‘তালগাছের আড়াই হাত’! এমনই অবস্থা বিশ্বজুড়ে পোলিয়ো নির্মূলকরণ কর্মসূচির। উল্লেখিত প্রবাদের সার হল, গোটা তালগাছ উজিয়ে শীর্ষদেশে চড়ার মুখেই সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়। পোলিয়ো-মুক্ত পৃথিবীর স্বপ্নও এখন আটকে আছে ওই তালগাছের আড়াই হাতে গিয়ে। সৌজন্যে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। ভারতীয় উপমহাদেশের এই দুই দেশে আজও পোলিয়ো নামক মারাত্মক ভাইরাসটি নিকেশ করা যায়নি। তবে ইউনিসেফ এবং ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (হু)-এর লেগে থাকার সুবাদে দেশ দু’টিতে পোলিয়ো-সন্ত্রাসী জীবাণুরা রীতিমত কোণঠাসা অবস্থায় ছিল। কিন্তু করোনা অতিমহামারী ও তজ্জনিত বিধিনিষেধ এবং আফগানিস্তানের শাসনক্ষমতার নাটকীয় পালাবদলের ঘটনা গোটা প্রচেষ্টায় জল ঢেলে দিয়েছে।
কী এই পোলিয়ো? এই বিপজ্জনক রোগটি একসময় মহামারীর আকার ধারণ করে। গোটা দুনিয়ায় অসংখ্য শিশু পঙ্গুত্বের শিকার হয়। দরিদ্র দেশগুলিতে অপুষ্টিজনিত কারণে এর প্রাদুর্ভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। পাঁচবছরের কম বয়সী শিশুরা এই রোগে আক্রান্ত হতে থাকে। বেশিরভাগ শিশুর পা পোলিয়ো ভাইরাসের প্রভাবে প্যারালাইসড হয়ে পড়ে। আবার আক্রান্তদের প্রায় দশ শতাংশ শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগে মারা যায়। পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে বিশ্বব্যাপী একযোগে পোলিয়ো টিকাকরণ কর্মসূচি নেওয়া হয়। সরকারি ও অসরকারি অর্থানুকূল্যে নিখরচায় এবং কার্যত ঘরে বসে পাওয়া এই পোলিয়ো টিকা প্রথমে পাঁচবছর বয়স পর্যন্ত সব শিশুকে একযোগে দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না একটি বিশেষ ধর্মীয় শিবিরের নেতৃত্বের অপপ্রচারের ফলে। পরে অবশ্য ধীরে ধীরে বাধা অনেকটাই কেটে যায়। তবে কয়েকটি দেশের দায়সারা স্বাস্থ্যনীতি এবং অস্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন ব্যবস্থা বিশ্বের পোলিয়ো-মুক্তির চেষ্টায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। হাল ছাড়েনি ইউনিসেফ এবং ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন। ফলও মিলেছে হাতেনাতে।
জানা গিয়েছে, ১৯৮৮-তে যেখানে ৩৫০০০০ জন পোলিয়ো আক্রান্ত ছিল, সেখানে বর্তমান সংখ্যা মোটে ২০০-রও কম। যেখানে পৃথিবীর ৫ মহাদেশের ১২৫টি দেশে এর প্রকোপ ছিল, সেখানে এখন মাত্র ২টি দেশেই বিদ্যমান। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন জানিয়েছে, তাদের লক্ষ্য একটা পোলিয়ো-বিহীন বসুন্ধরা। ইতিমধ্যেই ‘ওয়াইল্ড পোলিয়োভাইরাস’ নামে তিনটি কুখ্যাত ভাইরাসের দু’টিকে নির্বংশ করা গিয়েছে। শেষ তিন দশকে ওয়াইন্ড পোলিয়োভাইরাস সংক্রমণ কমানো গিয়েছে ৯৯.৯ শতাংশ। ২৭ মার্চ ২০১৪-তেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে পোলিয়ো-মুক্ত ঘোষণা করেছিল ‘হু’। ভারতে ২০১১-র পর নতুন করে আর কেউ পোলিও আক্রান্ত হয়নি। ২০১৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভারতকে ‘পোলিও-এন্ডেমিক’ দেশগুলির তালিকা থেকে সরিয়ে দেয়।
কীভাবে সম্ভব হয়েছে এই অসাধ্যসাধন? না, গোটা বিশ্ব একজোট হয়েছে বলে। শিশুদের অভিভাবক, স্বেচ্ছাসেবী থেকে রাষ্ট্র বা সরকার, জনগোষ্ঠীর নেতৃত্ব থেকে রাষ্ট্রসংঘ— পঙ্গুত্ব বয়ে আনা এই চরম সংক্রামক অসুখটিকে ঝাড়ে বংশে বিনাশ করতে সক্রিয়তা দেখিয়েছে বলে। কিন্তু তীরে এসেও তরী ডুবল যে! আশার বাণী শুনিয়েছেন হু-র স্বাস্থ্য আধিকারিকরা, নতুন করে পোলিয়ো টিকাকরণ অভিযান চালানো হচ্ছে। সবাই একজোট হলে দ্রুত ধরিত্রী থেকে চিরতরে মুছে যাবে পোলিয়োভাইরাস। সে-দিন হয়তো খুব দূরে নয়, যে-দিন ‘পোলিয়ো’ শব্দটা থাকবে শুধু মানুষের দুঃস্বপ্নের ইতিহাসে। পোলিয়ো দূরীকরণ প্রকল্পে নিয়োজিত সর্বস্তরের মানুষের হাত ধরে আসা এই সাফল্যকে ‘মানবসমাজের ঐতিহাসিক অর্জন’ বলে লেখা হবে।


সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি
সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব্যথিত গতি নিয়ে।