Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ফো-তি

কলকাতা-ঘেঁষা এই অঞ্চলটি তিরিশ-চল্লিশ বছর আগেও পুকুর আর বাগান ঘেরা মফস্বল ছিল। এখন গাছের গ দেখা যায় না, শুধুই উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি। খাস উত্তর কলকাতা ছেড়ে নানা কারণে ‘উৎখাত’ হওয়া লোকজনই এখানে এই ফ্ল্যাটবাড়িগুলোতে বাস করেন। উত্তর কলকাতার সেই ঢিলেঢালা জীবন, সেই আড্ডা, সেই অবসরযাপন অনেকেই বেশ মিস করেন। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষজন। সারাটা জীবন এক ঠাঁইতে বাস করে, এক পাড়ায় ছোট থেকে বড় হয়ে বুড়ো হওয়ার পরে নতুন জায়গায় এসে তাঁদের মানাতে বড় অসুবিধে হয়। এইরকমই তিন ফ্ল্যাটবাড়ির তিন বয়স্ক ভদ্রলোক নিজেদের মধ্যে এক সান্ধ্য আড্ডা চালু করেছেন। পাড়ার একটি ফ্ল্যাটবাড়ির নীচে কতকগুলি দোকান এখনও বিক্রি হয়নি। সেই বন্ধ দোকানের সামনের সিঁড়িতে রোজ সন্ধেবেলায় তাঁদের আড্ডা।

একটু কান পাতলে নানান আলোচনা শুনতে পাবেন। এই নতুন পাড়াটি যে কত খারাপ, বাড়ির বউমা কীরকমভাবে সংসার ভাঙার চক্রান্ত করছে, পেনিসিলিন ছাড়া যখন কোনও অ্যান্টি-বায়োটিক ছিল না তখন কীভাবে চিকিৎসা হত, উত্তর কলকাতার কোন দোকানের আলুর চপ-বেগুনি ভাল, উঠতি বড়লোকেরা এখানে কীভাবে দামের তোয়াক্কা না করে বাজার করে, কোন সময়ে কী না-খাওয়ার বিধান শাস্ত্রে আছে, কোন ডাক্তার টেস্ট করার নামে গলা কাটছে ইত্যাদি প্রভৃতি। সঙ্গে থাকে স্মৃতি রোমন্থন। নিজেদের যৌবনের হিরোইজম, নানান অভিজ্ঞতার কথা। পাড়ার বাচ্চাদের কিন্তু এঁরা খুব ভালবাসেন। বাচ্চারাও এতগুলো দাদুকে খুব পছন্দ করে। ফাঁক পেলেই দাদুদের সঙ্গে গল্প করে যায়। আর বাচ্চার মা-রা রাস্তায় যাতায়াতের পথে প্রায়ই ধমক খান, মেয়ে কেন রোগা হয়ে যাচ্ছে, এতটুকু ছেলেকে এতদূরে কেন ইস্কুলে পাঠানো হয়— এইসব বিবিধ কারণে।

জন্মইস্তক দর্জিপাড়ার ছেলে হরিনাথ মুখুজ্জে এই আসরের মধ্যমণি। সরকারি চাকুরে ছিলেন। মাথাভর্তি সাদা চুল, বাঁধানো দাঁত, সুগারের রুগি আর তিরিক্ষে মেজাজ। কারণে-অকারণে চেনা-অচেনা সবাইকে দু-কথা শুনিয়ে দিতে তাঁর জুড়ি নেই। কথায় কথায় বলেন, ‘আমাকে শেখাতে এসো না, আমি দর্জিপাড়ার ছেলে, তোমাকে এক হাটে কিনে আর-এক হাটে বেচে দিতে পারি।’ শার্ট-প্যান্ট পরেই রোজ আড্ডায় আসেন, বাজারেও যান। প্যান্ট-শার্ট ছাড়া তাঁকে কেউ কোনওদিন ফ্ল্যাটের বাইরে দেখেননি।

আড্ডায় থাকেন সৌম্যকান্তি, চক্রবর্তীমশাই, পণ্ডিত পুরোহিত ছিলেন। বেণীমাধব শীলের পাঁজি লেখার যে পণ্ডিতদের দল থাকতেন তিনি একসময় তাঁদের অন্যতম ছিলেন। চব্বিশ ঘণ্টাই ধুতি পরে থাকেন। বাইরে বেরোলেই ধোপদুরস্ত পোশাক। কথায় আভিজাত্যর ছোঁয়া। আজন্ম উত্তর কলকাতায় কাটালেও অত্যন্ত পরিশীলিত ভাষায় কথা বলেন, ওনার মুখে কেউ কোনওদিন কোনও অপশব্দ শোনেননি। আড্ডার আর-এক সদস্য রতন ঘোষ, লুঙ্গি আর হাফশার্ট পরেন। একটু তোতলা, মাথা জোড়া বিরাট টাক।

সেদিন সন্ধেবেলা আড্ডা মারতে বসে তিনজন দেখলেন, তাঁদের আড্ডার সিঁড়িতে আর-একজন বসে আছে। চেনা কেউ নয়, গোলগাল আমুদে চেহারার লোক, বেশ ফিটফাট পোশাক। ওই সিঁড়িটা বেশ চওড়া। আড্ডার তিনজন বসার পরেও বেশ খানিকটা খালি জায়গা থাকে। মাঝে মাঝেই চেনা বা অচেনা কেউ এসে খানিক বসেন সেখানে। তাদের পাত্তা না দিয়েই আড্ডা চলে। সেদিনও তাই হল। কথা হচ্ছিল প্রস্টেটের সমস্যা নিয়ে। মুখুজ্জেবাবু বলেই ফেললেন, ‘এরকম নচ্ছার রোগ আর নেই মশাই, এই প্যান্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে তো এই আটকে গিয়ে শ্বাস ওঠার জো।’ চক্রবর্তীমশাই বললেন, ‘কী আর করা যাবে বলুন? জরা তো অবশ্যম্ভাবী। কোনও মানুষের সাধ্যি নেই জরাকে এড়িয়ে যাবার।’ রতন ঘোষ তখন আবার বাঁধানো দাঁতে যে খাওয়াদাওয়া কতরমের অসুবিধের সৃষ্টি করে সেই নিয়ে তোতলাতে তোতলাতে অনুযোগ শুরু করলেন।

‘আমি আপনাদের সঙ্গে দুমিনিট কথা বলতে পারি?’ আচমকা ঘাড়ের কাছে গলার আওয়াজ শুনে আড্ডা থামল। সবাই তাকিয়ে দেখে সেই গোলগাল মাঝবয়িসি লোক। মুখুজ্জেবাবু তার আপাদমস্তক সন্দেহের চোখে জরিপ করে বললেন, ‘বলুন।’ লোকটি বসে থাকা তিন বয়স্ক লোকের সামনে এসে দাঁড়াল। বলতে শুরু করল। লোকটির কথায় হাসি মিশে যেন এক জাদু তৈরি হয়। তিনজনে চুপচাপ শুনে যেতে লাগলেন। লোকটি নীচু গলায় বলে চললেন,

‘বয়েস হওয়ার অনেক অসুবিধে। চুল সাদা হয়, মাথা ভরা টাক। দাঁত থাকে না, হজম হয় না, খাওয়ার মজা শেষ। হাঁটুতে বাত, ঘাড়ে স্পন্ডিলোসিস। মলমূত্রের নানা সমস্যা। প্রেসার সুগার কিডনি। আমাদের দেশে ষাট থেকেই এসবই এসে চেপে ধরে। বেঁচে থাকাই অর্থহীন হয়ে পড়ে। শুধু অল্পসল্প বিস্বাদ খেয়ে দাদু দাদু ডাক শুনে ভয়ে ভয়ে মরার দিনগোনা। কিন্তু জানেন না কি, চিনে বহু মানুষ আশি-নব্বইতেও বৃদ্ধ হন না। অসাধারণ কেউ নন তাঁরা সকলে, আপনাদের মতই ছাপোষা। কিন্তু তাঁদের আশি বছরেও মাথায় কালো ঘন চুল। ঝকঝকে আসল দাঁত। রাত্তিরে এক থালা ভাত আর ইয়া বড় দুটো চর্বি ভর্তি শুয়োরের মাংসের স্লাইস খেয়ে শুতে যান। হজমের কোনও সমস্যা নেই। সুগার প্রেসার সব নরম্যাল। এন্তার সিগারেট ফুঁকছেন, মদটদও টানেন অনেকে। এমনকি পঁচাশিতে বিয়েথাও করছেন।’

‘ওই চিনেরা ম্যাজিক জানে নাকি?’ প্রশ্ন করেন রতন ঘোষ।

‘ম্যাজিক নয়, ফো-তি। একটা গাছের মূল।’ জবাব দিল লোকটি।

‘ফো-তি? নাম শুনিনি তো। ওদের জিনসেং-এর নাম জানা আছে ঘনাদার কল্যাণে। কিন্তু ফো-তি তো শুনিনি।’ জানালেন চক্রবর্তীমশাই।

