Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

মামলায় জয়ী হয়ে থোড় কুঁচি দিয়ে কালীর আরাধনা করেন জমিদার-গিন্নি

করালবদনী দেবী মহাকালীকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন এক জমিদার-গিন্নি! সেই হুঁশিয়ারির জেরেই নাকি আদালতের রায় নির্ধারিত হয়েছিল এবং একইসঙ্গে ঠিক হয়েছিল জমিদারবাড়ির কালীপুজোর ভবিষ্যৎ। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও, অনেককাল ধরে সেই জনশ্রুতি বহন করে চলেছেন জয়পুর থানার থলিয়ার মানুষ। থলিয়া গ্রামে তখন বসবাস করতেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার রূপনারায়ণ (রাও দে সরকার) মজুমদার। আশপাশের চারটি বিশালাকার গ্রাম নিয়ে ছিল তাঁর জমিদারি। জানা যায়, ১৮৫৫ সালে সিপাহী বিদ্রোহের দু’বছর আগের এক সকালে কালীপুজোর ঠিক আগের দিন জমিদার-গিন্নি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দেখেন জমিদারবাড়ির সদর দরজার পাশে কেউ বা কারা একটি কালী প্রতিমার খড়ের মেড় বসিয়ে দিয়ে গিয়েছে। তার পরের দিনই ছিল দীপাবলি উৎসব, তাই দেবী কালিকার খড়ের মেড় দেখে প্রথমটায় চমকে উঠেছিলেন জমিদার-গিন্নি। তিনি ভাবছিলেন, তাহলে কি স্বয়ং মা মহাকালী তাঁর বাড়ি বয়ে এলেন? নাকি এটা কারও কোনও দুরভিসন্ধি? কী করবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না তিনি। যাহোক, তখন জমিদারি সংক্রান্ত একটি বিষয় নিয়ে মজুমদার জমিদারদের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী এক জমিদারের দীর্ঘদিন যাবৎ আদালতে একটি ফৌজদারি মামলা চলছিল। মামলার জেরে তাঁদের জমিদারির হাল বেহাল।

ঘটনাচক্রে সেদিনই ওই মামলার রায় ঘোষণার কথা ছিল। দেবী কালিকার খড়ের মেড় দেখে মজুমদার গিন্নি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, মামলার রায় যদি তাঁদের পক্ষে যায় তাহলে কলাগাছের থোড় কুঁচো দিয়ে হলেও জগজ্জননী মা মহাকালীর পুজো করা হবে, আর যদি মামলার রায় তাঁদের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে ওই খড়ের মেড় দামোদরের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। যদিও সেদিন দুপুরের মধ্যেই আদালত থেকে মজুমদার জমিদার পক্ষের জয়লাভের খবর পৌঁছেছিল থলিয়ার মজুমদার বাড়িতে। মজুমদার-গিন্নিও অক্ষরে অক্ষরে তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা তাঁর স্বামী রূপনারায়ণ মজুমদারকে জানিয়েছিলেন। মামলায় জয়লাভের খবর পাওয়া মাত্রই জমিদার-গিন্নির নির্দেশে প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দীপাবলি উৎসবের আয়োজন শুরু হয়ে যায়। কেউ ছোটেন মৃৎশিল্পীর খোঁজে, আবার কেউবা বেরিয়ে পড়েন পুরোহিত খুঁজতে। রাতারাতি দেবী কালিকার সেই খড়ের মেড়ে মাটি ধরানোর কাজ শুরু হয়ে যায়। জমিদার বাড়িতে তখন সাজো সাজো রব। প্যারাফিন লন্ঠনের আলোর রোশনাইয়ে ভরে ওঠে সারা প্রাঙ্গণ, রাতের অন্ধকার সরে গিয়ে আলোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সর্বত্র। পরের দিন মজুমদার বাড়ি জুড়ে ধুমধামের সঙ্গে শুরু হয় দীপাবলি উৎসব। সেই উৎসবে অংশগ্রহণ করেন আশপাশের গ্রামগুলির অগণিত মানুষ।

মহাকালীকে চতুর্দোলায় চড়িয়ে দামোদরের তীরে নিয়ে যাওয়া হয়। দামোদরের জলে বিসর্জিতা হন দেবী।

মজুমদার পরিবারের বর্ষীয়ান সদস্য অশোক মজুমদার জানান, রূপনারায়ণ মজুমদারের হাত ধরেই মা মহাকালীর পুজো শুরু হয়। যেহেতু জমিদার-গিন্নি পুজোর উপকরণ হিসাবে কলা-থোড় কুঁচোর কথা মুখে এনেছিলেন, তাই পুজোর অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে সেদিন দেবীকে থোড় কুঁচোও উৎসর্গ করা হয়েছিল। আজ ১৬৯ বছর পরেও এখনও কালী মন্দিরেই মৃৎশিল্পীরা মায়ের মূর্তি গড়ে তোলেন। প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছরেরও বেশি সময়ে এই এলাকাটি ছিল বর্ধমান জেলার অন্তর্গত। মজুমদার বাড়ির সদস্যরা জানান, বর্ধমানের তৎকালীন মহারাজা তাঁদের পূর্বপুরুষকে একটি কষ্টিপাথরের রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি ও চারটি গ্রাম উপহারস্বরূপ প্রদান করেন। ওই মূর্তিকে ‘মুরলীধর’ নামে ডাকা হয়। কালীপুজোর দিন সন্ধ্যায় মুরলীধরের মন্দিরের সামনের মাঠে বসে দীপান্বিতা উৎসব। সেখানে আগে মুরলীধরের পুজো অনুষ্ঠিত হয়। সেই উৎসবে সারা গ্রামের মানুষ অংশগ্রহণ করেন। সুসজ্জিতা মহিলারা দীপালোকে উদ্ভাসিত করে তোলেন দীপান্বিতা প্রাঙ্গণ। মুরলীধরের পুজো শেষ হলে সেই যুগল মূর্তিকে কালী মন্দিরে নিয়ে গিয়ে শুরু হয় মা মহাকালীর পুজো। বাড়ির ও গ্রামের পুরুষ, মহিলারা একত্রিত হয়ে খুবই ভক্তি ও নিষ্ঠা সহকারে এই পুজোর সমস্ত আয়োজন করে থাকেন। দ্বিতীয় দিনের পুজো সমাপ্তি ঘটলে সেই রাতেই মহাকালীকে চতুর্দোলায় চড়িয়ে কিছুটা দূরে দামোদরের তীরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই দামোদরের জলে বিসর্জিতা হন মা মহাকালী।

চিত্র: অতিন্দ্রীয়া মজুমদার
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

স্বামী বিবেকানন্দ : প্রয়াণদিনে স্মরণ

বিবেকানন্দই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক বাঙালি তথা ভারতীয়। রবীন্দ্রনাথ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ১৯১২-পর্বে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় যাওয়ার পর, এবং তার পরের বছর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে। কিন্তু এর প্রায় কুড়ি বছর পূর্বেই বিবেকানন্দ শিকাগো-বক্তৃতা ও আমেরিকা-ইয়োরোপে এক নাগাড়ে প্রথম দফায় চার বছর থাকার সুবাদে আমেরিকার বিদ্বজ্জনমহলে যেমন, তেমনই জার্মানির মাক্সমুলার, ফ্রান্সের রোমাঁ রোলাঁ, রাশিয়ার টলস্টয় প্রমুখের শ্রদ্ধা এবং মনোযোগ আদায় করেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

প্রফুল্ল রায়: ব্রাত্য সময়ের কথাকার

প্রফুল্ল রায় নাকি অতীশ দীপঙ্করের বংশের। দেশভাগের অভিশাপেই দেশছাড়া হতে হয় তাঁকে, ১৯৫০-এ। একটা বিধুর বিষয় আমরা লক্ষ্য না করে পারি না। দেশভাগ সুনীল-শ্যামল-মহাশ্বেতা-শীর্ষেন্দু-অতীনদের কেবল ভূমিচ্যুত করেই ছাড়ল না, এমনকি তাঁদের কারুবাসনাকেও অন্যতর রূপ দেওয়ালো। দেশভাগ না হলে আমরা সুনীলের হাতে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, শীর্ষেন্দুর ‘দূরবীণ’ বা প্রফুল্ল রায়ের ‘পূর্বপার্বতী’ পেতাম না, যেমন পেতাম না শওকত ওসমানের ‘কর্ণফুলি’ বা হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি।’

Read More »
শৌনক দত্ত

মন্দ মেয়ে ভদ্র অভিনেত্রী: সুকুমারী দত্ত

বিনোদিনী দাসীর বর্ণময় জীবনের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া এই ‘তারকা অভিনেত্রী’-র বহুমাত্রিক জীবনটিও কম রঙিন নয় বরং বিস্মৃত নক্ষত্র এক, যিনি ১২৮২ বঙ্গাব্দের ৩ শ্রাবণ (১৮৭৫ খ্রি., মূল্য ছিল ১ টাকা) ‘অপূর্ব্বসতী’ নাটকটি লিখে বাংলা নাট্যাতিহাসের প্রথম নারী নাট্যকার হিসেবে সুবিদিত হয়ে আছেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস ও কালিদাস

পণ্ডিতেরা তর্ক তুলেছেন, কালিদাস ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ লেখেননি৷ কেননা একেবারে পয়লা আষাঢ়েই যে মেঘ নেমে বৃষ্টি আসবে, তা হয় না। তাঁদের মতে, ওটা আষাঢ়ের শেষদিন, ‘আষাঢ়স্য প্রশম দিবস’ হবে। কিন্তু প্রথম দিবস-ই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এবং তা এতটাই যে, কালিদাসকে নিয়ে ভারত সরকার যে ডাকটিকিট বের করেছে, সেখানে ‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ শ্লোকটি উৎকীর্ণ।

Read More »
রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »