কবি চণ্ডীদাস। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিন চণ্ডীদাস। এক, বীরভূম জেলার নানুরের চণ্ডীদাস বাগচী, পিতা দুর্গাদাস বাগচী। ছিলেন বারেন্দ্র শ্রেণির ব্রাহ্মণ। সাহিত্য-ভনিতায় ইনি নিজেকে বলেছেন ‘দ্বিজ চণ্ডীদাস’ এবং সাধনসঙ্গিনী রজকিনী রামীর সঙ্গে একত্রে ‘রামী-চণ্ডীদাস’ নামেও পরিচিত।
দ্বিতীয়জন বাঁকুড়া জেলার ছাতিনা গ্রামের (মতান্তরে, মানভূমের হুড়া থানার) উৎকল শ্রেণির ব্রাহ্মণ চণ্ডীদাস পাণিগ্রাহী এবং ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের রচয়িতা, সাহিত্য-ভনিতায় নিজেকে বলেছেন ‘বড়ু চণ্ডীদাস’।
তৃতীয়জন বর্ধমান জেলার পশ্চিম অংশের বাসিন্দা চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য, যিনি তাঁর লেখায় নিজেকে ‘দীন চণ্ডীদাস’ বলে উল্লেখ করেছেন।
তবে খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর বাঙালি কবি হিসেবে দু’জন চণ্ডীদাসই বিখ্যাত— দ্বিজ চণ্ডীদাস এবং বড়ু চণ্ডীদাস। দ্বিজ চণ্ডীদাস ছিলেন বীরভূমের নানুরের মানুষ এবং তিনি ছিলেন বাশুলী-সেবক। (তথ্যসূত্র: মিহির চৌধুরী কামিল্যা এবং রমাকান্ত চক্রবর্তী)
দ্বিজ চণ্ডীদাসের সাধনসঙ্গিনী ছিলেন রজকিনী রামী। নানুরের চণ্ডীদাস বলেছিলেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ অন্যদিকে, বড়ু চণ্ডীদাস ছিলেন বাঁকুড়ার ছাতিনা গ্রামের মানুষ। ‘বড়ু’ বলতে বোঝায়, মন্দিরের পরিচারক।
বাশুলী মানে দেবী বিশালাক্ষী। চণ্ডীদাসের পদে আমরা পাই তাঁর পরিচয়। যেমন, ‘বাশুলী আদেশে, কহে চণ্ডীদাসে…।’ কবি চণ্ডীদাস আরাধিতা এই দেবী বাশুলী বা বিশালাক্ষী রক্তমাংসের মানবী ছিলেন বলে প্রাচীন দেবীমন্দিরের আশপাশে প্রবাদ প্রচলিত আছে। বীরভূমের দ্বিজ চণ্ডীদাসের উপাস্য দেবী বাশুলী হচ্ছেন সরস্বতীর একটি রূপ, অন্যদিকে বাঁকুড়ার ছাতিনার বড়ু চণ্ডীদাসের উপাস্য দেবী বাশুলী হচ্ছেন দেবী চণ্ডী বা মনসা।
একথা ঠিক, আমাদের দেশের বিভিন্ন মন্দিরের প্রথা, পুজোপদ্ধতি ও বিগ্রহকে ঘিরে প্রচলিত প্রবাদের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ইতিহাস। সে হিসেবে দেবী বাশুলী মানবী হলে এর মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকত্ব নেই, এমন কথা বলাই যায়।
কেউ কেউ বলেন, চণ্ডীদাস এক যোগসিদ্ধা দ্বিজকন্যার কাছ থেকে তাঁর প্রেমরসের কাব্যরচনার প্রেরণা পেয়েছিলেন এবং নিত্যার সাধিকা এই নারীকে ভক্তরা কখনও ‘বাশুলী’, আবার কখনও ‘ডাকিনী’ বলে ডাকতেন।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, তন্ত্রসাধনায় অনেক রকম সিদ্ধির মধ্যে দু’রকম প্রধান, দিব্যাচার ও বামাচার। যারা বামাচারে সিদ্ধ, তাদের ‘বীর’ বলে এবং তাদের প্রধানকে বলা হয় ‘বীরেশ্বর’। আর এই বীরেশ্বরদের মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠ, তাঁর দেশীয় নাম হল ‘ডাক’। ‘ডাক’ মানে, জ্ঞানী। অন্যদিকে, যে নারী বামাচারে এই অবস্থায় চরম সিদ্ধিলাভ করেন, তাঁকে বলা হয় ‘ডাকিনী’। বৌদ্ধগ্রন্থে ডাকিনীদের বহু অলৌকিক কাজকর্মের বিবরণ লেখা আছে।
তবে ডাকিনী-যোগিনীরা যে রক্তমাংসের মানুষ ছিলেন, চণ্ডীদাসের লেখায় আমরা সে রকম তথ্য পাচ্ছি, যেমন—
“শালতোড়া গ্রামে অতি পীঠস্থান
নিত্যের আলয় যথা।
ডাকিনী বাসুলী নিত্যা সহচরী,
বসতি করয়ে তথা।”
এই শালতোড়া হল পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার একটি গ্রাম। শুধু তাই নয়, বৌদ্ধ সাহিত্য ‘পদ সমুদ্র’ থেকে আরও জানা যাচ্ছে, এই শালতোড়া গ্রামে সহজিয়া ধর্মপ্রচারিকা ডাকিনীদের আখড়া ছিল। আসলে এই ডাকিনী-যোগিনীরা ছিলেন বৌদ্ধ সহজযান ও বজ্রযান সম্প্রদায়ভুক্ত রক্তমাংসের সাধিকা। এ বিষয়ে রমেশচন্দ্র বসু তাঁর ‘বৌদ্ধ ও শৈব ডাকিনী ও যোগিনীদের কথা’ (বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ১৩৩৩/১ প্রকাশিত) প্রবন্ধে জানাচ্ছেন, ‘…যেসব ডাকিনী যোগিনীদের কথা বলিতে যাইতেছি, তাঁহারা রক্তমাংসের মানুষ এবং বৌদ্ধ সহজযান ও বজ্রযান সম্প্রদায়ভুক্ত ধর্মচারিণী নারী, অনেক সময় ইঁহাদের আদেশেই অনেক তন্ত্রের গ্রন্থ লিখিত হইয়াছে।’ এভাবেই চণ্ডীদাস-বঁধুয়া বাশুলী মানবী থেকে আজ লৌকিক দেবী হিসেবে পূজিতা হচ্ছেন রাঢ়-বাংলায়।
শ্রীচৈতন্যদেবের আগে বীরভূমের নানুরে সহজিয়া কবি দ্বিজ চণ্ডীদাস বর্তমান ছিলেন এবং কবি কৃত্তিবাসের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। (তথ্যসূত্র: হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সাহিত্যরত্ন)। কবি চণ্ডীদাসের স্মৃতি নিয়ে নানুর বর্তমানে ‘চণ্ডীদাস-নানুর’ নামেই পরিচিত। বর্তমানে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীনে রয়েছে চণ্ডীদাস-সেবিত বাশুলী মন্দিরসহ ১৪টি শিবমন্দির এবং ‘চণ্ডীদাসের ভিটে’ বলে পরিচিত উঁচু ঢিবি। বীরভূমের নানুরে সেই ‘চণ্ডীদাসের ভিটে’ কবি দ্বিজ চণ্ডীদাসের সাক্ষ্য দিচ্ছে আজও।
দেবী বাশুলী হলেন সরস্বতীর একটি রূপ। তাঁর এক হাতে বীণা এবং অন্য হাতে রয়েছে বই। বাশুলী মন্দিরের পাশের ১৪টি শিবমন্দির হল দেউল রীতির এবং এগুলির গায়ে সূক্ষ্ম টেরাকোটার অলংকরণ রয়েছে। ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বাশুলীদেবীর একদা পূজারী প্রয়াত মৃত্যুঞ্জয় ভট্টাচার্যের কাছে এখান থেকে পাওয়া একটি স্বর্ণমুদ্রা দেখেছিলেন। মুদ্রাটিতে ‘নরবালাদিত্য’ লেখা ছিল এবং এ থেকে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সেটি গুপ্তরাজ বালাদিত্যের মুদ্রা বলেছেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে ১৯৪৫-৪৬ সালে এবং ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের তরফে ১৯৬৩-৬৪ সালে এখানকার ‘চণ্ডীদাসের ভিটে’-য় প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ চালানো হয়। পাওয়া যায় তাম্রপ্রস্তর ও মধ্যযুদ্ধের বেশকিছু নিদর্শন।
নানুর ছিল প্রথমে ‘বারবকসিংহ’ পরগনার অন্তর্গত, চণ্ডীদাসের সময় এখানকার রাজা ছিলেন ‘কিঙ্কিন’ নামের এক হিন্দুরাজা। তিনি অজয় নদের তীরবর্তী ‘অমরার গড়’ থেকে এসে এখানকার নল বংশীয় শাসক ‘সাতরায়’-কে পরাজিত করে তাঁর রাজ্য দখল করেন। পরে কিলগির খান নামে এক মুসলমান শাসকের অধীনে যায়। নানুর গ্রামের পশ্চিমে ‘সাতরায়’ নামে একটি পুকুরও রয়েছে।
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের আবিষ্কর্তা বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ। বলা বাহুল্য, ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামের একটি গোয়ালঘর থেকে তিনি এই কাব্যের খণ্ডিত পুথিটি আবিষ্কার করেন। পরে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁরই সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে পুথিটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। সেই বসন্তরঞ্জন স্থানীয় প্রবাদের সূত্র ধরে বড়ু চণ্ডীদাসের মৃত্যু সম্পর্কে জানাচ্ছেন, গৌড়ের সুলতান একবার তাঁর গান শুনতে চেয়ে চণ্ডীদাসকে আহ্বান করেছিলেন। সেই আসরে চণ্ডীদাসের মধুর প্রেমের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে যান সুলতানের বেগম। এ খবর শুনে সুলতান রেগে যান এবং তার আদেশে চণ্ডীদাসকে চাবুক মারতে মারতে হাতির পিঠে বেঁধে চারদিকে ঘোরানো হয়। এর ফলেই মৃত্যু হয় বড়ু চণ্ডীদাসের। এ খবর শুনে সুলতানের বেগমও সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত মারা যান।
অন্যদিকে, রজকিনী রামীর সঙ্গে ব্রাহ্মণসন্তান দ্বিজ চণ্ডীদাসের প্রেমকে মেনে নেয়নি সেকালের গোঁড়া হিন্দু সমাজের শিরোমণির দল। তাদের নির্দেশে চণ্ডীদাসকে মেরে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। অন্য একটি মতে, চণ্ডীদাস পালিয়ে গিয়েছিলেন সেসময়ের বৈষ্ণবধর্মের অন্যতম পীঠস্থান বীরভূমের ইলামবাজারের দিকে। তারপর আর কিছু জানা যায় না। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ বলে রাঢ়-বীরভূমের নানুরের মাটিতে মানবিকতাবাদের জন্ম দিয়েছিলেন যে কবি, তাঁর মৃত্যুরহস্য আজও অন্ধকারেই ঢাকা।
তবে দ্বিজ চণ্ডীদাসের সময়কার বীরভূমের তদানীন্তন রাজধানী রাজনগরের হিন্দু শাসক ছিলেন ‘বীররাজা’ বসন্ত চৌধুরী। সে সময় দ্বিজ চণ্ডীদাস রাজনগরে এসেছিলেন রামীকে নিয়ে এবং রাজনগরে বর্তমান বড়বাজারের দুর্গামন্দির এলাকায় কিছুদিন ছিলেন বলে ক্ষেত্রানুসন্ধানে স্থানীয় জনপ্রবাদ সূত্রে জানা যায়।
খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর আর এক কবি বিদ্যাপতি সে সময়কার তুর্কি অত্যাচারের কথা তুলে ধরেছেন এইভাবে,
“ধরি আনয়ে বামুন বড়ুয়া।
ফোঁটা চাট গায়কো চড়ুয়া।।”
অর্থাৎ ব্রাহ্মণ বা মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের ধরে এনে তুর্কিরা তাদের তিলক মুছে, টিকি কেটে, গাধার পিঠে চাপিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াত। ইসলাম ধর্ম গ্রহণে অনিচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্য তুর্কি সেনানায়কদের এটাই ছিল একধরনের আমোদ-উল্লাস। তুর্কিদের এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রথম কলম নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন নানুরের কবি দ্বিজ চণ্ডীদাস। নির্ভীকভাবে তিনি লিখলেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
মানবতার শাশ্বত বাণী সেই ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ উচ্চারণকারীকে ধর্মের ধ্বজাধারীরা যে শত্রু বিচার করে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে কসুর করবে না, এ তো জানা কথা।