Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

প্রমোদ দাশগুপ্ত: যে জীবন বর্ণময়, বিতর্কিতও

প্রায় দায়সারাভাবে প্রমোদ দাশগুপ্তের জন্মশতবর্ষপূর্তি উদযাপন করেছিল সিপিআই (এম)। কলকাতা জেলা কমিটির সদর দপ্তর প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে ১৩ জুলাই, ২০০৯ পার্টির তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট প্রমোদ দাশগুপ্ত জন্মশতবর্ষ স্মারক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ওই দিন দলের প্রভাতী দৈনিক ‘গণশক্তি’ প্রমোদবাবুকে নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিল। পরের দিন কারাটের বক্তৃতার সারাংশ নিয়ে একটি সংবাদও বেরিয়েছিল ওই দৈনিকে। কারাট যেদিন বক্তৃতা করেন, সেদিনই কলকাতা জেলা কমিটি একটি ৮০ পৃষ্ঠার একটি চটি বই বের করেছিল— ‘শতবর্ষে প্রমোদ দাশগুপ্ত’। সেখানেই প্রায় ২০০০ কপি বিক্রি হয়। ভূমিকায় জেলা সম্পাদক রঘুনাথ কুশারি লিখেছেন, ‘প্রমোদদার জীবনাবসান হয়েছিল ২৯ নভেম্বর ১৯৮২। গত ২৮ বছরে বহু নতুন সদস্য এসেছেন পার্টিতে। পরিসংখ্যান বলছে, এই মুহূর্তে আমাদের মোট পার্টি সদস্যের শতকরা ৮২ জন প্রমোদদার মৃত্যুর পরে নানা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে পার্টিতে এসেছেন। তাঁরা তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে শুনেছেন, বইতে পড়েছেন, কিন্তু প্রমোদদাকে কাছ থেকে দেখেননি, তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাননি। প্রবীণ যাঁরা, যাঁদের অনেকেই আজ আর আমাদের মধ্যে নেই, তাঁদের স্মৃতিচারণার মধ্য থেকে এই নতুনেরা একজন মহান বিপ্লবীকে জানবেন, পরিচিত হবেন তাঁর কর্মধারার মধ্যে। সেই নতুন কমরেডদের কিছুটা অনুপ্রাণিত করতে পারলেই এই বইয়ের সার্থকতা।’ ন্যাশনাল বুক এজেন্সি একটি সংকলন প্রকাশ করেছিল ৫ অগাস্ট— মুজফফর আহমেদের জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানে। এর বেশি কিছু নয়। আশা করেছিলাম ২০০৯ সালের ১৩ জুলাই প্রমোদ দাশগুপ্ত জন্মশতবর্ষ স্মরণের সূত্রপাত হবে এবং সারা বছর ধরে সেমিনার, সিপিআই (এম)-এর দলীয় ও গণ-সাংগঠনিক পত্রপত্রিকায় বিশেষ সংখ্যা বেরুবে প্রমোদবাবুর জীবন ও কর্মকাণ্ড নিয়ে। কিন্তু তা হয়নি। পঞ্চদশ লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবিতে রাজ্য পার্টির সদর দপ্তর মুজফফর আহমেদ ভবনের কর্তাব্যক্তিরা কি নৈরাশ্যে এতই মূহ্যমান হয়ে পড়েছিলেন যে দলের প্রধান স্থপতিকেই ভুলে যেতে বসেছিলেন?

তিনি জন্মেছিলেন বরিশালে ১৯১০ সালের ১৩ জুলাই। তাঁর বাবা মতিলাল দাশগুপ্ত বরিশাল জেলের সাব-অ্যাসিস্টেন্ট সার্জেন ছিলেন। তিনি ছিলেন বেঙ্গল প্রভিনশিয়াল মেডিকেল সার্ভিসে। তাঁদের আসল বাড়ি ফরিদপুর জেলার কুঁয়োরপুর গ্রামে। পারিবারিক স্বদেশীয়ানা তাঁকে অনেক ভাল ছাত্রের মত তাঁকেও ঐহিক উচ্চাশার মোহে আটকে রাখতে পারেনি। মহাত্মা গান্ধীর ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর বাবা বাড়িতে চরকায় সুতো কাটতেন। জ্যাঠতুতো দাদা পান্নালাল দাশগুপ্ত তাঁকে টেনেছিলেন সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে। কিশোর প্রমোদ অনেক সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিঠিপত্র আদান-প্রদানের কাজ করতেন। অগোচরে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে দীক্ষিত হয়েছিলেন। বরিশাল জেলা স্কুল থেকে ১৯২৮ সালে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে পিতৃ-ইচ্ছায় ক্যালকাটা টেকনিক্যাল স্কুলে ভর্তি হন। একজন মেধাবী ছাত্রের মত কেরিয়ার গড়ে উচ্চ-মধ্যবিত্তের জীবনযাপন করতে পারতেন। কিন্তু তাঁর চিত্ত অন্য দিশায়, দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমুক্তির সংকল্পে। অনুশীলন সমিতির বিপ্লবীদের সংস্পর্শে এলেন। পুঁথিগত পড়াশুনোর সেইখানেই ইতি। সংস্পর্শে এলেন অনুশীলন গোষ্ঠীর তরুণ নেতা নিরঞ্জন সেনগুপ্তের। তিনি তখন বন্দিদশা (যখন বিনা বিচারে আটক রাখার কুখ্যাত আইন— প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন অ্যাক্ট— অর্থাৎ নিবর্তনমূলক আইন সবে লাগু হয়েছে) থেকে মুক্ত হয়ে গোপনে পুরোদমে বিপ্লবী কাজকর্ম শুরু করলেন তরুণতরদের মধ্যে। প্রমোদবাবু তাঁদের অন্যতম। ছিলেন সুধাংশু দাশগুপ্ত ও সত্যব্রত সেন (পরবর্তীকালে খ্যাতিমান অর্থশাস্ত্রবিদ ও সংখ্যাতাত্বিক; নমুনা সমীক্ষা তত্ত্ব নিয়ে প্রশান্ত মহলানবিশের সঙ্গে তাঁর যৌথভাবে লেখা গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছিল)— যাঁরা মেছুয়াবাজার বোমা মামলায় (১৯৩০) নিরঞ্জনবাবুর সঙ্গেই কারাবাস করেছিলেন। ওই মামলায় কারারুদ্ধ হয়েছিলেন একাধিক সুপ্রসিদ্ধ বিপ্লবী— সতীশ পাকড়াশী, মুকুল সেন, পান্নালাল দাশগুপ্ত, ডা. নারায়ণ রায় প্রমুখ। প্রমোদবাবুও ওই বৈপ্লবিক কাণ্ডে জড়িয়ে পড়লেও আড়ালে ছিলেন। সুধাংশুবাবু লিখেছেন, ‘পুলিশ এই মামলায় প্রমোদ দাশগুপ্তকে গ্রেপ্তার করতে পারল না, কারণ প্রমোদের উপর যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তা তিনি অত্যন্ত সংগোপনে করে চলেছিলেন। আমরা কেউই জানতাম না প্রমোদের কাজের ধারা, শুধু জানতেন নিরঞ্জনদা। যেই মেছুয়াবাজার বোমার মামলা শুরু হ’ল, অমনি প্রমোদ ঐ মামলার লিগ্যাল এডভাইসারদের সঙ্গে মিশে গেলেন। এই মামলা পরিচালনার জন্য প্রমোদ নিরঞ্জনদার ভাই প্রফুল্ল সেন ও অন্যান্যদের সাথে অর্থ সংগ্রহের অভিযানে নামলেন।’ (সুধাংশু দাশগুপ্ত— ‘প্রমোদ দাশগুপ্ত-র সঙ্গে সেই দিনগুলি’, নিশান প্রকাশনী, আগস্ট ১৯৯৮, পৃ. ১০)।

