হৃদয়পুর স্টেশনের কতগুলো বৈশিষ্ট্য আছে।
এক, এখানে কোনও ট্রেন দাঁড় করানোর অনুমতি দেয়নি প্রশাসন।
দুই, এখানকার সিমেন্টের বেঞ্চগুলোতে বিকেলের পর পাখির মত বসে থাকে যুবক এবং যুবতীরা।
তিন, প্রতিদিন এক বেহালাবাদক এখানে সকাল থেকে রাত অবধি বেহালা বাজান। তার খোলা টুপিতে দিনের শেষে পড়ে থাকে কয়েকটি সাদামাটা পয়সা।
এছাড়াও অনেক বৈশিষ্ট্য আছে, সেসব এখানে বর্ণনা করতে গেলে অহেতুক দীর্ঘ হবে। কীভাবে প্রথম হৃদয়পুর স্টেশন চিনেছিলাম তা বিশেষ মনে পড়ে না। মায়ের বড় মাসির বাড়ি ছিল এই স্টেশনের ধারে। ছোটবেলায় তার বাড়িতে এসেছি দু-একবার। তবে এতই ছোট তখন যে স্মৃতি বলতে প্রায় কিছুই নেই। ঝাপসা কিছু দৃশ্য আছে সেই বাড়িটি সম্পর্কে। যদিও বাড়িটি আর নেই।
তারপর কখন জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছিল হৃদয়পুর স্টেশন। যে স্কুলে পড়তাম, স্টেশন থেকে সাইকেলে পনেরো মিনিট। আমার বন্ধুরা অনেকেই থাকত হৃদয়পুর এবং মধ্যমগ্রামে। তাদের সঙ্গে আড্ডার একটা বড় জায়গা ছিল স্টেশনের ওই সিমেন্টের বেঞ্চগুলো।
তারপরে দুবছর ধরে একটা প্রেম করেছিলাম হৃদয়পুরে। একুশ থেকে তেইশ বছর বয়সে। তখনই হৃদয়পুর সবচেয়ে চেনা হয়ে গেল। এভাবেই চেনা হয় কোনও জায়গা সবথেকে গাঢ়ভাবে। কোন পথ দিয়ে গেলে ওর বাড়ির লোকেদের সামনে পড়ব না, ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে সমস্ত অলিগলিই চিনে রাখতে হয়।
কিন্তু প্রথম হৃদয়পুর স্টেশন তীব্রভাবে ভেতরে ঢুকে গেল যখন আত্মহত্যা করল বাবুনমামা।
বাবুনমামা আত্মহত্যা করেছিল উনত্রিশ-ত্রিশ বছর বয়সে। মায়ের যে মাসির বাড়ি ছিল হৃদয়পুর, তার একমাত্র ছেলে বাবুন। যেদিন ও আত্মহত্যা করেছিল সেদিন সকালবেলা মা ও আমি চলে গেলাম হৃদয়পুর। তখন একুশ বছর বয়স আমার। প্রায় প্রতিদিন বিকেলেই আসি এই পথগুলোতে প্রেম করতে। সেদিন বিকেলেও আসা স্থির ছিল। সকাল সকাল আমাকে টেনে নিয়ে এল বাবুনমামার একটা ঝুলন্ত শরীর, ভেঙে যাওয়া ঘাড়, চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসা, ইত্যাদি ইত্যাদি। বাবুনমামাকে চিনতে পারলাম না। মনে পড়ে ছোটবেলায় মামাবাড়িতে যখন ভাইফোঁটা হত তখন সবচেয়ে শেষে এসে পৌঁছত বাবুনমামা। ফোঁটা নিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করে চলে যেত। প্রতি বছর ঠিক ওই সময়েই বাবুনমামার সঙ্গে কিছু কথা হত। তারপর আর সারাবছর দেখা হত না। হৃদয়পুর স্টেশনে আড্ডা দেওয়ার সময়, প্রেমিকার সঙ্গে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানোর সময় পথেঘাটে কখনওই মুখোমুখি হইনি। শুধু আত্মহত্যার চার-পাঁচ দিন আগে একটি গলির মোড়ে অপেক্ষার সময় বাবুনমামাকে দেখেছিলাম সাইকেলে।
বাবুনমামার তখন এক মুখ দাড়ি। চোখদুটো উদ্ভ্রান্ত। আমার দিকে তাকিয়েও যেন দেখতে পেল না আমাকে। কোন এক শূন্য পৃথিবীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চলে গেল বাবুনমামা। আমিও ডাকতে পারলাম না ওকে। আসলে আমি তো লুকোতেই চেয়েছিলাম। তবে লুকোতে হয়নি। মাঝে মাঝে আফসোস হয় সেদিন যদি বাবুনমামাকে ডাকতাম এবং কথা বলতাম, তাহলে হয়তো এমন একটা ঘটনা ঘটত না। হয়তো বা ঘটত, কী জানি।
মায়ের কাছে শুনেছিলাম কেবলমাত্র চাকরি পায়নি বলেই বাবুনমামা নাকি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। এত সামান্য কারণে কেউ নিজেকে শেষ করে দিতে পারে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। বাবুনমামার কি কোনও প্রেমিকা ছিল না? ওর কি কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল না? চারিদিকের এই যুদ্ধটা কি ওর রক্ত গরম করে তুলতে পারেনি? বিকল্প কোনও পথের সন্ধান পায়নি বাবুনমামা? জানি না। আমি আত্মহত্যার কথা কোনওদিন ভাবতে পারি না। বেঁচে থাকতে আমার প্রবল ভাল লাগে। আমি এই পৃথিবীতে দীর্ঘ সমস্ত যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে চাই। আমি নীচু হয়ে হোক, অপরাধ করে হোক, নানারকম দুর্নীতি করেই হোক বেঁচে থাকতে চাই। সবাই হয়তো তা পারে না। যারা পারে না তাদের অবস্থা হয়তো বাবুনমামার মত হয়।
হৃদয়পুরের প্রেমটা নেই বহুবছর হল। আমিই ছেড়ে এসেছি প্রেমটা। অহেতুক মাথায় চাপ পড়ছিল। শুধুই আবেগ দিয়ে সম্পর্ক একজন লেখকের পক্ষে খুবই বিপজ্জনক। আমি খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী। শুধুমাত্র প্রেমেই জীবন ঢেলে দেব, এ আমার পথ নয়। এটা কোনও শিল্পীরই পথ হতে পারে বলে মনে হয় না। মেয়েদের আমার ভাল লাগে। তারা সুন্দর। তাদের ভেতর এক অদ্ভুত রহস্য আছে। মেয়েদের শরীর আমাকে টানে না। টানে ওদের গল্পগুলো। মেয়েদের গল্পগুলো খুব অলৌকিক হয়। সেই গল্পগুলোর লোভে আমি একের পর এক মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারি। যারা সেই বন্ধুত্বকে নীচু নজরে দেখে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয়। যাই হোক, হৃদয়পুরের প্রেম না থাকলেও রোজ বিকেল করে আমি অশেষ মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সুন্দরী মেয়েদের দেখি। আমার চোখ তৈরি হয়ে গেছে। যার মধ্যে একটা আলাদা রহস্য আছে তার সঙ্গে যেচে পড়ে বন্ধুত্ব গড়ে নিই। তারপর ধীরে ধীরে তার গল্পগুলোকে বের করে নিই ভেতর থেকে। এই বের করে নেওয়ার পর একজন মেয়ের কী হয় সেই নিয়ে আমার বিশেষ মাথাব্যথা নেই। কারণ সেসব নিয়ে ভাবা একজন লেখকের জন্য দরকারি নয়।
