Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

কুহক

বাপের সঙ্গে বাধ্য মেয়ের মত পানের বরজের দিকেই যাচ্ছিল মালতি, হঠাৎ তার কানে ঢোকে সেই আশ্চর্য শব্দটা যেটা আজ ক’দিন হল তাকে জ্বালাচ্ছে। যেন কেউ দৌড়চ্ছে, বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। শুধু শব্দ কেন, ছায়ার মত কী যে সরে সরে যায় গাছের আড়ালে, বাপের ভয়ে মালতি ভাল করে চাইতেই পারে না। অথচ তাদের সঙ্গে সঙ্গে সারা রাস্তা যায় সেই ছায়া, লুকোচুরি খেলে, যেন হাতছানি দিয়ে মালতিকে ডাকে। তার কল্পনায় সেই ছায়াকে কখনও দেখায় যেন ভালুকের মত, কখনও হলদে রঙের চিতাবাঘ। ঘন কালো লোমশ শরীরে পেছনের দু’পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, যেন একটা পান গাছের চেয়েও লম্বা সে। আবার কখনও গাছের ফাঁকফোকরে সোনালি রোদের শিখার মত চারপায়ে ছোটে আর লম্বা লেজখানা মাটিতে আছাড় পাড়ে। এই আছে, আবার এই নেইও।

সবর বারুইয়ের কিন্তু কোনও ভাবান্তর নেই, সে ঝুড়ি নিয়ে যেমন যাচ্ছিল তেমনই যায়। কিছু শোনেও না, দেখেও না। বরং মেয়ের উসখুসানি দেখে ভাবে ‘থাপরাইয়া দেওন লাগে। বয়স্থা মাইয়া, মাটির ওপর চক্ষু থাকা লাগে, তা না, খালি উলুকঝুলুক।’

বাপকে যমের থেকেও বেশি ডরায় মালতি। মা-মরা মেয়ে বলে সবর তাকে একটুকু রেয়াত করে না। মদ খেয়ে ঘরে এসে যদি দেখে পান থেকে চুন খসা, তাহলে মেয়ের মাথার মোটা বেণি পাকলে ধরে হাতে, চোখ ভাঁটার মত করে জিগায়, ‘এইডা হয় নাই ক্যান?’ ব্যাস, মালতির প্রাণটা যেন উড়ে গিয়ে বরজের ছাদে বসে। বসে বসে দেখতে থাকে শুকনো কাশের মরা শরীর দিয়ে তৈরি বরজের ছাদ, সেই ছাদ ছুঁয়ে ফেলা আঁকশির মত কচি সবুজ পানপাতা, বরজ ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা সুপুরির গাছ আর কোনার পুকুরটা। বাপ যতবার থাপ্পড় মারে, পুকুরের কাদাজলে লাফিয়ে পড়া সোনা ব্যাঙের মত কেঁপে ওঠে মালতি, কিন্তু তেমন ব্যথা তার লাগে না। কারণ মনটা তখন সে নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারে বরজের আশেপাশে।

মোদ্দা কথা, পানের বরজটি মেয়ের প্রাণ। কেন তা মেয়ে নিজেও জানে না। নামের পরে বারুই শুনে বোঝা যাচ্ছে বাপ তার পানচাষিই বটে, কিন্তু নিজের বরজ তাদের কস্মিনকালেও ছিল না। অন্যের বরজে জন খেটেই দিন কাবার। ভেঙে পড়া মাটির দাওয়া আর ফুটো ছাদের মাটির ঘর থেকে বাপ-মেয়ে রোজ সকালে পান্তা নিয়ে রওনা হয়, ফিরতে ফিরতে সুয্যি ঠাউর অস্তে বসেন।

পান বরজে কাজ কী কম! দু’সারি লতিয়ে ওঠা পানের সারির মধ্যে দু’ফুটের মত তফাত, সেখানে উড়েপুড়ে আসা লতাপাতা আবর্জনা পরিষ্কার করা, পান গাছের বাইতে পারার সুবিধের জন্য তাকে সরু বাঁশের গায়ে বেঁধে দেওয়া, গাছের গোড়ায় খোল দেওয়া, নতুন গাছ লাগাবার সময় নির্দিষ্ট তফাতে এক সাইজের গোল গর্ত করা, বরজে অনেক কাজ। গাছের গোড়া পুঁতে চারধারে ঝুরো মাটি দিয়ে সে গর্ত সবর বারুই বুজিয়ে দেয় নতুন করে লতা বসাবার সময়। ঝুরো মাটিতে নতুন গজানো নরম শেকড় হাত পা আর সরু সরু আঙুল নিশ্চিন্তে মেলার অবকাশ পায়। গাছ তরতর করে বাড়ে।

তবে সবচেয়ে বড় কাজ মালতির। মাটির কলসিতে করে পুকুর থেকে জল তুলে এনে পাঁচ আঙুল কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে জলের ফোঁটা ফেলতে হয় পান গাছের গোড়ায়। সে এক বিশেষ কায়দা। সবাই পারে না। সব আঙুলে হয় না। কচি ঢ্যাঁড়সের মত গোড়া মোটা, ডগা সরু আঙুল চাই, তবে পান গাছ তেষ্টার জল নেবে। পুরুষের ঢ্যাবঢেবে কড়াপড়া কোদালের মত হাতে অমন আঙুলও থাকে না, পান গাছ তাদের হাতে জলও খায় না। তবে মালিক পাম্প করে গাছে জল দেবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ধোপে টেঁকেনি। এখানে কারেন্ট বড় কমজোরি। আদ্দেক সময় থাকে না, আদ্দেক সময় থাকলেও কুপি জ্বেলে দেখতে হয় আছে কিনা।

এইসব মাপটাপ নির্ভুল বোঝে-শোনে বলেই পানের বরজটা সর্বদা তার কলজের টুকরো মালতিকে আয় আয় বলে ডাকতে থাকে। মালতিও যাই বলে পা বাড়িয়েই আছে, কিন্তু বাদ সাধে গ্রাম থেকে বরজের দূরত্ব। ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া সরু রাস্তা, দু’পাশে গাছগাছালির উবুড় করা মাথায় দিনের বেলাতেই যেন আন্ধার! ভুতপ্রেতের ভয় আছে, দত্যিদানো, হিংস্র পশু, বদ মানুষ, কীসের ভয় নেই সেখানে! এই অঞ্চলের পুরনো রাজবাড়ি ঘেঁষা বরজ। কয়েক বিঘার ওপর। একলপ্তে এতটা জমি আর কোথায়ই বা পাওয়া যেত।

কিন্তু ঝামেলা করেছে পরিত্যক্ত রাজবাড়িটা। বিশাল প্রাসাদের দরজা-জানালা তো অনেক আগেই চুরি হয়ে গেছে, এখন কার্নিস থেকে শুরু করে থাম, সামনের বিশাল তোরণ সবই খসে খসে পড়ছে। সব কিছু গিলে খাওয়া অন্ধকারকে পেটের ভেতর জমিয়ে নিয়ে রাজবাড়ি একা দাঁড়িয়ে শীতে কাঁপে, গরমে ঘামে, বৃষ্টিতে ভেজে।

আশপাশের ধানখেত বা এই বরজে যারা খাটতে আসে, তারা জঙ্গল পার হয়েই আসে, কিন্তু ভুলেও জষ্টির দুপুরে তপ্ত মাথা ঠান্ডা করতে, মাঘের জাড় বা ঝড়বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে রাজবাড়িতে ঢোকে না। কীসের যে ভয়, গ্রামীণ মানুষগুলো ভাল করে বলতে পারে না, বোঝেও না। কিন্তু ভয় পায় আর কাজের সময়টুকু ছাড়া এ তল্লাটে আর এক মুহূর্তও তিষ্টোয় না।

তাই বরজে যাবার পথে কী না কী দেখে মালতি যখন চঞ্চল হয়ে উঠল, তখন তার মাথায় প্রথম এল রাজবাড়ির কথা। যা সে আবছা দেখছে, অথচ তার বাপ দেখছে না মোটেই, তার বাস ওই প্রাসাদের পেটের ভেতরের আন্ধারে নয় তো! পুকুর থেকে জল আনতে গিয়ে রাজবাড়ির ভাঙা চুড়ো নজরে আসে, মালতির হাত ভরে যায় লোমকাঁটায়। মনে হয় আলকুশি ঝোপের পেছনে কী যেন সাঁৎ করে সরে গেল। খেতে বসেছে, টুপ করে একটা পাথর গড়িয়ে এল তার পাতের দিকে। সারাক্ষণ কে যেন তাকে নজরে নজরে রাখছে।

নজরে রাখার মতই মেয়ে তো মালতি। শুধু চাঁপাকলির মত আঙুল নয়, তার শরীরের গড়নও বড় লক্ষ্মীমন্ত। কোমর ছাপানো চুল আর ভারী দুঃখী একজোড়া চোখ। ভরা বুকে আকছারই নজর আটকে বঁড়শিতে বেঁধা মাছের মত ছটফটায় বরজের অন্য খাটিয়েরা। লোকে বলে তার মায়ের মত হয়েছে সে অবিকল। সেই মা, যে নিজে পানচাষির মেয়ে ছিল বলে পান নিয়ে কত গল্পকথা জানত!

এখনও জোছনার ক্ষীর মাখামাখি রাতের বাতাসে মা-র গলার আভাস পায় মালতি, ‘পান পাতা সহজ পাতা না। দ্যাবতা আর অসুরের যুদ্ধে যখন সমুদ্রমন্থন হইল, তখন সুধার কলসি সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্য থিকা উইঠ্যা আইল বাসুকিরে দিয়া দড়ি টানাটানিতে। সেই কলসি দেইখ্যা হুড়াহুড়ি পইড়া গেল দুই দলে। তার ঠ্যালায় দুই এক ফোঁটা অমৃত ছিটকাইয়া গিয়া পড়ল পাতালে নাগরাজের বাসায়। সেইখানে নাগবল্লি নামে যে লতা গজাইল, হেই আমাগো পানের লতা। কত্ত যে রোগ সারে মা, মনের শোক দূরে যায় এই পাতার সেবনে, তা আর তরে কী কমু, মা।’

মনের শোক দূরে যায় কথাটা মনে পড়তে মালতি নড়েচড়ে বসে। তার মাতাল বাবা তাকে মারে, খেতে দেয় না, অকথ্য গালাগাল করে। এমন সন্দেহ বাতিকওয়ালা পুরুষ সে, অন্য কারও সামনে মেয়ে মাটি থেকে চোখ উপরে তুললেই তার মাথায় ভুত চাপে। মেয়ের অস্থানে-কুস্থানে লাথি মারতেও পা কাঁপে না। চুল টেনে মাটিতে শুইয়ে দেয়। মনের শোকে মালতি পাগল হয়ে যেতে যেতে ঘরে রাখা দু-একটা শুকনো পান পাতা চিবিয়ে নেয়, তারপর আবার ভাতে ভাত রাঁধে, ছেঁড়া কাঁথা রোদে দেয়। কে যে তাকে দেখে নোনা ঝোপের আড়াল থেকে, বরজ অব্দি সবটা রাস্তা দৌড়ে যায় তার সঙ্গে সঙ্গে, জানতে পারলে মালতি তার কাছেই চলে যেত। এইসব ভাবতে ভাবতে আনচান করা শরীর আর অবশ মন নিয়ে মালতি শুঁড়িখানা থেকে বাপের ফেরার অপেক্ষায় দাওয়ায় বসে থাকে মাঝরাত অব্দি।

কিন্তু সেদিন শেয়ালের ডাক শেষ হলে, টুপটাপ শিশির পড়ার আওয়াজ শুনতে শুনতে মালতি ভাবে ভোর হয়ে গেল, ছেঁড়া কাঁথা ভাঁজ করে সে বাইরে আসে। বাইরে এসে তার চোখে ধাঁধা লেগে যায়। কী জোৎস্না, কী জোৎস্না গাছের পাতায়, খোড়ো চালের ওপর, যেন হাটের গর্জন তেল মাখা দুর্গা প্রতিমার মত চকচক করছে চারধার। দাওয়ার সামনে নয়নতারা ফুল গাছে এ ডাল থেকে সে ডালে বোনা সূক্ষ্ম কারুকাজের মাকড়সার জালে শিশির বিন্দু আটকে রয়েছে, যেন গল্পে শোনা রানিমার সাতনরী হার।

এত সুন্দর কিছু কমই দেখেছে মালতি তার ছোট জীবনে। দরজার বাঁশ ধরে সে শুধু চেয়েই থাকে, গঞ্জের মাগীপাড়ায় রাত কাটাবার জন্যও বাপের ওপর যেন রাগ করতেও ভুলে যায়। প্রায়ই তো সে যায় সেখানে এবং ফিরে এসে একটুও লজ্জা না পেয়ে মেয়ের ওপর তম্বি করতে থাকে।

অবাক মেয়ে চাঁদ থেকে ঝরে পড়া সুধা চোখ দিয়ে চেটে নিতে থাকে, যতটুকু রাত বাকি আছে, এমন ঠেসান দিয়ে কাটিয়ে দেবে ঠিক করে ফেলে। তখনই নজর যায় সবেদা গাছের ছায়ার দিকে, ছাগল বাঁধার খুটোর ওপাশ থেকে কে যেন সরে গেল। একবার মনে হল অতিকায় কিছু, কালো রেশমে ঢাকা তার বিরাট শরীর। পরক্ষণেই ভাবল, না না, লাল-হলুদ মেশানো মহার্ঘ্য ত্বক আর সরু কোমরের কিছু যেন লাফ দিয়ে চলে গেল। আগুনের খণ্ডের মত তার দুই চোখ, মেয়েকে দেখে যেন একপলকের জন্য বড় কোমল হয়ে এসেছিল!

যেইই হোক না কেন সে, মালতির আর ভয় করছিল না। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে দেখল ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে যেন দোল খাচ্ছে পানলতার উজ্জ্বল রংধরা নতুন পাতার বাহার। কী যে গোলমাল হয়ে গেল মাথার ভেতর, ঠিক করে নিল এই শেষরাতেই রওনা হয়ে যাবে বরজের দিকে। মা তাকে বলেছিল এইরকম জোছনার রাতে শিশিরের আওয়াজের মধ্যে পুরুষ পাতারা আদর করে জড়িয়ে ধরে মেয়ে পাতাদের। দু’ধরনের পাতা সাপ্টে লেগে থাকে এ ওর সঙ্গে, যতক্ষণ আকাশে জোছনা থাকে ততক্ষণ। ভোরের প্রথম মোরগ ডাকের সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়ে যায় এই বাঁধন, দুই পাতা দুইদিকে এলিয়ে পড়লে দেখা যায় ডগা থেকে বেরিয়েছে নতুন কচি পাতা। ফনফনিয়ে বাড়ে তারা খোল খেয়ে; না জোছনায় লুকনো আদর খেয়ে কেউ জানে না। ওই সদ্য গজানো কচি পাতাটি যে খাবে মনের শোক কাকে বলে সে ভুলে যাবে।

ঘুমজড়ানো দুঃখী চোখে ঘরের ভেতর মাচার নিচে হাঁটু ভেঙে বসে থাকা ছাগলছানার লটপটে কানে চুমু খায় মালতি। বাইরে এসে দোর বাঁধে পাটের দড়িতে। কনুই থেকে দু’হাত ভেঙে মেঘের মত একরাশ চুল হাতখোঁপায় জড়িয়ে নেয়, তারপর হাঁটতে থাকে পানপাতার জোড়া লাগা দেখবে বলে। জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে পড়ে তার চেনা রাস্তায়, ডালপালা মাথায় ঝুঁকে পড়ে চুমু খায়। লতাপাতা পায়ে জড়িয়ে ধরে। মেয়ে বুঝতে পারে কে যেন রাস্তার ধারে গাছের আড়ালে চলে তার পায়ে পায়ে। সে অতিকায় না ক্ষিপ্র গতির, এসব ভাবেই না সে। তার পোষা ছাগলছানাটির মত তাকে অনুসরণ করে যে যাচ্ছে বনপথে, তার জন্য জীবনের সবচেয়ে আগ্রাসী চুমুটি ঠোঁটে চেপে রেখে পানপাতা হবে বলে, মনের শোক ভুলবে বলে বাতাসে দুলে দুলে বরজের দিকে ছুটতে থাকে মালতি বারুই।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
PRAJNA PARAMITA BHATTACHARJEE
PRAJNA PARAMITA BHATTACHARJEE
3 years ago

আস্বাদিত তাই এমন গল্পের জন্য মন উচাটন। কী অনাবিল। কী নিটোল।

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস ও কালিদাস

পণ্ডিতেরা তর্ক তুলেছেন, কালিদাস ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ লেখেননি৷ কেননা একেবারে পয়লা আষাঢ়েই যে মেঘ নেমে বৃষ্টি আসবে, তা হয় না। তাঁদের মতে, ওটা আষাঢ়ের শেষদিন, ‘আষাঢ়স্য প্রশম দিবস’ হবে। কিন্তু প্রথম দিবস-ই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এবং তা এতটাই যে, কালিদাসকে নিয়ে ভারত সরকার যে ডাকটিকিট বের করেছে, সেখানে ‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ শ্লোকটি উৎকীর্ণ।

Read More »
রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সোমেন চন্দ: এক বহ্নিময় কথাকার

মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি একটি উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন, যদিও তা অসমাপ্ত থাকে। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘বন্যা’। পরবর্তীকালে উপন্যাসটি অসমাপ্ত-ই থেকে যায়। আরও দুঃখের বিষয়, এর বৃহদংশ হারিয়েও গেছে। আজ যে সোমেন চন্দের লেখককৃতির জন্য আমরা তাঁকে স্মরণ করি, তা হল তাঁর বেশ কিছু অসামান্য ছোটগল্প। সংখ্যায় খুব বেশি নয়, মাত্র চব্বিশটি। আরও কিছু গল্প লিখলেও তা কালের ধুলোয় হারিয়ে গেছে। গল্পের সংখ্যা সামান্য, তবে অসামান্যতা রয়েছে সেগুলির রচনার পারিপাট্যে, বিষয়বস্তু চয়নে, শিল্পিত প্রকাশে ও লেখনীর মুনশিয়ানায়। এছাড়া তিনি দুটি নাটিকাও লেখেন, ‘বিপ্লব’ ও ‘প্রস্তাবনা’। লেখেন কিছু প্রবন্ধ। তাঁর ছোটগল্পগুলি এতটাই শিল্পোত্তীর্ণ ছিল যে, তাঁর জীবিতকালেই একাধিক ভাষায় তা অনূদিত হয়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »