অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য
১
আসলে জীবনে এমন অনেক সত্য থাকে, যা আড়ালে থাকে, গোপনে থাকে, লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকে।
আজ ২৫শে বৈশাখ। কবির জন্মের আজ একশো বছর।
সন্ধ্যায় শান্তিনিকেতনে নাট্যঘরে জন্মোৎসব উপলক্ষে বিরাট স্মরণসভার আয়োজন হয়েছিল। মঞ্চে পণ্ডিতজী রাধাকৃষ্ণণ সুধীদা সুনীতিবাবু ছিলেন। প্রধান বক্তা ছিলেন ডক্টর রাধাকৃষ্ণণ। বিশাল হল জুড়ে সুশৃঙ্খল মানুষের ভিড়। পাখা ঘুরলে কী হবে, মে মাসে গরম অত্যন্ত প্রকট। একটু আজ গুমোটও আছে। সারাদিনই সূর্যটা যেন একটু চাপা ছিল। শুনলাম, কালবৈশাখী সেই চৈত্রশেষে একদিন হয়েছিল, বৈশাখে আর হয়নি।
গত পরশু সকালে শান্তিনিকেতনে এসেছি। আমার গাড়িতে এসেছি। রতনকুঠির কোণের একটা ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।
পরশুদিনই দুপুরে রবীন্দ্রভবনে গিয়েছিলাম। কবির আর আমার চিঠিপত্রের ফাইল কীভাবে এঁরা সংরক্ষণ করেছেন জানতে কৌতূহল ছিল। শোভনলালবাবু আমাকে যত্ন করে সব দেখালেন। ফাইল খুলে দেখলাম সেই কবির চিঠি সেই আমার চিঠি। কত চিঠি, কত অজস্র, শতশত। সব চিঠি আলাদা করে কপি করাও হয়েছে। শোভনবাবুর হাতে ফাইলটা তুলে দেবার আগে একবার ওটা আমার নিজের মাথায় ঠেকালাম।
আজ সকালে বৈতালিক হয়েছিল খুব ভোরে, সূর্য ওঠার আগেই। শান্তিনিকেতনের সব ছাত্রছাত্রী শিক্ষক-কর্মী বৈতালিকে অংশ নিয়েছিলেন। সকালে মন্দিরের ঘণ্টা বাজল। সুধীদা মন্দিরে আচার্যের আসনে বসে মন্দির পরিচালনা করলেন। বৈতালিকে পা মেলাতে পারিনি, মন্দিরে গিয়ে বসেছিলাম। কী অপূর্ব ভালো যে লাগল! কতদিন পর, কতদিন পর, সেই মন্দিরের উপাসনায় বসলাম এসে। সবই সেই আগের মতন। সেই কাচঘর, সেই বেদমন্ত্র। শুধু আজ তিনি নেই।
কে বলেছে তিনি নেই?
তিনি আছেন, তিনি আছেন। আমার স্মৃতির কণায়-কণায় তিনি রয়েছেন অনুক্ষণ। মনে হতে পারে আমার বিবাহের পর আমার জীবন থেকে তিনি বুঝি অনেকটাই সরে গিয়েছিলেন। কিন্তু তা তো আদৌ সত্য নয়। আসলে জীবনে এমন অনেক সত্য থাকে, যা আড়ালে থাকে, গোপনে থাকে, লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকে। তাকে বাইরে প্রকাশ করা যায় না। সেই সত্য বুকের মধ্যে থাকে। শাড়ির আঁচলের মধ্যে ঢাকা থাকে।
আজ জন্মোৎসব থেকে ফিরে এসেছি; রাতের আহারও শেষ করে নিজের ঘরে এসে ঢুকেছি। ছোট রেডিওটা বের করে রাতের খবর শুনলাম। খবর আর কী? শুধুই কবির জন্মশতবার্ষিকীর কথা। আজ নাট্যঘরে সন্ধ্যায় যে অনুষ্ঠান হল তারও বিস্তৃত বিবরণ রেডিওতে বলল।
আজ শুয়েছি বটে, কিন্তু আমার মনটা আজ এমন অস্থির হচ্ছে কেন? এ অস্থিরতা আমার কাছে যে নতুন তা নয় ঠিকই— তবু আমার শরীর মন আজ বড়ই উতলা। কবির জন্য আমার মন আজ এত অস্থির এত চঞ্চল কেন?