কিন্তু তরুণ প্রমোদ গ্রেপ্তার এড়াতে পারেননি। তাঁর গ্রেপ্তারি ওয়ারেন্ট জারি হয়েছিল ১৯২৯ সালে ঔপনিবেশিক সরকারের ১৯২৮ সালে জারি করা ‘বেঙ্গল ক্রিমিনাল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’ অনুসারে, যাতে বিনা বিচারে যে কোনও মানুষকে দীর্ঘদিন কারাবন্দি করা যেত। প্রায় দুবছর আত্মগোপন করে বিপ্লবী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু গোয়েন্দারা তক্কে তক্কে ছিল। বগুড়ায় ১৯৩১ সালে তাঁকে ধরে ফেলে এরা। তখন তাঁর বাবা বগুড়া জেলে বদলি হয়ে কর্মরত। তার পরে সাত বছর বহরমপুর, বক্সার ও দেউলি বন্দি শিবিরে কারাবাস।

জেলেই তাঁর মার্ক্সবাদ–অধ্যয়নের সূত্রপাত এবং দীক্ষা। এ বিষয়ে তাঁকে প্রেরণা যোগান নিরঞ্জনবাবু ও ডা. নারায়ণ রায়। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৩৮ সালের মে দিবসে সিপিআই-তে যোগ দেন। সুপারিশকারীদের মধ্যে অন্যতম ডা. রণেন সেন। তিনি তার আগে পাঁচ বছর সিপিআই-এর প্রথম গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। সেই সময় বাংলায় আর দু’জন কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য ছিলেন— আব্দুল হালিম ও সোমনাথ লাহিড়ি। এঁরা ছিলেন অভিন্নহৃদয় বন্ধু। সিপিআই-এর কতিপয় প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম মুজফফর আহমেদের অভিভাবকত্বে এই তিনজন ১৯৩০-এর দশকে অবিভক্ত বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির ভিত গড়ে তোলেন।

যদিও পার্টির নেতৃত্ব-স্তরে আসতে তাঁকে দেড় দশক অপেক্ষা করতে হয়েছিল, প্রমোদবাবু প্রাদেশিক স্তরে নেতাদের কাছাকাছিই ছিলেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় সিপিআই-এর বঙ্গীয় রাজ্য কমিটি প্রাদেশিক সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরকে ১৯৪২ সালের ডিসেম্বর মাসে সিপিআই-এর নীতিগত অবস্থানের (Memorandum on Communist Party and Plan of Work) অনুলিপি পাঠায়, সঙ্গে বাংলায় সিপিআই-এর প্রাদেশিক নেতা ও কর্মীদের জেল থেকে মুক্ত করার বিষয়ে টালবাহানা করা হচ্ছে, এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। তাতে স্বাক্ষর ছিল আব্দুল হালিম, ধরণী গোস্বামী, গোপেন চক্রবর্তী, আব্দুল মোমিন, স্মৃতীশ ব্যানার্জি, রণেন সেন, মহম্মদ ইসমাইল, নিরঞ্জন সেন, শৈলেন মুখার্জি, অপূর্ব মুখার্জি, প্রমোদ দাশগুপ্ত ও গোপাল আচার্য। কিছুটা প্রসঙ্গান্তর হলেও বলি, সিপিআই সাধারণ সম্পাদক পূরণচাঁদ যোশী জনযুদ্ধের প্রতি দায়বদ্ধতার পাশাপাশি জাতীয় কংগ্রেসের নেতা ও কর্মীদের কারামুক্ত করার দাবি করা হয়েছিল। ওই স্মারকলিপিতে বলা হয়েছিল।

We consider this war to be a People’s War, a war of world liberation in which the Indian people in their own interest must participate to win their own liberation [Government of Bengal, Home (Political) Department, File No 3D-99/42 (103-158)] বড় হরফ সংযোজিত)। আর ৯ অগাস্ট ১৯৪২-এ প্রেস বিবৃতিতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় যোশী বলেছিলেন—
‘We Communists firmly believe that the lead for struggle given by the Working Committee was not the path of national struggle but of national struggle but of national suicide. Nevertheless the national leadership,backed by the AICC, had expressed its eagerness to strive for settlement to the very last moment. It is the insolent alien government that has precipitated the crisis. We Communists will do all we can to force the Government to retreat. We will rally the people to demand the unconditional release of national leaders and immediate negotiations with the Congress for National Government and Indian Freedom.’

দুঃখের বিষয়, এখনও এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী (যাতে কতিপয় অধ্যাপক, প্রবীণ সাংবাদিকও আছেন) বস্তাপচা অপপ্রচার চালাচ্ছেন যে, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কালপর্বে কমিউনিস্টরা কংগ্রেসিদের ধরিয়ে দিয়েছিল। যদি তা সত্য হত, যিনি ক্রান্তি ময়দানে ১৯৪২ সালে তেরঙ্গা পতাকা উড্ডীন করেছিলেন, সেই অরুণা আসফ আলি ১৯৫২ সালে ক্রেমলিনে জোসেফ স্তালিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পরে সিপিআই-তে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নিতেন না (যদিও তিনি ১৯৫৬ সালে পার্টির সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন, তবু বাকি জীবন ঘনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন), উত্তরপ্রদেশের বালিয়ায় ও মহারাষ্ট্রের সারাতায় অস্থায়ী স্বাধীন সরকারের অন্যতম প্রধান নেতা ঝাড়খণ্ডে রাই ও নানা পাতিলও সিপিআই-তে যোগ দিতেন না। অনেকে হয়তো জানেন না, শরৎচন্দ্র বসু হীরেন মুখোপাধ্যায়কে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বলেছিলেন, ‘সম্ভবত আমাকে স্বীকার করতেই হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মূল্যায়নে আমাদের ভুল হয়েছিল।’

কিন্তু তার মানে একথা বলছি না, সিপিআই-এর অবস্থান ১০০ শতাংশ ঠিক ছিল, কিন্তু তা মূলত ভুল ছিল কি না তা ইতিহাস ঠিক করবে। অবিভক্ত পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য এন কে কৃষ্ণান লিখেছেন, পার্টির অভ্যন্তরে উচ্চতম নেতৃত্বে অজয় ঘোষের অভিমত ছিল যে, সিপিআই সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা ও ফ্যাসিবাদ-বিরোধিতার মেলবন্ধন করুক। জাতীয়তার প্রশ্নে পার্টির অন্যতম শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক সত্যেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার (এই মতের পক্ষে ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাক্তন প্রধান প্রয়াত ড. বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য) অধুনালুপ্ত Problems of National Liberation-এ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু নিয়ে একটি প্রবন্ধে এই যুক্তি জোরালোভাবে তুলেছিলেন ব্রহ্মদেশে আউং সান-এর দৃষ্টান্ত দিয়ে। আউং সান-এর নেতৃত্বে সেখানকার জাতীয় আন্দোলন ফ্যাসিবাদ-বিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি ওলন্দাজ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে উদ্যত হয়েছিল। প্রায় সমসময়েই ছিল সত্যেন্দ্রনারায়ণের জন্মশতবর্ষ। সিপিআই নেতৃত্ব তাঁকে স্মরণ করতে অনীহ। পুরনো দিনের বামপন্থীদের মনে থাকবে তাঁর ১৯৫০ দশকে প্রথম দিককার স্মৃতিকথা ‘কাঞ্চনজঙ্ঘার ঘুম ভাঙছে’, যা দার্জিলিং-এ নেপালি জাতীয়তাবাদ প্রশ্নটিকে মার্ক্সবাদী (স্তালিনবাদী নয়) দৃষ্টিকোণ থেকে প্রথম বিচারের প্রয়াসও বটে, কীভাবে বে-আইনি সিপিআই-এর আমলে চিয়া কামান মজদুরদের মধ্যে এআইটিইউসি গড়ে উঠেছিল, তাও।

সিপিআই জনযুদ্ধ নীতি গ্রহণ করার পরে ঔপনিবেশিক সরকারের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করেছিল। জেল থেকে ছাড়া পাবার পরেই প্রমোদবাবু পার্টির পক্ষ থেকে বাংলায় ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পঞ্চম বাহিনী বিরোধী কার্যের দায়িত্বে ছিলেন। মার্কাস ফ্রান্ডা ১৯৭১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘Radical Politics in India’ গ্রন্থে লিখেছেন, প্রমোদবাবু সেই সময় ভারতে যুদ্ধ-প্রয়াসে যে সব রাজনৈতিক দল বিরোধিতা করছিল সে সম্পর্কে খবরাখবর সংগ্রহে মার্কিন গুপ্তচরদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। (পৃ. ৬৫)। নকশালপন্থী তাত্ত্বিক সুনীতিকুমার ঘোষও এ কথা লিখেছেন ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)— একটি মূল্যায়ন’-এও, অনিল বিশ্বাসের জীবদ্দশাতেই প্রমোদবাবু বা সিপিআই (এম)-এ তাঁর অনুগামী নেতারা এ নিয়ে কোনও প্রতিবাদ বা মামলা করেননি।

প্রমোদবাবুর অবশ্য উপরে উঠে আসার বাসনা প্রচ্ছন্ন ছিল। সুধাংশুবাবু লিখেছেন, ১৯৩৯ সালে (তখন প্রমোদবাবু কলকাতা কর্পোরেশনে জল-পরিমাপের প্রকৌশল-কর্মী ছিলেন) প্রমোদবাবুর এক সহপাঠী দেখা করেন। তিনি থাকতেন চিত্তরঞ্জন এভেন্যুর এভেন্যু ক্লাবে। সেই ছাত্রবন্ধু চলে যাবার পরে, প্রমোদবাবু সুধাংশুবাবুকে বলেন: ‘নিখিল কড়াল এসেছিল দেখা করতে। আমি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছি জেনেই দেখা করতে এসেছিল। কি বললো জানেন? বললো। কমিউনিস্ট পার্টি হোক, আর যাই হোক না কেন, লেগে থাক, দেখবি তুই-ই তড়তড় করে উঠে যাবি উপরে।’ (পূর্বোদ্ধৃত, পৃ. ১১৮-১১৯)।

তাঁর সাংগঠনিক প্রতিভা কিশোরকালেই পরিষ্ফুট হয়েছিল ক্রীড়া ক্ষেত্রে। আবাল্য সুহৃদের তা চোখে পড়েছিল।

অবিভক্ত সিপিআই-এর পালঘাট (১৯৫৬) বাদে বাকি পাঁচটির মধ্যে চারটি কংগ্রেসেই প্রমোদবাবু প্রতিনিধি ছিলেন। প্রথম পার্টি কংগ্রেসে (১৯৪৩) তিনি প্রতিনিধি ছিলেন না, যদিও সে বছর রাজ্য সম্মেলনে (প্রথম প্রকাশ্য রাজ্য সম্মেলন) প্রতিনিধি ছিলেন। সেই সম্মেলনে পার্টি দৈনিক ‘স্বাধীনতা’ প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সম্পাদক সোমনাথ লাহিড়ী, কর্মাধ্যক্ষ প্রমোদবাবু। কর্মাধ্যক্ষের কাজ মোটেই সহজ ছিল না। সার্কুলেশনের চেয়েও বড় কাজ ছিল। নিউজপ্রিন্ট যোগাড় করা, যা না হলে পার্টির পক্ষে দৈনিক প্রকাশ সম্ভব ছিল না। প্রমোদবাবু এদুটি কাজে নিষ্ঠা, শ্রম ও বুদ্ধিমত্তার স্বাক্ষর রেখে কমরেডদের মধ্যে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পেরেছিলেন।

তাঁর রাজনৈতিক জীবনের নতুন বাঁক রণদিভে পর্যায়ের (বলা উচিত, রণদিভে-ভবানী সেন-অধিকারী কালপর্ব) শেষদিকে। তিনি, জ্যোতি বসু, মণিকুন্তলা সেন, জলি মোহন কল, নিরঞ্জন সেন, হীরেন মুখার্জি, ভূপেশ গুপ্ত, স্নেহাংশু আচার্য প্রমুখ ১৯৪৭ সালে পার্টির রাজ্য নেতৃত্ব-স্তরে নির্বাচিত হন। তখন বলা হত, পিসিও, পি সি বা পিওসি নয়। জলি কল অবশ্য বলেছেন, পিসিওতে তিনি, জ্যোতিবাবু ও প্রমোদবাবু তখন নির্বাচিত হননি, কলকাতা জেলা কমিটিতে ছিলেন। মণিকুন্তলা সেন পিসিও-র সদস্য ছিলেন। সেই সময় জেলা সম্পাদক ছিলেন কুমুদ বিশ্বাস। ডা. সেন লিখেছেন, এ তিন জনেই ১৯৪৭-র রাজ্য কমিটিতে নির্বাচিত হন। (দ্বিতীয় কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত হয় একটি প্লেনামে। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বিদেশ বিভাগের সঙ্গে ডাঙ্গের ১৯৪৭ সালের ২৪ জুলাই আলোচনার মিনিটস থেকে জানা গেছে। ঠিক হয়েছিল, কিন্তু পরের বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ মার্চ কলকাতায় মহম্মদ আলী পার্কে হয়েছিল।) ভবানীবাবু পলিট ব্যুরোতে নির্বাচিত হন দ্বিতীয় কংগ্রেসেই। তাঁর জায়গায় রাজ্য সম্পাদক হন ডা. রণেন সেন। এই রাজ্যে কার্যত কায়েম হয় ব্যারাক সাম্যবাদ। আর এটা শুরু হয়েছিল প্রথম থেকেই। জ্যোতিবাবু স্মৃতিচারণে লিখেছেন: ‘পার্টি কংগ্রেসে বক্তৃতা করার সুযোগ আমার হয়নি। আমি কংগ্রেসের সভাপতিমণ্ডলীর কয়েকটি প্রশ্ন পাঠিয়েছিলাম। ফলে পরের দিন প্রাদেশিক কংগ্রেসের তৎকালীন সম্পাদক ভবানী সেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এক সভা আহ্বান করলেন। সভায় যে ক’জন প্রতিনিধি থিসিসের সঠিকতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, তাঁদের নিন্দা করা হলো। সভাপতিমণ্ডলীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া প্রস্তাব পাশ করানো হলো, প্রস্তাবটি পার্টি কংগ্রেসে শুনিয়ে দেওয়া হলো।’ (জ্যোতি বসু: ‘জনগণের সঙ্গে’, এন বি এ, ১৯৯৪, প্রথম পর্ব, পৃ. ৭৮)। চরম কর্তৃত্ববাদী হুকুমত কায়েম করায় মুখ্য ভূমিকায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অন্যতম ভবানীবাবু, সোমনাথ লাহিড়ী ও নৃপেন চক্রবর্তী। ডা. সেন, ভবানীবাবু, লাহিড়ী ও নৃপেনবাবুর ছদ্মনাম ছিল যথাক্রমে বলাই, রবি, গৌর ও নিতাই। প্রমোদবাবু, জ্যোতিবাবু ও জলি কলের নাম ছিল যথাক্রমে হরিনাথ, বকুল (প্রথমে টাইগার) ও মদন। ডা. সেনকে ‘নৈতিক অধঃপতনের’ অভিযোগে ১৯৪৮-এর শেষদিকে সাসপেন্ড করা হয় (প্রাদেশিক সার্কুলার নং ১২/৪৮)। ব্যারাক সাম্যবাদে অধঃপতনের কাজটা অত্যধিক মাত্রায় করে ছিলেন নৃপেনবাবু, ভবানীবাবু ও লাহিড়ীও। ডা. সেনের পরে রাজ্য সম্পাদক হন মহ. ইসমাইলও (ছদ্মনাম মল্লিক)। তিনিও এই অতিরিক্ত কর্তৃত্ববাদ কায়েম করায় কম ছিলেন না। তাঁর হয়ে লেখালেখি করতেন সুভাষ সিঞ্চন রায়, এককালে ইতিহাসের কৃতী ছাত্র। রণদিভে অবশ্য তখন স্বরাট এবং আচরণে আদ্যন্ত একনায়কতন্ত্রী। কেউ বিন্দুমাত্র সমালোচনা করলেই তাঁকে ‘যোশীবাদী’, সংশোধনবাদী বলা হত। অভ্যুত্থানের ডাক দেওয়া হয় ৯ মার্চ, ১৯৪৯। প্রাদেশিক সম্পাদক একটি সার্কুলারে লিখলেন— ‘মার্চের ৯ তারিখের পর থেকে বিশ্বাসঘাতকরা, শত্রুর গুপ্তচরেরা আর যোশিপন্থীরা পার্টির নেতৃত্ব ও উচ্চতর কমিটির বিরুদ্ধে মিথ্যা গুজব ছড়াতে প্রচারাভিযানে নেমে পড়েছে।’ পরে জানা গেছে, এই অভিযোগ কুৎসাত্মক। আরেকবার ১৯৪৮-এর মে মাসে চটকল মালিকেরা নিপীড়ন শুরু করলেন, প্রাদেশিক সম্পাদক মহম্মদ ইসমাইল স্লোগান দিলেন— ছাঁটাই হোগি তো পিটাই হোগি। অথচ আমরা ইসমাইল সাহেবের মত নিরহঙ্কার, ঠান্ডা মেজাজের মানুষ বেশি দেখিনি। মেহনতি মানুষের জন্য নিবেদিত ও শান্ত প্রকৃতির মানুষ এরকম হতে পারেন, ভাবাই যায় না। ভবানীদাকে যাঁরা ১৯৫০ দশকের শেষে বা ১৯৬০-এর দশকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরাও রণদিভে আমলের ভবানীদা বা নৃপেন চক্রবর্তীর ভূমিকার কথা শুনে অবাক হতেন।

সংকীর্ণতাবাদী হঠকারী লাইনের বিরুদ্ধে শিরোনামে সিপিআই-এর প্রাদেশিক সাংগঠনিক কমিটির ১৯৫০ সালে প্রচারিত একটি আত্মসমালোচনামূলক দলিলের ছত্রে ছত্রে পরিস্ফুট। এই দলিলটি ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রকাশিত ‘বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলন: দলিল ও প্রাসঙ্গিক তথ্য’ (দ্বিতীয় খণ্ড)-এ আছে। ডা. সেনকে প্রাদেশিক সম্পাদকের পদ থেকে আগেই সরিয়ে দেওয়া হয়। স্নেহাংশু আচার্যকে বহিষ্কৃত, বিশ্বনাথ মুখার্জিকে সাসপেন্ড করা হয়।

জ্যোতিবাবু এবং প্রমোদবাবু ১৯৫০ সালের প্রথম দিকে গ্রেপ্তার ও কারারুদ্ধ হন। সে বছরেই কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে জেল থেকে ছাড়া পান। কিন্তু ডা. সেন, জলি কল, গণেশ ঘোষ, বিনয় চৌধুরী প্রমুখ জেলেই রয়ে গেলেন (ডা. সেন, বিনয়বাবু ১৯৫২ সালে সাধারণ নির্বাচনে জেলে থেকেই জিতেছিলেন)। প্রেসিডেন্সি জেলে ছিলেন মুজফফর আহমদ, চারু মজুমদার, জলিদা প্রমুখ। পার্টির জেল কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন জলিদা। সেই সময়, বিশেষ করে যাঁরা কারারুদ্ধ হয়েছিলেন, জেলের ভিতরেই তাঁরা রণদিভে লাইনের সমালোচনা শুরু করেছিলেন। জলিদা এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, জেলের ভিতরে মুজফফর আহমেদ ও তিনি, রণেন সেন (জেলে ও বাইরে) এবং জেল থেকে ছাড়া পেয়ে জ্যোতিবাবু এবং প্রমোদবাবু-নিরঞ্জনবাবুও এই ব্যাপারে মুখর ছিলেন।

হঠকারী লাইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সর্বত্রই অঙ্কুরিত হয়েছিল। বাংলার বাইরে অন্ধ্রে ডাঙ্গে, সুন্দরায়া, রাজেশ্বর রাও, বাসবপুন্নাইয়া ও রবি নারায়ণ রেড্ডী আগে থেকেই বিরোধিতা করছিলেন। অজয় ঘোষ জেলে প্রথম থেকেই সমালোচনা করছিলেন, যে জন্যে কংগ্রেস থেকে পলিট ব্যুরোয় নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে কার্যত পলিট ব্যুরোর বাইরেই রাখা হয়েছিল। দ্বিতীয় কংগ্রেস-এর আগে কেন্দ্রীয় কমিটি সভায় (ডিসেম্বর ১৯৪৭) বাংলার সদস্যরা লাইন পরিবর্তনের দাবি প্রথম করেন। যোশী ও সুন্দরায়া পুরনো লাইনে থাকার কথা বলেন সদ্য রাষ্ট্র-ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রেক্ষাপটে। রণদিভের লাইনের পথ সেই অর্থে বাংলার কমরেডরাই প্রশস্ত করেন। বাংলা থেকে ছিলেন ডা. সেন, লাহিড়ী, ভবানী সেন, অরুণ বসু ও ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত।

রণদিভে-অধিকারী-ভবানী সেনের কর্তৃত্ববাদী অধ্যায়ের অবসান হল ১৯৫০ সালের জানুয়ারী মাসের শেষে। কমিনফর্মের মুখপত্র For Lasting Peace and For People’s Democracy-তে ২৫ জানুয়ারির ঐতিহাসিক সম্পাদকীয় Mighty Advance of National Liberation Movement কর্তৃত্ববাদী ও হঠকারী লাইনের ওপর তীব্র আঘাত হানল। তীব্রতর হল আন্তঃপার্টি সংগ্রাম— জেলে ও জেলের বাইরে। মুজফফর আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক খাঁ, ডা. সেন, বঙ্কিম মুখার্জি, প্রমোদবাবু, জ্যোতিবাবু, জলি কল প্রমুখ প্রতিবাদী ভূমিকা নিলেন। তার পরে এল Three P’s Document— প্রভাকর, প্রবোধ ও পুরুষোত্তমের লেখা (ডাঙ্গে, অজয় ঘোষ ও সচ্চিদানন্দ বিষ্ণু ঘাটের ছদ্মনাম। অবিভক্ত পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য এস জি সরদেশাই লিখেছেন, ওই দলিল মুসাবিদা করেছিলেন অজয় ঘোষ। দ্বিতীয় দলিলটি গুরুত্বপূর্ণ। ডা. সেন লিখেছেন— Three P’s Document-এ বলা হল, ‘Lasting Peace-এর সম্পাদকীয়ের বিকৃত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যান্ত্রিকভাবে চীনের লাইন অনুসরণ করা হচ্ছে।’

