পাকিস্তান তখন সামরিক শাসনে দোদুল্যমান। পূর্ব পাকিস্তানে চরম সরকার-বিরোধী গণআন্দোলন চলছে। তখনও বাংলাদেশ তৈরি হয়নি। চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক আগে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী অবরুদ্ধ করেছে ঢাকা। বিখ্যাত হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (এখন রূপসী বাংলা)-এর সামনে পাক-সেনার ঘেরাটোপে ক্যামেরা নিয়ে ছুটছিলেন এক মহিলা আলোকচিত্রী। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সে এক অভিনব মুহূর্ত। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সামনে এই বাঙালি মহিলা চিত্রসাংবাদিক তখন বিস্ময়। পাক-সেনার বন্দুকের মুখে ক্যামেরা হাতে ইতিহাসকে লেন্সবন্দি করেছেন ফটোগ্রাফার। তিনি পুরুষ নন, মহিলা। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের আগে ঢাকা ছিল আন্তর্জাতিক সংবাদের কেন্দ্রস্থল। বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে নারী বাহিনীর যে অনবদ্য ছবি বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে, সেটি তাঁরই তোলা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে তিনিই চিত্রসাংবাদিকতার আইকনে পরিণত হন। বাংলাদেশের প্রথম মহিলা চিত্রসাংবাদিক তিনি।
১৯৫৬ সালেই ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশ নেন তিনি। সে-বছরই জার্মানিতে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড কোলন পুরস্কার পেয়ে যান। মানুষ তাঁকে ততদিনে চিনতে শুরু করেছে। ‘অবজারভার’, ‘ইত্তেফাক’-সহ বেশ কিছু দেশি পত্রিকায় তাঁর ছবি ছাপা হয়। দুটো জাপানি পত্রিকাতেও ছাপা হয়েছিল তাঁর ছবি। তারই সূত্র ধরে জাপান, ফ্রান্স, সুইডেন-সহ বিভিন্ন দেশের আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে তাঁর ছবি দেখা যেতে থাকে। ১৯৬০ সালে ‘অল পাকিস্তান ফটো প্রতিযোগিতা’-য় প্রথম হয়েছিল তাঁর ছবি। সে-সময় বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। পাকিস্তানের মতো একটি গোঁড়া দেশে একজন নারী আলোকচিত্রী প্রথম হয়ে গিয়েছেন, ব্যাপারটা হেলাফেলা করার মতো ছিল না মোটেও।
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে উপমহাদেশের বিখ্যাত প্রায় সকল ব্যক্তিত্ব— ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, ইন্দিরা গান্ধী, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, মওলানা ভাসানী, বেগম সুফিয়া কামাল, মৈত্রেয়ী দেবী, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, আশাপূর্ণা দেবী, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়— কার ছবি তোলেননি! সেই সাথে রানি এলিজাবেথ, মাদার টেরেসা, মার্শাল টিটো, অড্রে হেপবার্নের মতো বিখ্যাত মানুষদের ছবিও তুলেছেন। এই বিশাল তালিকায় আরও তিনটি নাম যুক্ত করে না দিলে অন্যায় হবে। চন্দ্রবিজয়ী নিল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিনস, মাইকেল কলিন্সের ছবিও তুলেছেন তিনি। বাংলাদেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী হিসেবে তিনি সর্বজনবিদিত। দেশের জন্য তিনি বয়ে এনেছেন অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার। একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৯৭৩ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ‘অল ইন্ডিয়া ফটো জার্নালিজম কনফারেন্সে’ যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে। ১৯৮২ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ এশিয়ান গেমসে ‘বেগম’ পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ফ্রান্স, সুইডেন, জাপান, পাকিস্তান, ভারত, সাইপ্রাস-সহ অনেক দেশে প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন, একক প্রদর্শনী করেছেন। নিজের তোলা মাদার টেরেসার ছবি নিয়ে তিনি একটি একক প্রদর্শনীও করেছিলেন! তিনি একুশে পদক-সহ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন।
প্রচারবিমুখ এই মানুষটির কথা খুব বেশি আলোচনায় উঠে আসেনি। ঠিকই ধরেছেন। আজ তাঁরই কথা। সাইদা খানম বাংলাদেশের প্রথম পেশাদার নারী আলোকচিত্রী।
জন্মেছিলেন এক প্রগতিশীল পরিবারে ১৯৩৭ সালে ২৯ ডিসেম্বর পাবনায়। মায়ের নাম নাছিমা খাতুন। বাবা আব্দুস সামাদ খান কর্মরত ছিলেন শিক্ষা বিভাগে। ছোটবেলায় সাইদার শরীরটা খুব ভাল ছিল না, একটু দুর্বল ছিলেন। এজন্য বাড়ি থেকে তাঁকে পড়াশোনার ব্যাপারে খুব চাপ দেওয়া হত না। বাড়ির সকলে ছিলেন প্রগতিশীল। ছোটবেলা থেকেই মুক্তমনে প্রকৃতির মধ্যে ঘুরে বেড়াতেন। আপারা স্কুলে চলে গেলে সাইদাও বাড়ি থেকে বের হতেন। পাড়ার সমবয়সী বাচ্চাদের সঙ্গে গ্রামের কাচারিতে ঘুরতে যেতেন। কাচারিতে ঘুরে ঘুরে দেখতেন বিচারকাজ চলছে। তারপর ইছামতীর পাড়ে বসে নদীর সঙ্গে একটু গল্প করতে করতে জেলেদের মাছধরা দেখতেন। নদীর বুকে দূরে কোনও নৌকা দেখলে মনটা উচাটন করে উঠত। নদীর কাছে একটা পুরনো বাড়ি ছিল। সেই বাড়ির ধারেকাছে কেউ যেত না। কিন্তু সেই পুরনো বাড়িটি ছোট্ট সাইদাকে খুব টানত। মাঝেমধ্যেই তার ভাঙা জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতেন ঘরের মধ্যে আলো-আঁধারের রহস্যময় খেলা। তাঁর মনে এক রোমাঞ্চের ঢেউ খেলে যেত।
১৯৪৯ সাল। বছর বারোর এক কিশোরী। ক্যামেরা হাতে ছবি তুলে বেড়ান মনের খেয়ালে। কখনও ইছামতী নদীর তীরে, কখনও ধানখেতে পাখির পেছনে, কখনও আকাশের ছবি, কখনও পোড়ো কোনও বাড়ি। যে সময়ের কথা বলছি সে সময় মুসলিম পরিবারের কোনও মেয়ে পড়াশোনা করার সুযোগই ঠিকমতো পেতেন না, ছবি তোলা তো দূরের কথা। কিন্তু এই মেয়ে ছিলেন অদ্ভুত ব্যতিক্রমী। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন স্বাধীনচেতা।
সাইদার মা ছিলেন সংস্কারহীন মুক্তমনের মানুষ। আসুন, সাইদা খানমের মুখ থেকেই শুনি তাঁর মা কেমন ছিলেন— “আমার মা সেকালের মানুষ হলেও সংস্কারহীন প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন। সব ধর্মের, জাতির মানুষকে তিনি আপন করে নিতে পারতেন। তাঁর ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ হত। সংসারের কাজ শেষ করে খাওয়াদাওয়ার পরে বিছানায় শুয়ে বই পড়তেন। দেশবিদেশ ভ্রমণ করতে, মানুষের সঙ্গে মিশতে পছন্দ করতেন। ধর্মীয় আচারগুলোও সুন্দরভাবে পালন করতেন।’’ রোজার সময় সাইদাও মায়ের সঙ্গে শেষরাতে উঠে পড়তেন। সাইদা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমাদের বাড়িতে একটা বড় নিমগাছ ছিল। তার তলায় চুলো করে কাজের মেয়েরা রুটি বানাত, খাওয়াদাওয়া হত। আমরাও মায়েদের সঙ্গে ওখানে গিয়ে বসতাম। আমাদের ছয়টা বিলাতি কুকুর ছিল। তারা দূরে বসে থাকত রুটি খাওয়ার আশায়। মা খুব জীবজন্তু ভালবাসতেন। কুকুর ছাড়াও হরিণ ছিল, ময়ূর ছিল, নয়টা বিড়াল ছিল। বিড়ালগুলো প্রাচীরের উপরে বসে থাকত। খাবার দিলে নেমে আসত। সবার মা-ই তো আসলে ভাল। তোমার মা তোমার কাছে ভাল, আমার মা আমার কাছে ভাল।”
মা, খালা, আপারা সবাই প্রগতিশীল ছিলেন। প্রগতিশীল পরিবেশের বেড়ে ওঠার ফলে তাঁর মানসিকতাও ছিল মুক্তমনের। ছোট থেকেই তাঁর ছবি তোলার ঝোঁক দেখে মেজ আপা (বোন) হামিদা খানম (হোম ইকনমিক্স কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল) রোলিকর্ড ক্যামেরাটা এনে দেন। সালটা ১৯৪৭। সেই প্রথম ভাল ক্যামেরা হাতে পাওয়া। এরপর দেশভাগের পর তাঁর জীবনে এল নতুন সুযোগ। দেশভাগ হওয়ার পরে ‘বেগম’ পত্রিকা যখন ঢাকায় চলে এল, তখন কবি-খালা (কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা) সাইদাকে সঙ্গে করে বেগমের অফিসে নিয়ে গিয়েছিলেন। নাসিরুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সাইদার তোলা কিছু ছবি নাসিরুদ্দিন সাহেবকে দেখালে তিনি খুবই প্রশংসা করেন। শুধু তাই নয়, নাসিরুদ্দিন সাহেব সাইদাকে ‘বেগম’ পত্রিকার কাভার এবং ভেতরের জন্য ছবি তুলতে বললেন। এটা একটা অসাধারণ সুযোগ। আর সেই সুযোগটির সাইদা আন্তরিকভাবে সদ্ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর কাজের একটা প্রকাশের জায়গা পেল। মেজবোনের উপহার দেওয়া ক্যামেরায় এক কিশোরী কাজের মেয়ের ছবি তুলেছিলেন সাইদা। পত্রিকায় ছবিটি প্রকাশিত হবার পর হৈচৈ পড়ে গেল। চারিদিকে গেল গেল রব। একে তো নারী আলোকচিত্রী, তার ওপর ছবির বিষয়বস্তুও এক কিশোরী— প্রবল আপত্তির বন্যা বয়ে গেল। তবে, সাইদার পরিবার তাঁকে সমর্থন দিয়েছিলেন। সাইদাও ছিলেন অসম্ভব জেদি। সমাজের অন্ধ সংস্কারের বেড়াজাল তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। নাসিরুদ্দিন সাহেব মেয়েদের প্রগতি ও জাগরণের বিষয়ে চিন্তা করতেন। নাসিরুদ্দিন সাহেব উপলব্ধি করেছেন যে, মেয়েদের উন্নতি হওয়া দরকার। মেয়েরা তো মায়ের জাত। তাদের উন্নতি না হলে সন্তানেরাও সেভাবে শিক্ষিত হতে পারবে না। নাসিরুদ্দিন সাহেব কিশোরী সাইদাকে বললেন, যত বাধা আসবে ততই মন শক্ত করে কাজের প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। এরপর ছবি তোলা তাঁর নেশাতে পরিণত হল।
সবচেয়ে বড় সুযোগটি করে দিয়েছিলেন ‘জায়েদী স্টুডিও’-র মালিক জায়েদী। ঢাকায় সেসময় ছবি তোলার স্টুডিওর সংখ্যা হাতেগোনা। এর মধ্যে জায়েদী স্টুডিওর ডাকনাম ছিল বেশ। জায়েদী সাহেব সাইদাকে শুধু যে ছবি নিয়ে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন, তা-ই নয়, তিনি এ সম্পর্কিত প্রচুর বইপত্র-ম্যাগাজিন পড়ার সুযোগও করে দিয়েছিলেন। ফটোগ্রাফির বিভিন্ন খুঁটিনাটি, অ্যাপারচার, এক্সপোজার, এমনকি ছবির কম্পোজিশন ইত্যাদি বিষয় এভাবেই শিখতে শুরু করেন সাইদা। একজন সত্যিকারের আলোকচিত্রী হয়ে ওঠার পেছনে জায়েদী সাহেবের অবদান তিনি সবসময় স্বীকার করেন। তাঁর ভাষ্যমতে, জায়েদী সাহেবই আমার ফটোগ্রাফির প্রথম শিক্ষক।
ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা। কবি-খালার কাছে থাকতেন। তাঁর কাছেই ঘুমাতেন। কবি-খালা ছোট্ট সাইদাকে গান গাইতে গাইতে ঘুম পাড়াতেন। নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত-সহ সবরকম গান গাইতে পারতেন। খালা খুব প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন। কলকাতার বড় বড় সাহিত্যিকদের সাথে খালার পরিচয় ছিল। সেখানে যখন বড় সাহিত্যসভা হত, খালা পাবনা থেকে যেতেন যোগ দিতে। দেশভ্রমণ করলে মানুষের মনটা প্রসারিত হয়, জাত-ধর্ম এসব নিয়ে সংস্কার চলে যায়। সাইদার মনেও সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে এক মানবিক বোধের জন্ম নিয়েছিল।
বাবার আপত্তি ছিল কেবল দুটো জায়গায়! বিয়ের আসরে আর স্টেডিয়ামে গিয়ে ছবি তোলা যাবে না। প্রথমটি মানলেও দ্বিতীয় কথাটি রাখতে পারেননি। ছবি তুলেছেন, আসলে কাজের খাতিরে তুলতে হয়েছে।
ছবি তোলার পাশাপাশি পড়াশোনার দিকেও দারুণ মনোযোগী ছিলেন তিনি। যে-সময় মেয়েরা সাধারণত ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেই পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ফেলত, সেসময় দু-দুটো মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছেন, ভাবা যায়? ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার্স করার পর ১৯৭২ সালে লাইব্রেরি সায়েন্সে আরেকটি মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছেন। তারপর ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই সঙ্গে প্রেস ফটোগ্রাফার হিসেবেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। ‘অবজারভার’, ‘ইত্তেফাক’, ‘সংবাদ’-সহ বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর ছবি বের হত।
১৯৬২ সালে ‘চিত্রালী’ পত্রিকার হয়ে এক কাজে কলকাতায় এসেছিলেন সাইদা খানম। এর আগেও নানা কাজে কলকাতায় এসেছেন। উত্তম-সুচিত্রাদের ছবি তোলার সুযোগও হয়েছে৷ কিন্তু সত্যজিতের সঙ্গে তখনও দেখা হয়নি তাঁর। ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এ প্রকাশিত সাইদা খানমের ভাষাতেই শোনা যাক তাঁর সেই অভিজ্ঞতার গল্প: “এর মধ্যে অনেকবারই ভেবেছি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যাপারে। কিন্তু সেভাবে সময়-সুযোগ হয়নি। একবার পত্রিকা থেকেই আমাকে বলা হল সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে কাজ করতে। তো আমি একদিন গেলাম তাঁর বাড়িতে। এটি ছিল লেক টেম্পল রোডে অবস্থিত। একবার ভাবলাম চলে যাই। তিনি হয়তো ব্যস্ত আছেন, বিরক্ত হতে পারেন। আবার কী মনে করে গেলাম তাঁর বাসায়। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি কী চাই? সে সময়টাতে অল্প সময় হয়েছে তিনি ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিনেমাটি শেষ করেছেন। ওই সিনেমাটি নিয়েই আমি কথা বললাম। তারপর কথায় কথায় আমি একফাঁকে তাঁর কাছে ছবি তোলার অনুমতি চাইলাম। তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন। পরে শুনেছিলাম তিনি আমার ছবি তোলার প্রশংসা করেছিলেন।” ঘটনার পরবর্তী অংশও সাইদা খানমের মুখ থেকেই শুনব আমরা। এ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বণিকবার্তা’-য়। সাইদার ভাষ্যমতে, “কয়েক দিন পর আমি ঢাকায় ফিরে এলাম। মানিকদা আমাকে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র কয়েকটি স্টিল ছবি দিয়েছিলেন। সেই ছবি, আমার নিজের তোলা মানিকদার ছবি এবং সাক্ষাৎকার লিখে যখন পারভেজ ভাইকে দিলাম, তিনি বিস্ময়ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী করে এই অসাধ্যসাধন করলেন!”
সেটা কেবল শুরু। পরে সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের সঙ্গে তাঁর বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়। সত্যজিতের স্ত্রীও তাঁকে বেশ স্নেহ করতেন। নানা সময় দুজনেই তাঁকে চিঠি লিখেছেন, আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বাসায়, ছবির শুটিংয়ে। ‘মহানগর’, ‘চারুলতা’ এবং ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’- এই তিনটি ছবির শুটিংয়ে ঘুরে ঘুরে ছবি তোলার সুযোগ পেয়েছিলেন সাইদা খানম। যাঁরা পেশাদার আলোকচিত্রী, তাঁদের জন্য এরকম সুযোগ আসলে চাঁদের বুক ঘুরে দেখার চেয়ে কিছু কম না। সাইদা খানম সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি সিনেমাটোগ্রাফার নন, তাই চলচ্চিত্রে সরাসরি কাজ করেননি। কিন্তু সত্যজিতের ছবির শুটিংয়ে উপস্থিত থেকে ছবি তোলার সুযোগ পেয়েছিলেন। তা-ও একটি নয়, তিন-তিনটি ছবিতে!
ক্যামেরা ছাড়াও, কলম হাতে বেশ কিছু কাজ করেছেন সাইদা খানম। এর মধ্যে ‘ধুলোমাটি’, ‘স্মৃতির পথ বেয়ে’, ‘আমার চোখে সত্যজিৎ রায়’ উল্লেখযোগ্য।
বার্ধক্যজনিত কারণে ১৮ আগস্ট ২০২০ সালে ৮২ বছর বয়সে ঢাকাতে প্রয়াত হন সাইদা। বর্ণাঢ্য এবং বিশাল এক কর্মজীবন পার করেছেন। ক্যামেরার সঙ্গে তাঁর প্রায় ৬৪ বছরের সংসার। বিয়েও করেননি। ইতিহাসের ছবি ধরে রাখার প্রত্যয়ে যে মানুষটি কাজ শুরু করেছিলেন, বাংলাদেশের আলোকচিত্রের ইতিহাসে তিনি পরিণত হয়েছিলেন এক অনস্বীকার্য অংশে।