জানি না কেন!
হয়ত শান্তিনিকেতনে এসেছি বলেই, হয়ত আজ তাঁর জন্মের শততমবর্ষ পূর্ণ হল বলেই।
যাঁকে কত কাছ থেকে পেয়েছি দিনের পর দিন বছরের পর বছর— আজ তাঁর জন্মশতবর্ষ।
দূরে উত্তরায়ণের ঘরগুলো দেখা যাচ্ছে। কবির ব্যবহৃত পাঁচটি বাড়ি প্রদীপের আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে। রাত দশটা বেজে গেছে। তবু প্রদীপের একটি আলোও নিভে যায়নি। কী অসাধারণ সুন্দর লাগছে উদয়ন বাড়িটিকে।
রাতের অন্ধকারে ওই আলোকোজ্জ্বল বাড়িটির দিকে তাকাতে তাকাতে কত কথা কত স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে।
আমার বিবাহের আগে আমার যৌবনের সাতটি পূর্ণ-বসন্ত আমি কবিকে কাছে পেয়েছিলাম। কাছে বলতে, সত্যিই বড় কাছে পেয়েছিলাম, খুবই কাছে।
ওই উদয়নের বাড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে কার ইচ্ছায় কার আদেশ পেলাম জানি না— সঙ্গে-আনা ছোট নতুন খাতাটা স্যুটকেশ থেকে বের করলাম। সামনে খাতা খুলে হাতে কলম তুলে নিলাম। কবি যে আমাকে কত কলম দিয়েছিলেন। এই সেফারর্স পেনটা কবিরই দেওয়া। সব সময় এটাই ব্যবহার করি। অপূর্ব কলম। আমার ভাবনার আগে কলম চলে। সেই কলমে খাতার প্রথম পাতা খুলে তাতে বড়-বড় হরফে লিখলাম— হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।
এ যেন তাঁরই আদেশ পেলাম এটি লিখে ফেলার।
হ্যাঁ। লিখতেই হবে।
কিছুটা আজ লিখে না ফেললে আমি আজ ঘুমতে পারব না।
আমার এই আত্মকথার শিরোনাম দিলাম কবিরই গানের চরণ ধরে— হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।
দূরের থেকে উদয়নের দোতলার ওই ঘরটি দেখতে দেখতে আমার শৈশব-যৌবনের ফেলে আসা দিনগুলো রাতগুলো কেমন আশ্চর্য স্পষ্ট হয়ে আমার চোখের সামনে এসে জেগে উঠছে।
আজ আমার এখন কিছুতেই ঘুম আসছে না, ঘুম আসবেও না। আজ এই মুহূর্তে যদি উদয়ন বাড়ির সামনের লাল সিঁড়িতে মাথা ঠেকিয়ে তাঁকে প্রণাম করে আসতে পারতাম, পরম শান্তি পেতাম। কিন্তু নাটক আমি করতে চাই না। তাঁর সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক, সে শুধু একান্তই আমাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্ক। প্রকৃত সেই সম্পর্কের ইতিহাস ক’জনেই বা জানে। বিবিদি রানীদি এঁরা তেমনভাবে কেউই কিছু জানেন না। আর তা ছাড়া বাইরে থেকে কেই বা কী জানবে? সম্পর্কের ব্যাপারটা কবিকে দেখেছি বেশ সুন্দর করে ছবির মতো করে সাজিয়ে রাখতে জানতেন। তিনি বাইরে মোটা কালো আলখাল্লা পরা দাড়ি গোঁফ ভর্তি দীর্ঘদেহী আরব সাগর থেকে উঠে আসা এক অসাধারণ সুন্দর গম্ভীর প্রাজ্ঞ পুরুষ মনে হলেও ভিতরে তিনি এক আশ্চর্য কোমল স্নেহপ্রবণ উদার প্রেমিক রোমান্টিক মুগ্ধকরা মানুষ। মানুষ? আমার তো তাঁকে প্রথম দর্শন থেকেই এক আশ্চর্য দৃষ্টিনন্দন দেবতা বলে মনে হয়েছিল। আমি দেশ-বিদেশের বহু পুরুষদেবতার ছবি দেখেছি, কিন্তু এমন অভূতপূর্ব এমন যিশুখ্রিস্ট সদৃশ পুরুষব্যক্তিত্ব দেখি নি। আমার চোখে আমার প্রথম দর্শনেই তাঁর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে নীরবে আপন মনে উচ্চারণ করে বলেছিলাম— কে তুমি কবি, তুমি যে খ্রিস্টের অপেক্ষাও সুন্দর। এই সুন্দরকে আমার চাই, এই সুন্দরকে আমি আমার আলিঙ্গনের মধ্যে চিরকালের জন্য বেঁধে রাখব। সুখে আমায় রাখবে কেন রাখো তোমার কোলে যাক না গো সুখ জ্বলে।।
২
আমাকে শিশু বলছেন? জানেন আমার এই বয়সের অল্প পরেই রথীদাদার মা রথীদাদার জন্ম দিয়েছিলেন।
আমরা কাশীতে থাকতাম। কাশী থেকেই রবিবাবুকে আমি প্রথম চিঠি দিই। হ্যাঁ, প্রথম চিঠিতে তাঁকে আমি ‘প্রিয় রবিবাবু’ সম্বোধন করেছিলাম। আসলে আমি অল্প বয়স থেকেই যথেষ্ট পাকা মেয়ে ছিলাম। বাবা ‘রবিবাবু রবিবাবু’ বলতেন বাড়িতে। আমাদের বাড়িতে দিনে একবার দুবার রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ আসতই আসত। আমি তাঁকে প্রথম চিঠি লিখি ১৯১৭ সালের জুলাই-আগস্ট মাস নাগাদ। চিঠিতে আমাদের কাশীর বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দিয়েছিলাম। 235 Agast Kund Benaras City. আর তার নীচে লিখে দিয়েছিলাম আমার চিঠির উত্তর শিগ্গির দেবেন। নিশ্চয়।
আমি তো জন্মেছিলাম ১৯০৬-এর ১৮ অক্টোবর। কবিকে আমি যখন প্রথম চিঠি দিই তখন আমার প্রকৃত বয়স দশ বছর দশ মাস।
কাশীতে অনেকেই আমাকে সারাক্ষণ বই হাতে থাকতে দেখে বুড়ি বা পাকা বুড়ি বলত। সত্যিই আমি বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসতাম। বিশেষ করে রবিবাবুর বই পেলে কথাই নেই। পুতুলখেলা ছেড়ে বই পড়তে শুরু করে দিতাম। বাবা তো দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। বাড়িতে প্রচুর বই ছিল। বাবা সবসময় তাঁর পঠন-পাঠন নিয়েই থাকতেন। তবে ছেলেমেয়েদের প্রতি তাঁর স্নেহ-ভালোবাসা ছিল অগাধ। সন্ধ্যায় কাজকর্ম শেষ করে বাড়ি ফিরে এসে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বসতেন। সেই সময় তাঁর ভালোবাসা আমরা কুড়িয়ে নিতাম। মায়ের ভালোবাসা ছিল কিছুটা শান্ত; তবে গভীর। মা কখনো নির্জনে একমনে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন। এক সন্ধ্যায় মাকে দেখলাম একলা বসে কবির গান গাইছেন; চোখ দিয়ে জলের ধারা। একবার ভাবলাম মায়ের কাছে গিয়ে বলি মা তুমি কাঁদছ? তারপর কী জানি কি মনে হল— আমি মাকে তাঁর সেই নিভৃত কান্নায় বাধা দিলাম না। আবার তারই ঘণ্টাখানেক পরে দেখি মা তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্বামীকে নিয়ে খুশিতে সংসারতরঙ্গে ভাসছেন। আমি তখন থেকেই জেনেছিলাম মেয়েদের মনের নিভৃত কোণে কোথায় কখন কার কী দুঃখ থাকে কেউ তা জানতে পারে না। যে কাঁদে সেও কি সবটুকু জানে? আমি একা বসি সন্ধ্যা হলে আপনি ভাসি নয়নজলে, কারণ কেহ শুধাইলে নীরব হয়ে রই।
বাবা আমাকে বিদ্যা দিয়েছিলেন, কিন্তু মা আমাকে আমার চেতনায় অবচেতনায় কোন্ অলক্ষে আমার হাতে নারীর আসল যে সম্পদ সেই প্রেমের বীণাখানি তুলে দিয়েছিলেন। নারীর বুকের মধ্যে যদি প্রেমই না থাকে, যদি তৃষ্ণা যদি বেদনা যদি ব্যাকুলতা যদি কান্না না থাকে তবে সে আবার কিসের নারী। নারীর নারীত্ব শুধু তার শরীর দিয়ে হয় না। নারীর সৌন্দর্যকে যদি কোনো সংগীতের সঙ্গে তুলনা করি তো তার শরীরটা সঙ্গতের সৃষ্টি করে মাত্র।
আমার দুই দাদুই ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত। বাবার বাবা বেণীমাধব অধিকারী ছিলেন সংস্কৃতের মস্ত পণ্ডিত। টোল ছিল। শিষ্য সম্প্রদায় ছিল। আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
অন্যদিকে মায়ের বাবা হরিমোহন চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন সংস্কৃতে বিশেষ অধিকারী। তিনি বড় সংগীতজ্ঞও ছিলেন। তা ছাড়াও তিনি বহুবিধ গুণেরও অধিকারী ছিলেন। আমার মামাদের মধ্যে একজন বিখ্যাত মানুষ ছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের থেকে মাত্র দু’বছরের ছোট ছিলেন। তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আলাপ ছিল পরিচয় ছিল যোগাযোগ ছিল। আমি যে আমার সাড়ে এগারো বছর বয়সে কবির কাছে গিয়ে পৌঁছতে পেরেছিলাম তার জন্যে তো কিছু জমি আগে থেকে তৈরি হচ্ছিলই।
যে মামার কথা বলছি তাঁর নাম শ্রীকালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়। ১৮৬৩-তে জন্ম। তাঁরা লাহোরের বাসিন্দা ছিলেন। সেখানেই পড়াশোনা। পরবর্তী কালে মামা সাংবাদিক এবং ধর্মীয় ও সামাজিক নেতারূপেও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এক সময় তিনি কলকাতায় শিশির ঘোষ মশায়ের আমন্ত্রণে অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের কাজে যোগ দিয়েছিলেন। কয়েক বছর পরেই অবশ্য কলকাতা ত্যাগ করেন। আমার মনে হয় কবির সঙ্গে আমার মাতুলের এই সময়েই হয়ত আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। পরে তো মামা আমার মামাতোভাই বিশ্বনাথকে ব্রহ্মবিদ্যালয়ে ভর্তিও করে দিয়েছিলেন। আর বাবার সঙ্গেও কবির আলাপ অনেক দিনের। বাবা ১৯১০ সালে একবার শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন কবির প্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মচর্যাশ্রম দেখতে। কবির সঙ্গে বাবার খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল। সেবার বাবা মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য শান্তিনিকেতনে আসেন। ঐ দেখার অভিজ্ঞতাটুকু নিয়েই বাবা ১৩১৭ অগ্রহায়ণ সংখ্যার প্রবাসীতে বোলপুর ব্রহ্মবিদ্যালয় শিরোনামে একটি বেশ বড় মাপের প্রবন্ধ লিখেছিলেন। আমি অল্প বড় হবার পর বাবা আমাকে প্রবাসীর ঐ সংখ্যাটা উপহার দিয়েছিলেন। বলেছিলেন শান্তিনিকেতনে আমার প্রথম যাওয়ার স্মৃতি তোর কাছেই থাক। বাবা তাঁর প্রবন্ধের গোড়াতেই লিখেছিলেন— ‘আজ কয় বৎসর ধরিয়া ব্রহ্মবিদ্যালয়ের কথা শুনিয়া আসিতেছি। বহু দূরে থাকি, বিদ্যালয়টি দেখিবার সাধ হইলেও সুযোগ হয় নাই। তাই এবারের গ্রীষ্মের ছুটিতে যখন দেশে যাই তখন দৃঢ় সংকল্প করিয়াছিলাম যে এ সুযোগ ছাড়িব না। কলিকাতা হইতে বারাণসী ফিরিবার সময় বোলপুরে নামি এবং শান্তিনিকেতনে কয়েক ঘণ্টা কাটাই। … বিদ্যালয়টি স্বর্গগত মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের মধ্যে অবস্থিত। কিন্তু এখানে বলিয়া রাখি— বিদ্যালয় বলিতে আমরা সচরাচর যাহা বুঝিয়া থাকি— ইহা তাহার মতো কিছুই নয়। প্রায় লোকালয়শূন্য প্রান্তরের মাঝখানে গাছপালায় ঢাকা একটি শান্তিময় স্থান। তাহাদেরই ছায়াতলে দূরে দূরে কতকগুলি চালাঘর। তাহাই ছাত্র এবং অধ্যাপকের আবাসস্থান। আসবাব অতি সামান্য।…
আমি যখন কবির লেখালেখি পড়তে শুরু করি, তারও বছর কয়েক আগে ১৩১৭-এর প্রবাসীটা বাবা আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন— পড়বি নাকি? ১৩১৭ অগ্রহায়ণ মানে ১৯১০ নভেম্বর-ডিসেম্বর হবে। তখন আমার বয়স সবে চার। ওই ১৯১০-এই আমার ছোটভাই অশোক জন্মেছিল। আমি যখন কবিকে ১৯১৭-তে চিঠি লিখি তখন হয়ত তিনি রাণুকে নামে চিনতেন না। হয়ত বাড়ির ঠিকানা আর বেনারস দেখে বুঝে থাকতেও পারেন পত্রলেখিকা কাশীর ফণীভূষণের কন্যা। আবার আমার বাবার নাম যেহেতু ছিল না আমার চিঠির কোথাও, তাই আমাকে তিনি সম্পূর্ণ অপরিচিতা একটি বালিকাও ভেবে থাকতে পারেন। যাই হোক আমার প্রথম চিঠিরই উত্তর পেয়েছিলাম। তারপর দীর্ঘ আট বছর ধরে দুজনের মধ্যে শুধু ভালোবাসার অন্তরঙ্গ পত্রবিনিময়। তাঁর স্নেহ তাঁর সান্নিধ্য তাঁর ভালোবাসা প্রতিদিনই আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল আমি একটু একটু করে বড় হয়ে উঠছি। একদিন, আমি তখন উদয়নে কবির ঘরে, সেটা কবির স্টাডিরুম; সে ঘরে কবি যখন কাজ করেন তখন সাধারণভাবে সে-ঘরে ঢোকার কারোর অনুমতি থাকত না। কিন্তু তাঁর ঘরে যখন তখন ঢোকার আমার কোনো বাধা ছিল না। কবির প্রশ্রয়েই সেই সুযোগ আমার ঘটেছিল। কোনো কোনো দিন দুপুরের খাবার আমিই নীচ থেকে নিয়ে গিয়ে তাঁর ঘরের টেবিলে সাজিয়ে দিতাম। প্রতিমা বৌঠানের কথা শুনতেন না। কিছুতেই গেলাসভরা দুধ খেতে চাইতেন না। দু চুমুক খেয়েই টেবিলের পাশে সরিয়ে রাখতেন। বাবামশায়, আপনি যে দুধটুকু কিছুই খেলেন না— বৌঠান বলতেন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে। কবি বলতেন— ওই তো অনেকটা খেয়েছি, আর পারব না বৌমা। আমি যখন শান্তিনিকেতনে থাকতাম তখন কবিকে খাওয়ানোর দায়িত্ব আমিই বৌঠানের কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছিলাম। বৌঠানকে বলেছিলাম ওঁকে খাওয়ানোর দায়িত্বটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। দেখি কেমন না খান! ওঁকে সব দুধ নিজে হাতে-ধরে খাওয়াব। দুধ না খেলে শরীর টিকবে কেমন করে?
তখন আমার বয়স ছিল তেরো বছর; কবির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বেশ জমে উঠছে। কবি যে আমাকে অগাধ স্নেহ করেন শান্তিনিকেতনে সব্বাই তা জেনে গেছে। কবির যেখানে এমন প্রশ্রয় সেখানে আর কার কী বলার আছে! সবাই বলে রাণু ছেলেমানুষ রাণু শিশু; ঐ খেপিকে কে বাধা দেবে?
লোকে যতই বলুক বাচ্চা মেয়ে, শিশু, ওর দুরন্তপনা অসীম ধৈর্য বলে কবি সহ্য করেন! কিন্তু আমি জানি আমি এখন মোটেই শিশু নই, আমার এখন তেরো বছর বয়স। একদিন কবিকে তাঁর ঘরে দুপুর বেলায় আমার দিকে তাকাতে বলে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেছিলাম— আমার তো এখন তেরো বছর বয়স; দেখুন তো আমি শিশু না লেডি? কবি আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে অনেকক্ষণ দেখলেন, তারপর বললেন— একবার পিছন ফেরো দেখি। তাও তাঁর দেখা হল। আমি অধৈর্য হয়ে বললাম— কী হল বলুন, আমি কি আদৌ এখন শিশু আছি? কবি ভেবেচিন্তে গালে হাত দিয়ে যেন অনেক চিন্তা করে বললেন— তুমি আমার কাছে সত্যিই খুব ছোট্ট শিশুই। তবে একটা বিশেষণ যোগ করে বন্ধনীতে বলতে হয় পাকা শিশু।
আমি রাগের ভঙ্গি করে বলেছিলাম— আপনি আমাকে শিশু বলছেন? জানেন আমার এই বয়সের অল্প পরেই রথীদাদার মা রথীদাদার জন্ম দিয়েছিলেন।
কবিকে আদর করে তাঁর মাথার চুলে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম— এবার লক্ষ্মীছেলের মতো দুধটুকু খেয়ে নিন দিকি। কবি রাগ করে কিনা জানি না, গেলাসভর্তি দুধটা মুখ দিয়ে ঢক্ঢক্ করে শেষ করলেন। এর পরদিন থেকে প্রতিদিনই খালি গেলাস ফেরত আসত।
ওঁর শরীর সুস্থ ও সুন্দর থাকলেই আমি খুশি। সে আমার উপর তিনি রাগই করুন আর ভালোই বাসুন।।
>>>
রবীন্দ্রনাথ কবিতায় বলেছেন, ‘কবিরে পাবে না তাহার জীবনচরিতে।’ গদ্যে তাঁর মন্তব্য, ‘মহৎব্যক্তির কার্যবিবরণী কেবল তথ্য মাত্র, তাঁহার মহত্বটাই সত্য’। এবং ‘তাহা কেবলমাত্র কবির লেখনীদ্বারাই বর্ণনসাধ্য।’ ‘‘হৃদয়ে রয়েছ গোপনে’’ উপন্যাসটি বস্ততপক্ষে গদ্যে রচিত কবিগুরুর অনবদ্য একটি জীবনকাব্য— পুরাতন শান্তিনিকেতন আশ্রমের পটভূমিতে কবির পরিণত প্রেমের সাতটি মধুর বসন্ত-যাপনের হৃদয়স্পর্শী এক প্রকৃত কবিকাহিনি। বিশ্বকবির ১৬১তম জন্মজয়ন্তীতে ‘আশাদীপ’ প্রকাশিত সেই সুবৃহৎ উপন্যাসের প্রারম্ভিক দুটি পর্ব রইল ‘ভালভাষা’-র পাঠকদের জন্য।
অসাধারন