একথা আমরা অনেকেই জানি, পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কলকাতায় আসার পথে বালক ঈশ্বরচন্দ্র পথের পাশের মাইল-ফলক (Milestone) দেখে দেখে ইংরেজি বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। আধুনিক কালের মাইলস্টোন আসলে মাইল বা দূরত্ব নির্দেশক স্তম্ভ বা প্রস্তর। কিন্তু তারও আগে যখন রাস্তার ধারে কোনও দূরত্ব-নির্দেশক স্তম্ভ বা পাথর ছিল না, তখন পথ চেনাতেন ‘পাথর বুড়ি’। স্তূপের আদলে আদিকালের মাইল-ফলক ‘পাথর বুড়ির থান’ এখনও পথিককে পথ চেনায়। লৌকিক দেবী ‘পাথর বুড়ি’-র ঠিকুজিকুষ্ঠি জানার আগে, আসুন, রাঢ়বাংলার ইতিহাস খানিক জেনে নিই।
জানা যায়, বীরভূমের আদি নাম ছিল ‘রাঢ়’। রাঙামাটির দেশ। এই রাঢ়ের উত্তর-পূর্বে ছিল গৌড়, পূর্বে গঙ্গা, দক্ষিণে সমতট বা মেদিনীপুর এবং পশ্চিমে মিথিলা। রাঢ়ের দুটি ভাগ— উত্তর রাঢ় এবং দক্ষিণ রাঢ়। গঙ্গা, ভাগীরথী আর অজয় পরিবেষ্টিত অংশ হল উত্তর রাঢ়, যা রাঢ়ের মূল ভূমি হিসেবে গণ্য। অন্যদিকে, অজয় ও দামোদরের মধ্যবর্তী ভূ-ভাগটি দক্ষিণ রাঢ়, যেটি রাঢ়ের দক্ষিণ দিকের সম্প্রসারিত বা বর্ধিত অংশ। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকের ঐতিহাসিক মিনহাজউদ্দিনের লেখা ‘তবকৎ-ই-নাসিরি’-র বর্ণনা অনুযায়ী, গঙ্গার পশ্চিমে ‘রাল’ অর্থাৎ ‘রাঢ়’। সুতরাং, ঐতিহাসিক মিনহাজের বয়ান অনুসারে, খ্রিস্টীয় দ্বাদশ থেকে অন্তত খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত ‘রাঢ়’ নামটি প্রচলিত ছিল।
‘রহ্’ ধাতুর সঙ্গে ভাবার্থে ‘ঘঞ্’ প্রত্যয় যোগে নিষ্পন্ন হয়েছে ‘রাঢ়’ শব্দ, যার অর্থ হল ‘নিয়ত গতিশীলতা’। আসলে ত্যাগব্রতধারী পরিব্রাজক আর্য ঋষিরাই ছিলেন নিয়ত গতিশীল। কোনও একটি বিশেষ জায়গায় মায়ার বাঁধনে বাঁধা না পড়ে তাঁরা ছিলেন সতত বিচরণশীল। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বিচরণ করে বেড়াতেন তাঁরা এবং তাই তাঁরা ছিলেন ‘রাঢ়া’। আর এই ‘রাঢ়া’-দের বিহারক্ষেত্র বলে তাদের লালমাটির এই ভূমির নাম ‘রাঢ়’। রাঢ়ভূমির উত্তরাংশের নাম পরবর্তীকালে হয়েছে ‘বীরভূম’। রাঢ়ের এই ‘বীরভূম’ নামকরণ আমরা দেখতে পাচ্ছি, খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীতে ‘মহেশ্বরের কুলপঞ্জিকা’-তে। সেখানে উল্লিখিত রয়েছে, ‘বীরভূঃ কামকোটী স্যাৎ প্রাচ্যাং গঙ্গাজয়ান্বিতা’।
বোঝাই যাচ্ছে, খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যেই রাঢ়ের নতুন নাম হয়েছে ‘বীরভূম’। আবার পরে বীরভূমেরই আরেক নাম হয় ‘ঝাড়খণ্ড’। অনেকগুলো খণ্ড খণ্ড ঝাড়-জঙ্গল ছিল বলেই এই নাম। আজও আমরা খণ্ডাংশ বোঝাতে ‘ঝোপঝাড়’, ‘বাঁশঝাড়’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে থাকি। ঘন জঙ্গলাকীর্ণ এই বীরভূমের মাটির বন্ধনে জড়িয়ে পড়েছিলেন ভাণ্ডীরবনে ঋষি বিভাণ্ডক, বক্রেশ্বরে শ্বেতমুনি শুক্রাচার্য-পতঞ্জলি ও অষ্টাবক্র, তারাপীঠে বশিষ্ঠ, বেহিড়ায় বৃহদারণ্যক মুনি, দুবসায় মহর্ষি দুর্বাশা এবং কাঞ্চীক্ষেত্রে মহর্ষি রুরু। ঘন জঙ্গলের জন্য পঞ্চপাণ্ডবরাও তাই তাঁদের অজ্ঞাতবাসের নিরাপদ স্থান হিসেবে এই বীরভূমকেই বেছে নিয়েছিলেন। বীরভূমের বেশি বৈদ্যনাথপুর, কোটাসুর, বর্ধমানের পাণ্ডবেশ্বর, ঝাড়খণ্ডের তন্ত্রেশ্বর ও আমজোড়া প্রভৃতি জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে পাণ্ডবদের অজ্ঞাত বাসপর্বের জনশ্রুতি।
একদা ঘন জঙ্গলের মধ্যে যাতে পথ হারিয়ে না ফেলে, সেই আশঙ্কায় এবং বন্য জন্তুর আক্রমণের হাত রেহাই পেতে হাতে পাথর নিয়ে চলাচল করতেন সাধারণ মানুষ। মানুষের আদি অস্ত্র পাথরের টুকরো বা ঢেলা। এক গ্রাম থেকে বিয়ে বা অন্য কোনও প্রয়োজনে পায়ে হেঁটে এই জঙ্গল পেরিয়ে গন্তব্যস্থলে যেতে হত। গ্রামের বয়স্ক মানুষেরা যেতেন লাঠি হাতে, আর কমবয়সী ছেলেরা মাসির বাড়ি-পিসির বাড়ি যেত পাথরের ঢেলা হাতে এবং এটাই ছিল তখনকার দিনের রেওয়াজ। তারপর নিরাপদ অঞ্চলে পৌঁছে নিশ্চিন্ত হয়ে সেসব পাথরের ঢেলাগুলি ফেলে দিত। নির্দিষ্ট জায়গায় অনেক পাথর জমতে জমতে একসময় সেটাই হয়ে যেত পথের নিশানা। আধুনিক মাইল ফলকের আদি সংস্করণ। এসব পাথরের স্তূপ দেখে পথিকের পথ হারানোর ভয় থাকত না।
এখন আর এলাকায় ঘন জঙ্গল নেই। কিন্তু অনেক জায়গাতেই রয়ে গেছে সেই পাথরের স্তূপ এবং এগুলো আজ পরিচিত হয়ে গেছে ‘পাথরবুড়ির থান’ হিসেবে। গ্রামের পথের ধারে এভাবেই তৈরি হয়েছে এই লৌকিক দেবীর স্থান। পথচলতি মানুষ আজও এই পাথর বুড়ির উদ্দেশে পথের বিপদ কাটাতে প্রণাম জানান। ইটবোঝাই লরি দুটো থান ইট ফেলে দিয়ে যায় পাথর বুড়ির উদ্দেশে। সিউড়ি-রাজনগর পিচ রাস্তার ধারে বড়কোন্দা গ্রামের কাছে এভাবেই মানুষের বিশ্বাসে এখনও দাঁড়িয়ে লৌকিক দেবী এক পাথর বুড়ির থান।
সে জঙ্গল আর নেই। ক্রমে ক্রমে সব জঙ্গল সাফ হয়ে চারপাশে গড়ে উঠেছে চাষের জমি ও আর মানুষের বসতি। কারণ, ‘চাষ’ করতে গেলেই সেই চাষের ফসল সংরক্ষণের জন্য সেখানেই ‘বাস’ করতে হয়। তাই ‘চাষবাস’ শব্দবন্ধের জন্ম। বসতবাড়ি ও চাষ জমির পেট চিরে চলে গেছে পাকারাস্তা। সেই রাস্তার ধারে ‘পাথর বুড়ি’-কে কেউ সরাতে সাহস করেনি আজও। অতীত এখনও মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে। জেটযুগেও দেবতারা বহাল তবিয়তে রয়েছেন তাঁদের নিজেদের জায়গাতেই।
তথ্যসূত্র :
১. Annuls of Rural Bengal : W.W. Hunter
২. ব্যক্তিগত ক্ষেত্রসমীক্ষা।