Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

বরিশাল শ্মশান-দীপালি

সাধারণভাবে হিন্দুদের শবদাহস্থান হল শ্মশান। তাছাড়া বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ধর্মালম্বীদের-ও মৃত্যুর পর দাহ করা হয়। ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের-ও দাহ করার বিকল্প বিধান আছে। সেজন্য ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশেও খ্রিস্টানদের শ্মশান আছে। অন্যদিকে, হিটলার গ্যাসচেম্বারে লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করার নৃশংসতার জন্য কুখ্যাত। ইহুদীদের হত্যা করা তো হত-ই, চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতা হিশেবে আউশউইৎস, সোবিবোর, বেলজেক ইত্যাদি স্থানে শ্মশানচুল্লীর ব্যবস্থা করে তাদের ছাই পর্যন্ত সার হিশেবে ব্যবহৃত হত। ছড়িয়ে দেওয়া হত খেতখামারে।

মৃতদেহ দাহ করার প্রাচীনত্ব কয়েক হাজার বছরের। সিন্ধু সভ্যতায় শবদাহের রীতি ছিল। ঋগ্বেদের ১০.১৫.১৪-তে শবদাহের উল্লেখ আছে। প্রাচীন গ্রীস ও রোমে হত, প্রাক্-খ্রিস্টীয় ইওরোপেও। প্রাচীনযুগে ফিনিশীয়রা দাহ করত, কবর-ও দিত।
এইখানে একটি কৌতূহলজাগানো তথ্য দিই। বিখ্যাত ইংরেজ কবি শেলির মৃত্যুর পর তাঁকে দাহ করা হয়। কারণ? শেলি ইতালিতে সমুদ্রভ্রমণে গিয়ে জলে ডুবে মারা যান। সে-সময় ইয়োরোপ জুড়ে প্লেগের দাপট বলে ইতালিতে আইন করা হয়, সমুদ্র থেকে ভেসে আসা যা কিছু, নিরাপত্তার কারণে তাকে পুড়িয়ে ফেলা হবে। শেলি-ও ছিলেন এই ‘যা কিছু’, তাই তাঁকেও! তবে তাঁর মৃতদেহের ছাই সংগ্রহ করে তা সমাধিস্থ করা হয়। কয়েক বছর পর শেলির বন্ধু টি বি-আক্রান্ত কীটস ইতালিতে স্বাস্থ্যোদ্ধারে গিয়ে সেখানেই প্রয়াত হলে শেলির পাশেই তাঁকে কবরস্থ করা হয়েছিল।

সাধারণত তিনভাবে মানুষের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়,– দাহ, সমাধি বা কবর, এবং খোলা জায়গায় রেখে দিয়ে, যাকে বলা হয় ‘অনাবৃত’। তাছাড়া নদী বা সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে।মৃতদের দাহ করা ছাড়াও বামাচারী সাধকরা, তান্ত্রিক বলা হয় যাদের, শবসাধনার জন্য শ্মশানে ঠাঁই নেন। বীরভূমের তারাপীঠ এরকম-ই একটি শ্মশান। শাস্ত্রমতে, কোনও নারী শবযাত্রী হয়ে শ্মশানে যেতে পারেন না। শ্মশানে যেতে হয় খালিপায়ে। এখনকার যুক্তিবাদী সময়ে সেসব নিয়ম আর নেই।

বরিশালের শ্মশান: এক অনন্যতা ও অভিনবত্ব

সমগ্র উপমহাদেশে বরিশাল শ্মশান একটি বিশেষ কারণে অনন্য। আগেই জানাই, তান্ত্রিক সাধকদের জন্যই সম্ভবত শ্মশানে কালীপুজো হয়। অন্যান্য স্থানের চেয়ে আলাদা ও ভয়ংকর রূপ এ-কালীর। আয়তন ও অবয়বে বিসদৃশতা, বিভৎসতা ও কুৎসিত কান্তি। সঙ্গে আবার ভূতপ্রেতের আতঙ্কিত অবস্থান। কলকাতার কালীঘাট ও অন্য কোনও কোনও শ্মশান-মহাশ্মশানে এরকম মূর্তি দেখা যায়। এ-পুজো মূলত শবদাহকারী ডোমেরা আয়োজন করেন। তাছাড়া কালীর রণরঙ্গিণী মূর্তি এর ফলে রূপায়িত হয়।