এই সময়টা প্রমোদবাবুর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। বাল্যবন্ধু নিখিল কড়ালের ভবিষ্যদ্বাণী সেই সময় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রাদেশিক দপ্তরে তিনি ধীরে ধীরে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। রাজ্য কমিটি ও সেক্রেটারিয়েটে নির্বাচিত হলেন ১৯৫৩ সালে। জ্যোতিবাবু হলেন রাজ্য কমিটি সম্পাদক। তিনি পার্টির সাংগঠনিক ব্যাপারে অনেকটা নিস্পৃহ ছিলেন। তখনকার পার্টির জাতীয় পরিষদ সদস্য জলি কল এই লেখককে বলেছেন, ‘জ্যোতিবাবুর মডেল ছিলেন বিধান রায়, মার্ক্স, লেনিন, স্তালিন, হো চি মিন নন। প্রমোদবাবু এই সুযোগে উপদলীয় কায়দায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে চলেছিলেন। ঠিক স্তালিনের মত। সাংগঠনিক কাজে ঘুরে বেড়াতেন লেনিন ও ত্রোৎস্কি, স্তালিন ক্রেমলিন আগলে থাকতেন।’ প্রমোদবাবুর উপদলীয় প্রবণতা যে কত তীব্র ছিল, তা জলি কল তাঁর আত্মজীবনী ‘In Search of a Better World : Memoirs’-এ লিখেছেন। জলিদা ১৯৫৮ সালে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হন, প্রমোদবাবুর তিন বছর আগে। তিনি তখন কলকাতা জেলা কমিটি সম্পাদক, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যও। যেহেতু একই সময় প্রায় প্রতিদিন জেলা ও রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সভা হত, জলিদা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যপদ ছাড়তে চাইলেন। প্রমোদবাবু বারণ করলেন, কারণ তাঁর জায়গায় লাহিড়ীকে নিতে হবে (পৃ. ২২৮)। লাহিড়ী ছিলেন জাতীয় ফ্রন্ট লাইনের সমর্থক, ডাঙ্গে, যোশী, রাজেশ্বর রাও, ভবানীবাবু, ড. অধিকারী, কৃষ্ণান, বিশ্বনাথ মুখার্জি, ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের মত। প্রমোদবাবু ও জলিদা ছিলেন গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট তত্ত্বের পক্ষে, মুজফফর আহমেদ, ডা. সেন, ভূপেশ গুপ্ত, জ্যোতিবাবু, অজয় ঘোষ (১৯৫৮ পর্যন্ত), সুন্দরাইয়া, রামমূর্তি, ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ, সুরজিৎ, বাসবপুন্নাইয়া, হরেকৃষ্ণ কোঙারও। কিন্তু প্রমোদবাবু, কোঙার, বাসবপুন্নাইয়া (কম-বেশি অন্য দিকে ডাঙ্গে, ভবানীবাবু, বিশ্বনাথ মুখার্জি প্রভৃতিও) উপদলবাদের দিকেই বেশি নিয়োজিত ছিলেন, মতাদর্শগতভাবে ততটা নয়।

জলিদা ও মণিদি (মণিকুন্তলা সেন, বিয়ের পরে কল) ১৯৫৯-৬০ থেকেই পার্টির কোন্দলবাজিতে উত্যক্ত। ‘আমি পার্টিতে আদৌ থাকব কি না, এই অন্তর্দ্বন্দ্ব আমার ভাবনায় এসে গিয়েছিল’, কথাচ্ছলে বলেছিলেন। জ্যোতিবাবু পার্টি সম্পাদক থাকতে চাইছিলেন না, ১৯৬০-এর গোড়ায় জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি ওই পদ ছেড়ে দেবেন। তাঁর জায়গায় এলেন প্রমোদবাবু। কিন্তু এ নিয়ে যে ধারণা প্রচলিত বা লিপিবদ্ধ আছে, তা যথেষ্ট সংশয়ান্বিত। সুধাংশুবাবু লিখেছেন, ‘সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কমরেড প্রমোদের তৎকালীন রাজ্য কমিটির সভ্যদের বিরাট অংশই মনে করলেন যে আগামী দিনের সংগ্রাম পরিচালনার জন্য প্রমোদেরই রাজ্য পার্টির সেক্রেটারী হওয়া উচিত।’ এটা সম্পূর্ণ বাজে কথা। প্রথমত সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে (অর্থাৎ জাতীয় ফ্রন্ট লাইনের বিরুদ্ধে) লড়াইয়ে জ্যোতিবাবু ও প্রমোদবাবু অভিন্ন অবস্থানে ছিলেন। দ্বিতীয়ত, তখন বলা হত রাজ্য পরিষদ, রাজ্য কমিটি নয়। জলি কল এই লেখককে বলেছেন, ‘বর্ধমানে কোনও সম্মেলন হয়নি, হয়েছিল প্লেনাম। প্রতিনিধি ছিলেন রাজ্য পরিষদ সদস্য, প্রত্যেক জেলা পরিষদ সম্পাদক ও রাজ্য পরিষদের সঙ্গে যুক্ত শাখাগুলির সম্পাদকেরা। রাজ্য সম্মেলন নয়। সকলেই চাইছিলেন জ্যোতিবাবু থেকে যান। বিকল্প হিসেবে সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন ডা. রণেন সেন। যোগ্যতম। একেবারেই উপদলবাদী ছিলেন না। ভোট হলে জিততেনই। এর বেশি কিছু বলব না। কিন্তু প্রমোদবাবু সবচেয়ে ফেবারিট ছিলেন তা নয়।’ জলিদা সুধাংশুবাবুর চেয়ে পদমর্যাদায় ও জনপ্রিয়তায় অনেক এগিয়ে ছিলেন। বর্ধমানে নেতাদের আলোচনায় চারটে নাম উঠেছিল। ডা. সেন, হরেকৃষ্ণ কোনার, প্রমোদ দাশগুপ্ত ও জলি কল। প্রমোদবাবু তাঁর কূটনৈতিক কূশলতা প্রয়োগ করে নিজে রাজ্য পরিষদ সম্পাদকের পদ বগলদাবা করেছিলেন। ডা. সেনকে এমপি হবার প্রায় টোপ দিলেন, তিনি অনেকটা অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবেই টোপ গিলেছিলেন। পরে এই লেখকের কাছে রণেনদা একাধিকবার আক্ষেপ করেছিলেন। ‘রাজ্য সম্পাদক হয়েই প্রমোদ দাশগুপ্ত জেলা সফরে বেরুতে শুরু করলেন। যখন দেখলাম গ্রুপিজম ও সব জায়গায় নিজের লোকদের তুলে ধরা তাঁর উদ্দেশ্য, মানে পাওয়ার কনসলিডেট তাঁর উদ্দেশ্য, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।’ কোঙারকে আগেই টোপ দিয়েছিলেন পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য করে। তিনি নিজে বর্ধমান ছেড়ে আসতেও চাইছিলেন না। আর জলিদা সে সময় তো পার্টিতে থাকবেন কি না, সেই দোটানায়। পার্টি ভাগের অনেক পরে প্রমোদবাবু লিখেছিলেন, ‘আমি কিছুতেই রাজ্য সম্পাদক হতে চাইনি। কমরেড মুজফফর আহমেদ আমার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করে বলেন, পার্টিটাকে সংশোধনবাদ কুরে কুরে শেষ করে দিচ্ছে। পার্টির বিপ্লবী চেহারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিপ্লবী সংগঠন হিসেবে পার্টিকে গড়ে তুলতে আপনিই পারবেন। আপনাকে রাজি হতেই হবে।’ মুজফফর আহমেদের জীবদ্দশায় কি তিনি এ কথাগুলি বলেছিলেন? এঁরা দু’জন ছাড়া কে ছিলেন সেই সময়? এই সব কথাবার্তা সেই সব ক্যাডারদের মন ভোলাতে পারে, যারা পার্টির ভিতরের উপদলবাদের দৌরাত্ন্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না; তাত্ত্বিক ভিত্তি দুর্বল। সিপিআই (এম)-এর কর্মীদের মতাদর্শগত ভিত যে দুর্বল, পার্টি একাধিক দলিলে স্বীকার করেছে। প্রমোদবাবু চাননি পার্টির অভ্যন্তরে সর্বস্তরে মতাদর্শগত বিতর্ক চর্চা হোক। বামফ্রন্ট আসার পরে সিপিআই (এম) প্রথম রাজ্য সম্মেলনে (১৯৭৮) রাজ্য কমিটি নির্বাচনে প্রথম ও দ্বিতীয় হন জ্যোতিবাবু ও গণেশ ঘোষ। প্রমোদবাবু প্রথম ২০ জনের মধ্যে ছিলেন না। খবরটা বেরিয়েছিল সিপিআই (এম)-ঘেঁষা ‘সাপ্তাহিক বাংলাদেশ’-এ সম্মেলনের পরেই। প্রমোদবাবুর স্থান আরও নীচে হত যদি না পর্যবেক্ষকরা বেনিয়মী ভোট দিতেন, হঠাৎ অনেকগুলি রাজ্য কমিটির প্রত্যক্ষ শাখা (যেগুলি সরাসরি রাজ্য সম্মেলনে প্রতিনিধি নির্বাচিত করে) গজিয়ে না উঠত প্রমোদ-উপদলের কৌশলে। এই বেনিয়মী ভোট নিয়ে একটি আন্তঃপার্টি তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। রূপায়িত হয়েছিল কিনা জানি না। প্রমোদবাবু এ নিয়ে হেনস্থা হোন এটা বোধ হয় জ্যোতিবাবু চাননি। যাই হোক, সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে তাত্ত্বিক ও বিপ্লবী লড়াইয়ে প্রমোদবাবুর বৌদ্ধিক যোগ্যতা ছিল, অবিভক্ত পার্টির নেতাদের কেউ মনে করতেন না। যদি থাকত, ১৯৭৮ সালে দলীয় নির্বাচনে সেই হাল হত না।