এই কিছুদিন আগেই তো শুনলাম, একজন বিখ্যাত আমেরিকান অভিনেতা একটি চরিত্রে অভিনয় করবার জন্য নিজের সমস্ত সম্পর্কের ইতি টেনেছেন। এমনকী, নিজের প্রেমিকার সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। শুধু অভিনেতা কেন, খুঁজলে এমন হাজার একটা উদাহরণ আমি দিতে পারি। আসল হল, কী রেখে যাচ্ছি, কী লিখে যাচ্ছি। তার বেশি কিচ্ছুটি নয়। জীবনে বাকি সমস্তকিছুই তুচ্ছ হয়ে দাঁড়ায়। অসুবিধে হল বাবুনমামার মত আমি এক ছোট শহরের মধ্যবিত্ত ঘরে জন্মেছি। যেখানে দুই বিপরীতধর্মী বিষয়কে কেন্দ্র করে জীবন চালিয়ে নিতে বলা হয়। এক হল অর্থ, অপরটি হল সংস্কার। এই দুটিকেই আমি তীব্র অস্বীকার করি। কোনও সংস্কার আমার নেই। এও বিশ্বাস করি তেমনভাবে অর্থ উপার্জন করতে গেলে সংস্কার থাকা সম্ভবও নয়।
কিন্তু কেনই বা এই দুই বিষয়কে একসঙ্গে মগজে ঢুকিয়ে দিয়ে আমাদের আত্মহত্যাপ্রবণ করে তোলে মধ্যবিত্ত পরিবার। নয় বলুক সৎ হয়ে ভিকিরির মত মরতে। নইলে অসৎ হয়ে রাজার হালে থাকতে এবং প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে। কিন্তু দুটি কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই অনেক ছোট থেকেই পরিবারের এই সমস্ত কথাগুলো এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে আমি বের করে দিই। বিশেষত, সম্পর্কজনিত বিষয়ে ওদের কোনও ধারণাই নেই। সম্পর্ক ওদের কাছে একপ্রকার সরকারি চাকরির মত একটা পদ। যে পদে রোমাঞ্চ থাক বা না থাক, অশেষ নিরাপত্তা আছে।
নিরাপত্তা মাই ফুট।
যাই হোক। বাবুনমামা আত্মহত্যার পর থেকে ওর বাড়ির সামনে দিয়ে তেমন যেতাম না। মাঝে মাঝে এমন ভাবতে ইচ্ছে করত যে সত্যিই যদি বাবুনমামা কাউকে ভালবাসত তাহলে সেই মেয়েটির কী হল? সে কি অন্য কোথাও নিজেরটা বুঝে নিয়েছে? অথবা, বেঁচে থাকলে যে চাকরিটা হয়তো একদিন বাবুনমামার পাওয়ার কথা ছিল, সেই পদে কোন লোক কাজ করে? সেই লোকটির প্রেমিকা রয়েছে কি? তারা কি শীঘ্র বিয়ের কথা ভাবছে? সেই লোকটি কি অফিস থেকে ফেরার পথ এমনই একটা মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সুন্দরী মেয়েদের দেখে? এইসব নানাপ্রকার প্রশ্ন প্রতিদিন আমার ভেতরে ভিড় করে আসে।
এবার হৃদয়পুর স্টেশন সম্পর্কে আরও দুটি তথ্য দেওয়া যাক।
এক, প্রতি রাতে একজন আত্মহত্যা করে এই স্টেশনে। ঘড়িটির পাশে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে তার শরীর। সেই শরীর বাড়ির লোক পায় না। সরকার নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দেয় রেললাইনের পাশে শুকনো পাতাদের সঙ্গে। তার পরিচয়ও সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে আনা হয় না।
দুই, এখানে ট্রেন দাঁড়ানো নিষেধ হলেও রাতে নাকি একটি ট্রেন এখানে দাঁড়ায়। তাতে উঠে চলে যায় বেহালাবাদক— এমন দৃশ্য কেউ কেউ দেখেছে। তারপর ভোরবেলা কখন আসে তা কেউ জানে না।
