্রাহ্মণী নদীর তীরে অবস্থিত শ্মশান চত্বরে এখনও রয়েছে পাথরের তৈরি সেই প্রতিষ্ঠাবেদি। ইতিমধ্যে হেস্টিংসের কুচক্রে ফাঁসি হয়ে যায় নন্দকুমারের। তবে আগেই পুত্র গুরুদাসকে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সেইমত অসমাপ্ত মন্দিরেই প্রতিষ্ঠা হয় গুহ্যকালীর।
আকালীপুরে এসেছেন তারাপীঠ-ভৈরব সাধক বামাক্ষ্যাপা। তিনি আকালীপুরের এই সর্পভূষণাকে বলেছেন, বেদের বেটি। এখন সারা বছর বহু পর্যটক ভিড় জমান নির্জন ব্রাহ্মণী নদীর তীরে। মন্দিরে নিত্যদিন নিয়ম করে চলে পুজো। অন্নভোগে থাকে মাছ। প্রতিদিন কুপন কেটে বহু মানুষ গ্রহণ করেন সেই অন্নভোগ। আকালীপুরের কালীমূর্তি নিয়ে পুরাণ, ইতিহাস একাকার। জনশ্রুতি, নন্দকুমারের ফাঁসির দিন নাকি বজ্রাঘাত হয়েছিল মন্দিরে, দেখা দিয়েছিল ফাটল। আবার, সন্ধ্যার পর সেখানে মানুষের যাতায়াতে মানা। এখনও স্থানীয়দের বিশ্বাস, সন্ধের পর নাকি দেবী মন্দির থেকে বেরিয়ে ভয়ংকর মূর্তি ধরে শ্মশান এলাকায় ঘুরে বেড়ান। তাই পুজোপাঠ-দর্শন সেরে রাত নামার আগেই এলাকা ছাড়তে হয় সবাইকে।
পৌরাণিক কাহিনি বা লোকবিশ্বাস যাই বলুক, বাস্তব এই যে, অদ্বিতীয় ভাস্কর্যটি বুক দিয়ে আগলে রাখতে চেয়েছিলেন মহারাজা নন্দকুমার। বিচারক-বন্ধু স্যার এলিজা ইম্পেকে ব্যবহার করে হেস্টিংস অন্যায়ভাবে নন্দকুমারকে ফাঁসিতে ঝোলাতে সমর্থ হলেও আশ্চর্য পুরাকীর্তিটিকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে পারেননি। শত চেষ্টাতেও হেস্টিংস তার নাগাল পাননি। লোকচক্ষুর অন্তরালে দেবীজ্ঞানে প্রতিষ্ঠা পেয়ে সেই পুরাকীর্তি রয়ে গিয়েছে নন্দকুমারের ভিটেতেই। আসলে, প্রবলকেও কখনও কখনও হেরে যেতে হয় দুর্বল প্রতিপক্ষর কাছে। যেমনটা হেরেছেন ওয়ারেন হেস্টিংস। আর হেরেও যেন জিতে গিয়েছেন নন্দকুমার। আকালীপুরের কালীকে লোকে বলে, নন্দকুমারের কালী।
খুব ভালো লাগলো?