উপদলবাদে তাঁর ঝোঁক ১৯৫০ দশকে প্রবল ছিল। অমৃতসর কংগ্রেস (১৯৫৮)-এ পরে অজয় ঘোষের সমর্থন গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট লাইন থেকে অন্য দিকে মোড় নিচ্ছিল। রাজ্য সম্পাদক হবার ঠিক আগে বা পরে তিনি পার্টির অভ্যন্তরে একটি দলিল বিতরণ করেন— Revisionist Trend in CPI— লক্ষ্য অজয় ঘোষ। তিনি তার জবাব দিরেছিলেন— ‘চাঁচাছোলা ভাষায় নয়, কমরেডসুলভ স্টাইলে’ (ডা. সেনের উক্তি)। অবশ্য প্রমোদবাবুর লেখা নয়। অন্য কারও লেখা। সুধাংশুবাবু নিজেই লিখেছেন, ‘কমরেড প্রমোদ নিজে কিন্তু লেখক ছিলেন না।’

অবশ্য সিপিআই-এর ভাঙনের জন্য যাঁরা সিপিআই (এম) গড়লেন, তাঁরাই ১০০ শতাংশ দায়ী তা মোটেই নয়। পালঘাট কংগ্রেসে ভবানী সেন একটি প্রস্তাবে লিখেছিলেন যে, নেহরু সরকার সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। সমর্থন করেছিলেন লাহিড়ী, বিশ্বনাথ মুখার্জি, রমেশ চন্দ্র প্রমুখ। নেহরুর ৭৪তম জন্মদিনে (১৪ নভেম্বর, ১৯৬২) সিপিআই-এর চেয়ারম্যান ডাঙ্গে অভিনন্দন জানিয়ে লিখলেন, ভারতে সমাজতন্ত্র গড়ে উঠুক নেহরুর নেতৃত্বে। নেহরু তাঁর আত্মজীবনীতে স্পষ্ট লিখেছেন যে তাঁর দায়বদ্ধতা পুঁজিতন্ত্রে। শিল্পনীতি প্রস্তাব (১৯৫৬) যখন গৃহীত হল, শিল্পপতিদের অনেকে গেল-গেল রব তুললেও ঘনশ্যামদাস বিড়লা বিশ্ব ব্যাঙ্কের সভাপতি ইউজিন ব্ল্যাক-কে লিখলেন, বেসরকারি ক্ষেত্রের কাছে ওই প্রস্তাব অভূতপূর্বভাবে অনুকূল— ‘single largest fillip to the private sector’। বৃহৎ শিল্পপতি-বণিক গোষ্ঠী এ বিষয়ে প্রথমে দিকে কিছুটা দ্বিধাবিভক্ত হলেও পরের দিকে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ ছিল, সমাজতান্ত্রিক ধাঁচ (সমাজতন্ত্র নয়) পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশে অন্তরায় হবে না, এ বিষয়ে তেমন সংশয় ছিল না। তা না হলে ১৯৬২ সালে মাদ্রাজে ধনিকবণিক মহাসভা ফিক্কি (FICCI )-র বার্ষিক সভায় অর্থনৈতিক নীতি-প্রস্তাব পেশ করার সময় মূল খসড়া ও ব্যাখ্যায় তুলসীদাস কিলাচাঁদ বলতেন না— ‘Business community has no political and ideological differences with the socialist objectives of the government’।

কিন্তু তার মানে এই নয় যে নেহরু সমাজতন্ত্র-বিদ্বেষী ছিলেন, বা হয়ে উঠছিলেন। পুঁজিতন্ত্র-সমাজতন্ত্রের মাঝে দোলাচলে ছিলেন, কিন্তু মতাদর্শগতভাবে সমাজতন্ত্রী ছিলেন না (আবার ‘ফেবিয়ান সোশ্যালিস্ট’-ও ছিলেন না)। গান্ধীজির কোনও আশঙ্কা ছিল না, যে নেহরু বাম দিকে মোড় নেবেন। সুতরাং ডাঙ্গের উক্তি শুধু পার্টি নেতৃত্বের একাংশের বিপ্রতীপে ছিল না, জাতীয় কংগ্রেস সম্পর্কে সাধারণ চরিত্রায়নেরও বিপরীত ছিল, কারণ জাতীয় কংগ্রেস যে পুঁজিতান্ত্রিক পথে বিকাশ প্রয়াসী এ বিষয়ে পার্টির কোনও স্তরে মতবিরোধ ছিল না। ডাঙ্গের এই ধরনের উক্তি ভাঙনেরই সহায়ক ছিল। (অনেকের স্মরণে আছে ১৯৬৯ সালে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে সিপিআই-আহুত জনসমাবেশে ডাঙ্গের সমাজতান্ত্রিক ধাঁচ সম্পর্কে স্বভাবসিদ্ধ শ্লেষাত্মক মন্তব্য। বাংলা করে দাঁড়ায় এই রকম, ‘আমরা বলি সমাজতন্ত্র, কংগ্রেসিরা বলে সমাজতান্ত্রিক ধাঁচ, যার মানে সমাজতন্ত্রও থাকবে, টাটা-বিড়লারাও থাকবে।’)

কিন্তু সিপিআই (এম)-এ যাঁরা গেলেন, তাঁদের অনেকে ভাঙন চাননি, মনে করতেন ডা. সেন, কিন্তু দু’পক্ষেই ভাঙনের অনুঘটকের ভূমিকা নেবার জাকে অনেকেই ছিল। ‘পার্টি ভাগ না হলে প্রমোদবাবু-জ্যোতিবাবু কেউই জাতীয় নেতা হতে পারতেন না’, ডা. সেন একাধিকবার আমাকে একথা বলেছেন। জলি কলের অন্য মত, ‘দুই লাইনের লড়াই নয়, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন। বিশেষ করে, চীনের পার্টি ভাঙ্গনে সবচেয়ে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল। কাজেই ভাগ হতই এর ইঙ্গিত ১৯৫৯-৬০ এই পাচ্ছিলাম।’ অজয় ঘোষের ১৯৬২-র জানুয়ারি মাসে অকালপ্রয়াণ (৫৩ বছর পূর্ণ হবার আগেই) ভাঙন ত্বরান্বিত করল।

প্রমোদবাবুকে বড় করতে গিয়ে অনাবশ্যক অসত্য ও অতিরঞ্জিত কথা লেখা হয়েছে, হচ্ছে। সিপিআই (এম)-এর কলকাতা জেলা কমিটি লিখেছে, ১৯৫১ সালে স্বাধীনতা দৈনিক নবপর্যায়ে প্রকাশ হবার পরে প্রমোদবাবু সম্পাদকীয় বোর্ডের অন্যতম সদস্য হয়েছিলেন। প্রথমত, ১৯৫১ নয়, ১৯৫২। এগারো জনের সম্পাদকীয় বোর্ডে তিনি ছিলেন না। বোর্ডের সভাপতি ছিলেন ভূপেশ গুপ্ত, কার্যকরী সম্পাদক জ্যোতি দাশগুপ্ত। জ্যোতি বসু, নিখিল চক্রবর্তী, রণেন সেন, প্রভাত দাশগুপ্ত, রেজ্জাক খাঁ, সুকুমার মিত্র, বিভূতি গুহ, অধীর চক্রবর্তী, জ্যোতির্ময় নন্দী ও শিবশঙ্কর মিত্র। (‘বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলন: দলিল ও প্রাসঙ্গিক তথ্য’ (দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৪৩২)। মোট ১৬টি সাব কমিটির কোনওটিতেই প্রমোদবাবু ছিলেন না। তাঁর উত্থান শুরু হয়েছে, আরও পরে। স্বাধীনতা পুনর্গঠন সংক্রান্ত কমিশনে (জুন ১৯৫৩) তিনি ছিলেন, সম্পাদকীয় বোর্ডে নয় (ওই, পৃ. ৪৯৮)। সুধাংশুবাবু লিখেছেন, ১৯৫৭ সালে প্রমোদবাবুর বিকল্প সরকারের স্লোগান তাঁকে বিশিষ্টতা দিয়েছিল, অনেকে বিদ্রূপ করলেও প্রমোদবাবু নাকি তা খণ্ডন করেছিলেন। ওই স্লোগান মানুষ গ্রহণ করেনি। নির্বাচনের পরে ১নং পার্টি চিঠিতে কবুল করা হয়েছিল, ‘গ্রামাঞ্চলে আমাদের কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে সকল স্তরের কৃষকদের ঐক্য সাধনে অক্ষমতা’-র কথা, যদিও কংগ্রেসের ‘ব্যাপক অপপ্রচার ও ভীতি প্রদর্শন’ পার্টি মোকাবিলা করতে পারেনি। বিধায়ক সংখ্যা ২৮ থেকে বেড়ে ৪৬। বিকল্প শক্তির বিধায়ক সংখ্যা ৮১ (মোট ২৫১ আসন)।

প্রমোদবাবুর জীবন যেমন বর্ণময় ছিল, তেমন বিতর্কিতও। সিপিআই (এম)-এর ভিতরে তাঁকে নিয়ে কম বিতর্ক ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমান-নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ একাই ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তান জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল, তাদের মূল স্লোগান ছিল, পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন শ্রেণি পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশবাদ মনে করে এবং তার বিরুদ্ধে গণভোট-প্রতিম রায় দিতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে আওয়ামী লীগ-এর প্রতীক নৌকা চিহ্নে ভোট দিতে ডাক দেন। তার অনুকরণে প্রমোদবাবু ১৯৭১-এর লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে স্লোগান দেন— ‘পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রের উপনিবেশ। সেবার সিপিআই (এম) এই রাজ্য থেকে ৪০টির মধ্যে ১৭টি লোকসভা আসনে ও ২৮০টি সভা আসনের মধ্যে ১১৩টি আসনে জেতে। কিন্তু পরে এ নিয়ে পার্টির ভিতরে তিনি সমালোচিত হন এবং পার্টি ওই স্লোগানের যৌক্তিকতা নাকচ করে, কেন, না ওই স্লোগানে প্রাদেশিকতাবাদের স্পর্শ ছিল। কেউ কেউ বলেছিলেন, নির্বাচনে সাফল্যের উদ্দেশ্যে পার্টি তার শ্রেণি অবস্থান থেকে সরে গিয়েছিল।

কিন্তু তিনি মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদকে আপ্তবাক্য হিসেবে নেননি, সুধাংশুবাবুর এই উক্তি বিতর্কমূলক। সিপিআই (এম)-ঘনিষ্ঠ ১৯৫০ দশকের সর্বভারতীয় ছাত্র-যুব নেতা হীরেন দাশগুপ্ত ১৯৯০ দশকের শেষদিকে জাতীয় গ্রন্থাগার কর্মচারী সমিতি প্রকাশিত একটি সংকলনে লিখেছিলেন, প্রমোদ দাশগুপ্ত বলতেন ‘মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ আমরা বুঝি যেভাবে কমরেড স্তালিন বুঝতেন।’ এই মনোভাব কি আপ্তবাক্য লালনের প্রতিফলন নয়?

মুজফফর আহমেদ, ডাঙ্গে প্রমুখ তো বটেই, প্রমোদবাবু, বিশ্বনাথ মুখার্জি, রণদিভে, হরেকৃষ্ণ কোঙারের মত নেতাদের নিয়েও আমাদের অহঙ্কার ছিল যে, তাঁরা ভারতের মুক্তি সংগ্রামের পথে, বহুবার কারাবরণ করে কমিউনিস্ট পার্টিতে এসেছিলেন, কিন্তু উপদলবাদের চোরাবালিতে পা দিয়ে এঁদের অবদান অনেকাংশে ব্যাহত হয়েছে। এঁদের সমালোচনা করার পূর্বশর্ত এঁদের নিঃশর্ত আত্মত্যাগ, যা কমিউনিস্টদের মধ্যেই বেশি ছিল, অন্তত আনুপাতিকভাবে। এক জায়গায় অবশ্য প্রমোদবাবু আলাদা। সিপিআই-এর প্রাদেশিক নেতৃত্বে তিনি কোনও গণসংগঠন থেকে উঠে আসেননি— না কৃষক, না শ্রমিক (অত্যল্প দিন মেটেবুরুজে শ্রমিকদের মধ্যে কাজ ধর্তব্যের মধ্যে নয়)। তিনি যখন রাজ্য পরিষদ সম্পাদক হলেন, তাঁর উপদলগত বিরোধীদের কেউ কেউ জনান্তিকে বিদ্রূপ করে বলতেন— ‘এক্কেবারে কেরানি থেকে সম্পাদক। বিশ্ব রেকর্ড!’

সূত্রোল্লেখ

১. এই বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে ১৩ জুলাই, শরৎ সদনে সিপিআই (এম)-এর রাজ্য সম্মেলনের কিছুদিন আগে। এন বি এ এটির প্রকাশক নয়। কোনও উৎসর্গ-বাক্যাংশ ছিল না। ‘জীবন সায়াহ্ণে একটি কর্তব্য পালন করলাম’। স্মৃতিমন্থনে প্রমোদবাবুর স্তুতিসর্বস্বতা সুধাংশুবাবুর উপদলবাদের প্রতি যে প্রচ্ছন্ন ছিল, তা স্পষ্ট এই বাক্যাংশে।

২. স্তালিন ১৯৫১ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি মস্কোয় সিপিআই-এর চার নেতার সঙ্গে আলোচনায় অবশ্য চিনের পথ অনুসরণের কথা বলেননি, কিন্তু ভারতকে নিজস্ব পথ নিরূপণ করতে হবে তাও বলেননি। চার জন ছিলেন নতুন সাধারণ সম্পাদক রাজেশ্বর রাও, অজয় ঘোষ, ডাঙ্গে ও বাসবপুন্নাইয়া। রণদিভে তখন বহিষ্কৃত (যোশী রণদিভে পর্যায়ের প্রথম দিকেই বহিষ্কৃত), ভবানীবাবু, লাহিড়ী, এন কে কৃষ্ণান, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত সাসপেন্ড)। স্তালিন বলেছিলেন- ‘Here you speak of the editorial of the newspaper of the Cominform concerning the Chinese path of development of the revolution. This editorial was a challenge to the articles and speeches of Ranadive which considered that India stood on the road to socialist revolution. We, Russian communists, considered that this is a very dangerous thesis and decided to come forward against this and point out that India is on the Chinese road, i.e. the first stage of the people’s democratic revolution. For you this has the attached importance of building your revolutionary front for a revolt of the entire peasantry and the kulaks against the feudal lords, for an uprising of all of the peasantry so that the feudal lords feel themselves isolated. A revolt of the public is necessary as of all the progressive stratum of the national bourgeoisie against English imperialism, in order to isolate the bloc of the English imperialists with the national bourgeoisie. Amongst you the view is prevalent that all of the imperialists need to be expelled in one blow, all, the English and the Americans. It is impossible to build such a front. The sharp blade of the all-national front is necessarily directed against English imperialism. Let the other imperialists, including the Americans, think that you are not concerned about them. This is necessary so your actions do not unite all of the imperialists against yourselves, and for that you must sow discord among them, Now, if the American imperialists themselves want to get into a fight, the united national front of India will need to plunge into action against them.’
এই চার জনের কেউ এ নিয়ে কোনও প্রশ্নও করেননি।

৩. চিঠির পূর্ণ বয়ান:

My dear Panditji:

Allow me to convey our heartfelt congratulations to you on behalf of CPI to you on your 73rd birthday. You have inspired and led heroically the Indian nation in the struggle for national freedom.In the post-independence period, you have laid the foundation of a new Indian nation,pledged to the policies if planned economic development, democracy, socialism, peace, non-alignment and anti-colonialism. Today, in this hour of grave crisis created by the Chinese aggression, the nation have mastered around you as a man to safeguard its honour, integrity and sovereignty. The CPI pledges its unqualified support to your policies of national defence and national unity. May you leave long to realize your ideals of building a prosperous and socialist India. Yours sincerely, S A Dange, Chairman of the CPI (New Age 18 Nov, 1962, Asian Recorder, 1962, p. 4931) বাঁকা হরফ লেখকের।

৪. ‘My politics had been those of my class. The bourgeoisie’, ‘Autobiography’ (1936, p. 38)

৫. দ্রষ্টব্য: Asim Chaudhuri, Private Economic Power in India, People’s Publishing House, New Delhi, (পৃ. ১৫৫-১৬১)

৬. নেহরুকে মনে করতেন ‘the best shield of the Congresss against Left-wing groups and organizations.’ (S Gopal, Nehru, A Biography, Vol I, পৃ. ১৩৬-১৩৭)

চিত্র: গুগল
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

মহাত্মা অশ্বিনীকুমার: মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিভা

সর্বভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন জড়িয়ে ছিলেন, এবং জাতীয় কংগ্রেসে নিয়মিত যোগ দিতেন। কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের রাজনৈতিক কার্যক্রম দেখে সিপাহী বিদ্রোহের পূর্ববর্তী বছরের জাতক এবং প্রখর প্রজ্ঞাবান অশ্বিনীকুমার ১৮৯৭-এর কংগ্রেসের অমরাবতী অধিবেশনে দৃঢ়তার সঙ্গে একে ‘Threedays’ mockery’,— ‘তিনদিনের তামাশা’ বলে উল্লেখ করেন। দুর্ভাগ্য দেশের, তাঁর কথা অনুধাবন করলেও কেউ গুরুত্ব দেননি। সে-অধিবেশনের সভাপতি চেট্টুর শঙ্করণ নায়ারকে নিয়ে অক্ষয়কুমার-অনন্যা পাণ্ডে অভিনীত বায়োপিক তৈরি হয়েছে। অথচ সারা উপমহাদেশ-কাঁপানো অশ্বিনীকুমারের মূল্যায়ন আজ-ও অপেক্ষিত।

Read More »
দীপক সাহা

বন্দুকের মুখে দাঁড়িয়ে ইতিহাসকে লেন্সবন্দি করেছেন সাইদা খানম

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে উপমহাদেশের বিখ্যাত প্রায় সকল ব্যক্তিত্ব— ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, ইন্দিরা গান্ধী, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, মওলানা ভাসানী, বেগম সুফিয়া কামাল, মৈত্রেয়ী দেবী, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, আশাপূর্ণা দেবী, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়— কার ছবি তোলেননি! সেই সঙ্গে রানি এলিজাবেথ, মাদার টেরেসা, মার্শাল টিটো, অড্রে হেপবার্নের মতো বিখ্যাত মানুষদের ছবিও তুলেছেন। এই বিশাল তালিকায় আরও তিনটি নাম যুক্ত করে না দিলে অন্যায় হবে। চন্দ্রবিজয়ী নিল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিনস, মাইকেল কলিন্সের ছবিও তুলেছেন তিনি।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

মামলায় জয়ী হয়ে থোড় কুঁচি দিয়ে কালীর আরাধনা করেন জমিদার-গিন্নি

দেবী কালিকার খড়ের মেড় দেখে মজুমদার গিন্নি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, মামলার রায় যদি তাঁদের পক্ষে যায় তাহলে কলাগাছের থোড় কুঁচো দিয়ে হলেও জগজ্জননী মা মহাকালীর পুজো করা হবে, আর যদি মামলার রায় তাঁদের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে ওই খড়ের মেড় দামোদরের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। যদিও সেদিন দুপুরের মধ্যেই আদালত থেকে মজুমদার জমিদার পক্ষের জয়লাভের খবর পৌঁছেছিল থলিয়ার মজুমদার বাড়িতে। মজুমদার-গিন্নিও অক্ষরে অক্ষরে তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। মামলায় জয়লাভের খবর পাওয়া মাত্রই জমিদার-গিন্নির নির্দেশে প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দীপাবলি উৎসবের আয়োজন শুরু হয়ে যায়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বরিশাল শ্মশান-দীপালি

সমগ্র উপমহাদেশে বরিশাল শ্মশান একটি বিশেষ কারণে অনন্য। এই শ্মশানের বৈশিষ্ট্য হল, প্রতিবছর কার্তিকী অমাবস্যায়, (যাকে শাস্ত্রে ‘অশ্বযুজা’ মাস বলে) সেখানকার এই শ্মশানে যে কালীপুজো হয়, সেখানকার পুজোর আগের দিন ভূতচতুর্দশীর রাতে লক্ষ লোকের সমাবেশ হয়। উদ্দেশ্য, ওখানে যাঁদের দাহ করা হয়েছে, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। সমগ্র শ্মশান জুড়ে কয়েক হাজার মঠ বা স্মৃতিসৌধ আছে, মুসলমানদের যেমন আছে বনানী বা অন্য বহু গোরস্তানে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বৌদ্ধসম্প্রদায়ের প্রবারণা ও কঠিন চীবরদান উৎসব

বিশ্বের বহু দেশেই এই উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়। স্পেন ও ফ্রান্স-সহ ইয়োরোপীয় দেশে চীনা, জাপানি, বাঙালি বৌদ্ধরা পালন করেন যেমন, তেমনই বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি থেকে কুয়াকাটা-কলাপাড়া এই উৎসবে মেতে ওঠে। ইওরোপীয়দের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েকবছর আগে দালাই লামা যেবার শিলিগুড়িতে তাঁর বার্ষিক অনুষ্ঠান করলেন, সেবার প্যারিস থেকে আগত বেশ কিছু ফরাসির সঙ্গে আলাপ হয়, যাঁরা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত। তাঁদের কাছেই শুনেছিলাম, ফ্রান্সে বহু মানুষ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিচ্ছেন।

Read More »
শায়ক মুখোপাধ্যায়

শায়ক মুখোপাধ্যায়ের দুটি কবিতা

যাদের কাছে আজকে তুমি পৌঁছে গেছ,/ সবাই কিন্তু আয়নার মতো এখানে/ এখনও পুরো ফিরে আসতে পারেনি;// আয়না হয়ে কেউ আবার ফেরে নাকি!/ হয়তো কেউ কেউ বা কাছে ফিরে আসে;// সূর্যের রং হরিদ্রাভ কুসুম আলো/ শেষ আশ্রয় হৃদয়শূন্য হয়ে গেলে,/ যারা তবুও মনে করে রক্তের গন্ধ/ আজ শিরায় শিরায় নতুন যাদের/ ফিরে আসা এখানে অথবা যেখানেই দূরে হোক,// সে সবের প্রয়োজন সমস্তটাই ফুরিয়ে গেছে।

Read More »