মনে করা হয় পলাশী যুদ্ধের পর থেকেই কলকাতার নগরায়ন শুরু হয়েছিল। তখন কোনও সংবাদপত্র তো দূরের কথা, ছাপার যন্ত্রের কথাও মানুষের কল্পনায় ছিল না। ১৭১০ সালে কলকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানুটি নামের যে তিনটি গণ্ডগ্রাম নিয়ে কলকাতা নগরী ছিল— সাকুল্যে সেটির লোকসংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার। ১৭৪০-৫০ সময়কালে বাংলার গ্রামে গ্রামে মারাঠা বর্গী হামলার ফলে আতঙ্কিত বহু মানুষ নিরাপত্তার জন্য কলকাতায় বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। এরপর থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও নানা কারণে কলকাতার লোকসংখ্যা ক্রমে বাড়তে শুরু করেছিল। দেখতে দেখতে কলকাতা নিজের গ্রামীণরূপ থেকে শহরে পরিণত হচ্ছিল। ১৭৫২ সালে হলওয়েল সাহেবের হিসেবমত কলকাতার লোকসংখ্যা প্রায় চার লক্ষ ন’হাজারের কাছাকাছি ছিল। একটা আধুনিক শহরের সমস্ত কদর্যতাকে সঙ্গে নিয়েই নগর কলকাতার ক্রমবিকাশ চলমান, আর ব্রিটিশ শাসনের হাত ধরেই এদেশে বারাঙ্গনাবৃত্তির উদ্ভব ঘটেছিল। তৎকালীন সমাজের শুধু নিম্নবর্গের নারীরাই নন, কুলীন ঘরের বহু নারীও তখন অবস্থার দুর্বিপাকে পড়ে বারাঙ্গনাপল্লিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সমকালীন সরকারি প্রতিবেদনে একথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল যে, হিন্দু বিধবাদের বারাঙ্গনাপল্লিতে আশ্রয় নেওয়াই সেই সময়ে বারাঙ্গনাদের সংখ্যাবৃদ্ধির একটা কারণ ছিল। তখনও পর্যন্ত বিধবাবিবাহ প্রথা চালু না হওয়ার ফলে বারাঙ্গনাপল্লিগুলিই পুরুষের লালসার শিকার হওয়া বিধবা তরুণীদের শেষ আশ্রয় হয়ে উঠেছিল। এই প্রসঙ্গে সেযুগের একটি সরকারি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল— “হিন্দুর বিবাহ-বিচ্ছেদ নেই, বিধবা হলে হয় পবিত্র হও, নচেৎ বেশ্যা হও।”
বাংলা থিয়েটারের তখন সবে শৈশবকাল ছিল। ১৮৭২ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখে কলকাতায় ন্যাশনাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়েই সাধারণ মানুষের জন্য রঙ্গালয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল। সেযুগের কলকাতার ধনকুবের আশুতোষ দেবের (ছাতুবাবু) দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ নাম দিয়ে একটি থিয়েটার খুলেছিলেন এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তকে তাঁদের থিয়েটারের জন্য দুটি নাটক লিখে দিতে অনুরোধ করেছিলেন। মধুসূদন যে শর্তে সেই কাজটি করতে সম্মত হয়েছিলেন, সেটা ছিল যে, তাঁর নাটকের স্ত্রী-চরিত্রের রূপায়ণ মেয়েদের দিয়েই করাতে হবে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি থিয়েটার সম্পর্কে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। তখন ভালভাবে থিয়েটার পরিচালনা করবার জন্য বেঙ্গল থিয়েটার একটি উপদেষ্টা সমিতি গঠন করেছিল। সেই উপদেষ্টামণ্ডলীতে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, উমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ ব্যক্তি ছিলেন। সেই মণ্ডলীর থিয়েটারে অভিনেত্রী নিয়োগ সংক্রান্ত একটি জরুরি সভায় বিদ্যাসাগর থিয়েটারে অভিনেত্রী নিয়োগের বিরোধিতা করলেও উমেশচন্দ্র দত্ত ও মধুসূদনের সমর্থন পেয়ে বেঙ্গল থিয়েটার কর্তৃপক্ষ বিদ্যাসাগরের মত মানুষের বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করেই কলকাতার বারাঙ্গনাপল্লি থেকে চারজন অভিনেত্রীকে মঞ্চে অভিনয় করবার জন্য নিয়োগ করেছিলেন। মেয়েদের জন্য থিয়েটারের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় অন্ধকার জগতের মেয়েরা মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন পেলেন। তাঁদের একটা তাগিদ ছিল— মুক্তির তাগিদ। থিয়েটারকে তাই তাঁরা নিজেদের মুক্তিতীর্থ মনে করলেন, এই পথ ধরেই থিয়েটারে এসেছিলেন গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনী, তারাসুন্দরী, কুসুমকুমারী, নীহারবালা, কৃষ্ণভামিনী, প্রভাদেবীরা। বস্তুত, নাট্যাভিনয়ে তাঁদের যোগদানের কারণেই বাংলা থিয়েটার তার শৈশব কাটিয়ে পুরো মাত্রায় পেশাদারি হয়ে ওঠার দিকে পা বাড়িয়েছিল। পরবর্তী সত্তর/আশি বছর বাংলা থিয়েটারকে আলোকিত করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন অন্ধকার জগৎ থেকে আসা এই মহিলারাই। থিয়েটারের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে অতএব দেড়শো বছরের ক্লেদাক্ত অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার সংগ্রাম শুরু করলেন পিতৃপরিচয়হীনা বারাঙ্গনা-কন্যারা। সে দিনের সমাজ যে তাঁদের সঙ্গে ছিল তা নয়। এ ছিল প্রবল শক্তিধর সমাজের সঙ্গে তাদের অসম লড়াই। থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত কিছু মানুষ তাঁদের অলোয় ফেরার সংগ্রামে সঙ্গ দিয়েছিলেন সেকালের সংবাদপত্র ও সমাজপতিদের লাগাতার বিরোধিতা ও নিন্দাবাদ সত্ত্বেও। সেইসব সমাজপতিদের উদ্দেশে গিরিশচন্দ্রের প্রশ্ন ছিল, “এই সব মেয়েদের তো আমি অন্তত রাস্তায় দাঁড়িয়ে খরিদ্দার পাকড়াবার চেষ্টা থেকে সরিয়ে, মঞ্চে তুলে দিয়ে রোজগারের একটা পথ দেখিয়েছি, কিন্তু তোমরা এদের জন্য কি করেছো?” পঙ্কজা থেকে মহীয়সী হয়ে ওঠা বারাঙ্গনাকন্যাদের অনেকেই আমাদের বিনোদন শিল্প তো বটেই, সাহিত্যে ও এবং সামাজিক ইতিহাসেও অতুল কীর্তি রেখে গেছেন। আমাদের সমাজ এই সব নারীদের প্রাপ্য মর্যাদা দেয়নি, দিতে চায়নি।
আজ এমন একজন মন্দ মেয়ের কথা লিখতে বসেছি যিনি উনিশ শতকের বাংলা থিয়েটারের একেবারে শুরুর এক তারকা যিনি নটী বিনোদিনীর একেবারে সমসাময়িক এক বিশিষ্ট অভিনেত্রী। সম্ভবত, শ্রীরামপুর মাহেশের কাছে গোলাপসুন্দরীর জন্ম। ছোট থেকেই শুনে শুনে গান তুলে নেওয়ার এক চমকপ্রদ শক্তি ছিল গোলাপের। যৌবনে মায়ের উদ্যোগে গোলাপ কীর্তন গানের প্রশিক্ষণ পান। অল্পদিনেই তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময়েই বেঙ্গল থিয়েটারের সত্ত্বাধিকারী শরৎচন্দ্র ঘোষ গোলাপের কথা জানতে পারেন। পরবর্তীকালে শরৎচন্দ্র ঘোষ যখন তাঁর বেঙ্গল থিয়েটার নামের নাট্যদলের জন্য অভিনেত্রী খুঁজছিলেন, তখনই গোলাপকে নিয়ে আসেন বাংলা মঞ্চে। এই বেঙ্গল থিয়েটারের হাত ধরেই অভিনেত্রী হিসেবে শুরু হয় গোলাপের জীবন। মাইকেলের নাটক শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯) নিয়ে বেঙ্গল থিয়েটারের উদ্বোধন হল ১৬ অগাস্ট, ১৮৭৩ সালে। বেঙ্গল থিয়েটার-এর হাত ধরে মঞ্চে এলেন বাঙালি অভিনেত্রী দল, যাঁদের মধ্যে অনেকেই থিয়েটারে অভিনয়কে তাঁদের অন্যতম পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। আধুনিক বাংলা নাট্যমঞ্চের অভিনয়ের সমস্ত প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন; একের পর একের নাটকে অংশগ্রহণ করে বাংলা নাট্যমঞ্চকে করে তুলেছিলেন সমৃদ্ধ, পরিপূর্ণ ও ঋদ্ধ। সেই অভিনেত্রী দলের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অভিনেত্রী ছিলেন গোলাপসুন্দরী। পরবর্তীকালে আধুনিক নাট্যমঞ্চে তাঁর প্রভূত জনপ্রিয়তার সূত্রে যাঁর নাম হবে সুকুমারী দত্ত। আধুনিক বাংলা থিয়েটারের যথার্থ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রথম অভিনেত্রী দলের একজন গোলাপসুন্দরী। অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির কাছে অভিনয় শেখার সৌভাগ্য হয়েছিল গোলাপসুন্দরীর। শখের নাট্যশালার আড় ভেঙে পেশাদারি রঙ্গমঞ্চের এক বিশিষ্ট তারকা এই গোলাপসুন্দরী।
‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকে নামভূমিকায় অভিনয়ের পরেই গোলাপসুন্দরী জনপ্রিয়তা পেতে থাকেন। বছর খানেক পরেই গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার নামের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি নাট্যমঞ্চে যুক্ত হন গোলাপসুন্দরী। সেখানকার নাট্য পরিচালক উপেন্দ্রনাথ দাসের জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নাটকে অংশ নিয়ে গোলাপের বর্ণময় জীবনের আর-একটি দিক উন্মোচিত হওয়ার সুযোগ পায়। গোলাপসুন্দরীর জীবনকে জানার জন্য তাঁর শিক্ষাগুরু ও পথপ্রদর্শক এই উপেন্দ্রনাথ দাসের জীবনচর্চাও একান্ত আবশ্যিক। মূলত এই উপেন্দ্রনাথ দাসের ছত্রছায়াতেই গোলাপের জাতীয়তাবাদী থিয়েটার জীবনের গতিটি নির্ধারিত হয়। উনিশ শতকের বাংলা নাট্যমঞ্চে স্বদেশচেতনা, সমাজসংস্কার, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, ব্রিটিশ-বিরোধী কর্মকাণ্ডের অন্যতম পুরোধা ছিলেন উপেন্দ্রনাথ দাস, তাঁর জীবনের গতিপ্রকৃতি ও নাট্যপ্রয়াসগুলি নিঃসন্দেহে বাংলা নাট্য ইতিহাসে কৌতূহলোদ্দীপক ও রোমাঞ্চকর অধ্যায় বিন্যাস করেছিল। আধুনিক ভারতের ঐতিহাসিক পরিমণ্ডলে উপেন্দ্রনাথ দাস ও তাঁর নাট্যশিষ্যা সুকুমারীর কথা প্রায় হারিয়েই গেছে বলা যায়। যেভাবে বাংলা নাট্যজগতে গিরিশ ঘোষ ও বিনোদিনী দাসীর কথা আলোচিত হয়, সেভাবে উপেন্দ্রনাথ দাস ও গোলাপসুন্দরী ওরফে সুকুমারী দত্তের নাম আলোচিত হয় না অথচ বিনোদিনী দাসীর থেকে বয়সে অল্প বড় এই নায়িকা ছিলেন বাংলা থিয়েটারের উজ্জ্বল নাম। রূপে-গুণে-মাধুর্যে ও সর্বোপরি ব্যক্তিগত জীবনের নাটকীয় অভিঘাতে এই মানুষটির জীবন রীতিমত একটি রোমহর্ষক রোমাঞ্চের দলিল। প্রতিনিয়ত লড়াই, নতুন নতুন সংগ্রাম, নতুন নতুন বাধা, আরও আরও সর্বনেশে পরিণতি, আবার নতুন প্রেরণায় উঠে দাঁড়ানো— সবটা মিলিয়ে গোলাপসুন্দরী একটি উপন্যাসের মতই।
বিনোদিনী দাসীর বর্ণময় জীবনের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া এই ‘তারকা অভিনেত্রী’-র বহুমাত্রিক জীবনটিও কম রঙিন নয় বরং বিস্মৃত নক্ষত্র এক, যিনি ১২৮২ বঙ্গাব্দের ৩ শ্রাবণ (১৮৭৫ খ্রি., মূল্য ছিল ১ টাকা) ‘অপূর্ব্বসতী’ নাটকটি লিখে বাংলা নাট্যাতিহাসের প্রথম নারী নাট্যকার হিসেবে সুবিদিত হয়ে আছেন। গোলাপসুন্দরী সুকুমারী হয়ে উঠলেন ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে উপেন্দ্রনাথ দাস পরিচালিত ‘শরৎ-সরোজিনী’ নামের নাটকে অভিনয়ের পরে। গোলাপসুন্দরী এই নাটকে ‘সুকুমারী’ নামের একটি চরিত্রে অভিনয় করেন। এই নাটকটি সম্পর্কে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জানুয়ারি অমৃতবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, নাটকটি নাকি এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে দ্বিতীয় শো-য়ের পর প্রায় ৪০০–৫০০ মানুষ টিকিট না পেয়ে ফেরত গিয়েছিল। নাটকটি যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আর এই নাটকে গোলাপের অভিনয় এতই প্রশংসা পায় যে, এরপর থেকে গোলাপসুন্দরী জনগণের কাছে ‘সুকুমারী’ নামেই পরিচিত হয়ে যান। বাংলা রঙ্গমঞ্চের প্রতাপশালী অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সুকুমারীর জীবনের এ এক নতুন মোড়! উপেন্দ্রনাথ দাসের পরের নাটক ‘সুরেন্দ্র-বিনোদিনী’ এই নাটককে হাতিয়ার করে সুকুমারীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের শুরু। আপাতভাবে একটি সামাজিক নাটকের আবরণে লেখা এই নাটক ছিল আসলে সরাসরি ইংরেজ-রাজের বিরুদ্ধে এক প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক উপাখ্যান। এই নাটকের মাধ্যমে ইংরেজ সরকারের আইন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে, ভারতীয়দের প্রতি ইংরেজদের বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ আনলেন উপেন্দ্রনাথ। নাটকের শেষের দিকে কয়েদি বিদ্রোহের ছবি দেখিয়ে উপেন নাট্যমঞ্চে রাজনৈতিক ভিত্তিটিকে জোরদার করে তোলেন। আবার তুমুল জনপ্রিয়তা পেল এই নাটকও। বিরাজমোহিনীর চরিত্রে অভিনয় করে সুকুমারী হয়ে উঠলেন বাংলা রঙ্গমঞ্চের এক প্রতিষ্ঠিত তারকা। একের পর এক নাটকে গান, অভিনয় ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ মাধুর্য বিলিয়ে নাট্যশালাকে মুগ্ধ করে দিলেন তিনি। ১৮৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর গ্রেট ন্যাশনাল উপেন্দ্রনাথ দাসের ‘সুরেন্দ্র-বিনোদিনী’ নাটক প্রথম অভিনীত হয়। সুকুমারী এই অভিনয়ে বিনোদিনীর অভিনয় করেন।
সুকুমারী এমারেন্ড থিয়েটারেও নিয়মিত অভিনেত্রী ছিলেন। নাটক করতে করতে সুকুমারীর জীবনে প্রেম আসে, উপেন্দ্রনাথ দাসের নাটক দলের সেই তরুণ অভিনেতার নাম গোষ্ঠবিহারী দত্ত। ধনী সুবর্ণবণিক পরিবারের ছেলে গোষ্ঠবিহারী ‘শরৎ-সরোজিনী’ নাটকে বৈজ্ঞানিকের চরিত্রে অভিনয় করেন। খবরটা জানাজানি হবার পরে নাটক পাড়ায় ফিসফাস শুরু হয়। গুঞ্জন ওঠে ভদ্রসমাজেও। নিচু ঘরের মেয়ে সুকুমারীকে গৃহস্থ জীবনে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁর শিক্ষাগুরু ও জীবনের অভিভাবক উপেন্দ্রনাথ দাস একটি বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি সুকুমারীকে একটি সামাজিক স্বীকৃতি উপহার দেওয়ার আশায় গোষ্ঠবিহারীর সঙ্গে বারাঙ্গনা-অভিনেত্রী সুকুমারী ওরফে গোলাপসুন্দরীর বিয়ে দেন। সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুসারে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁদের বিয়ে হয়। এই আইনের সহজবোধ্য নাম ছিল ‘তিন আইন’। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রণয়ন হওয়া এই আইন অনুযায়ী যে কোনও মানুষ তাঁর জাতি-ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে গিয়ে আরেকজন মানুষকে বিবাহ করতে পারতেন। আন্তঃজাতি ও আন্তঃধর্ম বিবাহকে বৈধতার সিলমোহর দিয়েছিল এই আইন। গোলাপসুন্দরী ইতিমধ্যেই পরিচিত হয়েছিলেন সুকুমারী নামে। এবার গোষ্ঠবিহারী দত্তের সঙ্গে বিবাহ হওয়ায় তিনি হয়ে গেলেন ‘সুকুমারী দত্ত’। সমাজে উপেক্ষিত-ঘৃণিত-লাঞ্ছিত-ব্রাত্য-অবহেলিত-অযাচিত শ্রেণির মেয়েটি সাধারণ গৃহস্থ জীবনের পথে পা বাড়াতে পেরেছিলেন সমাজসংস্কারক উপেন্দ্রনাথ দাসের উৎসাহে। ‘ভদ্রমহিলা’-র সংজ্ঞার মধ্যে একটি ‘অভদ্র’ মেয়েকে ঢুকিয়ে দিয়ে উপেন্দ্রনাথ দাস একটা প্রগতিশীল পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলেন। সমালোচনা এল প্রচুর। উনিশ শতকীয় সাবেকি সমাজ এই বিবাহকে ভাল চোখে দেখেনি। ভাগ্যের পরিহাস প্রেমিক-প্রেমিকার এই বৈবাহিক জীবন সুখের হল না। গোষ্ঠবিহারীর ভদ্র সমাজ তাঁকে সমাজচ্যুত করল।
ব্যক্তি জীবনে পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে নাট্যজীবনেও সুকুমারীর সংগ্রাম চলতে থাকে। সহজ সরল সামাজিক নাটকের গণ্ডি পেরিয়ে সুকুমারী একের পর এক দেশাত্মবোধক নাটকে অংশ নিতে থাকেন। গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে ‘শরৎ-সরোজিনী’, ‘সুরেন্দ্র-বিনোদিনী’, ‘হীরকচূর্ণ’, ‘সরোজিনী’ প্রভৃতি রাজনৈতিক নাটকগুলি মঞ্চস্থ হতে থাকে। এই সময়ে নাট্যসম্রাজ্ঞী নটী বিনোদিনীও গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে কিছুদিন অভিনয় করেছিলেন। বিনোদিনী ও সুকুমারী দুইজনেই যখন গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনয় করছেন, সেই সময় উপেন্দ্রনাথ একটি ছোট নাটক মঞ্চস্থ করেন। নাম হল ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’। উপেন্দ্রনাথ এমন সময় এই নাটক মঞ্চস্থ করেন যখন মহারানি ভিক্টোরিয়ার পুত্র প্রিন্স অফ ওয়েলস কলকাতা আসেন। রাজপুত্রের এই আগমন দেশপ্রেমী বাঙালিরা ভাল চোখে দেখেননি। ‘বিশেষ ভাবে রাজ-অভ্যর্থনার জন্য ইংরেজ সরকার অর্থসংগ্রহে যে নিয়মনীতি প্রয়োগ করেছিলেন, সাধারণ বাঙ্গালীর কাছে তা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়’। তার ওপর, হাইকোর্টের প্রসিদ্ধ উকিল জগদানন্দ মুখোপাধ্যায় সেই রাজপুরুষকে নিজের অন্দরমহল দেখাতে নিয়ে যান। এই ঘটনায় সমাজে অত্যন্ত সমালোচনার ঝড় ওঠে। হিন্দু পেট্রিয়ট লেখে, ‘National feeling has been outraged’। রাজপুত্রকে অন্দরমহলে ঢোকানোর এই ঘটনাটিকে নিয়েই উপেন্দ্রনাথ লেখেন ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’ প্রহসনটি। কিন্তু ইংরেজভক্ত বাঙালি প্রজাদের এমন অপমান করার অভিযোগে সেটি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। পরবর্তী অভিনয়ের সময়ে সেই একই নাটকের নাম পালটে দেওয়া হয়। ‘হনুমানচরিত্র’ নামে আবার একই নিষিদ্ধ নাটকটিই অভিনীত করা হয়। চলতে থাকে ইংরেজদের সঙ্গে উপেন ও তাঁর শিল্পীগোষ্ঠীর লুকোচুরি খেলা। এরপর ‘হনুমানচরিত্র’ নাটকটিও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ফলে আবার ‘সুরেন্দ্র-বিনোদিনী’ ও নতুন নাটক The Police of Pig and Sheep প্রহসন মঞ্চস্থ হয়। পুলিশ কমিশনার স্যার স্টুয়ার্ট হগ ও সুপারিন্টেন্ডেন্ট ল্যামকে ব্যঙ্গ করে লেখা এই নাটক। এই নাটকটিও আসলে সেই ‘হনুমানচরিত্র’ প্রহসনটিরই নাম পাল্টে, সামান্য বদল করে মঞ্চস্থ করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে ইংরেজ সরকার। উপেনের এই কার্যকলাপগুলিকে আর সামলাতে না পেরে নাটকের মাধ্যমে বিপ্লবীয়ানা প্রচার করার ধৃষ্টতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অর্ডিন্যান্স জারি করল তারা। সঙ্গে সঙ্গে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার এই ধরনের বিতর্কিত রাজনৈতিক নাটকের অভিনয় বন্ধ করে অন্য সামাজিক নাটক করা শুরু করল। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ৪ মার্চ, সেইরকমই সাধারণ একটি সামাজিক নাটক চলার সময়ে ডেপুটি কমিশনার এসে অভিনয় বন্ধ করে দিল। ‘সুরেন্দ্র-বিনোদিনী’ নাটক ‘অশ্লীল’— এই অভিযোগে নির্দেশক উপেন দাস, অধ্যক্ষ অমৃতলাল বসু, এইরকম দশ জন নাট্যকর্মী গ্রেপ্তার হলেন। অথচ গ্রেট ন্যাশনালে নাটক কিন্তু চলতেই থাকল। ১১ মার্চ অভিযুক্তদের সাহায্য করতে অভিনীত হল ‘সরোজিনী’ নাটক। পুলিশকে অগ্রাহ্য করে সরকারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পদক্ষেপ ছিল সেটি। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এই নাটকের যে অভিনয় হয়েছিল, তাতে ‘সরোজিনী’ চরিত্রটিতে বিনোদিনী দাসী অভিনয় করতেন। কিন্তু মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে পরিস্থিতি দাঁড়াল ভিন্ন। নেতৃত্ব দিলেন সুকুমারী দত্ত। কাগজে বিজ্ঞাপনে বিশেষভাবে উল্লিখিত হল তাঁর নাম। পুলিশকে উপেক্ষা করে মুখ্যভূমিকা গ্রহণ করলেন তারকা-অভিনেত্রী শ্রীমতী সুকুমারী দত্ত। উনিশ শতকীয় বাংলা থিয়েটারে এমন বিপ্লবী পদক্ষেপ আর কখনও হয়েছে কিনা জানা যায় না। ২০ মার্চ মামলা শেষ হল। অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হল। বেকসুর খালাস পেলেন উপেন্দ্রনাথ দাস ও অমৃতলাল বসু। ‘সুরেন্দ্র-বিনোদিনী’ নাটকের এই মামলার রায় যেদিন ঘোষণা হল, সেই দিনই নাট্য নিয়ন্ত্রণ বিলটি Legislative Council-এ পেশ হয়েছিল। কয়েক মাসেই তা আইনে পরিণত হল। এরপর থেকেই আইনের কঠিন নিগড়ে বাঁধা পড়ল স্বদেশী বাংলা থিয়েটার।
জীবনের অন্য একটা দিকের যাপন তখনও অপেক্ষমাণ। মামলা-মোকদ্দমায় গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার জেরবার হয়ে বন্ধ হয়ে গেল। দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে গেল থিয়েটার। থমকে গেল সুকুমারীর অভিনয় জীবন। উপেন এই মামলা নিষ্পত্তির আগেই টিবি আক্রান্ত হয়েছিলেন। মামলায় জড়িয়ে প্রচণ্ড অর্থাভাবে এসে পড়েন। এইসময়ে তাঁর স্ত্রী আত্মহত্যা করলেন। সবদিক থেকে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন উপেন। বন্ধু শিবনাথ শাস্ত্রী ও উপেনের পিতার বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মধ্যস্থতায় পিতা শ্রীনাথ দাসের সাহায্যে উপেন অসুস্থতা কাটিয়ে কিছুদিন পরেই লণ্ডন পাড়ি দিলেন। উপেন্দ্রনাথ দাস যতদিন কলকাতা শহরে ছিলেন, সুকুমারীর বিবাহিত জীবন একভাবে চলে যাচ্ছিল। বিয়ের পর থেকে সুকুমারী ও তাঁর স্বামী গোষ্ঠবিহারীকে সমাজ একেবারে একঘরে করে দিয়েছিল। নিদারুণ অর্থকষ্টে চলত তাঁদের। কিন্তু উপেন লণ্ডন চলে যাওয়ায় তাঁদের পরিস্থিতি আরও সঙ্গীন হয়ে পড়ল। এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ সহ্য করতে না পেরে গোষ্ঠবিহারী পালালেন। অসহায় অবস্থায় জাহাজের খালাসি হয়ে উপেন্দ্রনাথের খোঁজে তিনিও পাড়ি দিলেন লণ্ডন। সেখানে উপেন তাঁকে হোটেলে বয়ের চাকরি যোগাড় করে দেন। কিন্তু অল্পদিনেই তিনি মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এদিকে কলকাতা শহরে একা হয়ে পড়েন সুকুমারী। আর এই সময়ে সুকুমারী ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। থিয়েটার করা বন্ধ হয়ে গেছে, স্বামী পরিত্যক্তা, জীবনের অভিভাবক উপেন্দ্রনাথও শহর ছেড়েছেন। রোজগার বন্ধ, সদ্যোজাত কন্যাকে নিয়ে সহায়সম্বলহীন সুকুমারী ঘোর বিপদে পড়লেন। সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করলেন। মেয়েদের নাচ ও অভিনয় শেখাবার একটা স্কুল খুললেন। কিন্তু বেশি দিন চালাতে পারলেন না। আবার রঙ্গমঞ্চে আশ্রয় খুঁজলেন সুকুমারী। মঞ্চের বুকে ফিরে এলেন তিনি। এবার নিজেই খুললেন নাট্যদল। সুকুমারী এবার নিজেই লিখলেন নাটক, নিজেই করলেন সেই নাটকের পরিচালনা এবং অবশ্যই নিজেও অংশ নিলেন অভিনয়ে। পেট চালানোর জন্য লিখলেন ‘অপূর্ব্বসতী নাটক’। নাটকটি সত্যিই তাঁর নিজেরই লেখা ছিল কিনা সেই ব্যাপারে গবেষক সুকুমার সেনের মতে, এ নাটক সুকুমারীর রচনা নয়। এ বই-এর নামপত্রে রচয়িতা হিশেবে নাম আছে দুটি আশুতোষ দাস এবং সুকুমারী দত্ত। সুকুমার সেনের মতে, আশুতোষ দাস নামটিও ছদ্মনাম, এর আসল লেখক উপেন্দ্ৰনাথ দাস। এ নাটকের ভাষা এত আড়ষ্ট এবং সংস্কৃতপ্রভাবিত যে, এটি অশিক্ষিতা অথবা সামান্য শিক্ষিতা সুকুমারীর পক্ষে লেখা সম্ভব ছিল বলে মনে হয় না। তবে এর কাহিনির সঙ্গে সুকুমারীর নিজের প্রথম জীবনের অনেকটাই মিল ছিল। সুকুমারীর মতই এর নায়িকা নলিনী সামান্য লেখাপড়া জানে, তার মা বারবণিতা। সেও সুকুমারীর মত প্রেমে পড়ে বিয়ে করতে চায়, কিন্তু বাধার মুখোমুখি হয়। নায়িকা নলিনী আত্মহত্যা করে প্রাণ জুড়ায়, অপর পক্ষে, সুকুমারী স্বামীপরিত্যক্ত হয়ে প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকেন। যদিও তাঁর এই ‘সিদ্ধান্ত’ পরবর্তীকালে কেউই মেনে নেননি। এমনকী ‘নাট্য আকাদেমি পত্রিকা’-র দ্বিতীয় খণ্ডে সংকলিত ‘সুকুমারী দত্ত এবং অপূর্ব্বসতী নাটক’-এর ভূমিকায় সম্পাদক হিসেবে বিজিতকুমার দত্ত (সুকুমার সেনের জামাতা) মন্তব্য করেছেন— “তবে বইটির আষ্টেপৃষ্টে সুকুমারীই যে নাটকটির রচয়িতা, তার প্রমাণ রয়েছে।” সুতরাং সুকুমার সেনের ‘সিদ্ধান্ত’ কখনই ‘প্রমাণিত সত্য’ হয়ে উঠতে পারেনি। ঠিক যেমন প্রিন্স অফ ওয়ালেস-এর কলকাতায় আগমন ও উকিল জগদানন্দ মুখোপাধ্যায়ের অন্দরমহলে প্রবেশের ঘটনা নিয়ে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনীত ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’ যে উপেন্দ্রনাথ দাসেরই লেখা তারও কোনও পাথুরে প্রমাণ নেই। অভিনয় করতে করতে ১৮৮৩ সালে সুকুমারী শুধুমাত্র মেয়েদের নিয়ে হিন্দু ফিমেল থিয়েটার নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন এবং সেখানে ‘শুম্ভ সংহার’ নামে একটি নাটক অভিনয় করান। ১৮৯৮ সালেও তিনি বেঙ্গল এবং মিনার্ভা থিয়েটারে একাধিক নাটকে অভিনয় করেছিলেন। দুর্গেশনন্দিনীতে বিমলা, পুরুবিক্রমে রাণী ঐলবালা, সরোজিনীতে সরোজিনী, সুরেন্দ্র-বিনোদিনীতে বিরাজমোহিনী, মৃণালিনীতে গিরিজায়া, অশ্রুমতীতে মলিনা, বিষবৃক্ষে সূর্যমুখী ইত্যাদি চরিত্রে তাঁর অভিনয় সমালোচকদের প্রশংসা লাভ করেছিল। তাঁর অভিনয় নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বলেছিলেন— ‘মলিনা সেজেছিল সুকুমারী দত্ত। স্টেজ-নাম ছিল গোলাপী, সে যা গাইত! বুড়ো বয়সেও শুনেছি তার গান, চমৎকার গাইতে পারত। মিষ্টি গলা ছিল তার, অমন বড়ো শোনা যায় না। আর কী অভিনয়, এক হাতে পিদিমটি ধরে শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢাকতে ঢাকতে আসছে, যেন ছবিটি— এখনো চোখে ভাসছে’। —অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (‘ঘরোয়া’, পৃষ্ঠা ৯৪)
ন্যাশনাল ফিমেল থিয়েটারের উদ্যোগে শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য নাটক করলেন। ইতিমধ্যে এক সহৃদয় মানুষ, নবভারত পত্রিকার সম্পাদক, বাবু দেবপ্রসন্ন রায়চৌধুরী সুকুমারীর কন্যার শিক্ষা ও প্রতিপালনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সারাজীবন অক্লান্ত সংগ্রাম করে যে মেয়েকে তিনি মানুষ করলেন, সেই মেয়েরও সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুসারে বিয়ে হয় এক ভদ্রবাড়ির তরুণের সঙ্গে। সর্বস্ব খরচ করে বিয়ে দেন মেয়ের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। পরে নাকি সুকুমারীর নাতি বিহারের এক প্রসিদ্ধ ডাক্তার হয়েছিলেন। নিজের সংসার জীবনের হতাশা সত্ত্বেও জীবনের শেষে জিতে গেলেন অপরাজেয় সুকুমারী। নিজের জীবনের সমস্ত লড়াই সুকুমারী সার্থক করেছিলেন মেয়ের জীবনের শান্তি ও সমৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে। একটাই মাত্র ছোট্ট দুঃখ— মেয়ের বিয়ের পর থেকে অনেকদিন পর্যন্ত মেয়েকে চোখে দেখার অধিকারও ছিল না তাঁর। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ‘কুমারসম্ভব’ নাটকে অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেলেন, পরের বছর ‘রাজা বসন্তরায়’ নাটক, পাশাপাশি চলতে থাকল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে ‘আনন্দমঠ’ নাটক। ক্রমে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফী, গিরিশ ঘোষ, অমরেন্দ্রনাথ দত্তদের তত্ত্বাবধানে অসংখ্য নাটকে তুমুল জনপ্রিয়তা পেলেন সুকুমারী। মোটামুটি ১৮৯০–৯১ পর্যন্ত তিনি বাংলা থিয়েটার মঞ্চের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন, এমনটা জানা যায়। দীর্ঘ প্রায় আঠেরো বছর নানা টানাপোড়েন, ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতন সত্ত্বেও সুকুমারী বারে বারে ফিরে এসেছেন মঞ্চের দ্বারে। ঘর গড়া, ঘর ভাঙা, একা হওয়া, মেয়েকে নিয়ে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা, মেয়েকে মানুষ করা, মেয়ের বিয়ে দেওয়া— জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে নিজের নেশা ও পেশা থিয়েটারের সঙ্গ ছাড়েননি সুকুমারী। মাঝে মাঝে হয়তো বিরতি নিয়েছেন। জীবনের নৃশংস বাঁকগুলিতে হয়তো খানিক বিমূঢ় অবস্থায় থিয়েটার থেকে সাময়িক দূরত্বে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু তাঁর বর্ণময় জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ের পরতে পরতে মেখে রয়েছে থিয়েটারের আঘ্রাণ, থিয়েটারের যাপন। বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে গেলেও নিম্ন শ্রেণি থেকে উঠে আসা একটি সাধারণ মেয়ের ভদ্রবাড়িতে ‘উন্নীত’ হওয়ার প্রচেষ্টা, জীবনের যে কোনও প্রতিবন্ধকতায় থিয়েটার না-ছাড়ার সংকল্প আর হার-না-মানার জেদ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে চলা পিতৃতন্ত্রের স্বরূপকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে অভিনয়, গান, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা, সুকুমারীকে ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান দেয়।
তথ্যঋণ:
পশ্চিমবঙ্গে কর্মী নারীর বিবর্তন, মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়, আকাদেমি পত্রিকা, জুলাই, ১৯৯৫। মৈত্র, রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী। চৌধুরী, বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস। গুপ্ত, বাংলার নট-নটী। দত্ত, সুকুমারী দত্ত ও অপূর্ব্বসতী নাটক। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ১৮৫৭, সম্পাদনা অক্ষয়কুমার দত্ত, উদ্ধৃত, আশুতোষ ভট্টাচার্য, ‘দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ’, পটভূমি অংশ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা প্রথম দে’জ সংস্করণ। অজিতকুমার ঘোষ, ‘প্রাক্-স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা নাটক রচনার ধারা’, নাট্য আকাডেমী পত্রিকা ৬, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি প্রকাশিত। সুকুমারী দত্ত: আধুনিক বাংলা থিয়েটারের প্রথম ‘ভদ্র’ অভিনেত্রী তূর্ণা দাশ। নারী ধর্ম ইত্যাদি – গোলাম মুরশিদ।