না, রবীন্দ্রনাথ কখনও মালদায় আসেননি।
এমনকি দার্জিলিং হয়ে শিলং পাহাড়ে যাওয়ার সময়ও ফরাক্কা পেরোননি তিনি— বিকল্প পথ ধরেছিলেন। কিন্তু হরিশ্চন্দ্রপুরের বিধুশেখর শাস্ত্রী বা চাঁচলের শিবরাম চক্রবর্তীর মত ব্যক্তিত্বদের মাধ্যমে মালদার সঙ্গে একটা পরোক্ষ যোগাযোগ ছিল বিশ্বকবির।
বিশ্বভারতীর একেবারে প্রথম দিন থেকে রবীন্দ্রনাথের কাছের মানুষ ‘শাস্ত্রীমশাই’। সংস্কৃত ও পালির বিরাট পণ্ডিত, অথচ যেকোনও গোঁড়ামি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত— এটাই ছিল বিধুশেখরের ঘরানা। আচার্যের বেদিতে বসে আরবি কবি ইমাম গজ্জালির কবিতা উদাত্তকণ্ঠে আবৃত্তি করছেন, আবার আশ্রমের মৌলানা শওকত আলিকে জড়িয়ে ধরে তাঁকে নিয়ে যাচ্ছেন আশ্রমের খাবার ঘরে— এ ছিল শান্তিনিকেতনের এক পরিচিত দৃশ্য।
আর চাঁচলের শিবরামকে রবীন্দ্রনাথ চিনতেন তরুণ কবি হিসাবে, তখনও তিনি রসসাহিত্যিক হয়ে ওঠেননি। ১৯২৯ সালে বেরোচ্ছে শিবরামের দুটি কাব্যগ্রন্থ— ‘চুম্বন’ আর ‘মানুষ’। কবিতার সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েও ওই বছরের ১০ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ চিঠি লিখছেন তরুণ শিবরামকে— ‘‘…তোমার কাব্যদুটি পড়েছি। ভাষা ও ছন্দের উপর তোমার অধিকার আছে সে আমি পূর্বেই দেখেছি।’’
শিবরামের মতই মালদার কালিয়াচকের এক কিশোর শিষ্য হতে চেয়ে চিঠি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। তারও উত্তর দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই অনালোচিত পত্রালাপকে কেন্দ্র করে আলোড়ন পড়েছে গবেষকমহলে।
‘‘… আমার কবিতা মালদার পত্রিকায় উঠে, তাই চিনে আমার কবিতাকে সকলেই কিন্তু সন্দেহ আছে আমায় চিনে কি না?
আপনার শিষ্য হ’লে আমার কি কি নিয়ম অবলম্বন করতে হ’বে জানাবেন?
…
পড়াশোনা ভাল লাগে না। কবিতা আজ আমায় মাতোয়ারা করেছে।’’
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৮-এ মালদা ডাকঘর থেকে শান্তিনিকেতনে প্রেরিত এই চিঠির নিচে স্বাক্ষর ছিল— ‘‘ইতি/ ভবিষ্যৎ শিষ্য/ এ, কে, এস, নূর মোহাম্মদ/ মালদহ জিলা স্কুল/ নবম শ্রেণী; (মালদহ)’’
নোবেল পাওয়া বিশ্বকবির কাছে প্রতিদিনের ডাকে এরকম অসংখ্য চিঠি আসত, কিন্তু কবি উত্তর দিতেন বেছে বেছে। আর এইখানেই চমক। মালদা জিলা স্কুলের ক্লাস নাইনের এই ছাত্রটির আকুল চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার করে ও আশীর্বাদ জানিয়ে ঠিক দু’দিনের মধ্যে অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারি শান্তিনিকেতন থেকে উত্তর দেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ— ‘‘কল্যাণীয়েষু, তোমার পত্র পেয়ে খুশি হলাম। তুমি আমার আশীর্বাদ গ্রহণ করো। শুভার্থী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শান্তিনিকেতন, ২৪/২/৩৮।’’
মালদা জেলার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগের এই নতুন সূত্রটি তোলপাড় তৈরি করেছে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও গবেষকমহলে। রবীন্দ্র গবেষকদের একাংশের মতে, ১৮ খণ্ডের চিঠিপত্র ছাড়াও বিশ্বভারতী মহাফেজখানায় প্রচুর ফাইলে এরকম নানা চিঠিপত্র রাখা আছে, যার একটা বড় অংশই অগ্রন্থিত। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে নূর মোহাম্মদের চিঠিটি ও রবীন্দ্রনাথের উত্তরের কপি। সেক্রেটারির নোট থেকে প্রমাণিত, কবি নিজে পড়ে এই চিঠির উত্তর দিয়েছেন।
কে এই এ. কে. এস. নূর মোহাম্মদ? তার উত্তর রয়েছে চিঠিটির মধ্যেই। নূর মোহাম্মদের জন্ম ১৯২৩ সালের ১ জানুয়ারি বর্তমান কালিয়াচকের অন্তর্গত গয়েশবাড়িতে। পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে মালদা সদরে এসে জিলা স্কুলে ভর্তি হন এই প্রতিভাবান লেখক। প্রথম দিকেই সাহিত্যচর্চায় উৎসাহী। তাঁর কবিতা মালদহ সমাচার সহ নানা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হত। তথ্য বলছে, ওই স্কুল থেকে তিনি ১৯৪০ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। আই এ পর্যন্ত পড়েছিলেন তিনি। দেশভাগের সময় পূর্ববঙ্গের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের পদস্থ কর্মী হিসেবে সিলেট ও ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। আ কা শ নূর মোহাম্মদ নামে তাঁর চারটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও ‘আসছে বছর’ নামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। একমাত্র গল্পগ্রন্থ ‘এই স্বাধীনতা’। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর কবিতা-গল্প জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের দিনাজপুরে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় তার ‘বস্তুবাদী রবীন্দ্রনাথ’ নামের একটি উচ্চমানের প্রবন্ধের সন্ধান পেয়েছেন গবেষকরা।
তাঁদের একাংশের মত: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র এবং বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্য রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিতর্কিত আত্মজীবনী ‘অন দ্য এজেস অফ টাইম’-এ তরুণ কবিযশোপ্রার্থীদের চিঠির উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের নির্বাচনের বিষয়টি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন— সব চিঠির উত্তর কখনওই তিনি দিতেন না, কারও মধ্যে সম্ভাবনা থাকলে তবেই দুকলম লিখতেন। তাহলে কি নূর মোহাম্মদের কবিতা পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
এর উত্তর— হ্যাঁ। কেননা রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠির প্রথমে তার প্রাণের কবিগুরুর উদ্দেশে কিশোর কবি একটি ছয় লাইনের কবিতা লিখেছিলেন। কাঁচা হাতে লেখা হলেও ১৫ বছরের কিশোরের মধ্যে কবিত্বের ছাপ আবিষ্কার করেছিলেন স্বয়ং বিশ্বকবি। এছাড়াও চিঠিতে ছিল জিলা স্কুলে প্রচলিত শিক্ষা সম্পর্কে কিশোর নূরের অনীহা আর কবিগুরুর শিষ্য হওয়ার এক সরল গ্রামীণ আকুলতা।
চিরকালের স্কুলপালানো ছেলে রবীন্দ্রনাথ সতেরো বছর বয়সেই লিখে ফেলেছিলেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কবি-কাহিনী’। তাই হয়তো মালদার এই পনেরো বছরের অনামী কিশোর সেদিন বঞ্চিত হয়নি তাঁর স্নেহ আশীর্বাদ থেকে।
এ. কে. এস. নূর মোহাম্মদের মূল চিঠির অবয়বটি দেখাতে না পারলেও চিঠির সম্পূর্ণ বয়ানটি পাঠকের গোচরে আনা যেতে পারে বলে আমাদের বিবেচনা।
Malda
22.2.38
পত্র : তিন
সাকীদের আঁখি তুমি সরাব খানায়,
মাতোয়ারা করে দিলে কবিতা নেশায়;
এই সোনার বঙ্গে হে বিশ্বের কবি,
এঁকেছ কি মনোরম কল্পনার ছবি—
লহ হে পূজারী তুমি লহ আরবার।
লহ এ ক্ষুদ্র কবির শত নমস্কার।।হে বিশ্ব বরেণ্য কবি—
আজ চিঠি লিখছি আপনাকে; ক্ষুদ্রজনের লেখা বলে নিক্ষেপ করবেন না আশা করি।
আমি আপনার শিষ্য হ’ব আর আপনি হবেন গুরু আমার—
আমি কয়েকখানা কবিতার বই লিখেছি কিন্তু অর্থাভাবে একটীও প্রকাশ করতে পারি নাই।
আমার কবিতা মালদার পত্রিকায় উঠে, তাই চিনে আমার কবিতাকে সকলেই কিন্তু সন্দেহ আছে আমায় চিনে কি না?
আপনার শিষ্য হ’লে আমার কি কি নিয়ম অবলম্বন করতে হ’বে জানাবেন?
আমি অতি গরীব পিতৃহীন বালক আমার জন্ম ১৯২৩ সালের ১লা জানুয়ারী।
পড়াশোনা ভাল লাগে না। কবিতা আজ আমায় মাতোয়ারা করেছে।
আমি আমার একখানা কবিতা পাঠাইলাম। আশা করি আমার পক্ষ হ’তে সুপারিস করিয়া সেটী কেন এক পত্রিকায় তুলাইয়া দিবেন। একখানা টিকিট পাঠাইলাম। আগামীতে আবশ্যক মত উত্তর দিবেন।
কোন পত্রিকায় আমার কবিতাটী উঠাইলেন অথবা উঠাইলেন কিনা তাহাও জানাবেন।
আবার বলি
‘‘শিষ্য হলে আমায় কি কি করতে হ’বে? আজকার মত শেষ হে গুরুদেব!
ইতি
ভবিষ্যৎ শিষ্য
এ, কে, এস, নূর মোহাম্মদ
মালদহ জিলা স্কুল
নবম শ্রেণী; (মালদহ)।