‘‘জিনসেং? সে তো ফো-তি-র কাছে একেবারে শিশু। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের পাশে ভুটানের রাজা। আসল রহস্য হল ফো-তি। যার আর-এক নাম, ‘হো শো ঊ’। মানে হল, কালো চুলের শ্রীযুক্ত হো।’’

‘এ আবার কেমনধারা নাম?’ জানতে চাইলেন মুখুজ্জে।

‘তারও এক ইতিহাস আছে কাকাবাবু।’ গোলগাল লোকটি বলে চলে, ‘অনেক কাল আগের কথা। চিনের এক অঞ্চলে দুর্ভিক্ষে সব উজাড় হওয়ার যোগাড়। খাবারের অভাবে সবাই গ্রাম ছেড়ে ছেড়ে পালাচ্ছে। শ্রীযুক্ত হো যে-গ্রামে থাকত সেখানেও সবাই পালাল কিন্তু অতিবৃদ্ধ, অথর্ব শ্রীযুক্ত হো-র সেই শারীরিক সামর্থ্য নেই। তিনি একা থেকে গেলেন গ্রামে। পাশের বন থেকে চেনা-অচেনা কিছু গাছের মূল যোগাড় করে এনে সেই খেয়েই দিন কাটাতে লাগলেন। দুর্ভিক্ষ একটু কমলে গ্রামের লোকেরা গ্রামে ফিরে এল। শ্রীযুক্ত হো এতদিনে নিশ্চয়ই মরে পচে সেখানে পড়ে আছেন এমনই ভেবেছিল সবাই। কিন্তু ফিরে এসে তারা তো অবাক! শ্রীযুক্ত হো-র মাথাভর্তি কালো চুল, আসল দুপাটি ঝকঝকে দাঁত, কথা বলতে গেলে আর হাঁপান না। মাইলখানেক অনায়াসে হেঁটে দিতে পারেন। কী করে এমন হল? বুড়ো হো বললেন, কেন এমন হল তা তিনি জানেন না। খোঁজ করতে বেরোল, শ্রীযুক্ত হো দুর্ভিক্ষর সময়ে একটি অচেনা গাছের মূল খুব খেয়েছিলেন আর তার থেকেই পুনরুদ্ধার হয়েছে তাঁর যৌবনের। সেই গাছের মূলের নামই হল ফো-তি। বললে বিশ্বাস করবেন না, সেই শ্রীযুক্ত হো তখন আর-একটি বিয়েও করলেন আর তাঁর একটি ছেলেও হল। চিনেরা ওই ফো-তি-র শেকড় খেয়েই বয়েস হলেও বুড়ো হন না।’

‘চিনেদের কথা তো বুঝলুম। কিন্তু আমরা চাইলে কোথায় পাব তোমার ওই ফো-তি?’ জিজ্ঞাসা করলেন রতন ঘোষ।

‘সব জায়গায় পাবেন। চিনে ওষুধের দোকানে পাবেন। আমাজন, ফ্লিপকার্ট-এর অনলাইন মার্কেটিং সাইটে পাবেন। কিন্তু ও সবই হল শ্বেত বা সাদা ফো-তি। ওতে তেমন কাজ হয় না। চাষই তো হয় ওই গাছের। কিন্তু আসল মাল হল লাল ফো-তি। চাষ করা যায় না। খুব দুর্লভ। যৌবন ফিরিয়ে আনার আসল চাবিকাঠি।’

‘সে পাওয়া যাবে কোথায়?’ রতন ঘোষ আবার জানতে চান।

‘এ দেশে আসলি চিজ পাবেন বলে মনে হয় না। তবে পাকেচক্রে আমার কাছে খাঁটি লাল ফো-তি কিছু এসেছে। কীভাবে তা জানতে চাইবেন না। ধরে নিন কনফুসিয়াসের আশীর্বাদ বর্তেছে আমার মাথায়। খানিকটাই আছে। আমি এগুলো বয়স্কদের বেচতে চাই। গেছিলাম কয়েকজনের কাছে। তারা চিটিংবাজ বলে ফুটিয়ে দিয়েছেন আমাকে। আপনাদের কারুর লাগলে দিতে পারি। অবশ্য আপনারা না-ও নিতে পারেন। অবিশ্বাস করতেই পারেন আমাকে। আর মালটা খুব সস্তা নয়। এক মাস রোজ দুটো ছোট টুকরো খেলেই কেল্লা ফতে। কিন্তু ওইটুকু মালেরও অনেক দাম। আমি কাকাবাবু ও মাল সস্তায় বেচব না। যে কিনবে তিনি যৌবন ফিরে পাবেন। আর কিছু বেশি লাভ আমি করবই। তাতে লোকে আমায় পয়সার চামার ভাবলে আমি চামার।’

