সম্প্রতি প্রয়াত গল্পকার-ঔপন্যাসিক প্রফুল্ল রায় (০১.০১.১৯৩৪-১৯.০৬.২০২৫) উপমহাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর সময়ের ধারাভাষ্যকার। সময়টা মন্বন্তর-ভারত ছাড়ো আন্দোলন-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-দাঙ্গা-দেশভাগ-মেদিনীপুরের বন্যা ও স্বাধীন তাম্রলিপ্ত সরকার, ঘটনার জটাজাল ও টানাপোড়েনে এক ক্রান্তিলগ্নে। লক্ষ লক্ষ মানুষকে গৃহচ্যুত হতে হয়েছে সাতচল্লিশের স্বাধীনতা অর্জনের ট্র্যাজিক দক্ষিণা দিতে গিয়ে। পৃথিবীর বৃহত্তম এক্সোডাস!
প্রফুল্ল রায় জন্মেছেন অবিভক্ত ভারতের ঢাকার বিক্রমপুরে। কৈশোর পেরোনো পর্যন্ত তাঁর কেটেছে পদ্মাপারের ওই ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যশালী শহরে, যে বিক্রমপুরের আছে একটি বিরাট মেধাতালিকা, সেযুগের অতীশ দীপঙ্কর থেকে পরবর্তীকালের চিত্তরঞ্জন দাস, জগদীশচন্দ্র বসু, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ১৯০৮-এর অলিন্দ যুদ্ধের তিন নায়ক, বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত, এঁরা সবাই বিক্রমপুরের। বাংলাদেশের জাতীয় সৌধের স্থপতি সৈয়দ মইনুল হোসেন, বিখ্যাত সাঁতারু ব্রজেন দাস, চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম প্রমুখ। হুমায়ুন আজাদ, ইমদাদুল হক মিলন।
প্রফুল্ল রায় নাকি অতীশ দীপঙ্করের বংশের। দেশভাগের অভিশাপেই দেশছাড়া হতে হয় তাঁকে, ১৯৫০-এ। একটা বিধুর বিষয় আমরা লক্ষ্য না করে পারি না। দেশভাগ সুনীল-শ্যামল-মহাশ্বেতা-শীর্ষেন্দু-অতীনদের কেবল ভূমিচ্যুত করেই ছাড়ল না, এমনকি তাঁদের কারুবাসনাকেও অন্যতর রূপ দেওয়ালো। দেশভাগ না হলে আমরা সুনীলের হাতে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, শীর্ষেন্দুর ‘দূরবীণ’ বা প্রফুল্ল রায়ের ‘পূর্বপার্বতী’ পেতাম না, যেমন পেতাম না শওকত ওসমানের ‘কর্ণফুলি’ বা হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি।’ জনবিন্যাস কেবল স্থানান্তরিত করে ছাড়েনি মানুষকে, তার চিন্তাচেতনার উত্তরমেরুকে পর্যন্ত দক্ষিণমেরুতে নিয়ে গেছে। এ যেন শুক্রগ্রহের মত ব্যাপার, যে গ্রহটি অন্য কোনও গ্রহের প্রবল ধাক্কায় তার আহ্নিকগতি অন্যান্য সব গ্রহের বিপরীমুখী করে ফেলেছে।
‘কেয়াপাতার নৌকো’ উপন্যাসটি প্রফুল্ল রায়ের সমগ্র সৃষ্টিকর্মের মধ্যবর্তীতে স্থান পেতে পারে। এমন নয় যে তিনি এ উপন্যাসটি ছাড়া আর কোনও ভাল উপন্যাস লেখেননি, কিন্তু প্রফুল্ল রায় ও এই উপন্যাসটি যেন তুল্যমূল্য হয়ে গিয়েছে। তাঁর শ্রদ্ধেয় লেখক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁকে এটি লিখতে উদ্বুদ্ধ করেন, যখন প্রফুল্ল রায় তাঁকেই দেশভাগের ওপর উপন্যাস লিখতে বলেছিলেন। ‘দেশভাগ আমার স্মৃতিতে আছে, অনুভবে নেই’, বলেছিলেন তাঁকে প্রবীণ নারায়ণ, ‘সুতরাং আমার পক্ষে এই নিয়ে বড়ো উপন্যাস লেখা সম্ভব নয়। অনুভবে না থাকলে কেবল স্মৃতি দিয়ে বড়ো কাজ করা যায় না। বরং আমি লক্ষ্য করেছি, তোমার স্মৃতি এবং অনুভবে অনেক বড়োভাবে আছে দেশভাগ। তুমি বরং শুরু কর’। শুরু করলেন। আর সংবাদটি যখন তখনকার সাপ্তাহিক ‘অমৃত’ পত্রিকার সম্পাদক মণীন্দ্র রায়ের কানে গেল, তিনি তাড়া দিয়ে শেষ করালেন, ছাপলেন স্ব-সম্পাদিত পত্রিকায়। এই হল উপন্যাসটির জয়যাত্রার সূচনা। তারপর বইটি পুস্তকাকারে ছাপা হয়ে বেরিয়েছে, পাঠকনন্দিত হয়েছে, টিভিতে ধারাবাহিক প্রচারিত হয়েছে, পুরস্কৃতও হয়েছে।
দেশভাগ নিয়ে বাংলা ও উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষায় লেখা হয়েছে অসংখ্য ছোটগল্প, আর এ নিয়ে উপন্যাসের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। খুশবন্ত সিং লেখেন ‘A Road to Pakistan, ভীষ্ম সাহানী ‘তমস’। আছে সাদাত হেসেন মান্টোর ‘টোবা টেক সিং’-এর মত হৃদয়বিদারী কিছু গল্প। বাংলায় দেশভাগ নিয়ে প্রথমতম উপন্যাসটি লিখলেন এক নারী,– জ্যোতির্ময়ী দেবী। তা-ও তাঁর ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’ বেরোবার অবকাশ ঘটে দেশভাগের কুড়ি বছর পর, ১৯৬৭-তে। আবুল ফজলের ‘রাঙাপ্রভাত’, হাসান আজিজুল হকের ‘সাবিত্রী উপাখ্যন’ ও ‘শিউলি’, সেলিনা হোসেনের ‘গায়ত্রীসন্ধ্যা’, হুমায়ুন আহমেদের ‘মধ্যাহ্ন’, মাহমুদুল হকের ‘কালো বরফ’, শহীদুল্লাহ্ কায়সারের ‘সংশপ্তক’, তানভীর মোকাম্মেলের ‘দুই নগর’, রাজিয়া খানের ‘বটতলার উপন্যাস’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতার স্বাদ’, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্বপশ্চিম’, মিহির সেনগুপ্তের ‘বিষাদবৃক্ষ’, এমন আরও। কিন্তু প্রফুল্ল রায় ও পাশাপাশি অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসদুটি ভাষার মায়াবী গ্রন্থনায়, চরিত্রচিত্রণ ও পরিবেশ নির্মাণে, বেদনার বৈভব আর হাহাকারের মরুময়তায় আমাদের কাছে অনন্য মাত্রা এনে দেয়। দেশভাগ নিয়ে শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতার ভগ্নাংশে পাই, ‘ভাঙা বাক্স পড়ে থাকে আমগাছের ছায়ায়’! এটুকু কথায় দেশভাগের যে বিনাশী রূপ চিহ্নিত, প্রফুল্ল রায়ের উপন্যাসটি তার-ই বৃহৎ ভাষ্য যেন, যেন মহাভারতের এ সময়কার মহাপ্রস্থানপর্ব!
দেশভাগ নিয়ে নানান মানুষের নানান প্রতিক্রিয়া। ঊর্বশী বুটালিয়া ও ঋতু মেনন ‘The Other Side of Partition-এ তাকে একভাবে বিশ্লেষণ করেন, ঋত্বিক ঘটক এবং নিমাই ঘোষ (‘ছিন্নমূল’) তাঁদের চলচ্চিত্রে আর একভাবে। গানে-কবিতায় আর একভাবে। আবার আয়েশা জালাল, শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়া চ্যাটার্জীর গবেষণামূলক কাজ আলাদা মাত্রার। দেশভাগের ওপর লেখা হচ্ছে ও হবে। প্রফুল্ল রায় দেশভাগ নিয়ে কিন্তু ট্রিলজি উপন্যাস লেখেন। আর দুটি হল ‘শতধারায় বয়ে যায়’ (২০০৬) ও ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’ (২০১৪)। উল্লেখ্য, ‘কেয়াপাতার নৌকো’-র জন্য তিনি দশ লাখ ভারতীয় টাকা অর্থমূল্যের সুরমা চৌধুরী পুরস্কার পান যেবার, সেবছর তাঁর সঙ্গে যাঁরা ওই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন, তাঁদের অন্যতম হলেন বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন (তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘নূরজাহান’-এর জন্য।) মিলন তাঁর জন্মভূমি বিক্রমপুরেরই লোক। আশ্চর্য সমাপতন! বয়সের বিভেদ সত্বেও দুজনের সঙ্গে সখ্য ছিলো। প্রফুল্ল রায়ের ঝুলিতে পুরস্কার অনেক,– দিল্লির সাহিত্য অকাদেমি, পশ্চিমবঙ্গের বঙ্কিম পুরস্কার। তাছাড়া ভুয়ালকা, মতিলাল।
তাঁর পাঠকগোষ্ঠী নানা ধরনের। জনপ্রিয় পত্রপত্রিকায় নিয়মিত তাঁর লেখা বেরোত যেমন, ঠিক তেমনি নির্মাল্য আচার্য ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যুগ্ম-সম্পাদিত ‘এক্ষণ’-এও তাঁকে ঔপন্যাসিক হিশেবে পাই। যেমন উপন্যাস, তেমনি ছোটগল্পের-ও তিনি সুনিপুণ নির্মাতা। তাঁর ছোটগল্পগুলোর বিষয়বস্তু কখনো প্রান্তিক মানুষকে নিয়ে, কখনো আবার মানুষের বিচিত্র আর স্ববিরোধী সত্তা নিয়ে। গল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো সাতঘরিয়া, শনিচারীর ইচ্ছাপূরণ, চুনাও, ভোর, মানুষ, কার্তিকের ঝড় ইত্যাদি। আর যেসমস্ত উপন্যাস তাঁকে অমর করে রাখবে, সে তালিকায় আগে আলোচিত উপন্যাসগুলি ছাড়াও আছে ‘যুদ্ধযাত্রা’, ‘নোনা জল মিঠে মাটি’, ‘আমাকে দেখুন’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ‘মহাযুদ্ধের ঘোড়া’, ‘সম্পর্ক’, ‘অদিতির উপাখ্যান’ ইত্যাদি।
তাঁর লেখা বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে বলে তাঁর একটি সর্বভারতীয় পরিচয় রয়েছে। তাছাড়া বেশ কিছু সিনেমা তাঁর কাহিনি নিয়ে নির্মিত হয়ে তাঁকে খ্যাতিমান করে তোলার সহায়ক হয়েছে। বীরেশ চট্টোপাধ্যায় করেছেন ‘মোহানার দিকে’, তপন সিনহা হিন্দিতে ‘আদমী আউর আউরত’। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তাঁর দুটি কাহিনিকে চলচ্চিত্রায়িত করেছেন, ‘চরাচর’, ও ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’। তরুণ মজুমদার বানিয়েছেন ‘এখানে পিঞ্জর’, যে ছবিতে অপর্ণা সেন ও উত্তমকুমার অভিনয় করেন। শোনা যায়, এই প্রথম একজন লেখকের ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে উত্তম নাকি প্রফুল্ল রায়ের কাছে বারবার যেতেন তাঁর মত করে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা শিখতে। উত্তমকুমার ‘বাঘবন্দী খেলা’-তেও অভিনয় করেন, যেটিও প্রফুল্ল রায়ের কাহিনি অবলম্বনে চিত্রায়িত। ছবিটির পরিচালক পীযূষ বসু। আর তাঁকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র বানিয়েছেন পরিচালক গৌতম ঘোষ। প্রফুল্ল রায়ের প্রয়াণে তাঁর-ই সমসাময়িক লেখক-বন্ধু শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছেন, তিনি ‘জীবনমুখী, ভ্রাম্যমান একজন সত্যিকারের ভালো মানুষ ছিলেন’। একটি পত্রিকা, ‘গল্পসরণি’, প্রফুল্ল রায়ের ওপর একটি বিশেষ সংখ্যা বের করেছে, যেখানে তাঁর সম্পর্কে বহু তথ্য জানা যায়। স্ত্রী গত হয়েছিলেন আগেই। মৃত্যুকালে তিনি রেখে গেলেন দুই কন্যাকে।
ডায়াস্পোরা শব্দটি আজকাল সাহিত্য, ইতিহাস ও রাজনীতির ক্ষেত্রে বহুব্যবহৃত শব্দ। তাত্ত্বিকভাবে এর সংজ্ঞা দেওয়া হয় ব্যাপকভাবে। প্রাচীন ইহুদীদের যে স্বরাষ্ট্র থেকে বহির্গমন, দাস ব্যবসায়ের জন্য আফ্রিকার লাখ লাখ মানুষকে আমেরিকায় নিয়ে আসা, বা শিক্ষা, চাকরি এবং ব্যবসার কাজে বিভিন্ন দেশের মানুষের দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়া, এ সব-ই ডায়াস্পোরার অন্তর্ভুক্ত। আবার লেখক-শিল্পীদের রাজনৈতিক কারণে অন্য দেশে অভিবাসিত হওয়া, তাকেও এই শিরোনাম দেওয়া যায়। ওভিদ থেকে ব্রেখট, চার্লি চ্যাপলিন থেকে সলঝেনিতসিন, সকলেই ডায়াস্পোরার বেদনাহত সন্তান। দেশভাগে বিড়ম্বিত মানুষ-ও, তা সে কোরিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ, যেখানকার-ই হোক। তাই তাদের বেদনার বৈভব ফুটে ওঠে শিল্পীর রেখায়, গায়কের গানের কাজরীগাথায়, কবির মরমী পঙক্তিতে, কথাকারের কর্কশ কেকাধ্বনিতে। কখনও কখনও তা জটিল ও রহস্যময়। ব্রেখটকে নাৎসি জার্মানি ছেড়ে আমেরিকায় আশ্রয় নিতে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে তিনি ফিরে এলেন বার্লিনে। হায়! মেলাতে পারেননি তিনি তাঁর পূর্বের স্বদেশকে! এ আরও এক ডায়াস্পোরার ট্র্যাজেডি। না, প্রফুল্ল রায়, শওকত ওসমান, হাসান আজিজুল হক বা ঋত্বিককে এই বিধুরতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি। তাঁরা কেবল নীলকন্ঠ পাখি-হারানোর এটলাস বুকে বহন করে বেঁচেছেন, আর তাঁদের কারুবাসনায় খুঁজতে চেষ্টা করেছেন ‘এ আমার, এ তোমার পাপ’-এর গূঢ়ার্থ।