পৃথিবীতে বহু ধর্মাবলম্বীর বাস,— খ্রিস্টান, মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, ইহুদি, শিখ ও অন্যান্য। এদের মধ্যে বৌদ্ধদের সংখ্যা সমগ্র বিশ্বে বাহান্ন কোটির ওপর, এবং এটি পৃথিবীতে চতুর্থ বৃহত্তম ধর্ম। এই ধর্মের প্রবক্তা ভগবান বুদ্ধ যিশুখ্রিষ্টের সাড়ে পাঁচশো বছর আগে জন্মেছিলেন, এবং আশি বছর বেঁচেছেন। রাজবংশে জন্মে ছিন্নকন্থাধারী হন, গৃহত্যাগ করে (মহাভিনিষ্ক্রমণ) তপশ্চর্যা করে বোধি লাভ করেন এবং দীর্ঘদিন ভারতময় তাঁর ঐশী বাণী, যা অহিংসা ও মধ্যপন্থা নামে খ্যাত, তা প্রচার করেন। আশি বছর বয়সে কুশিনগরে তাঁর মৃত্যু (মহাপরিনির্বাণ) ঘটে।
বৌদ্ধমতাবলম্বীদের সবচেয়ে প্রিয় ও বড় উৎসব গৌতম বুদ্ধের জন্মদিন বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি পালন। যেমন: হিন্দুদের দুর্গোৎসব ও দোল, মুসলমানদের ঈদুজ্জোহা ঈদ্-উল-আজহা ও ইসলামধর্মের প্রবর্তক হজরত মুহম্মদ রসুলুল্লাহর জন্মদিন ফতেহা দোহাজ দাহাম পালন ইত্যাদি। খ্রিস্টানদের বড়দিন, অর্থাৎ প্রভু যিশুর জন্মোৎসব। বা শিখদের গুরু নানকের জন্মোৎসব পালন।
প্রবারণা উৎসব বৌদ্ধদের দ্বিতীয় বড় উৎসব। এর সঙ্গে যুক্ত তাঁদের আরও একটি উদযাপন, আর তা হল কঠিন চীবরদান। এ-দুটি সম্পর্কে তাই আমাদের অবহিত হওয়া প্রয়োজন। পৃথিবীতে বাস করে নিজ নিজ ধর্ম সম্পর্কে যেমন আমাদের অবহিতি জরুরি, তেমনই অপরাপর ধর্ম নিয়েও। এর মাধ্যমেই আমরা প্রকৃত উদার ও পরধর্মসহিষ্ণু মানুষ হিশেবে গড়ে উঠব।
প্রবারণা উৎসব পালিত হয় আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে। উল্লেখ্য, গৌতম বুদ্ধের জীবনে পূর্ণিমা তিথিটি নানাভাবে যুক্ত হয়ে আছে। তাঁর জন্ম লুম্বিনীর কাছে এক শালতরুতলে, আর বোধিলাভ বুদ্ধগয়ার কাছে উরুবিল্বের অশ্বত্থবৃক্ষের তলায়। এবং তাঁর মহাপরিনির্বাণ কুশীনগরে, আশি বছর বয়সে। এই তিনটি-ই ঘটেছিল বৈশাখী পূর্ণিমায়। আর তাঁর গৃহ ছেড়ে প্রব্রজ্যাগ্রহণ, বৌদ্ধরা যাকে বলে থাকেন মহাভিনিষ্ক্রমণ, তা ঘটে আষাঢ়ী পূর্ণিমায়। প্রবারণা উৎসব হিন্দু সম্প্রদায়ের কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর রাতটির সঙ্গে মিলে যায়।
প্রবাবণা উৎসবে যে চুলামণি আর ফানুস, তার ইতিহাস অতঃপর জানা যাক। বত্রিশ বছর বয়সে গৌতম বোধি লাভের আশায় গৃহত্যাগ করেছিলেন। নিজ অশ্ব কন্ধক তাঁকে বহন করে নিয়ে আসে অনোমা নদীতীরে, নিজ রাজ্যের বাইরে। সারথি ছিলেন ছন্দক, যাঁর হাতে রাজপোশাকটি দিয়ে ছিন্ন কন্থা অঙ্গে ধারণ করেন তিনি। তারপর নিজ তরবারি দিয়ে কেটে ফেলেন নিজের চুল, আর তা ঊর্ধ্বে ছুড়ে দিতে দিতে বললেন, ‘যদি আমার মধ্যে বুদ্ধ হওয়ার মতো গুণাবলি থেকে থাকে, তাহলে আমার চুলের এই গোছা মাটিতে না পড়ে উঠে থাকুক আকাশেই।’ আশ্চর্য, চুল নিম্নায়িত হল না! স্বর্গের রাজা ইন্দ্র সেই কেশ হিরে-মণি-মানিক্য খচিত সোনার পাত্রে তা ধারণ করে ‘তাবতিংস’ স্বর্গে সেই কেশ স্থাপন করে একটি চৈত্য তৈরি করেন। এর নাম ‘চুলামণি চৈত্য।’ কিংবদন্তি আছে, স্বর্গের দেবতারা এখনও এর পুজো করেন। এই পুণ্যময় পূর্ণিমাতিথিতে বুদ্ধ সেই তাবতিংস স্বর্গে নিজ মাতা মায়াদেবীকে অভিধম্মদেশনার পর মর্ত্যে ফিরে আসেন এবং সাংকাশ্য নগরে বাস করতে থাকেন। এই দিনেই তাঁর তাবতিংস স্বর্গ দৃষ্টিগোচর হয়। তিনমাসের গুহাবাসের-ও সমাপ্তি। প্রবারণা উৎসবকে বুদ্ধের এই কাহিনি স্মরণ করে ফানুস ওড়ানো হয়, আকাশের ঊর্ধ্বে উঠে যাতে সেই স্বর্গ দৃষ্টিগোচর হয়। এসময়ে হিন্দুরা যে আকাশপ্রদীপ জ্বালেন সমগ্র কার্তিকমাস জুড়ে, তার পেছনে কি বৌদ্ধ প্রভাব রয়েছে?
প্রবারণা সম্পর্কে জানতে হলে বৌদ্ধধর্মের কয়েকটি তথ্য জেনে নিতে হবে। প্রবারণা কথাটির ব্যাপক অর্থ রয়েছে,— একদিকে তা বোঝায় নিমন্ত্রণ, আহ্বান, অনুরোধ, মিনতি, অন্যদিকে ত্যাগ, নিষেধ, সমাপ্তি। কীসের সমাপ্তি? বুদ্ধের সময়কাল থেকেই বৌদ্ধরা বর্ষার তিনমাস নির্জন গুহায় কাটাতেন। বর্ষাশেষে বহির্গত হতেন, এই গুহাবাসের সমাপ্তির সঙ্গে প্রবারণা শব্দটি অন্বিত। বাকি অর্থগুলো আমরা একে একে বিবেচনা করব।
বর্ষান্তে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা, যাঁরা স্থবির বা থের নামে আখ্যায়িত, বেরিয়ে নানাদিকে ছড়িয়ে পড়তেন, বুদ্ধের অহিংসা, করুণা ও মৈত্রীর বাণী প্রচার করতে। স্বয়ং তথাগত বুদ্ধের এরকম নির্দেশ ছিল। বুদ্ধ স্বয়ং এই দিনে তাঁর শ্রেষ্ঠ ষাটজন শিষ্যকে ‘সনন্তন ধম্ম’ প্রচারের জন্য বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘চরথ্থ ভিকখবে চারিকং, বহুজন হিথায়, বহুজন সুখায়’, অর্থাৎ ‘তোমরা বহুজনের হিত এবং সুখের জন্য চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ো’। দেখা যাচ্ছে, খ্রিস্টান ধর্মযাজক বা মুসলমান পীর-আউলিয়ার পূর্বসূরি ছিলেন এই বৌদ্ধ ভিক্ষুরা, যাঁরা দেশে-দেশান্তরে গিয়ে ধর্মপ্রচার করতেন, ও শিষ্য সংগ্রহ করতেন।
প্রবারণার আগে তিনমাস ধরে বৌদ্ধ স্থবিরেরা একটানা ‘বর্ষবাস’-এ কাটান। এই সময়কাল তাঁদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা এই সময় অতিবাহিত করেন কৃচ্ছ্রসাধন, ধর্মচর্চা ও সংযমের মধ্য দিয়ে। নিজ বিহারেই তখন কাটান তাঁরা, বাইরে বেরোন না। বুদ্ধের সময় থেকেই এ-নিয়ম চলে আসছে। ভগবান বুদ্ধ ছিলেন সর্বজীবে দয়াবান। বর্ষাকালে কীটপতঙ্গের পরিমাণ বেড়ে যায়। তাই এসময় বাইরে গেলে অহেতুক প্রাণীহত্যা হওয়ার আশঙ্কা থেকেই বুদ্ধদেবের এই নিষেধাজ্ঞা, কীটপতঙ্গের অকালমৃত্যু বাঁচাতে!
এ ছাড়াও স্থবিরবর্গ এসময়ে প্রতি অমাবস্যা, পূর্ণিমা ও অষ্টমী তিথিতে অষ্টশীল পালন করেন, বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ও সূত্রপাঠ, ধর্মশ্রবণ ও ধ্যানানুশীলনে রত থাকেন।
এখানে অষ্টশীল সম্পর্কে একটু ধারণা দেওয়া দরকার। অষ্টশীল আর অষ্টাঙ্গিক মার্গ কিন্তু এক নয়, যদিও উভয়ের মধ্যে আপাত মিল আছে। অষ্টশীল হল নিম্নলিখিত দোষাবলি থেকে বিরত থাকা। যেমন:
১. যে-কোনও উচ্চ-নীচ প্রাণীহত্যা থেকে বিরত থাকা, ২. চৌর্যবৃত্তি থেকে বিরত থাকা, ৩. অব্র্হ্মচর্য থেকে বিরতি, ৪. মিথ্যাবাক্য বলা থেকে বিরত থাকা, ৫. মাদকসেবন থেকে বিরত থাকা, ৬. বিকাল-ভোজ থেকে বিরত থাকা, ৭. নৃত্য-গীত-বাদ্য ইত্যাদি প্রমত্তচিত্তে দেখা, মাল্যধারণ, শরীরে সুগন্ধ বিলেপন, মূল্যবান বস্তু, যেমন স্বর্ণালংকার ও মূল্যবান বস্ত্র দিয়ে শরীর সুশোভিত করা থেকে বিরতি। সুস্থ গীতবাদ্য আমোদপ্রমোদকে বর্জন করতে কিন্তু বলা হয়নি। এবং ৮. উচ্চশয্যা ও মহাশয্যা (লেপ-তোষকাদি) থেকে বিরত থাকা। কঠিন সংযমপালন নিঃসন্দেহে। কৌতূহলের বিষয় হচ্ছে, হিন্দুদের কাছে ধর্মের যে পাঁচটি লক্ষণ, তার সঙ্গে বৌদ্ধদের এই অষ্টশীলের মিল আছে, ‘অহিংসা সত্যমস্তেয়ম্’ ইত্যাদি বাক্যে ধর্মের পাঁচটি লক্ষণের যে-কথার কথা বলা হয়েছে, ‘ধর্মস্য পঞ্চ লক্ষণম্’ বলে, তার অন্তর্ভুক্ত হল, সত্য বলা, অহিংস হওয়া, চুরি না করা (‘অস্তেয়’), শরীর পরিচ্ছন্ন রাখা ও অন্যের হিতচিন্তা।
উল্লেখ্য, ত্রিপিটক-এর ‘বিনয়পিটক’-অন্তর্গত অংশে ভগবান বুদ্ধের ‘পাতিমোক্ষ’ বা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ২২৭টি নিয়ম পালনের নির্দেশ আছে। পরবর্তীকালে তার কিছু কিছু সংশোধন ঘটে। এই পিটকের তৃতীয় বিভাগ ‘খন্দক’। এর অন্তর্ভুক্ত ‘বসসুপনায়িকা খন্দক’, অর্থাৎ বর্ষপাল্য স্কন্ধে ভিক্ষুদের বর্ষবাসের সময়, বিধান, যোগ্য ও অযোগ্যস্থান ইত্যাদি বিষয়ে নির্দেশাবলি লভ্য। একে প্রাচীনতম ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক দলিলরূপে বিবেচনার যোগ্য মনে করা যেতে পারে। গোড়ায় ভিক্ষুদের জন্য কিন্তু তিনমাস বর্ষবাসের এই নির্দেশাবলি ছিল না। বর্ষায় ভিক্ষুদের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে অন্নব্যঞ্জন গ্রহণে কৃষকদের ক্ষতি হত,— নতুন রোপিত চারার ওপর দিয়ে তাঁরা যাতায়াত করলে ফসলের ক্ষতি রোধ করা যেত না। কৃষকরা বুদ্ধের কাছে অভিযোগ জানালে বুদ্ধ এর প্রতিবিধানকল্পে ভিক্ষুদের বর্ষবাসের নির্দেশ দেন। আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে। দিনটি তিন তিনটি কারণে বৌদ্ধদের কাছে স্মরণীয়। ওইদিন তিনি মাতৃগর্ভে প্রবেশ করেছিলেন (মাতৃগর্ভে প্রতিসন্ধি)। তাছাড়া এর দীর্ঘদিন পরে মহামতি অশোকের পুত্র মহেন্দ্র সিংহলে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতে গিয়ে প্রয়াত হন। তৃতীয় কারণ, বর্ষবাস— সূচনার দিন।
প্রবর্তনার ব্যাপ্তি ও অনুষ্ঠান-পালন
আগেই বলা হয়েছে, উৎসবটি বৌদ্ধধর্মের গোড়া থেকেই যাপিত হয়ে আসছে, ভারতে ও বিশ্বের যেসব দেশে বৃহৎ সংখ্যক বৌদ্ধের বাস, যেমন মায়ানমার, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, চিন, জাপান, নেপালে। মূলত একদিনের পার্বণ হলেও অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি ও অনুষ্ঠান-পরবর্তী উৎসবের মেজাজ শেষ হতে আরও কয়েকদিন লাগে। প্রবারণা-পরবর্তী একমাসের যেকোনও দিন পালিত হয় কঠিন চীবরদান কৃত্য। সেটিও কম আনন্দদায়ী এবং কম উদযাপ্য নয়।
একদা ভারত তথা এই উপমহাদেশে ব্যাপ্ত ছিল বৌদ্ধধর্ম। বিহার তথা বৌদ্ধ স্থবির ও শ্রমণদের জন্য কখনও রাজপৃষ্ঠপোষকতায়, কখনও বণিকদের দানে, আবার কখনও বা সাধারণ মানুষের আনুকূল্যে গড়ে উঠেছিল রাজগীর, নালন্দা, বেনারস, রাজশাহী থেকে তক্ষশিলা পর্যন্ত জনপদ। মিনান্দার থেকে অশোক, বিম্বিসার, কনিষ্ক থেকে ধর্মপাল ছিলেন বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক। তা থেকে প্রবারণা উৎসবের ব্যাপ্তি ও রমরমা উপলব্ধি করা যাবে। আফগানিস্তান, তুরস্ক, ইরান ইত্যাদি স্থানেও বৌদ্ধধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল। হিউ এন সাঙ, ইৎ সিং এবং ফা হিয়েনের লেখায় এসবের বিবরণী পাওয়া যায়।
উল্লেখ্য, বিহার ও বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কিন্তু ঠিক এক নয়, যদিও বিহারগুলিতেও পাঠদানের ব্যবস্থা থাকত। অধুনা পশ্চিম বাংলায় রক্তমৃত্তিকা বিহার, জেতবন বিহার ইত্যাদি বহু নামকরা বিহারের অস্তিত্ব জানি আমরা। বাংলাদেশেও ছিল এবং এখনও আছে। ঢাকাতে ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহার, কুমিল্লায় কনকস্তূপ বিহার, চট্টগ্রামে নন্দনকানন বিহার, পটিয়ায় লঙ্কারাম বিহার, বান্দারবনে রাজবিহার, রাঙামাটিতে বনবিহার, কক্সবাজারে অগ্গমেধা বিহার এগুলির অন্যতম। বাংলাদেশেই ছোটবড় প্রায় তিন হাজার এরকম বিহার রয়েছে। তাহলে ভারতে বিহারের সংখ্যা কত, তা সহজেই অনুমেয়। একদা এই উপমহাদেশ অহিংস বৌদ্ধধর্মে ছেয়ে গিয়েছিল। এর অবশ্য একটি কুফল রয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছেন, এজন্যই এদেশ বারবার বিদেশীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল।
প্রবারণা থেরবাদীদের যাপন। এটি প্রাচীনতম বৌদ্ধ মতবাদ। ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, চীন, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দেশে এর প্রসার। ত্রিপিটকে বর্ণিত আদি ও মৌলিক ধর্মাচার থেরবাদ নামে প্রসিদ্ধ।
এর তিনটি স্তর শনাক্তকরণযোগ্য। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতক হল প্রথম স্তর। পূর্ণাঙ্গ থেরবাদের যুগ এটা। প্রথম থেকে সপ্তম শতক দ্বিতীয় স্তর, আর অষ্টম থেকে দ্বাদশ অবধি তৃতীয়। দ্বিতীয় স্তরে মহাযানপন্থার উদ্ভব ও বিকাশ, আর অন্তিমস্তরে বজ্রযান, সহজযান ইত্যাদি। বাংলাদেশের উপজাতিকুলের বিরাট এক থেরবাদী বৌদ্ধ। বাংলাদেশের বৃহত্তম নৃগোষ্ঠী চাকমা। তাঁরা বৌদ্ধ। বাংলাদেশে এঁদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ, যেখানে ভারতে তাঁদের সংখ্যা দুলাখ আঠাশ হাজার।
সে যাই হোক, আজকের দিনে প্রবারণা মূলত বৌদ্ধদের মিলন উৎসব। তাই সকাল থেকেই কী কলকাতার মহাবোধি সোসাইটি, কী হাটহাজারির জোবরা সুগত বিহার, কী চার প্রধান বৌদ্ধতীর্থ লুম্বিনী, বুদ্ধগয়া, সারনাথ এবং কুশীনগরে, সর্বত্র আনন্দের জোয়ার বয়ে যায় দিনটিকে ঘিরে। বুদ্ধের মৈত্রী, সম্প্রীতি ও শান্তির বার্তা প্রচারিত হয় সর্বত্র। বৌদ্ধদের জীবনাদর্শ হল আদি, মধ্য ও অন্তে কল্যাণ। এই পরম বার্তা বিকশিত হয় বিহারে, সঙ্ঘারামে, বৌদ্ধদের গৃহে গৃহে।
অনুষ্ঠান এখন ব্যাপক। পালিত হয় পঞ্চশীল, পিণ্ডদান, ক্ষমাপ্রার্থনা, রথটানা ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতা। সন্ধ্যায় ফানুস ওড়ানো হয়, যা বিগত তিনমাস ধরে বহু যুবক, বয়স্ক ও কারিগর মিলে তৈরি করেছেন। এ-জিনিশ কেবল যে এই উপমহাদেশেই হয় তা নয়, ফানুসের ঐতিহ্য চীন-জাপান-মায়ানমার-থাইল্যান্ড-শ্রীলঙ্কা জুড়ে। তৎসহ আতসবাজি। সেইসঙ্গে পরিবেশিত হয় এদিনের উপযুক্ত বিশেষ গান ও কবিতা। হয় ডাব্য খেলা। উপন্যাসকার বরেন্দ্রলাল ত্রিপুরার ‘সোনালী ঊষা ধূসর গোধূলি’ উপন্যাসে রাঙামাটির (পার্বত্য চট্টগ্রাম) প্রবারণা, ও তার অনুষঙ্গে জনজীবনের আনন্দমুখরতার কথা বিধৃত হয়ে আছে।
বিশ্বের বহু দেশেই এই উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়। স্পেন ও ফ্রান্স-সহ ইয়োরোপীয় দেশে চীনা, জাপানি, বাঙালি বৌদ্ধরা পালন করেন যেমন, তেমনই বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি থেকে কুয়াকাটা-কলাপাড়া এই উৎসবে মেতে ওঠে। ইওরোপীয়দের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েকবছর আগে দালাই লামা যেবার শিলিগুড়িতে তাঁর বার্ষিক অনুষ্ঠান করলেন, সেবার প্যারিস থেকে আগত বেশ কিছু ফরাসির সঙ্গে আলাপ হয়, যাঁরা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত। তাঁদের কাছেই শুনেছিলাম, ফ্রান্সে বহু মানুষ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে রসিকতা না করে পারিনি: অবশেষে নেপোলিয়নের দেশে বৌদ্ধধর্মের জয়!
জয় তো বটেই! বুদ্ধের জন্ম, মহাভিনিষ্ক্রমণ আর মহাপরিনির্বাণের দিন বৈশাখী পূর্ণিমাকে কি না হলে ১৯৯৯ থেকে রাষ্ট্রসংঘ আন্তর্জাতিক ছুটির দিন (International Holiday) ঘোষণা করে? তার বেশ কিছুকাল আগেই, ১৯৫০-এ ‘The World Fellowship of Buddhists’ দিনটিকে ওই সম্মান দিয়েছিল। আন্তর্জাতিকভাবে দিনটিকে বলা হয় ‘VESAK’.
জন্মমৃত্যুবোধিলাভ, এক-ই মাসের এক তিথিতে! এ কি প্রমাণিত, না কিংবদন্তি? প্রমাণ আছে। শ্রীলঙ্কা থেকে প্রাপ্ত ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘মহাবংশ’-তে এর ঐতিহাসিককতা লিখিত আকারে আছে। তাছাড়া পর্যটক ও চিত্রশিল্পী ফা হিয়েন কর্তৃক-ও তারিখটি সমর্থিত, তাঁর ভ্রমণকাহিনি মোতাবেক। পৃথিবীতে বেশ কিছু মহাপুরুষের জন্মদিন-মৃত্যুদিন ‘একাসনে দহে মিলিয়াছে’, যেমন হজরত মুহম্মদ রসুলুল্লাহ্, যেমন শেকসপিয়ার। বুদ্ধদেবে মিলল তিনটে।
বাংলাদেশের চাকমা ও মারমা, এই দুই বৌদ্ধ নৃগোষ্ঠী সম্পর্কে এবার কিছু লিখি। বাংলাদেশে নৃগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমারা জনসংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ। ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা, অরুণাচল ও আসাম মিলিয়ে তাঁদের সংখ্যা সওয়া দুলাখের মতো। যাই হোক, ধর্মে এঁরা বৌদ্ধ। কেউ কেউ খ্রিস্টান। প্রবারণার দিনটি এঁদের বিরাট আনন্দের দিন। বাংলাদেশের রাঙামাটিতেই এঁরা মূলত বাস করলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের বহু জেলা-উপজেলাসহ নানা জায়গায় ছড়িয়েছিটিয়ে আছেন এঁরা। রাঙামাটির রাজবন বিহার মেতে ওঠে এইদিন। লোকমুখে ফেরে তাদের দরদী কণ্ঠের গান, ‘আমরা নাকি বৌদ্ধ জাতি,/ সবাই বলে সরলমতি/ অহিংসার নামটি ধরে/ জ্বালাই শুধু মোমের বাতি’! বাংলাদেশের সুবিখ্যাত শিল্পী নিশীতা বড়ুয়ার কণ্ঠে প্রবারণার গান না শুনলে দিনটি সর্বার্থসার্থক হয় না, ‘দেখো তো আকাশে ওড়ে কতো রঙের ফানুস,/ বুদ্ধকে পূজা করি সে যে ব্রত আমার!’
তাছাড়া ফাল্গুনী বড়ুয়া, ঈশানী বড়ুয়া, এঁরা এবং আরও অনেকেই প্রবারণার গান দিয়ে দিনটিকে শান্ত, স্নিগ্ধ ও নান্দনিক করে তোলেন।
শেষ কথা
অথচ বিগত আড়াই হাজার বছর ধরেই তো আমরা বুদ্ধকে সরিয়ে আত্মঘাতী হয়েছি বারম্বার। তিনি বলেছিলেন, ‘আত্মদীপো ভব’, অনেকটা সক্রেটিসীয় ভাষা, ‘Know thyself’. আর আমরা যুদ্ধ, মন্বন্তর, হিংসা, আত্মকলহে বিক্ষত করেছি পৃথিবী, চেঙ্গিস-তৈমুর-হিটলার-পল পটের মাধ্যমে! সাম্প্রতিক ইতিহাসে কয়েক দশক আগে চীন যে তিব্বতের বৌদ্ধ মন্দির আর স্থাপত্য শেষ করে দিল, বাংলায় সেন আমলে বৌদ্ধদের ওপর নির্মম অত্যাচার ও নিপীড়নের মাধ্যমে তাদের বহু লোককে দেশান্তরী করা, বামিয়ান বুদ্ধ ধ্বংস, তা যে অশোক, ধর্মপাল, মিনান্দারকে লজ্জা দিচ্ছে! ভারত পরমাণু বোমার পরীক্ষা চালায়, আর তার সাফল্যকে বলে ‘Buddha smiles’! ১৯৩৭-এ জাপান যখন চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবার আগে বুদ্ধের সামনে জয়ের জন্য প্রার্থনায় বসে, তখন তীব্র ঘৃণায় রবীন্দ্রনাথ জাপানের উদ্দেশে লেখেন, ‘ওরা শক্তির বাণ মারছে চীনকে, ভক্তির বাণ বুদ্ধকে’!
রবীন্দ্রনাথ-ই আমাদের শেষ আশ্রয়, বুদ্ধ ও প্রবারণার আলোচনায়। তাই তাঁর ‘জন্মদিনে’ কাব্যগ্রন্থের পাঁচনম্বর কবিতাটি স্মরণ করা যাক:
এ ধারায় জন্ম নিয়ে যে মহামানব
সব মানবের জন্ম সার্থক করেছে একদিন,
মানুষের জন্মক্ষণ হতে
নারায়ণী এ ধরণী
যাঁর আবির্ভাব লাগি অপেক্ষা করেছে বহু যুগ,
যাঁহাতে প্রত্যক্ষ হল ধরায় সৃষ্টির অভিপ্রায়,
শুভক্ষণে পুণ্যমন্ত্রে
তাঁহারে স্মরণ করি জানিলাম মনে–
প্রবেশি মানবলোকে আশি বর্ষ আগে
এই মহাপুরুষের পুণ্যভাগী হয়েছি আমিও।
( মংপু, বৈশাখ, ১৩৪৭)।