অশেষের মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে যখন আমি মেয়েদের দেখি, তখন মনে হয় এদের মধ্যেই তো থাকতে পারে বাবুনমামার সেই প্রেমিকা। অথবা, এমন কেউ যার প্রেমিক আত্মহত্যা করেছে। এমন কত মেয়েদের কাছে আমি গেছি যাদের প্রেমিক আত্মহত্যা করেছে। সেইসব গল্প তারা অবলীলায় বলে গেছে আমাকে। আমিও শুনেছি। কেন আত্মহত্যা করল তারা? চাকরি পায়নি বলে? টাকা উপার্জন করতে পারেনি বলে? না, জীবন তাদের ঠকিয়েছিল। পরিবার তাদেরকে ভুল পথ চিনিয়েছিল। সততা দিয়ে কিচ্ছু করা যায় না এই পৃথিবীতে। প্রবলভাবে বেঁচে থাকতে হয়। সেই বেঁচে থাকার পথে তাদের নীচু হতে হয়, অনেকটা নীচু। ব্যবহার করতে হয় মানুষদের প্রয়োজনমত। নইলে বেঁচে থাকার কোনও পথই তারা কখনও পাবে না। যে সমস্ত মেয়েরা তাদের সৎ প্রেমিকের জন্য হা-হুতাশ করে তাদের অসহ্য লাগে আমার। তাদের গল্প শোনার কোনও ইচ্ছেই আর থাকে না। মনে হয়, তাদের জোরে জোরে ঠাপ দিই। তাদেরই বিছানায় নিয়ে যেতে সবচেয়ে ইচ্ছে করে আমার। প্রেমিকের আত্মহত্যা নিয়ে ন্যাকা কান্না কাঁদা মেয়েরাই সবচেয়ে বিরক্তিকর।
যখন শহর থেকে ফিরি তখন ট্রেনের জানলা দিয়ে হৃদয়পুর স্টেশনের দিকে আমি একেবারেই তাকাই না। তাকালেই সেই সিমেন্টের বেঞ্চিগুলো দেখি। দেখি, হতাশ যুবক-যুবতীরা সেখানে বসে আছে। তাদের মাথার ওপরে নির্লিপ্তভাবে ঝুলছে একখানি মৃতদেহ। বেহালা বাজিয়ে যাচ্ছে সেই বেহালাবাদক এবং কিছু লোক তাকে দিয়ে যাচ্ছে বেশ কিছু আধুলি। এই দৃশ্যটা আমার অসহ্য লাগে।
স্কুলের পুরনো বন্ধুদেরও আমি দেখতে চাই না। তারা কেবল অতীতের স্মৃতি নিয়ে আলোচনা করে। মনে করিয়ে দেয় জীবনের দীর্ঘ সময় কেবল সততা এবং প্রেমই আমাকে আছন্ন করে রেখেছিল। সেসব কথা মনে করলে নিজেকে বাবুনমামা মনে হয়। মনে হয়, একটা সরকারি চাকরি জোটাতে না পারলে আমাকে হয়তো ওই হৃদয়পুর স্টেশনে ঝুলে পড়তে হবে। আমি মরতে পারব না। যত নীচু হয়েই হোক, আমাকে ঠিক বেঁচে থাকতে হবে। সরকারি চাকরির আমি গাঁড় মারি। একটি প্রেম, একটি জীবন— এই তত্ত্বকে আমি স্রেফ অস্বীকার করতে চাই। কোনও পিছুটান আমাকে আর বেঁচে থাকা থেকে আটকাতে পারবে না। আমি বেঁচে থাকার জন্য যতটা দুর্নীতি করতে পারি, করব।
এসবের মধ্যেই মনে পড়ে এই হৃদয়পুরেই একটি জায়গার কথা। রেললাইন পার করে পূর্বদিকে যে অটোস্ট্যান্ড কিছুটা ছাড়িয়ে গেলে একটা পথ ছিল। সেই পথ দিয়ে গেলে পাওয়া যেত ম্যাজিক পুকুর। বন্ধুরা স্কুল পালিয়ে সেই ম্যাজিক পুকুরের ধারে গিয়ে বসতুম। এগারো-বারো ক্লাসই তো ছিল প্রথম মদ খাওয়ার সময়। জায়গাটি এত নিরিবিলি ছিল যে স্বচ্ছন্দে মাতাল হতে পারতাম। নিজেদের মনে হত পৃথিবীর রাজা। তারপর সেই ম্যাজিক পুকুরের শান্ত টলটলে জলে যতক্ষণ খুশি সাঁতার কাটতে পারতাম আমরা। আমরা কয়েকজন মাত্র পালাতাম। যারা পালাতাম, তারা একদিন ভেবেছিলাম কেবল মুক্তিই আমাদের জীবনের মূল হতে চলেছে। কী বোকা!
সেই পুকুরের ধারেই একবার এক বৃদ্ধ সাধুর সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল। তিনি চেয়েছিলেন আমাদের ভেতর থেকে সংস্কার কিনে নিতে। বদলে তিনি দেবেন জীবনে সাফল্য অর্জন করবার এক মহামন্ত্র। বন্ধুরা কেউ এগিয়ে যায়নি। ভয় পেয়েছিল তারা। কেবলমাত্র আমিই এগিয়ে গেছিলাম। সেই সাধু বেশ ভাল অর্থেই কিনে নিয়েছিল আমার সংস্কারটুকু। আমাদের দুজনেরই বেশ লাভ হয়েছিল বলা যায়। এরপর যতবার সেই পথে গেছি, খুঁজে পাইনি পুকুরটাকে। আমার সমস্ত জীবন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে পুকুরটা। হয়তো, আমারই ভুল। এমন কোনও পুকুর পৃথিবীতে কখনওই ছিল না। সে আমাদের কল্পনামাত্র। অথবা এমন হতে পারে কিছুমাত্র অন্ধত্ব না থাকলে সে পুকুরের কাছে পৌঁছনো যায় না। অন্ধই তো ছিলাম আমরা। ভেবেছিলাম এ জীবন সৎ, আনন্দময়, কবিতার মত সুন্দর।
দীপ শেখর বাবুনমামা হতে চায় না। তৃতীয় পৃথিবীর এক দেশে সে সরকারি চাকরির জন্য আত্মহত্যা করতে চায় না। সে প্রেমিকার জন্য এক মস্ত জীবন— এসমস্ত আদর্শে নিজেকে ভারী করে তুলতে চায় না। যদিও সে জন্মেছে এমন এক ছোট শহরে, এক পরিবারে যেখানে সকলকে ঠেলে দেওয়া হয় বাবুন হওয়ার জন্য। তারপর ঝুলে পড়তে হয় হৃদয়পুরের বড় ঘড়িটার পাশে। প্রশাসন সেই দেহ আর ফিরিয়ে দেয় না। বরং তা রেললাইনের পাশে শুকনো পাতাদের সঙ্গে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপর শুরু হয় আরও একটা বাবুন তৈরি। আরও একটি আত্মহত্যার জন্য।
এক সন্ধেতে তাই দীপ শেখর প্রস্তুত হয়ে নেয়। বাড়ি থেকে একটা অটো ধরে পৌঁছয় ডাকবাংলো মোড়ে। গুচ্ছ মেয়েদের বাড়ি অতিক্রম করে, অতিক্রম করে বাবুনমামার বাড়ি, যা ভেঙে ফ্ল্যাট উঠেছে। হৃদয়পুর বাজারের মধ্যে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। দাঁড়ায় অশেষের মিষ্টির দোকানের সামনে। তবে আজ কোনও মেয়ের সঙ্গে গিয়ে যেচে আলাপ করে না। আজ তার অন্য কাজ, গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তারপর স্টেশনে গিয়ে দেখে ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেনগুলোকে। জন্তুর মত সব মানুষ ফিরছে। কোনও ট্রেন দাঁড়ায় না হৃদয়পুরে। ভাগ্যিস দাঁড়ায় না। চা খায়, বেশ কয়েক কাপ। তারপর, ধীরে সুস্থে গিয়ে বেহালাবাদকের টুপির মধ্যে ছুড়ে দেয় একশো টাকার নোট। বেহালাবাদক যখন খুশি হয় তখন তাকে জড়িয়ে ধরার নামে পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় ধারালো একটা ছুরি।
তারপর বড় ঘড়িটার সামনে থেকে নীচে নামিয়ে আনে সেদিনের মৃতদেহটাকে। ঝুলিয়ে দেয় বেহালাবাদকের দেহ। খুব হাসে দীপ। এই এতদিনে একটা কাজের মত কাজ সে করতে পেরেছে। আজ থেকে যেকোনও মোড়ে মৃত্যুর পরেও বাবুনমামার অমন শূন্য চোখের মুখোমুখি তাকে হতে হবে না। তাকে আর শুনতে হবে না মেয়েদের ঘ্যানঘ্যানে গল্প। আজ থেকে আর কোনও যুবক-যুবতী আত্মহত্যা করবে না মফস্বলে। এই খুন তাকে করতে হত, একদিন। এই মৃতদেহ-ই এবার জানিয়ে দেবে সকলকে বেঁচে থাকাটা একটা নোংরা ষড়যন্ত্র ছাড়া কিচ্ছু নয়।
একটা ট্রেন এসে দাঁড়াল দীপের সামনে। একটা ফাঁকা ট্রেন। সিগারেট ধরিয়ে উঠে গেল দীপ। আর ঠিক তক্ষুনি মাটিতে শোওয়ানো বাবুনমামার মৃতদেহটা আর্তনাদ করে বলল— জল, একটু জল।