বরিশাল শ্মশান বেশ বড় জায়গা জুড়ে। আগে অন্যত্র ছিল, পরে এখানকার কাউনিয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছে। এই শ্মশানের বৈশিষ্ট্য হল, প্রতিবছর কার্তিকী অমাবস্যায়, (যাকে শাস্ত্রে ‘অশ্বযুজা’ মাস বলে) সেখানকার এই শ্মশানে যে কালীপুজো হয়, সেখানকার পুজোর আগের দিন ভূতচতুর্দশীর রাতে লক্ষ লোকের সমাবেশ হয়। উদ্দেশ্য, ওখানে যাঁদের দাহ করা হয়েছে, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। সমগ্র শ্মশান জুড়ে কয়েক হাজার মঠ বা স্মৃতিসৌধ আছে, মুসলমানদের যেমন আছে বনানী বা অন্য বহু গোরস্তানে। কলকাতার কালীঘাট শ্মশানেও আছে, তবে সংখ্যায় মুষ্টিমেয় (এখানে অন্যান্য বুধজনদের মধ্যে দরদী কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সমাধি আছে। আছে তিপ্পান্ন ফুট উঁচু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সমাধি। তিপ্পান্ন বছরের আয়ু ছিল তাঁর, সেজন্য।) কিন্তু কেবল একটি দিনে সমস্ত প্রয়াতজনকে শ্রদ্ধানিবেদন অন্তত অন্য কোনও শ্মশানে নেই, কী ভারতবর্ষ, কী বাংলাদেশের অন্যত্র। মনে রাখতে হবে, এর সঙ্গে খ্রিস্টানদের ‘All Souls’ Day’ বা মুসলমানদের ‘শবে বরাত’-এর, এমনকি হিন্দুদের মহালয়ার তর্পণ অনুষ্ঠানের কোনও মিল নেই। কেননা সেটা পালিত হয় সেই সেই ধর্মাবলম্বীদের সবার পক্ষ থেকে, এবং বিশ্ব জুড়ে। অন্যদিকে বরিশাল শ্মশান-দীপালি কেবল ওই শ্মশানে দাহ হয়েছে যাঁদের, এক-আধটি ব্যতিক্রম ছাড়া তাদেরই শ্রদ্ধা-সম্মান জানানো হয়, জ্বালানো হয় মোমবাতি বা প্রদীপ, ধূপদীপ, আর তাঁদের উদ্দেশে নিবেদিত হয় ফল ও মিষ্টি। ব্যতিক্রম বলছিলাম। মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত প্রয়াত হন কলকাতায়, এবং সেখানেই তাঁর অন্ত্যেষ্টি হয়। কালীঘাট মহাশ্মশানে তাঁর স্মৃতিসৌধ-ও রয়েছে। কিন্তু বরিশালবাসী তাঁকে স্মরণ করবে না, সে কি হয়? তাই বরিশাল মহাশ্মশানেও তাঁর একটি সমাধি গড়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, নানান সময়ে অমাবস্যায় কালীপুজো হয়, যেমন জ্যৈষ্ঠমাসের অমাবস্যায় ফলহারিণী কালী। অন্য তিথিতেও হয়, যেমন মাঘের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে রটন্তী কালীপুজো। রামপ্রসাদ ও শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে কালীপুজো জড়িয়ে আছে। সত্যজিৎ রায়-রবীন্দ্রনাথের মতো ব্রাহ্ম, কাজী নজরুলের মতো মুসলমান, এন্টনি ফিরিঙ্গির মতো খ্রিস্টান পর্যন্ত শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন। এতেই দেবী কালীর জনপ্রিয়তা বোঝা যায়।

সারা শ্মশান আলো দিয়ে সাজানো হয়। সারারাত ধরে চলে মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। সারা বাংলাদেশের নানা জায়গায়, এমনকি বিদেশেও থাকেন প্রয়াতদের পুত্রকন্যা, স্বামী বা স্ত্রী, অন্য আত্মীয়রা। তারাও সুযোগ করে আসেন। প্রয়াতদের স্মরণে অশ্রুসিক্ত হতে দেখেছি কতজনকেই না! সবচেয়ে মর্মান্তিক দৃশ্য অকালপ্রয়াতদের প্রতি ব্যক্ত শোকোচ্ছ্বাস, দেখে নিজের চোখেও জল না এসে পারে না।

এখানে এসে এই শোক ও অশ্রুর বৈভবের মধ্যেও মনে হয়, ‘ফুরায় যা তা, ফুরায় শুধু চোখে,/ অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার, যায় চলে আলোকে’! আর মনে পড়ে হজরত মুহম্মদ রসুলুল্লাহ যা বলেছেন, তার ইংরেজি করলে দাঁড়ায়, ‘When a man dies, his good deeds come to an end, except three: Ongoing charity, beneficial knowledge, and a righteous child, who will pray for him’!

চিত্র: রাকিবুল হাসান
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

যত মত তত পথ

বহুদিক দিয়েই একজন স্বতন্ত্র মননের ধর্মীয় সাধক। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ধারণাতীত, আর তা কেবল তাঁর স্বদেশ বা এই উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিনের পর দিন তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ভাব-আন্দোলন, তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের নিয়ে নিয়ত চর্চা ও গবেষণা হয়ে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী দুশোর ওপর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যাবলি প্রমাণ করে (প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে), আজকের এই অশান্ত বিশ্বে তাঁরা মানুষের কতখানি আশ্রয়।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »