সাধারণভাবে হিন্দুদের শবদাহস্থান হল শ্মশান। তাছাড়া বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ধর্মালম্বীদের-ও মৃত্যুর পর দাহ করা হয়। ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের-ও দাহ করার বিকল্প বিধান আছে। সেজন্য ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশেও খ্রিস্টানদের শ্মশান আছে। অন্যদিকে, হিটলার গ্যাসচেম্বারে লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করার নৃশংসতার জন্য কুখ্যাত। ইহুদীদের হত্যা করা তো হত-ই, চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতা হিশেবে আউশউইৎস, সোবিবোর, বেলজেক ইত্যাদি স্থানে শ্মশানচুল্লীর ব্যবস্থা করে তাদের ছাই পর্যন্ত সার হিশেবে ব্যবহৃত হত। ছড়িয়ে দেওয়া হত খেতখামারে।
মৃতদেহ দাহ করার প্রাচীনত্ব কয়েক হাজার বছরের। সিন্ধু সভ্যতায় শবদাহের রীতি ছিল। ঋগ্বেদের ১০.১৫.১৪-তে শবদাহের উল্লেখ আছে। প্রাচীন গ্রীস ও রোমে হত, প্রাক্-খ্রিস্টীয় ইওরোপেও। প্রাচীনযুগে ফিনিশীয়রা দাহ করত, কবর-ও দিত।
এইখানে একটি কৌতূহলজাগানো তথ্য দিই। বিখ্যাত ইংরেজ কবি শেলির মৃত্যুর পর তাঁকে দাহ করা হয়। কারণ? শেলি ইতালিতে সমুদ্রভ্রমণে গিয়ে জলে ডুবে মারা যান। সে-সময় ইয়োরোপ জুড়ে প্লেগের দাপট বলে ইতালিতে আইন করা হয়, সমুদ্র থেকে ভেসে আসা যা কিছু, নিরাপত্তার কারণে তাকে পুড়িয়ে ফেলা হবে। শেলি-ও ছিলেন এই ‘যা কিছু’, তাই তাঁকেও! তবে তাঁর মৃতদেহের ছাই সংগ্রহ করে তা সমাধিস্থ করা হয়। কয়েক বছর পর শেলির বন্ধু টি বি-আক্রান্ত কীটস ইতালিতে স্বাস্থ্যোদ্ধারে গিয়ে সেখানেই প্রয়াত হলে শেলির পাশেই তাঁকে কবরস্থ করা হয়েছিল।
সাধারণত তিনভাবে মানুষের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়,– দাহ, সমাধি বা কবর, এবং খোলা জায়গায় রেখে দিয়ে, যাকে বলা হয় ‘অনাবৃত’। তাছাড়া নদী বা সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে।মৃতদের দাহ করা ছাড়াও বামাচারী সাধকরা, তান্ত্রিক বলা হয় যাদের, শবসাধনার জন্য শ্মশানে ঠাঁই নেন। বীরভূমের তারাপীঠ এরকম-ই একটি শ্মশান। শাস্ত্রমতে, কোনও নারী শবযাত্রী হয়ে শ্মশানে যেতে পারেন না। শ্মশানে যেতে হয় খালিপায়ে। এখনকার যুক্তিবাদী সময়ে সেসব নিয়ম আর নেই।
বরিশালের শ্মশান: এক অনন্যতা ও অভিনবত্ব
সমগ্র উপমহাদেশে বরিশাল শ্মশান একটি বিশেষ কারণে অনন্য। আগেই জানাই, তান্ত্রিক সাধকদের জন্যই সম্ভবত শ্মশানে কালীপুজো হয়। অন্যান্য স্থানের চেয়ে আলাদা ও ভয়ংকর রূপ এ-কালীর। আয়তন ও অবয়বে বিসদৃশতা, বিভৎসতা ও কুৎসিত কান্তি। সঙ্গে আবার ভূতপ্রেতের আতঙ্কিত অবস্থান। কলকাতার কালীঘাট ও অন্য কোনও কোনও শ্মশান-মহাশ্মশানে এরকম মূর্তি দেখা যায়। এ-পুজো মূলত শবদাহকারী ডোমেরা আয়োজন করেন। তাছাড়া কালীর রণরঙ্গিণী মূর্তি এর ফলে রূপায়িত হয়।
বরিশাল শ্মশান বেশ বড় জায়গা জুড়ে। আগে অন্যত্র ছিল, পরে এখানকার কাউনিয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছে। এই শ্মশানের বৈশিষ্ট্য হল, প্রতিবছর কার্তিকী অমাবস্যায়, (যাকে শাস্ত্রে ‘অশ্বযুজা’ মাস বলে) সেখানকার এই শ্মশানে যে কালীপুজো হয়, সেখানকার পুজোর আগের দিন ভূতচতুর্দশীর রাতে লক্ষ লোকের সমাবেশ হয়। উদ্দেশ্য, ওখানে যাঁদের দাহ করা হয়েছে, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। সমগ্র শ্মশান জুড়ে কয়েক হাজার মঠ বা স্মৃতিসৌধ আছে, মুসলমানদের যেমন আছে বনানী বা অন্য বহু গোরস্তানে। কলকাতার কালীঘাট শ্মশানেও আছে, তবে সংখ্যায় মুষ্টিমেয় (এখানে অন্যান্য বুধজনদের মধ্যে দরদী কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সমাধি আছে। আছে তিপ্পান্ন ফুট উঁচু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সমাধি। তিপ্পান্ন বছরের আয়ু ছিল তাঁর, সেজন্য।) কিন্তু কেবল একটি দিনে সমস্ত প্রয়াতজনকে শ্রদ্ধানিবেদন অন্তত অন্য কোনও শ্মশানে নেই, কী ভারতবর্ষ, কী বাংলাদেশের অন্যত্র। মনে রাখতে হবে, এর সঙ্গে খ্রিস্টানদের ‘All Souls’ Day’ বা মুসলমানদের ‘শবে বরাত’-এর, এমনকি হিন্দুদের মহালয়ার তর্পণ অনুষ্ঠানের কোনও মিল নেই। কেননা সেটা পালিত হয় সেই সেই ধর্মাবলম্বীদের সবার পক্ষ থেকে, এবং বিশ্ব জুড়ে। অন্যদিকে বরিশাল শ্মশান-দীপালি কেবল ওই শ্মশানে দাহ হয়েছে যাঁদের, এক-আধটি ব্যতিক্রম ছাড়া তাদেরই শ্রদ্ধা-সম্মান জানানো হয়, জ্বালানো হয় মোমবাতি বা প্রদীপ, ধূপদীপ, আর তাঁদের উদ্দেশে নিবেদিত হয় ফল ও মিষ্টি। ব্যতিক্রম বলছিলাম। মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত প্রয়াত হন কলকাতায়, এবং সেখানেই তাঁর অন্ত্যেষ্টি হয়। কালীঘাট মহাশ্মশানে তাঁর স্মৃতিসৌধ-ও রয়েছে। কিন্তু বরিশালবাসী তাঁকে স্মরণ করবে না, সে কি হয়? তাই বরিশাল মহাশ্মশানেও তাঁর একটি সমাধি গড়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, নানান সময়ে অমাবস্যায় কালীপুজো হয়, যেমন জ্যৈষ্ঠমাসের অমাবস্যায় ফলহারিণী কালী। অন্য তিথিতেও হয়, যেমন মাঘের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে রটন্তী কালীপুজো। রামপ্রসাদ ও শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে কালীপুজো জড়িয়ে আছে। সত্যজিৎ রায়-রবীন্দ্রনাথের মতো ব্রাহ্ম, কাজী নজরুলের মতো মুসলমান, এন্টনি ফিরিঙ্গির মতো খ্রিস্টান পর্যন্ত শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন। এতেই দেবী কালীর জনপ্রিয়তা বোঝা যায়।
সারা শ্মশান আলো দিয়ে সাজানো হয়। সারারাত ধরে চলে মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। সারা বাংলাদেশের নানা জায়গায়, এমনকি বিদেশেও থাকেন প্রয়াতদের পুত্রকন্যা, স্বামী বা স্ত্রী, অন্য আত্মীয়রা। তারাও সুযোগ করে আসেন। প্রয়াতদের স্মরণে অশ্রুসিক্ত হতে দেখেছি কতজনকেই না! সবচেয়ে মর্মান্তিক দৃশ্য অকালপ্রয়াতদের প্রতি ব্যক্ত শোকোচ্ছ্বাস, দেখে নিজের চোখেও জল না এসে পারে না।
এখানে এসে এই শোক ও অশ্রুর বৈভবের মধ্যেও মনে হয়, ‘ফুরায় যা তা, ফুরায় শুধু চোখে,/ অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার, যায় চলে আলোকে’! আর মনে পড়ে হজরত মুহম্মদ রসুলুল্লাহ যা বলেছেন, তার ইংরেজি করলে দাঁড়ায়, ‘When a man dies, his good deeds come to an end, except three: Ongoing charity, beneficial knowledge, and a righteous child, who will pray for him’!