রতন ঘোষ দীর্ঘদিন বড়বাজারের মারোয়ারিদের গদিতে অর্ডার সাপ্লাই করেছেন। তিনি দুম করে কেনাবেচার ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নেন না। দু-চারদিন অপেক্ষা করেন। ফলে চুপ করে রইলেন। চক্রবর্তীমশাই বিধাতার বিধানে বিশ্বাসী। যৌবন পুনরুদ্ধারের ম্লেচ্ছ উপায়ের প্রতি তাঁর কোনও মোহ নেই। তিনিও চুপ করেই রইলেন। আর দুজনেই অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন হরিনাথ মুখুজ্জের মুখঝামটা এসে আছড়ে পড়ে এই গোলগালের ওপর। কিন্তু দুজনকে অবাক করে মুখুজ্জেবাবু বললেন, ‘কই দেখাও তো ভাই তোমার ওই ফো-তি।’

লোকটি তখন ব্যাগ থেকে একটি কাচের ছোট স্বচ্ছ চৌকো বাক্স বার করে মুখুজ্জেবাবুর হাতে দিলেন। ভেতরে অনেককটা কালো কালো ছোট বস্তু, কাঠের টুকরোর মত। মুখুজ্জেও সেই বাক্স খুলে একটা টুকরো হাতে নিলেন আর তার গন্ধ শুঁকলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘এইটুকুর কত দাম?’

‘দেড় হাজার টাকা। কোনো ডিসকাউন্ট নেই।’ লোকটি জানাল।

‘পাঁচশ হলে এখনই নেব। নয় তো তুমি এসো হে।’ মুখুজ্জেবাবুর ছোট্ট জবাব। বাকি দুজন প্রমাদ গণলেন। রতন ঘোষ গলা খ্যাঁকারি দিলেন। চক্রবর্তীমশাই তো বলেই ফেললেন, ‘সাইড এফেক্ট-টেফেক্ট কী হবে না জেনে এত দাম দিয়ে কেনাটা কি ঠিক হবে?’ মুখুজ্জেবাবু এসব যেন শুনেও শুনলেন না। দুজনে বুঝলেন যুবক হওয়ার লোভটা হরিধন মুখুজ্জে সামলাতে পারছেন না। তাঁরা চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করলেন।

‘এ কী বাজারের বাটামাছ পেয়েছেন যে তিন ভাগের এক ভাগ দাম দিচ্ছেন?’ এই বলে গোলগাল দর শুরু করল। মুখুজ্জেবাবু কিন্তু আর কিছুই বললেন না। ১২০০ ১০০০ ৮০০ অনেক দরই গোলগাল দিল। মুখুজ্জেবাবু নিশ্চুপ। শেষকালে এই মাল সে প্রথম বিক্রি করছে। সায়েত বলে একটা ব্যাপার আছে বলে ৫০০-য় সে রাজি হল। হরিনাথ মুখুজ্জে আর কথা না বাড়িয়ে মানিব্যাগ থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট বার করে দিলেন। কথা না বাড়িয়ে সেই গোলগাল সেখান থেকে দ্রুত হেঁটে বিদায় নিল।

‘এ কী করলেন ভাই? এত দাম দিয়ে কী না কী কিনলেন?’ শুধোলেন চক্রবর্তীমশাই। মুখুজ্জেবাবু তখন সেই বাক্স থেকে দুটো কালো টুকরো বার করে মুখে ফেললেন।

‘দাদার তো দেখি তর সইছে না। খালিপেটে সকালে যা খাওয়ার কথা, এই ভরসন্ধেতেই সেটা খেয়ে নিচ্ছেন।’ একটু ব্যঙ্গই করলেন রতন ঘোষ।

মুখুজ্জেবাবু এতক্ষণে মুখ খুললেন, ‘যা ভেবেছিলাম তাই। আমলকীর টুকরোই বটে। একটু মোটা করে কাটা।’

‘আমলকী? মানে আপনি পাঁচসিকের আমলকী পাঁচশ টাকায় জেনেবুঝে কিনলেন?’

‘ফো-তি’, জবাবে বললেন মুখুজ্জেবাবু, ‘আসলে কী জানেন ফেরেববাজ দুরকমের হয়। একদল নিজেদের বিশ্বাসযোগ্য সৎ দাবি করে লোক ঠকায়। এরাই সংখ্যায় বেশি। কিন্তু আর একটা ছোট দলও আছে। এরা নিজেদের খারাপ বলেই ঘোষণা করে এবং সেই ঘোষণার গুণেই লোককে ঠকিয়ে দেন। এ হল সেই দ্বিতীয় জাতের রেয়ার ঠগ। দেখলেন না কীরকম নিজেকে পয়সার চামার পর্যন্ত বলল।’

‘সে তো বোঝা গেল। কিন্তু এত বুঝেও আপনি পাঁচশ টাকা ঠকতে গেলেন কেন? লটারি পেয়েছেন নাকি?’ রতন ঘোষের খোঁচা।

‘মাস তিনেক আগে’, মুখুজ্জেবাবু বলে চললেন, ‘আমাকে কেউ একটা জাল পাঁচশ টাকার নোট গছিয়েছিল। যে দোকানেই দি কেউ নেয় না। শেষমেষ ব্যাঙ্কে চালাতে গেলুম। তারা তো আর একটু হলেই নোটটা বাজেয়াপ্ত করে নিচ্ছিল। অনেক বলেকয়ে উদ্ধার করে এনেছিলুম। সেই থেকে নোটটা আমার মানিব্যাগেই থাকে। কাউকে আর চালাতে যাইনি। সে বেচারি যদি টাকাটা ভাল মনে নিয়ে ফেঁসে যায়। মানিব্যাগে থেকে থেকে ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়ে নষ্ট হওয়াই ছিল সে নোটের ভবিতব্য। কিন্তু আজ এই ফেরেববাজকে দেখে ওই নোটের কথা মনে পড়ল। দিলুম চালিয়ে। আধো-অন্ধকারে ব্যাটা আর ঠাউর করতে পারেনি। এখন ও যদি সেই নোট চালাতে পারে তো ওর কেরামতি আর না পারলে ঠগের শাস্তি। আমার লাভ এই শুকনো আমলকীর বাক্স।’ বলে উঠে পড়লেন হরিধন মুখুজ্জে।

আর যেতে যেতে স্বগতোক্তি করলেন, ‘হেঁ হেঁ বাবা। আমরা দর্জিপাড়ার ছেলে। অমন ফেরেববাজকে একহাটে কিনে আর-এক হাটে বেচে দিতে পারি।’

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস ও কালিদাস

পণ্ডিতেরা তর্ক তুলেছেন, কালিদাস ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ লেখেননি৷ কেননা একেবারে পয়লা আষাঢ়েই যে মেঘ নেমে বৃষ্টি আসবে, তা হয় না। তাঁদের মতে, ওটা আষাঢ়ের শেষদিন, ‘আষাঢ়স্য প্রশম দিবস’ হবে। কিন্তু প্রথম দিবস-ই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এবং তা এতটাই যে, কালিদাসকে নিয়ে ভারত সরকার যে ডাকটিকিট বের করেছে, সেখানে ‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ শ্লোকটি উৎকীর্ণ।

Read More »
রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সোমেন চন্দ: এক বহ্নিময় কথাকার

মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি একটি উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন, যদিও তা অসমাপ্ত থাকে। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘বন্যা’। পরবর্তীকালে উপন্যাসটি অসমাপ্ত-ই থেকে যায়। আরও দুঃখের বিষয়, এর বৃহদংশ হারিয়েও গেছে। আজ যে সোমেন চন্দের লেখককৃতির জন্য আমরা তাঁকে স্মরণ করি, তা হল তাঁর বেশ কিছু অসামান্য ছোটগল্প। সংখ্যায় খুব বেশি নয়, মাত্র চব্বিশটি। আরও কিছু গল্প লিখলেও তা কালের ধুলোয় হারিয়ে গেছে। গল্পের সংখ্যা সামান্য, তবে অসামান্যতা রয়েছে সেগুলির রচনার পারিপাট্যে, বিষয়বস্তু চয়নে, শিল্পিত প্রকাশে ও লেখনীর মুনশিয়ানায়। এছাড়া তিনি দুটি নাটিকাও লেখেন, ‘বিপ্লব’ ও ‘প্রস্তাবনা’। লেখেন কিছু প্রবন্ধ। তাঁর ছোটগল্পগুলি এতটাই শিল্পোত্তীর্ণ ছিল যে, তাঁর জীবিতকালেই একাধিক ভাষায় তা অনূদিত হয়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »